আপন গন্ধ ঢেলে এ হৃদয় ছুঁয়ে গেলে

এমনকি জন্ম নিরোধক ব্যবস্থায়ও সুগন্ধি থাকা লাগে!

সেঁজুতি জাহানসেঁজুতি জাহান
Published : 22 May 2023, 04:19 AM
Updated : 22 May 2023, 04:19 AM

খুব ছোটোবেলায় শুনেছিলাম আতর নাকি মহানবি হজরত মুহাম্মদ(স.)-এর গায়ের ঘাম, আর সুরমা নাকি তূর পর্বতের পোড়া ছাই। আমাদের নানি দাদিদের আমলে তাই আতর আর সুরমা লাগানো সুন্নত মনে করা হতো। অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক মনে করেন খ্রিস্টের জন্মের ২০০০ বছর পূর্বে মিশরে সুগন্ধির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। ইরাকের মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার উৎকর্ষের যুগে সুগন্ধিকে ভাবা হতো ঈশ্বরের গায়ের ঘাম। আর মিশরের মমিগুলোর সমাধিতে 'অঞ্জলি' হিসেবে ধূপ ব্যবহার করা হতো।তাই সুগন্ধি ব্যবহারের ব্যাপারটা ছিল ঈশ্বরের সঙ্গে পবিত্র যোগাযোগের একটা বিশ্বাস হিসেবে।সুগন্ধিকে আমরা বেশি চিনি perfume নামে। এই শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ Perfumare থেকে, বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় ‘ধোঁয়ার মাধ্যমে’। অর্থাৎ ধোঁয়ার মাধ্যমে যে সুগন্ধ ছড়ানো হয়।তিন-চার হাজার বছর আগে ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মেসোপটেমিয়া ও মিশরে সুগন্ধি সাধারণত ব্যবহার হতো ধোঁয়ার মাধ্যমে এবং সেটা প্রধানত ব্যবহৃত হতো উপাসনালয়ে, রাজপরিবার, ও অভিজাত মানুষের মধ্যে। তখন এমন বিশ্বাস ছিল যে, উপাসনালয়গুলোতে দেবতাদের সামনে প্রার্থনারত মানুষের ও দেবতাদের সঙ্গে সেতু তৈরির জন্য এই সুগন্ধিযুক্ত ধোঁয়া কাজ করতো। হাজার বছরের এই জাতীয় কিছু বিশ্বাস এখনও কিন্তু বহাল আছে। মিলাদ, বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব বা মাহফিল, মন্দির, মৃত বাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কিন্তু এখনও আগরবাতি জ্বলতে দেখা যায় সুগন্ধি ধোঁয়াকে পবিত্র মনে করেই। সুগন্ধি আবিষ্কারের ইতিহাস সম্পর্কে গুগল শত শত তথ্য মজুদ রেখেছে। তার মধ্যে প্রথম সুগন্ধি আবিষ্কারক হিসেবে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার অবদানকে অধিক সংখ্যক তথ্য লিঙ্কে মজুদ রাখা আছে। আবার কোনো কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক  দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন সুগন্ধি হচ্ছে আরবদের আবিষ্কার। এখনো নাকি 'পবিত্র ভূমি'র মতো আরবে 'সুগন্ধির ভূমি' নামক স্থান আছে। আরবের প্রসাধনী সামগ্রী নিয়ে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায় ইউসুফ আল কিন্দির সুগন্ধি প্রসাধনী সামগ্রী বিষয়ক গ্রন্থ “রসায়ন ও পাতন” (খ্রিস্টাব্দ ৮৩০-৮৭০) থেকে। সপ্তম শতকে সুগন্ধি প্রসাধনী অন্যান্য  পণ্যসামগ্রীর মতো একটি শিল্পের মাধ্যম ছিলো। সপ্তম শতকে বাগদাদ ছিলো সুগন্ধি ব্যবসায়ের কেন্দ্র। আরবের সুগন্ধি বণিকরা পুরো আরব সাম্রাজ্য জুড়ে সুগন্ধি সামগ্রী বিক্রি করতো।

ব্রিটেনের ধর্মযোদ্ধারা আরব থেকে ফিরে যাবার সময় আরবের বিখ্যাত সুগন্ধি কিনে নিয়ে যেত। সুগন্ধি পাতন পদ্ধতির উদ্ভাবন করে মূলত ইরানিরা। ইবনে সিনা রসায়নের মূলনীতিসমূহ সুগন্ধি প্রস্তুত প্রণালীতে ব্যবহার করেছিলেন এবং ফুলের মন মাতানো সৌরভ সুগন্ধি সামগ্রীতে সঞ্চিত করতে পেরেছিলেন। এভাবে খ্রিস্টীয় তের শতকে পারস্য সুগন্ধি তৈরীর কাঁচামাল প্রস্তুতে ব্যাপক এগিয়ে গিয়েছিল। মোঘল সম্রাট বাবর গোলাপ ও সুগন্ধি খুব পছন্দ করতেন। তিনি পারস্য থেকে সুগন্ধি ও বিশেষ জাতের গোলাপ আনিয়েছিলেন। ভারতবর্ষে কেবল পারস্য সুগন্ধির কদরই ছিল, এমন কিন্তু নয়। এখানে চন্দন গুড়া আর কস্তরী মৃগনাভীর সুগন্ধির খ্যাতি মহাদেশ থেকে মহাকালেও ছোটাছুটি করেছে। চন্দন কাঠ আর কস্তরি মৃগনাভির সুঘ্রাণ আর সুনাম যেন রামায়ণ, মহাভারত এমনকি বৈষ্ণব কবি গোবিন্দ দাসের কাছেও ধরা পড়েছে। যেমন:“নন্দ নন্দন চন্দ চন্দন গন্ধ নন্দিত অঙ্গজলদ সুন্দর কন্ধু কন্নুর নিন্দি সিন্দুর ভঙ্গ।” আবার আজকের কালজয়ী বাংলা গানের স্রষ্টা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠেও সুগন্ধির সে সুনাম শোভা পাচ্ছে। তাইতো তিনি গাইছেন:'কস্তুরি মৃগ তুমি যেন কস্তুরি মৃগ তুমি আপন গন্ধ ঢেলে এ হৃদয় ছুঁয়ে গেলে সে মায়ায় আপনারে ঢেকেছি'। সুগন্ধি খুব ভালোভাবে প্রস্তুত করা হলে তা অনেক বছর টিকে থাকে। এর প্রমাণ ১৯২২ সালে যখন তুতেনখামেন “তুত” এর সমাধি ফলক খোদাই করা হয়, তখন সেই ফলকের গায়ের তিন হাজার বছর পুরনো সুগন্ধি তেলের প্রলেপ থেকে সুঘ্রাণ বের হয়েছে। বিস্ময়কর মনে হলেও এই ঘটনায় প্রাচীনকালের সেই সুগন্ধি আবিষ্কারের সঙ্গে ঈশ্বরকে বা দেবতাকে কিছু একটা নিবেদনের যোগসূত্রতা কাজ করে থাকতে পারে৷ কে জানে! সুগন্ধিযুক্ত আঠা অঞ্জলি দেয়া হতো পুজোর বেদির আগুনে। আজও চিতার মড়ার জন্য চন্দন কাঠ প্রয়োজন হয় ঐশ্বরিক পবিত্রতার কথা মনে রেখেই।  চীনে একসময় শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে সুগন্ধিযুক্ত তৃণ ব্যবহার করা হতো। ফারাওদের যুগে সভাসদরা লিলিফুলের সুঘ্রাণযুক্ত পরচুলা পরতেন। ধর্মীয় বিশ্বাসের বাইরেও সুগন্ধির প্রথম প্রয়োগের কথা উল্লেখ আছে যীশুর জন্মের চারশ বছর আগে। তখনকার দিনে আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট এর দুঃসাহসিক অভিযানের জন্য তাঁর বুকের বর্মতে সুগন্ধি দিয়ে তাঁকে সম্মান জানানো হতো। প্রাচীন মিশরীয় নানা গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, রাণী ক্লিওপেট্রা নাকি নিজেকে আচ্ছন্ন করে রাখতেন সুগন্ধিযুক্ত ধূপের ধোঁয়া দিয়ে।একবার তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সৌগন্ধিকদের নির্দেশ দিলেন একেক সময় একেক রকম সুগন্ধি তৈরি না করে উৎকৃষ্ট ধরনের একটি নির্দিষ্ট সুগন্ধি তৈরি করতে। তখন সুগন্ধি প্রস্তুতকারকরা 'কিফি' নামের সুগন্ধি তৈরি করলেন। এবং এর ভেতর দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পারফিউমের ব্র্যান্ডিং শুরু হলো। শুধু তাই নয় কেবল ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম থেকে ব্যক্তিগত সৌন্দর্যের উৎকর্ষ সাধনে ভূমিকা রাখলো 'কিফি' পারফিউম। শুধু মিশর নয়, পারফিউমের ব্যাপারে গ্রিক রোমান ও পারস্য অঞ্চলও ছিল দারুণ রকম উচ্চাভিলাষী। রোমান সম্রাট নিরো (৩৭ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৬৮ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন ক্লিওপেট্রার মতোই সুগন্ধি-ভক্ত। সম্রাটের হিসাবপত্রের খাতা ঘেঁটে দেখা যায় শুধু একদিনে সুগন্ধির পেছনে তিনি ব্যয় করেছেন বর্তমানের লক্ষাধিক টাকা! আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে যখন পারস্যের রাজা তৃতীয় দারিয়ুসকে হারিয়ে প্রথম রাজদরবারে আসেন তখন তিনি পারস্য সম্রাটের অনেক কিছুর সঙ্গে অভিভূত হোন প্রাসাদের ভেতর দারিয়ুসের তৈরি করা ঐশ্বরিক এক সুগন্ধির সন্ধান পেয়ে।যোজনগন্ধা প্রাসাদটি সুগন্ধে মেতে ছিল। তিনি জোরে জোরে শ্বাস টেনে সে ঘ্রাণের সুধা লাভ করেন। তারপর এক সতীর্থ সমর নায়ককে উদ্দেশ্য করে বলেন- “একেই বলে যথার্থ এক মহান রাজা ও তার সাম্রাজ্য। মনে হচ্ছে যেন সুগন্ধির কোনো এক মহান স্বর্গে তৈরি করা হয়েছে এই রাজপ্রাসাদ।” শচীন দেব বর্মন যেভাবে সুরে সুরে বলেন, 'বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছো দোলা', ঠিক সেরকমই যেন দুলে উঠেছিলেন দ্যা গ্রেট আলেকজান্ডারের ঘ্রাণেন্দ্রিয় তৃপ্ত হওয়া চিত্ত! মক্কার পবিত্র কাবা ঘরের দেয়ালগুলো নাকি সুগন্ধি দিয়ে সিক্ত করা হয়েছিল।এই তথ্য একটি ফিচারে পেলাম। ইতালির “টেম্পল অফ মিনারভা”র দেয়ালগুলো নির্মাণের সময় নাকি এর উপরিস্তরে দুধ ও জাফরান মিশ্রিত প্রলেপ ব্যবহার করা হয়। এখনো নাকি সেখানে জাফরান-এর স্বাদ পাওয়া যায়।

পারফিউমের দুনিয়ায় বিখ্যাত প্যারিসের বিভিন্ন ব্র্যান্ড। জার্মান ফিল্ম মেকার টম টিকোয়ার তাঁর বিখ্যাত সিনেমা 'পারফিউম: দ্যা স্টোরি অফ মার্ডারার' বানিয়েছেন প্যারিসের পারফিউম তৈরির কারখানাকে ভিত্তি করেই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'ছবির দেশে কবিতার দেশে' গ্রন্থে ফ্রান্সের শিল্প, সাহিত্য, জ্ঞান ও সভ্যতার নানা চিহ্নের স্তুতি করা হয়েছে। এই ফ্রান্সের সতেরো শতকের শিল্পরুচির সম্ভ্রান্ত বোদ্ধা রাজা চতুর্দশ লুইকে নিয়ে আছে মজার মজার সব ঘটনা। এই রাজা নাকি গোসল করতেন না। দুর্গন্ধে মন্ত্রীরা দূরে দূরে বসতেন। তাই তিনি ফুল ও ফুল দিয়ে তৈরি পারফিউম দিয়ে রাজ্য-সভা ভরিয়ে রাখতেন। পারফিউমের ব্যাপক প্রসার লাভ করে রাজা চতুর্দশ লুইয়ের আমলে। রেঁনেসার যুগে ইতালিতে পারফিউমারি বিদ্যার বেশ উন্নতি লক্ষ করা যায়। ষোড়শ শতকে ইতালির অভিজাত সম্প্রদায়ের একজন সদস্য ক্যাথেরিন দে মেদিচি-এর ব্যক্তিগত পারফিউমার ছিলেন রেঁনে দ্য ফ্লোরেন্তিন। তিনি নিজের যন্ত্রপাতি এবং উপকরণ নিয়ে ফ্রান্সে চলে আসেন। তার এখানকার অ্যাপার্টমেন্টটি নিজস্ব গবেষণাগারের সাথে গুপ্ত পথের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলো। তাঁর আবিষ্কৃত পারফিউমের এই বিরল ফর্মুলা যাতে চুরি না হয়ে যায় সেজন্য এই সাবধানতা ।'পারফিউম: দ্যা স্টোরি অফ মার্ডারার'-এর মধ্যে ঠিক এ জাতীয় একটি ঘটনার চমৎকার দৃশ্যায়ন দেখা যায়। ফ্রান্স সুগন্ধি এবং প্রসাধন সামগ্রী উৎপাদনে ইউরোপের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। সেদেশে চতুর্দশ শতকে পারফিউমের নির্যাসের কাঁচামাল হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ শুরু হয়। এসময়ে এসে দক্ষিণ ফ্রান্সে এটি অত্যতম শিল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সুগন্ধি বা পারফিউমের ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি ও অর্থনীতি যা নিয়েই আলোচনা করি না কেন, আর হালের নব্য ধর্মীয় জ্ঞান ও চেতনা নারীদের সুগন্ধি ব্যবহারে যতোই নিষেধাজ্ঞা জারি করুক না কেন, প্রাত্যহিক জীবন থেকে সুগন্ধি ছাড়বার কোনো জো নাই। অতীতে উদ্ভিজ্জ বা প্রাণিজ নানা উৎস থেকে সুগন্ধি তৈরি হতো বলে পর্যাপ্ততার অভাবে সেগুলো শুধু মানুষের শরীরেই প্রসাধনী হিসেবে শোভা পেত। হালের ক্যামিক্যাল দুনিয়ায় সুগন্ধি মানুষের শরীর থেকে পাতে এবং বিচিত্র পথে ছড়িয়ে পড়েছে। একটা টিস্যু পর্যন্তও এখন পারফিউমড হয়। খাবারের ক্ষেত্রে বিচিত্র অ্যাসেন্স তো আছেই। এমনকি জন্ম নিরোধক ব্যবস্থায়ও সুগন্ধি থাকা লাগে!