কালানুক্রমিক হয়েও কালাতিক্রমী

সাহিত্যের ভাণ্ডার হয়ে উঠেছে বিপুল, বইয়ের সংখ্যা এখন অগণন, বৈশ্বিক জ্ঞান তাই অসম্ভব। -ভলতেয়ার

রাজু আলাউদ্দিনরাজু আলাউদ্দিন
Published : 30 Jan 2023, 00:59 AM
Updated : 30 Jan 2023, 00:59 AM

মহৎ সাহিত্য ভালো লাগার ক্ষেত্রে রচনার (Text) সমসাময়িকতা বা প্রাচীনতা কখনোই নিয়ামক ভূমিকা পালন করেনি, করবেও না। এর কারণ সাহিত্যের সার্বজনীন ও চিরকালীন গুণ। ঠিক এই কারণে সাহিত্যের গুণাগুণ বা উৎকর্ষ কখনোই কালানুক্রমিকতার (Linear) অনুবর্তী নয়। কিন্তু আবার এটাও সত্যি যে কালানুক্রমিক এমন কিছু উন্নতি সাহিত্যের ক্ষেত্রে ঘটেছে যা কেবল ধারাবাহিকতার ফলেই ঘটতে পারে। সাহিত্যের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর ইন্টারটেক্সুয়ালিটি; এই ইন্টারটেক্সুয়ালিটির কারণে সাহিত্যের উন্নতি কালানুক্রমিক হতে বাধ্য। বাধ্য কারণ একটি নির্দিষ্ট রচনা (Text) থেকে উদ্ভুত হচ্ছে আরেকটি রচনা। কোনো কোনো শিল্পকাঠা্মো বা শিল্পীরীতি কালের ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছে,ভলতেয়ার যাকে প্রতিধ্বনি (Echo) বলে অভিহিত করেছেন, কিন্তু ‘প্রতিধ্বনি’ হওয়া সত্ত্বেও তা নতুন বিন্যাসে তাৎপর্যময়। ফলে ধারাবাহিকতাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগই নেই। কারণ, ভলতেয়ারের ভাষায়:

“সাহিত্যের ভাণ্ডার হয়ে উঠেছে বিপুল, বইয়ের সংখ্যা অগণন, সামগ্রিক জ্ঞান তাই অসম্ভব। পরিশীলিত মন প্রতিধ্বনি হওয়া ছাড়া বেশি কিছু নয়, এবং বর্তমান যুগ গত শতাব্দীরই শিষ্য মাত্র। আমরা নিজেদের জন্য ধারণা (ideas) ও অভিব্যক্তির এক ভাণ্ডার তৈরি করেছি যেখানে প্রত্যেকেই নিজেকে সহযোগিতা করছে।”

Literature has been immense, the number of books countless, universal knowledge impossible. The cultivated mind is no more than an echo, and the present age is  only the disciple of the past century. We have made for ourselves a storehouse of ideas and expression to which every one helps himself. ( Candide and Other Writings, Voltire, Modern Library, 1956, P-566)

আমরা প্রত্যেক লেখক পূর্ববর্তী লেখকদের সঞ্চিত পুঁজিকে সুদেআসলে খাটিয়ে তা পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে যাই। অর্থাৎ সাহিত্য আসলে এক পরম্পরা। কার্লোস ফুয়েন্তেসও বিশ্বাস করেন এই পরম্পরায়:

“প্রত্যেক মহান লেখক, প্রত্যেক মহান সমালোচক, প্রত্যেক সেরা পাঠকই জানেন যে বই এতিম নয়; এমন কোনো রচনা নেই যা অন্য রচনা থেকে আসেনি।”

Every great writer, every great critic, every great reader knows that no book is an orphan; there is no text that does not descend from other texts. (Great Latin American Novel, Carlos Fuentes, Dalkey Archive Press, 2016, P-112)

 কিন্তু এই পরম্পরা, যার সাহিত্যিক কেতাবি নাম  ইন্টারটেক্সুয়ালিটি, তার বাইরে--এবং যুগপৎভাবে ভেতরেও--সাহিত্যের এমন একটি দিক রয়েছে যা তাকে চিরকালের নাগরিকত্ব দেয়, আমরা যাকে বাচনিক ঐশ্বর্য বলে অভিহিত করি। ঠিক এই কারণে সাহিত্য কালানুক্রমিক হয়েও আবার তা কালাতিক্রমী। আর তাই সাহিত্যকে একতরফাভাবে ইতিহাস, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের মতো করে একরৈখিকভাবে বিচার করার সুযোগ নেই। হাজার বছর আগের বলেই তা অচল হয়ে যায় না। পাঁচ শ’ বছর আগের বৈজ্ঞানিক আবিস্কার আজকে অচল হলেও, পাঁচশ বছর আগের শেক্সপিয়র বা হাজার বছর আগের হোমার, কিংবা সফোক্লিসকে আমরা অচল বলতে পারি না। না-পারার কারণ শাশ্বত এমন কিছু এই লেখকদের রচনায় রয়েছে যা পরম্পরা-নিরপেক্ষ।

আর এই কারণেই শিল্প কালানুক্রমিক হয়েও কালাতিক্রমী হয়ে ওঠে। কালের এই পরস্পরবিরোধিতা শিল্পের ক্ষেত্রে খানিকটা ধাঁধার মতো হলেও, শিল্প চিরকালই সেই ধাঁধার মধ্যদিয়েই পথ কেটে এগিয়ে গেছে।