শেকড়ের কাছে যাওয়ার ঈদ

অগত্যা গেটের ঠিক পাশের দোকানের লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, এখানে ঈদের জামাত কয়টায় হয়?

ফারুক মঈনউদ্দীনফারুক মঈনউদ্দীন
Published : 22 April 2023, 08:30 AM
Updated : 22 April 2023, 08:30 AM

কয়েক বছর আগে আমার এক ভাগ্নেকে কেবল দেখে আসার জন্য মাত্র একদিনের সফরে মেলবর্ন থেকে সাতশ কিলোমিটার ডিঙিয়ে সিডনি গিয়েছিলাম দেড় ঘন্টার উড়ানে। ভাইপো ভাগ্নেদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ পিয়াল ছোটবেলা থেকে আমার খুব ভক্ত, এখন সে নিজেই দুই বাচ্চার বাবা, কাজ করে সিডনির এক ফার্মে, যাদের কাজ বিভিন্ন বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ফরেনসিক অ্যাকাউন্টিং। এয়ারপোর্টে আমাকে নিতে এসে ছোটবেলার মতো করে যে কথাটা আমাকে বলেছিল ও, সেটা ঘনিষ্ঠ একজনের স্নেহসিক্ত ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা হলেও তার ভেতরে ভাবনার খোরাক ছিল। ও আমাকে অকপটে জানায় যে আমি ওর কাছে যাচ্ছি বলে গত রাতটা ওর কাছে ঈদের আগের রাতের মতো বলে মনে হচ্ছিল। কথাটায় আমি ভেতরে ভেতরে চমকে যাই। আমাকে কাছে পাওয়ার আনন্দের চেয়ে ওর সরল স্বীকারোক্তির ভেতর তিন থেকে চার দশকে আমাদের ক্রমশ বদলে যাওয়ার একটা অপ্রচ্ছন্ন ভেদরেখা স্পষ্টতর হয়ে ওঠে।

এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার পর কিছুদূর গিয়ে বড় রাস্তা ছেড়ে আচমকা একটা জায়গায় গাড়ি ঢুকিয়ে দেয় ও। জানুয়ারি মাসে উত্তর গোলার্ধে তথা বাংলাদেশে শীতকাল হলেও দক্ষিণ গোলার্ধের সিডনিতে কাঠফাটা গ্রীষ্ম। বালারতের মাউন্ট ক্লিয়ার থেকে মেলবোর্ন হয়ে সিডনি পর্যন্ত আসতেই তাপমাত্রা তিন থেকে চার ডিগ্রি বেড়ে গেছে। সেই গরমে ভরদুপুরের রোদের মধ্যে লা পেরুজ নামের বৃক্ষহীন একটা বিশাল চত্বরে আমাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা খুঁজতে চলে যায় পিয়াল। তার আগে বলে যায়, প্রাচীন নিদর্শনের প্রতি আমার আকর্ষণ আছে জেনে এবং এয়ারপোর্ট থেকে ওর বাসায় যাওয়ার পথে পড়ে বলে ঐতিহাসিক এই জায়গাটা আমাকে একঝলক দেখিয়ে নিতে চায় ও। ২৩০ বছর আগে (১৭৮৮ সালে) এখানেই ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন আর্থার ফিলিপ ১১টি জাহাজের এক বহরে হাজার দেড়েক যাত্রী নিয়ে নেমেছিলেন।

পার্কিংয়ে কোনো জায়গা না পেয়ে পিয়াল গাড়ি নিয়ে ধীরে ধীরে চক্কর দিচ্ছে যাতে আমি কিছু সময় কাটিয়ে দেখে নিতে পারি ঐতিহাসিক জায়গাটা, কিন্তু আমার মাথার ভেতর চক্কর দিচ্ছিল ঈদের আগের রাতের আনন্দের কথাটার মাত্রা ও ব্যাপ্তি। জায়গাটা এমনই বৈশিষ্ট্যহীন ও উষর যে ভালো কিছু ছবি তোলার মতো সাবজেক্টও চোখে পড়ে না। তাই সেই রোদের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে এদিক-সেদিক তাকানো ছাড়া আর কিছু করার নেই। সমুদ্রের এক খাঁড়ির পাশে ঘাসে ঢাকা বিশাল এক মাঠের মাঝ বরাবর অষ্টভুজ একটা টাওয়ারের মতো পাথরের ঘর। পরে জেনেছি এই বন্দরে আসা বিদেশি চালান থেকে শুল্ক আদায়ের গুমটি ঘর ছিল এখানে, তার মানে হালের কাস্টমস চেকপোস্ট। খাঁড়ির পাড়ে দাঁড়ালে দেখা যায় দিগন্তরেখা বিলীন হয়ে আকাশের সঙ্গে মিশে যাওয়া সুনীল জলরাশি। সেই নীল জলে এদিক-সেদিক ছুটে চলা স্পিডবোট পেছনে এঁকে যাচ্ছে চকের দাগের মতো সাদা রেখা। সেই সব মিলিত রেখাকে নীল স্লেটের গায়ে সাদা রেখার আঁকিবুকি মনে হয়।

এসব সীমিত দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে উঁকি দিচ্ছিল ঈদের আগের রাতের আনন্দের কথা। এই আনন্দ বোঝার মতো যখন আমার বয়স, তখন রোজা ও ঈদ শীতকালে হতো। সেই শীতে ঘুমজড়ানো চোখে খেতে বসে চোখে পড়ত গরুর মাংসের ঝোল জাফরানি রঙের দইয়ের মতো জমে গেছে, চুলোয় বসানোর পর ফিরে আসত স্বাভাবিক রং। তারপর চান্দ্রবছরের পরিক্রমায় ঈদের দিনগুলো গ্রীষ্মমণ্ডলে ঢুকে পড়ে, আবার ধীরে ধীরে শীতে ফিরে যায়। মুহূর্তের জন্য সেই স্মৃতি মাথায় উঁকি দিতেই চেহারায় হতাশ ভাব নিয়েই যেন পিয়ালের গাড়ি ফিরে আসে, পার্কিং খালি পাওয়া যায়নি। ছায়াহীন এই প্রান্তর থেকে দ্রুত সরে পড়ার অজুহাত তৈরি হয়েছে বলে কিছু স্বস্তিও পাই।

শিশুবেলার ঈদের আনন্দ এবং শীতের আরামের স্মৃতি নিয়ে গাড়ির তাপানুকুল ছায়ায় বসতেই আমার মাথার ভেতর শৈশবের স্মৃতি আবার জেগে ওঠে। আমাদের শৈশবের ঈদের আনন্দ এখনকার কিশোর-কিশোরীরা পায় কি না জানি না। পিতার চাকরিসূত্রে একাধিক মফস্বল শহরে কাটানোর সুবাদে বয়স অনুপাতে ঈদের কথা খুব মনে পড়ে না। কেবল বর্তমান চাঁদপুরের মতলবে একটা বড় মাঠে বাবার সঙ্গে জামাতে যাওয়ার অস্পষ্ট স্মৃতি মনে পড়ে। পরবর্তী সময়ে গ্রামের বাড়িতে ঈদের আগের অনুভূতি স্মৃতিতে এখনো প্রখর। স্থানীয় দরজির হাতে সেলাই করা অতি সাধারণ জামাকাপড় ধুয়ে শুকিয়ে ঘরেই ইস্ত্রি করা হতো। তখন আমাদের একটা কয়লার ইস্ত্রি ছিল, সেটি কেমন এখনকার ছেলেরা ভাবতেই পারবে না। আনাড়ি হাতে ইস্ত্রি করা সেই পোশাক আবার রাতের বেলায় বালিশের নিচে চাপা দিয়ে রাখা হতো, কারণ সুতির কাপড়ের কোঁচকানো ভাব দূর করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। তার পরের কাজ ছিল চাচাত ভাই বোনদের সঙ্গে নিয়ে বাড়ির সামনের মাঝারি আকারের ঘাসে ঢাকা মাঠটা থেকে ছড়িয়ে থাকা শুকনো পাতা, ছেঁড়া কাগজের টুকরো ইত্যাদি এক এক করে তুলে ফেলা। মাঠটা পরিষ্কার করার পর ঘাসে ঢাকা মাঠটাকে যেন আর চেনাই যেতো না।

সকালে বাবার সঙ্গে মাইল খানেক হেঁটে স্কুলের বড় খোলা মাঠে নামাজে যেতাম। নামাজের পর দীর্ঘ মোনাজাতের সময় অনেককে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখেছি কখনো। একবার বাবাকেও অঝোরে কাঁদতে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলাম। বাড়ি ফিরে এলে মায়ের হাতের সেমাই ছাড়াও মূল আকর্ষণ ছিল নারকেল দিয়ে পোলাও আর মিষ্টি কোরমা। সেরকম পোলাও আর কখনো কোথাও খাইনি। আগের দিন থেকে যাবতীয় প্রস্তুতি এবং পরের দিনের নতুন জামা কাপড়, বিশেষ ধরনের খাবার-- সবকিছুই ছিল অনাবিল আনন্দের।

বাবার মৃত্যুর পর মা বাড়ি আগলে পড়ে রইলেন, আমরা ভাইয়েরা নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছি, কিন্তু ঈদের সময় বাড়ি যাওয়ার বিকল্প কিছু ভাবতে পারতাম না। ছাত্র জীবনে ঢাকা থেকে, পরবর্তী সময়ে চাকরি জীবনে খুলনা থেকে, সিলেট থেকে চট্টগ্রাম গিয়েছি। তখন বোধহয় ঈদের আগে এরকম জান লড়িয়ে দিয়ে টিকিট কিনতে হতো না। খুলনা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথটিও খুব সহজ ছিল না, নাইট কোচে আরিচা হয়ে ঢাকা, সেখান থেকে অন্য বাসে চট্টগ্রাম। ঢাকায় কোনো বন্ধুকে বলে রাখলে টিকিট করে রাখত।

দুয়েকবারের ব্যতিক্রম ছাড়া পেশাগত জীবনের প্রায় প্রতিটি ঈদে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতাম। তারপর দীর্ঘ পাঁচ বছরের দশটি ঈদ কাটাতে হয়েছে মুম্বাইতে। তখন ঈদে মিলাদুন্নবীর সময়েও কোনো কোনো অমুসলিমকে ‘ঈদ মুবারক’ বলে শুভেচ্ছা জানাতে দেখেছি। সেখানে পূর্বঘোষিত ঈদের ছুটির তারিখের সঙ্গে একবার কি দুবার চাঁদের মোলাকাত ঘটেনি বলে ঈদের দিনেও অফিসে যেতে হয়েছে। আত্মীয়স্বজনহীন সেই শহরে ঈদের দিনের একাকীত্ব দূর করতে বন্ধুস্থানীয় কোনো বাঙালি বন্ধুকে নিয়ে দূরের কোথাও ডিনারে যাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত ঈদ উদযাপন। বাংলাদেশ থেকে বন্ধু এবং আত্মীয়দের ফোন পেলে পরবাসের কষ্টটা দ্বিগুন হয়ে উঠত।

একদিন মা-ও চলে গেলে গ্রামের বাড়ির সঙ্গে বন্ধনটা শিথিল হয়ে আসে। তারপরও পূর্ব পুরুষের ভিটাতে একবার যেতে মন চায়, তাই ঈদের পরে হলেও একবার যাওয়া হয়।

কখনো ঈদের ছুটিতে দেশের বাইরে গিয়ে ওদের ঈদ উদযাপন দেখতে চেয়েছি। চীনে, কলকাতায়, বার্মায় ঈদের দিন বিশেষ কোনো দৃশ্য চোখে পড়েনি। একবার চীনের কুনমিংয়ে পৌঁছালাম ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায়। হোটেলে চেক ইন করে ভাবি, আগামিকাল ঈদ, মসজিদ খুঁজে বের করতে হবে, যাতে জামাতটা অন্তত ধরা যায়। চীনারা কীভাবে ঈদের নামাজ পড়ে সেটাও দেখা হয়ে যাবে। হোটেলের নিচে নেমেই বোঝা গেল পুরো জায়গাটা ট্যুরিস্টে সয়লাব। আশেপাশের পরিবেশও অনুকূল। আমরা দুপাশে বৃক্ষশোভিত একটা সোজা রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকি। রাস্তাটাতে সাইকেল ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন নেই। কেবল পথচারী মানুষের হেঁটে বেড়ানোর জন্যই রাস্তাটা। দুপাশে একই আকারের সোজা উঠে যাওয়া গাছের সারি। কোথাও কোনো বিসদৃশ অসুষম গাছ নেই, যেন একটা আরেকটার প্রতিচ্ছবি।

বৃক্ষসারির মাঝের রাস্তা দিয়ে যেতে পথে পড়ে বড় এক মসজিদ। আগামীকাল তাহলে হোটেলের কাছেই ঈদের নামাজটা সেরে নেওয়া যাবে। রাতের খাবারের খোঁজে যাওয়ার আগে মসজিদের মূল দরজার কাছে গিয়ে ঘোরাঘুরি করি, যদি কাউকে পাওয়া যায়। কিন্তু জিজ্ঞাসা করার মতো কাউকে দেখা যায় না। রোজা শেষ, তারাবী পড়া লোকজনও নেই। আশপাশে লোক যে একেবারেই নেই, তা নয়। মসজিদের গেটের দুপাশে দোকানের সারি, কিন্তু মসজিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তেমন কাউকে পাওয়া যায় না। আমাদের দেশে মসজিদের ভেতর ইমাম, মুয়াজ্জিন, নিদেনপক্ষে তালেবুল এলেম গোছের কাউকে না কাউকে যেরকম পাওয়া যায়, এখানে সেরকম কোনো লোককে দেখা গেলনা। চীনাদের দাড়ি থাকেনা, ফলে শ্মশ্রুমন্ডিত কোনো লোককেও পাওয়া গেলনা। অগত্যা গেটের ঠিক পাশের দোকানের লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, এখানে ঈদের জামাত কয়টায় হয়?

লোকটা কি বুঝল কে জানে, হাতের ইশারা দিয়ে ‘বলাই’ গল্পের ফটিকের মতো এক অস্পষ্ট দিক নির্দেশ করে, যা থেকে কিছুই বোঝা যায় না। আরো কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করেও খুব একটা সুবিধা করতে পারি না। কেউ কিছু না বলে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকে, কেউ হড়বড় করে কি বলে বুঝতে না পেরে আমরাই ঘাবড়ে যাই। শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দিয়ে ঠিক করি আগামি কাল সকালে উঠে মসজিদের দরজায় ধর্না দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব, আর নামাজী লোকজন ঢোকার সময় পিছু নেব ওদের।

সমস্যার একটা আপাতসমাধান পাওয়া গেলে ঈদের নামাজের পুণ্যার্জনের আগাম ব্যবস্থা স্থগিত রেখে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে মনস্থ করি। হোটেলের পাশের মলে ম্যাকডোনাল্ডসের একটা দোকান দেখেছিলাম, কোনো ঝুঁকি না নিয়ে ওটাতেই গিয়ে বসা গেল। আমাদের দলে বাচ্চাকাচ্চা মিলিয়ে মোট আটজন সদস্য, কমপক্ষে চার থেকে ছয় রকম অর্ডার। কাউন্টারের মেয়েটিকে ওর মাথার ওপরের বিভিন্ন আইটেমের ছবি দেখিয়ে অনেক কষ্টে বোঝানো সম্ভব হলো, আমরা ঠিক কী খেতে চাই। ভাগ্যিস ম্যাকডোনাল্ডসের দোকানে প্রতিটা মেন্যুর আকর্ষণীয় ছবি দেওয়া থাকে, তা না হলে সেদিন হয়তো উপোস করেই কাটাতে হতো। ভাবছিলাম, আহা ! দেশে আজ ‘চান রাইত’, সবাই মিলে কত মজা করছে, আর আমরা বিদেশে বিভুঁয়ে ভাষার বিভ্রাটে প্রায় না খেয়ে থাকার জোগাড়।

পরদিন সকালে একটু দেরি করেই ঘুম ভাঙে। ফলে ভোরে উঠে মসজিদের সামনে ওৎ পেতে বসে থাকার পরিকল্পনাটা ভেস্তে যায়। ঈদের দিনের সকালে সেমাই খাওয়া সেবছর ভাগ্যে ছিল না, ফলে হোটেলের রেস্তোরাঁয় পাউরুটি, মাখন, কর্ণ ফ্লেক্স ইত্যাদি দিয়েই ঈদের দিনের নাস্তা সারতে হয়। ঈদের দিন বলেই হয়তো আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজের ব্যবস্থা হয়েছে এক মুসলিম রেস্তোরাঁয়। মনে মনে কল্পনা করেছি, মুসলিম রেস্তোরাঁ মানে ক্যাশ কাউন্টারের সামনে বসে থাকবে টুপি পরা কোনো চীনা বৃদ্ধ, থুতনিতে থাকবে হো চি মিন-এর মতো দীর্ঘ পাতলা দাড়ি। হাতে একটা তসবিহ থাকলেও থাকতে পারে। আর দোকানে কাচের ফ্রেমে বাঁধানো থাকবে কাবা শরিফের বিশাল ছবি। সেখানে ঘন শুরুয়ায় রান্না করা থাকবে গরুর মাংসের টুকরো আর ডুমো ডুমো করে কাটা আলু। সোফিয়া নামের গাইড মেয়েটি আমাদেরকে নিয়ে যায় একটা সাধারণ মার্কেটের নিচে ছোট এক খাবারের দোকানে, যার মুসলিম নিদর্শন বলতে দরজার ওপর কোঁচকানো একটা সবুজ ব্যানার, ওটাতে কাকের ঠ্যাং বগের ঠ্যাংয়ের মতো চীনা ভাষার নিচে ইংরেজিতে লেখা, ‘ঈদ মুবারক’, ব্যস এটুকুই। বোঝা গেল ফি বছর শুধুমাত্র ঈদের দিনই ওটা সিন্দুক থেকে বের করে ওরা। দোকানে কোনো ক্যাশ কাউন্টার নেই, টুপি পরা কোনো বৃদ্ধও নেই। শার্ট ট্রাউজার পরা কয়েকজন স্থানীয় তরুণী আমাদের অর্ডার নিতে আসে, ওদের কারো মধ্যেই মুসলানিত্বের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তবে আমরা দোকানে ঢোকার পর তরুণীদের একজন ঘটা করে চীনা উচ্চারণে ‘ঈদ মোবারক’ বলে অভ্যর্থনা জানায়। সোফিয়া নিশ্চয়ই ঢোকার সময় আমাদের ধর্মীয় পরিচয়টা জানিয়ে দিয়েছে ওদের। প্রত্যুত্তরে ‘ঈদ মুবারক’ বলে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি। দোকানের দেয়ালে কাবা শরিফের ছবি বা এজাতীয় কিছু নেই, বরং কাচের শোকেসে বিয়ার, স্থানীয় নাম না জানা সুরাসহ নরম শক্ত বিভিন্ন পানীয় সাজানো। কল্পনার চোখে দেখা গরুর মাংসের ঝোল নেই, পরিচিত খাবারের মধ্যে আছে কেবল আঠালো ভাত। তার সঙ্গে শাক, ঝোলবিহীন গরুর মাংস এসব পরিচিত খাবার দিয়ে ঈদের দিনের ভোজ সারতে হয় আমাদের।

জ্ঞানার্জনের জন্য না হলেও, ঈদ আনন্দের কথা বলতে গিয়ে সুদূর চীন চলে গিয়েছিলাম। শুরু করেছিলাম যার কথা দিয়ে, একসময়ের সেই ছোট্ট পিয়ালের মতো এখনকার ছোট পিয়ালদের ঈদের আনন্দ কি একইরকম হয়? জানি না। এখন তো আনন্দ উপভোগের বহু উপকরণ হাতের মুঠোয়, মোবাইল ফোনের মতো এক অত্যাশ্চর্য যন্ত্র আমাদের কিশোর-কিশোরীদের ঈদ আনন্দের বিকল্প মাধ্যম কি হয়ে ওঠেনি? তবু পরিবারের হাত ধরে ওদেরও যেতে হয় পূর্বপুরুষের ঠিকানায়। আনন্দও হয়তো তাদের হয়, তবু কেবল একপ্রস্ত নতুন পোশাকের মধ্যে যে আনন্দ ও তৃপ্তি ছিল, সেটা বোধ হয় আর নিরঙ্কুশ নেই।

মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে, একেবারে দরিদ্রসীমার নিচের মানুষেরা ছাড়া, সবাই যে যার সাধ্যমতো কিছু কেনাকাটা করে ঈদ উদযাপন করার চেষ্টা করে। শত প্রতিকুলতার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কয়েকদিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার মরিয়া প্রয়াস দেখে মনে হয় এখনো আমাদের বেশিরভাগ মানুষ শেকড়ের কাছে ফিরে যেতে চায় বার বার। নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যও তাদের ধরে রাখতে পারে না। হয়তো যেতে হয়, যেমন ব্যান্ড শিল্পীরা পশ্চিমের সুর ও ঢঙে যতই সংগীত পরিবেশন করুন না কেন, মাটি ও মানুষের চিরন্তন লোকগীতির কাছেই অন্তত একবার ফিরে যেতে হয় নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই। সেজন্যই মনে হয়, ঈদ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বটে, কিন্তু তার মধ্য দিয়ে নিজের শেকড়ের কাছে যাওয়ার যে আপ্রাণ চেষ্টা, সেটার ভেতরই বোধকরি ঈদ উৎসবের মূল বাণীটা উচ্চারিত হয়।