সতীমার লাখ লাখ অনুসারীর মাঝে নিম্নবর্গের মানুষের পাশাপাশি শিক্ষিতজনও ছিলেন।
Published : 13 Feb 2024, 12:06 PM
(সূত্রকথা: গুরুবাদী সাধনচর্চায় এক ঐতিহাসিক ও জনপ্রিয় চরিত্র সতীমা। একটি বৃহৎ বাউল ঘরানার বিকাশ ঘটেছে এই নারী গুরুর নামেই। সম্প্রদায়ের অনুসারীরা নিজেদের ‘সতীমার ঘর’ পরিচয় দিয়ে থাকেন। যদিও পণ্ডিত ও আধুনিক মহল তাদেরকে কর্তাভজা সম্প্রদায় হিসেবেই চিহ্নিত করে এসেছে।)
অষ্টম বা নবম শতকে বাংলায় যোগ ও তন্ত্র সাধনায় নারী গুরুর নিদর্শন মেলে। দীক্ষাগুরু হিসেবে চুরাশি সিদ্ধাচার্যের মধ্যে লক্ষীঙ্করা, মেখলা, কণাখলা, মণিভদ্রার নাম পাওয়া যায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে দেহতাত্ত্বিক সাধনচর্চার বিষয়গুলো সান্ধ্যভাষায় পদ আকারে রয়েছে। পরবর্তীতে বাংলার লোকায়ত ধর্মের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যেও দেহকেন্দ্রিক সাধনধারা বহমান। নারীর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান এই সাধনচর্চায় বৈশিষ্ট্যময়। আবার এ সাধনচর্চায় গুরুর ভূমিকাই মুখ্য। গুরুই সান্ধ্যভাষার গুপ্ত জ্ঞান তরজমা করে শিষ্য-সাধককে দিশা দেন। এ অঞ্চলে চর্যাপদের সময়কালের তান্ত্রিক সহজিয়া সাধনায় যেমন নারী গুরুর দেখা মেলে, তেমনি পরবর্তী সময়ে বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যেও নারী গুরুর দৃষ্টান্ত রয়েছে।
বাংলাদেশের কুষ্টিয়া-যশোর ও ভারতের নদীয়া-মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে বাউলদের সাধুসঙ্গে যে পাঁচ ঘরানার সম্মেলন প্রয়োজন হয়, তার মধ্যে একটি বড় ঘরানার বিকাশ ঘটেছে নারীগুরুকে কেন্দ্র করেই। সম্প্রদায়ের অনুসারীরা নিজেদের সতীমার ঘর হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। এ সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ায় ঘোষপাড়ার বিখ্যাত দোলের মেলা সতীমার মেলা নামেই আজও বিখ্যাত। তাঁর নামেই সেখানে মন্দির প্রতিষ্ঠিত।
তবে পণ্ডিত ও আধুনিক মহল তাদেরকে কর্তাভজা সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত করে এসেছে। বিভিন্ন বইপত্রে কর্তাভজা নামেই তাঁদের উল্লেখ পাওয়া যায়। যদিও তাদের রচনায় এ সম্প্রদায়ের বিকাশে সতীমার একচ্ছত্র প্রভাব ও গুরুত্বই বারবার উঠে এসেছে। সম্প্রদায়ের ভক্তদের কাছে তিনিই যে আরাধ্য গুরু দ্বিধাহীনভাবে তার উল্লেখ করা হয়েছে।
অষ্টাদশ শতকে সতীমায়ের জীবদ্দশাতেই তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা শীর্ষে পৌঁছায়, যে কারণে তাঁর নামেই অনুসারীরা নিজেদের পরিচয় দেয়া শুরু করেন। গুরুবাদী সাধনচর্চায় গুরুই সাধকের কাছে পরম। গুরুর অস্তিত্বেই শিষ্যের অস্তিত্ব। গুরুর নামেই পরিচিত হতে চান ভক্ত-সাধক। লক্ষণীয়, লালনের ঘর, পাঞ্জুশাহ’র ঘর, সতীমার ঘর, চৌধুরীর ঘর এবং দেলবার শাহ’র ঘর- বাউলদের এই পাঁচ ঘরানা বা ঘরের মধ্যে অন্যতম সতীমার ঘরকেই কেবল গুরুর নাম সরাসরি না ধরে কর্তাভজা নামে উল্লেখ করেন তাত্ত্বিকরা।
অনুসারীরা নিজেদের যে নামে পরিচয় দেন সেই নাম ব্যবহারে অনীহা বা তার বদলে ভিন্ন নামে তাদের উল্লেখ করার পেছনের কারণ দৃশ্যমান নয়। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোয় ধর্মগুরু হিসেবে নারীকে সাধারণত স্থান দেয়া হয় না। ধর্ম সংক্রান্ত মনস্তত্ত্বে তারও প্রভাব পড়াও স্বাভাবিক। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তবে কি নারীগুরু হবার কারণেই তাকে কম গুরুত্ব দিয়ে লেখাজোকায় এই ভিন্ন নামের প্রয়োগ করেছেন পণ্ডিতরা?
দেবেন্দ্র নাথ দে রচিত ‘কর্তাভজা ধর্মের ইতিবৃত্ত’ (১৯৫০) বইটির ‘সতী-মা’ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে; ‘আউলচাঁদ প্রবর্তিত ধর্মমত প্রচারে রামশরণের স্ত্রী সরস্বতী দেবীর (সতীমা) অবদানও নিতান্ত কম নহে। সাধারণ ভক্তের মধ্যে কর্তাবাবা অপেক্ষা কর্তামায়ের প্রতিষ্ঠাই অধিক- এবং তিনিই এ সম্প্রদায়ের আরাধ্যা দেবী।’ (কর্তাভজা ধর্মের ইতিবৃত্ত, পৃ. ৩২)
দেবেন্দ্র নাথ দে কর্তাভজা নামটি সম্প্রদায়ের বাইরের লোকদের দেয়া বলে মত প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন- “নামটি কবে থেকে প্রচলিত এবং কার দেওয়া? আমার অনুমান, নামটি বোধহয় সম্প্রদায়ের বাইরে থেকে এদের উপর আরোপিত এবং তা সম্প্রদায় হিসাবে এদের প্রতিষ্ঠার পর।” (ইতিবৃত্ত, পৃ. ৮৪)
তবে তাত্ত্বিকরা যে নামেই ডাকুক না কেন, অনুসারী-চর্চাকারীদের কাছে তাদের পরিচয় ‘সতীমার মতের লোক’ হিসেবেই। বাংলাদেশের বাউল-ফকিরদের একটি বড় অংশ সতীমার ঘর থেকেই আসা। দুই শতাব্দী পার হলেও গুরু পরম্পরায় তারা নিজেদের সতীমার ঘরের লোক হিসেবে পরিচয় দেন। তবে অনুসারীদের বাদ দিলে, সতীমার নাম আজও অন্যদের কাছে আড়ালেই ঢাকা।
সম্প্রতি কুষ্টিয়ার বাউলদের সাথে কথা বলে এই চিত্রই মিলেছে। পোড়াদহের বাউল আনু ফকির জানালেন, গুরু পরম্পরায় তিনি সতীমার ঘরের অনুসারী। আনু ফকির বলেন, ‘গুরু সত্য, তাঁর নির্দেশই প্রধান। আমি সতীমার ঘরের একজন নগন্য বাউল। আমার গুরুর নাম নিমাই শাহ, তাঁর গুরু অমূল্য শাহ, অমূল্য শাহ’র গুরু হরিপদ বাবু। এ পর্যন্তই আমি জানি।’ পোড়াদহে নিবাস হলেও নদীয়ার ঘোষপাড়ায় যেয়ে সতীমার মন্দির ও অনুসারীদের সাথে দেখা করে এসেছেন তিনি। ‘সতীমার কথা আমার সাঁইজির কাছেই শুনেছি। ১৯৭৫ সাল থেকে গুরুর সাথে চলি। ৮৪/৮৫ সালে বয়াত নেই। বয়াত নেয়ার পর জানালেন আমরা সতীমার ঘরের লোক। পাঁচটি ঘরানা আছে। নাম পাঁচটি, তবে মূলে একই’, বলেন আনু ফকির।
বাউলদের প্রাচীনতম ঘর সতীমার ঘর নিয়ে এবার কিছুটা পেছন ফিরি। এই মতবাদের উদ্ভব, বিকাশ, বৈশিষ্ট্য আর সতীমার ঘর হয়ে ওঠার উপাখ্যান সংক্ষেপে দেখে নেয়া যাক।
অষ্টাদশ শতকে আউলচাঁদের মতবাদ:
অষ্টাদশ শতকে বাউল মতবাদসহ বাংলার বিভিন্ন লৌকিক উপধর্মের ভিত্তি গড়ে উঠেছিল আগেই। ষোড়শ শতকে শ্রী চৈতন্যের উদার সমন্বয়বাদী বৈষ্ণব ধর্ম বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু চৈতন্যের তিরোধানের পর দুটি ধারায় ভাগ হয়ে যান তাঁর অনুসারীরা। ষড়গোস্বামীদের গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধারা, অপরদিকে শিষ্য নিত্যানন্দের ছেলে বীরভদ্রের সহজিয়া বাউল ধারা। এর কিছু পরে আঠারো শতকে দেহতাত্ত্বিক সহজিয়া ধারার বাউল হিসেবে আসেন আউলচাঁদ। ভক্তদের কাছে 'কর্তা' ডাকে পরিচিত ফকির আঁউলচাদের ধর্মমতে, হিন্দু, মুসলমান জাতভেদ নেই। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম-বর্ণের সীমারেখা পার হয়ে কেবল মানবদেহকে কেন্দ্র করে দেহবাদী সাধনচর্চাই মূল উপজীব্য। যদিও লেখক সুধীর চক্রবর্তী বৈষ্ণব ধর্মের সাথেই এর মিল খুঁজে লিখেছেন, “এই সূত্র অনুসরণ করে আমরা সকৌতূহলে দেখতে পাই কর্তাভজা ধর্মের প্রথম দিকের ঘোষণা ছিল- 'কৃষ্ণচন্দ্র গৌরচন্দ্র আউলেচন্দ্র / তিনেই এক একেই তিন'। তার মানে বীরভদ্র সরে গিয়ে এলেন আউলেচন্দ্র। তৈরি হল বৈষ্ণববিশ্বাসী এক নতুন উপধর্ম।“ (গহীন নির্জন পথে, পৃ. ২৩)
ফকির আউলচাঁদের জন্ম আনুমানিক ১৭৫৪/৫৫ সালের মধ্যে। প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী মৃত্যু ১৭৬৯ /৭০ সালে। আউলচাঁদের উল্লেখ প্রথমবারের মত পাওয়া যায় তার আট বছর বয়সের বিবরণে। “উলা গ্রামে ১৬১৬ বঙ্গাব্দে মহাদেব নামে এক বারুই তাকে আট বছরের অজ্ঞাত কুলশীল বালক হিসেবে পান।” (ভারতবর্ষীয় উপাসক-সম্প্রদায়, পৃ. ১৮৬-১৮৮)।
আউলচাঁদের জন্মস্থান অজ্ঞাত এবং বাউল লালন ফকিরের মতই তারও পারিবারিক পরিচয়ও অজ্ঞাত। লালন ফকিরের জীবনকাল ১৭৭২ থেকে ১৮৯০ সাল হলে আউলচাঁদ লালনের পূর্বসুরী। আবার এক মতে, লালন ফকিরের মতই আউলচাঁদ এক মুসলমান ফকিরের শিষ্য ছিলেন। অপর মতে, তিনি ফুলিয়ার বলরাম দাসের কাছে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা নেন এবং তখন তার নাম হয় আউলচাঁদ।
আউলচাঁদের ২২ জন শিষ্যের নাম পাওয়া যায়। প্রধানতম শিষ্য রামশরণ পাল। পরবর্তীতে রামশরণের স্ত্রী সরস্বতীর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার ঘোষপাড়া হয়ে ওঠে এই মতবাদের পীঠস্থান। সরস্বতীই পরবর্তীকালে সতীমা নামে খ্যাত হন।
সতীমার ঘর গড়ে ওঠা বা দেহবাদী সহজিয়া চর্চার বিস্তার:
সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠায় সতীমার প্রভাব প্রতিপত্তি ও অবদান অন্যান্য নারী সাধকের মাঝে তাকে বিশিষ্ট করেছে। তাকে নিত্যানন্দের স্ত্রী জাহ্নবী দেবীর সঙ্গে তুলনা করেছেন অনেক লেখক। আউলচাঁদ, রামশরণের নাম অনেক অনুসারী না জানলেও সতীমা নামটি ঠিকই তাদের জানা। তাকে নিয়েই ভক্তদের মুগ্ধতা পরিণত হয়েছে জনশ্রুতিতে।
“এক হিসাবে ইনি জাহ্নবী দেবীর থেকেও শক্তিমতী। জাহ্নবী দেবীর মহিমা চৈতন্যদেবকে, এমন কি নিতানন্দকেও ছাড়িয়ে উঠতে পারে নি। কিন্তু সতীমা দেবীতে পরিণত হয়েছেন। এর আমলেই ফকির আউলচাঁদ একেবারে পশ্চাৎ্পটে চলে যান এবং কর্তাভজাধর্ম সতীমা আরাধনায় পরিণত হয়।” (কর্তাভজা ধর্মের ইতিবৃত্ত, পৃ. ৮৫)।
আউলচাঁদ প্রবর্তন করলেও এ ধর্মমতের ব্যাপক প্রচার সম্ভব হয়েছিল সরস্বতীর হাত ধরেই। তিনিই হয়ে ওঠেন সম্প্রদায়ের আদর্শের প্রতীক। জনসাধারণের মধ্যে একে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন সতীমা। গড়ে তোলেন লাখ লাখ মানুষের বিশাল অনুসারী গোষ্ঠী। তার সময়েই এই মতবাদ বিভিন্ন জায়গায় বিস্তার লাভ করে। তখন থেকেই ভক্তদের কাছে কর্তা প্রবর্তিত সত্যধর্ম বিশেষ পরিচিত হয়ে ওঠে সতীমার মত হিসেবে।
এইচ এইচ উইলসন তার Hindu Religions: An Account of the Various Religious Sects of India গ্রন্থে এই সম্প্রদায়ের অনুসারী অসংখ্য বলে উল্লেখ করেছেন। ওয়ার্ডের লেখাতেই কর্তাভজাদের সম্পর্কে প্রথম লিপিবদ্ধ বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে শিষ্য সংখ্যা চার লক্ষাধিক বলা হয়েছে। অক্ষয়কুমার দত্ত লিখেছেন, “লক্ষ লক্ষ লোক এই ধর্ম অবলম্বন করিয়াছে।” রমেশচন্দ্র মজুমদার বাংলার ইতিহাস'-এ লিখেছেন : ক্ৰমে এই সম্প্রদায়ের খুব সমৃদ্ধি হয় এবং ভক্তের সংখ্যা অসম্ভব বৃদ্ধি হয়।'(পৃ. ২৬৯)। সুকুমার সেন এবং উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য কর্তাভজাকে পশ্চিমবঙ্গের একটি বৃহৎ সম্প্রদায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
১৭৮৩ সালে রামশরণের মৃত্যুর পর থেকে পরবর্তী কয়েক দশক সতীমা কর্তাভজার সত্যধর্ম প্রচারে ব্রতী হয়েছিলেন। আগে উল্লেখ করা বাউলসঙ্গের পাঁচ ঘরানার মধ্যে সতীমার ঘরেই একমাত্র বংশানুক্রমিক গদিনসীন প্রথা রয়েছে। সরস্বতী দেবীর জন্ম আনুমানিক ১৭৫৮/৫৯ সালে (১১৬৫-৬৬ বঙ্গাব্দে), মারা গেছেন ১৮৪৯ সালে (১২৪৬ বঙ্গাব্দ)। অর্থাৎ লালন ফকিরের জন্মের আনুমানিক ১৪ বছর আগে সতীমার জন্ম।
লালন ফকির ঘোষপাড়ার দোলের উৎসবে অংশ নিয়েছিলেন বলে ধারনা করা হয়। লক্ষণীয়, ফাল্গুনে দোলের সময় কুষ্টিয়ায় ফকির লালনের আখড়াতেও দোল উৎসব একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। লালন ফকির নিজেই এই দোল উৎসবের আয়োজন করতেন।
কুষ্টিয়ার আনু ফকিরের জবানিতে, ‘আমাদের ঘরটা তো লালনের থেকেও অনেক পুরনো। লালন ফকির ওখানে গিয়ে সঙ্গ অনুষ্ঠান করেছেন। যেতে যেতেই উনি নিজে এখানে একটা সঙ্গ করা শুরু করলেন। দোল পূর্ণিমার সময়। সে সঙ্গটা এখনো চলে। ওটা উনি নিজেই করতেন বেঁচে থাকতে।‘
আউলচাঁদের প্রতি যে সরস্বতীর প্রগাঢ় ভক্তি ছিল তা সহজেই অনুমেয়। আমরা দেখি, ফকির আউলচাঁদের কাছে তাঁর মতই একটি সন্তান কামনা করে বর চেয়েছিলেন সরস্বতী দেবী। পরে দুলালচাঁদ নামে এক ছেলে হয়। (কর্তাভজা ধর্মের ইতিবৃত্ত, পৃষ্টা ৩২)। রামশরণের মৃত্যুর সময় দুলালচাঁদের বয়স ছিল সাত বছর। স্বামীর মৃত্যুর পর সরস্বতীই ঘোষপাড়ার সম্প্রদায়কে দিশা দিতেন। পরে কিছুকাল স্বল্পায়ু দুলালচাঁদ সম্প্রদায় পরিচালনা করেন। তিনিই এ সম্প্রদায়ের আইনিপুস্তক ভাবের গীতের রচয়িতা।
সতীমার লাখ লাখ অনুসারীর মাঝে নিম্নবর্গের মানুষের পাশাপাশি শিক্ষিতজনও ছিলেন। ভক্তদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল তার অলৌকিক ক্ষমতার কাহিনী। ১৯৬১ সালের দেশ পত্রিকায় নির্মলচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় তার সর্ম্পকে লিখেছিলেন, “আউলচাঁদের আর্শীবাদে ও আপন সাধন বলে সতী-মা অলৌকিক শক্তির অধিকারিণী হন। তিনি বাকসিদ্ধা ছিলেন। ভক্তের মনস্কামনা তার বরে পূর্ণ হত। তার স্পর্শে রূগ্ন হত সবল, খঞ্জ হত সচল। অন্ধ পেত দৃষ্টি, মূক বধির লাভ করত বাক ও শ্রবণ শক্তি, বন্ধ্যা ও মৃতবৎসার কোলে আসত সুলক্ষণযুক্ত সন্তান …”
সতীমাকে নিয়ে ভক্তরা গান বেঁধেছিলেন -
সতী মা উপরে যেবা রাখিবে বিশ্বাস।
সেরে যাবে কুষ্ঠ ব্যাধি হাঁপ শূল কাশ |
কৃপা হলে ভবে তাঁর ঘটে অঘটন।
অন্ধ পায় দৃষ্টিশক্তি বধিরে শ্রবণ ॥
সতীমার উল্লেখ বইপত্রে কম থাকলেও সম্প্রদায়ের কাছে তার জনপ্রিয়তা যে আকাশছোঁয়া ছিল তা ঢেকে রাখা যায়নি। আজও ভক্তজনের কাছে ঘোষপাড়ায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান সতী মায়ের মন্দির ও তার সমাধি।
তবে সরস্বতী দেবী কীভাবে কর্তা মা বা সতীমা হয়ে উঠলেন সেই যাত্রা রহস্যময়। কারণ বিদ্যজনরা রামশরণ ও দুলালচাঁদের উল্লেখ বারবার করলেও, সতীমার কথা তাদের রচনায় উপেক্ষিত হয়েছে বরাবরই। সুধীন চক্রবর্তীও প্রশ্ন তুলেছেন, "এই সতী মা যে কেমন করে ক্রমে ক্রমে কর্তা মা হয়ে উঠেছিলেন সেও এক রহস্য। কেননা ১৮১১ সালে এবং ১৮২৮ সালে ওয়ার্ড সাহেব এবং পরে হোরেস হেম্যান উইলসন তাঁদের লেখায় রামশরণ ও দুলালচাঁদের সুবিস্তৃত উল্লেখ বারবার করলেও এক জায়গাতেও সতী মা-র কথা লেখেননি। বরং ওয়ার্ড সাহেব ঐশীক্ষমতা ও রোগ আরোগ্যের মিথ তৈরি করেছেন আউলচাঁদ ও রামশরণের নামে।" (গহীন নিজর্ন পথে, পৃ. ৫৯)
সতীমার মতে নারীর অবস্থান
লোকায়ত ধর্ম বা উপাসক সম্প্রদায় জাত-ধর্মের পাশাপাশি নারী-পুরুষের বৈষম্য স্বীকার করে না। গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত জনপদে ঠাঁই পাওয়া এসব সম্প্রদায়ের কাছে নারীগুরুরাও দ্বিধাহীনভাবে ভক্তির কেন্দ্র বা পূজনীয়। অন্য বাউল-ফকির ঘরের মতই সতীমার ঘরেও হিন্দু গুরু বা মহাশয়ের মুসলমান শিষ্য বা বয়াতি যেমন আছেন, তেমনি মুসলমান গুরুর হিন্দু শিষ্যর দেখা মেলে। এ সম্প্রদায়ে নারী পুরুষ নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না। একারণে গুরুর ভূমিকায় নারী পুরুষ উভয়েরই দেখা মিলতে পারে।
যদিও সে সময়ের লেখক-পণ্ডিতদের কাছে নারীর স্বাধীন অবস্থান, নারী পুরুষের মেলামেশাকে সহজভাবে দেখা হয়নি। দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন, “এই দলে নারী-পুরুষের অবাধ মিলনে বাধা না থাকলেও তাদের নীতি-অনুশাসন উচ্চ মানের। ‘স্ত্রী হিজড়ে, পুরুষ খোজা, তবে হবে কর্তা ভজা।’ (বৃহৎ বঙ্গ, দ্বিতীয় খন্ড, দীনেশচন্দ্র সেন ৮৯৪ পৃ.)
সুধীর চক্রবর্তীর গহীন নির্জন পথে বিনয় ঘোষের বইয়ের থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে: “এ বৎসর দোলে প্রায় ৬৫ হাজার লোকের সমাগম হইয়াছিল। যাত্রীদিগের মধ্যে চৌদ্দ আনা স্ত্রীলোক। কুলকামিনী অপেক্ষা বেশ্যাই অধিক, পুরুষদিগের সকলেই প্রায় মূর্খ।”
অক্ষয়কুমার দত্ত ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় গ্রন্থে নানা সমালোচনার মাঝেও সতীমার ঘরের শক্তিশালী হয়ে ওঠার দিকটিরও উল্লেখ করেছেন। “বিশেষত ফাল্গুনে দোলের সময় নদীয়ার কল্যাণীর ঘোষপাড়া যে নানা জাতের লোকের তীর্থে পরিণত হয় তাও উঠে এসেছে তার রচনায়। এবং বিস্ময় নিয়ে দেখা যাচ্ছে, উৎসবে সেখানে নারী-পুরুষ একসাথে খাচ্ছেন, ধর্মীয় সঙ্গীত গাইছেন, শুনছেন। হিন্দু-মুসলিম নানাজাতের লোকের মাঝে সেখানে নারীর অংশগ্রহণও সমান মাত্রায়।” (ভারতবর্ষীয় উপাসক-সম্প্রদায়, পৃ ১৯৫-৯৬)
নেতিবাচক এসব বিবরণ থেকেও একটি বিষয় স্পষ্ট বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, নারীর উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ মেলায় ব্যাপক মাত্রায় ছিল, বলা যায় ‘নারী-বান্ধব’ পরিবেশ ছিল সেখানে। অত্যন্ত গুরুত্বের বিষয় এই যে, আজও যেখানে নারীকে দ্বিতীয় লিঙ্গ হিসেবে দেখা হয় এবং তার জীবনাচরণ পুরুষকর্তৃক র্নিধারিত ও নিয়ন্ত্রিত, সেখানে সতীমার সম্প্রদায়ে নারীর অবস্থান, অংশগ্রহণ ছিল পুরুষের সাথে স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্তভাবে একই সারিতে। গুরু হিসেবে একজন নারীকে মেনে নেয়াই শুধু নয়, তাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পরম আরাধ্যের স্থান দেয়া সম্ভব হয়েছে। হয়ত প্রথমত নারীকে সমমর্যাদায় মানুষ হিসেবে দেখতে পারার কারণেই।
সমন্বয়বাদী লোকধর্ম: সতীমার সম্প্রদায়
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় সহজিয়াদের কর্মে-ধর্মে মানবতার সুর বেজেছে। চর্যাপদে যেমন সাধারণ মানুষের মুখের বুলি বাংলাতে তাদের জীবনাচরণ, তাদের সাধনার কথা পাওয়া যায়, তেমনি মধ্যযুগের সহজিয়া কবি চন্ডীদাসের গলায়ও শোনা যায় মানবতার জয়জয়কার।
শুনহ মানুষ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই
একই ধারায় আধুনিক যুগের গোড়ায় সাধারণ মানুষের জন্য ও সহজিয়াধারার গুরুবাদী সাধনা সতীমার মতবাদেরও মূল। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কামার, কুমার, তাঁতী, জেলে, কৃষকসহ সবার এখানে প্রবেশাধিকার সমান। সহজাত বৃত্তিকে অবলম্বন করে তাদের সাধনা। প্রতিষ্ঠিত ধর্মশাস্ত্রে তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা নেই। তারা মানবের মুক্তিতে প্রেমেরই জয়গান গেয়েছেন।
বাংলা চর্যাপদের পদে যে দেহকেন্দ্রিক বয়ান বাংলার মাটিতে সেই একই দেহবাদী সাধনচর্চার গল্প পাওয়া যায় বাউল-সাধকদের মাঝে। তাদের সাধনাও দেহাশ্রয়ী। সহজিয়া সাধনারই তারা একটি ধারা। চর্যাপদের সান্ধ্যভাষা সঙ্গতকারণেই বাউলগানেও অনুসৃত।
শ্রী চৈতন্য পরবর্তী যুগে বিশুদ্ধ বৈষ্ণব সাধন কেন্দ্রচ্যুত হয়ে সহজিয়া সাধন ধারায় জন্ম নিয়েছিল যেসব মত, সতীমার মতকেও তাদের একটি শাখা হিসেবে ধরেন পণ্ডিতরা। যদিও সতীমার ধর্মমতে হাজার বছর আগের সেই চর্যাপদের দেহবাদী সহজসাধন ধারাই আমরা লক্ষ্য করি। এই দেহই তাদের সাধনস্থল, মানুষই তাদের পূজনীয়। দুলাল চাঁদ রচিত ভাবের গীতে যেমন বলা হয়েছে, ‘আছে মানুষে মানুষে যার ভেদাভেদ জ্ঞান, সে রাজ্য গমনে তার মিলবে না সন্ধান। ’
সতীমার জনপ্রিয়তা ও ব্রাক্ষণদের বিরূপ ভাব
শাস্ত্র ও শরিয়তের কাছে অনাদৃত, নিগৃহীত লোকায়ত ধর্মকে সমাজের উপর মহলও কখনোই সহজে গ্রহণ করেনি। তারা সতীমার মতকেও সুনজরে দেখেননি। উনবিংশ শতকের সমাজে ব্রাক্ষণ পণ্ডিতদের কাছে এই জাতপাতহীনতা, নারী-পুরুষের সাধারণ মেলামেশার বিষয়টিকে গুরুতর অপরাধ হিসেবেই ধরা হয়েছে। তাদের কাছে এই সম্প্রদায় কটাক্ষের শিকারও হয়েছে। এমন কি লালন ও বাউল মতাদর্শ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের করা আলোচনার আগে শিক্ষিতমহলে বাউলদের খুব সহজভাবে নেয়া হয়নি। লোকায়ত সহজ ধর্মে নারীর স্বাধীন বিচরণ, নারী-পুরুষের স্বাভাবিক মেলামেশা উনবিংশ-বিংশ শতকের সামাজিক দৃষ্টিতে অশালীন ঠেকেছে। বাছবিচার ছাড়াই বসেছে যৌন অনাচারের তকমা। বিংশ শতাব্দীর পণ্ডিতদের লেখায় তাই সতীমার সম্প্রদায়কেও সেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। অক্ষয়কুমার দত্তের ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় বইয়ে কর্তাভজাসহ অনুরূপ সম্প্রদায়কে ব্যভিচারসহ নানা দোষে দুষ্ট করা হয়েছে।
যদিও সেসব মন্তব্যের অসত্যতাও প্রমাণিত হয়েছে। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বাংলার বাউল ও বাউল গান বইটিতে অক্ষয়কুমারের মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। দীনেশ চন্দ্র বৃহৎ বঙ্গ গ্রন্থে কর্তাভজার উল্লেখ করলেও সেখানে ব্যভিচারের দোষ ধরেননি। নবীনচন্দ্র সেন ১৮৯৫ সালে ঘোষপাড়ার মেলায় তিন দিন অবস্থান করে অক্ষয়কুমারের ‘জঘন্য মন্তব্যের’ কিছুই পাননি, উল্টো রীতিমত এই ধর্মমতে শ্রদ্ধাশীল মনোভাব প্রকাশ করেছেন।
লোকায়ত ধর্মগুলোকে অনেক গবেষক-পণ্ডিতই এখন খোলা চোখে দেখছেন। ধর্মীয় উদারতা, জাতি-বর্ণ বৈষম্যহীনতার বাইরে মানবিক উদার দিগন্ত নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল সতীমার মত। নানা বিঘ্ন থাকা সত্ত্বেও তাই এর প্রসার ঘটে। মানুষে মানুষে ভেদহীন অবস্থাই তো যুগে যুগে সহজ মানুষের প্রত্যাশা। যেমন দুলাল চাঁদের ভাবের গীতে বলা হচ্ছে- “ভেদ নাই মানুষে মানুষে, খেদ কেন ভাই এদেশে”।
সহায়ক বইপত্র:
১. অক্ষয়কুমার দত্ত, ভারতবর্ষীয় উপাসক-সম্প্রদায়, প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলিকাতা, ১৮৮৮
২. দেবেন্দ্র নাথ দে, কর্তাভজা ধর্মের ইতিবৃত্ত, প্রথম প্রকাশ ১৯৫০, কলিকাতা
৩. সুধীর চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত, বাংলা দেহতত্ত্বের গান, দ্বিতীয় পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ, জানুয়ারি ২০০০
৪. সুধীর চক্রবর্ত্তী, গহীন নির্জন পথে, প্রথম সংস্করণ ১৯৮৯, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০২, দশম মুদ্রন ২০২২
৫. দীনেশচন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, দ্বিতীয় খন্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৩৫, দে'জ পুনর্মুদ্রন ১৯৯৩
৬. সোমব্রত সরকার, কর্তাভজা, দেহবাদ, লোকধর্ম, অন্বেষা প্রকাশন, ২০১৯