Published : 06 Oct 2024, 01:18 PM
উরুগুয়ের সাংবাদিক এবং লেখক, এদুয়ার্দো গালেয়ানোকে (১৯৪০-২০১৫) লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এদুয়ার্দো গালেয়ানোর প্রতিটি লেখা তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ সেগুলি নিপীড়িতদের দৃষ্টিতে ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করে, তাদের কন্ঠে কথা বলে। বিশ্বসাহিত্যে যে কয়জন লেখক দেশ-গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ব রাজনীতি ও ইতিহাস বিবরণের ভিন্ন এক ধারা সৃষ্টি করেছেন, তাদের মধ্যে গালেয়ানো অন্যতম। তার অসাধারণ, স্বকীয় লেখনী সমগ্র মহাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতিকে আলোকিত করতে সাহায্য করেছে। একই সাথে সেগুলির অন্ধকার দিকটিও আমাদের সামনে ষ্পষ্টভাবে তুলে এনেছে।
গালোয়ানো তার জীবদ্দশায় বহুবার মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিয়ে কলম ধরেছেন। ইরাক, ফিলিস্তিন, লেবানন, আফগানিস্তানের যুদ্ধ নিয়ে তিনি বিশ্বকে বার বার প্রশ্ন করেছেন। ক্ষমতাধরদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন।
তেমনি প্রশ্ন আর যুদ্ধ নামক দুর্দশা নিয়ে ২০০৬ সালে লাতিন আমেরিকান ইনফরমেশন এজেন্সি (ALAI) সম্পাদিত "ল্যাটিন আমেরিকা ইন মুভমেন্ট" নামক অনলাইন সংবাদ পরিষেবায় তিনি একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। সেই নিবন্ধের আলোকে আসাদ মিরণ এই নিবন্ধটি রচনা করেছেন। লেখার সাথে ব্যবহৃত পোস্টারগুলো শিল্পী দেবাশিস চক্রবর্তীর।
একটি দেশ দু'টি দেশে বোমা মারছে। এই ধরনের দায়মুক্তি বিস্ময়কর হতে পারে, যদি না সেটিকে একটি স্বাভাবিক ব্যবসা বলে গণ্য করা না হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কিছু ভীরু ও কাপুরুষোচিত প্রতিবাদের প্রতিক্রিয়ায়, ইসরায়েল বলে: ভুল হয়েছে।
বিভীষিকাকে আর কতকাল ভুল বলা হবে? কিছু মানুষকে অপহরণের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনের বেসামরিক নাগরিকদের উপর এই হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। তার আগেও এরকমটি ঘটেছে। ফিলিস্তিনি সার্বভৌমত্বকে ন্যায্যতা না দেবার জন্য আর কতদিন ইসরায়েলি নাগরিকদের অপহরণ করার সুযোগ করে দেওয়া হবে? কিছু ইসরায়েলি নাগরিক অপহরণের বিনিময়ে আর কতকাল ফিলিস্তিন ও লেবাননের সমগ্র জাতিকে নিধনের ন্যায্যতা দেওয়া হবে?
বহু শতাব্দী ধরে ইহুদি হত্যা ছিল ইউরোপীয়দের প্রিয় খেলা। জার্মানীর 'অউশউইৎজ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প' ছিল একটি সহজাত প্রাচীন সন্ত্রাসের নদী, যা সমগ্র ইউরোপ জুড়ে প্রবাহিত হয়েছিল। আর কতদিন ফিলিস্তিন এবং অন্যান্য আরবদের তাদের কৃত অপরাধের জন্য মূল্য চুকাতে হবে, যে অপরাধ তারা কখনই করেনি? এর আগে ইসরাইল যখন লেবাননে আগ্রাসন চালিয়ে ধ্বংস করেছিল, তখন হিজবুল্লাহর অস্তিত্ব ছিল না। আর কতদিন আমরা এই হামলাকারীর হামলার গল্প বিশ্বাস করবো, যারা সন্ত্রাস থেকে আত্মরক্ষার অধিকারের নামে নিজেই অবিরাম সন্ত্রাসবাদের চর্চা করে চলেছে? ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, লেবানন: ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে আর কতদিন দায়মুক্তিসহ এই দেশগুলোকে নির্মূল করতে দেওয়া হবে?
আবু গারিবের নির্যাতন, যেটি এক সুনির্দিষ্ট সার্বজনীন অসুস্থতার সূত্রপাত করেছিল। পরবর্তীতে, পৃথিবীর বহু দেশে এই কারাগারের আমেরিকান পদ্ধতি জনপ্রিয়তা পায়। আমাদের মিলিটারিরাও আমেরিকান স্কুল থেকে জিজ্ঞাসাবাদের কৌশল শিখেছে, সেগুলি হয়তো আর নামে নেই, কিন্তু কার্যকারিতায় বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। আর কতদিন আমরা মেনে নেব যে নির্যাতনকে বৈধতা দেয়া যায়? ইসরায়েল এমন একটি দেশ যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ছেচল্লিশটি প্রস্তাব তো বটেই, অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইনকেও বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বীর দর্পে এগিয়ে চলছে।
ইস্রায়েল আর কতদিন বাছাইকৃত বধিরতার বিশেষাধিকার উপভোগ করবে? জাতিসংঘ সুপারিশ করতে পারে কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। যদি কখনো এটি সিদ্ধান্ত নেয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন নিশ্চিত করে যে সিদ্ধান্তটিকে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। ১৯৪৫ সাল থেকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে ৮৯টিরও অধিক প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে; কিন্তু কোন ফল আসেনি। অদ্যাবধি, ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে, তাদের কাছে থেকে জমি কেড়ে নেয়া হচ্ছে, অনেক রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। তারপরও আর কতদিন জাতিসংঘ এমন ধারায় কাজ করে যাবে যা এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই অপর এক নাম?
আর কত রক্ত প্রবাহিত হলে পর জবরদস্তিকে অগ্রাহ্য করে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা পাবে? দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় এবং প্রত্যেক ইসরায়েলির জন্য দশজন আরব মারা যায়। দশটি আরব জীবনের মূল্য একজন ইসরায়েলি জীবনের সমান, এভাবে আর কতকাল পরিমাপ করা হবে?
সামগ্রিক জনসংখ্যার অনুপাতে, ইরাকে নিহত ৫০,০০০ বেসামরিক নাগরিক- যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু- তারা ৮০০,০০০ আমেরিকানদের সমতুল্য। যেন মেনে নেয়াটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, একটি অন্ধ যুদ্ধে অসংখ্য ইরাকিদের হত্যার সকল মিথ্যা যুক্তির বয়ান মানুষ ভুলে গেছে। আর কতকাল আমরা সবকিছু মেনে নিয়ে ভুলে যাব?
অন্যদিকে, তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইরানের পারমাণবিক শক্তির বিকাশ নিয়ে যারপরনাই উদ্বেগে ভুগছে। কিন্তু ইসরায়েলের কাছে ২৫০টিরও অধিক পারমাণবিক বোমা থাকা সত্ত্বেও স্থায়ীভাবে স্নায়ুবিকবৈকল্যের প্রান্ত সীমায় দাঁড়িয়ে থাকা এই দেশটিকে নিয়ে তাদের কপালে বিন্দুমাত্র চিন্তার বলিরেখা দেখা যায় না।
কে-ইবা সর্বজনীন বিপদসূচকের ক্রমাঙ্ক পরিমাপ করে? ইরান কি সেই দেশ ছিল যে নাগাসাকি এবং হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা ফেলেছিল? বিশ্বায়নের যুগে, মত প্রকাশের অধিকারের চেয়ে চাপ প্রয়োগের অধিকার বেশী শক্তিশালী। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের অবৈধ দখলদারিত্বের ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য যুদ্ধকে বলা হয় শান্তি। ইসরায়েলিরা দেশপ্রেমিক এবং ফিলিস্তিনিরা সন্ত্রাসী; আর সন্ত্রাসীরা সর্বজনীন শঙ্কার বীজ বপন করে চলেছে।
আর কতদিন গণমাধ্যম সংবাদের পরিবর্তে ভয় প্রচার করে যাবে? আজ যে হত্যাকাণ্ড ঘটছে, তা তো প্রথম নয় এবং আমাদের আশঙ্কা এই হত্যাকান্ড কখনই শেষ হবে না, নীরবে ঘটতেই থাকবে। পৃথিবী কি বধির হয়ে গেছে?
বিচারের বাণী আর কতকাল নিভৃতে কাঁদবে? পূর্বের হিসাব বাদ দিলেও, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরাইল যুদ্ধের নামে গাজায় ৪১,৬৯৮ জন বেসামরিক লোককে হত্যা করেছে। আহতের সংখ্যাা ৯৬, ৬২৫ জন। তাদের বোমা হামলায় প্রতিনিয়ত নারী ও শিশুরা নিহত হচ্ছে। গাজার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, এই সংখ্যা ১৬, ৭৯৫ জন। প্রতিদিন গড়ে সেখানে ৫০ জনেরও অধিক মানুষ নিহত হচ্ছে! যারা সাহস করে এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানায়, তাদেরকে ইহুদিবিরোধী বলে আখ্যা দেয়া হয়।
আর কতদিন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সমালোচকদের ইহুদি বিরোধী বলে গণ্য করা হবে? জুলুমের এই জঘন্য রূপ আমরা আর কতদিন মেনে নেব? তাদের নামে যা করা হচ্ছে, তাতে করে আতঙ্কিত ইহুদিরাও কি ইহুদিবিরোধী বলে গণ্য হবে? ফিলিস্তিনের স্বদেশকে রক্ষার জন্যও কি এমন কোন আরব কণ্ঠ নেই যারা এই আগ্রাসনকে ধিক্কার জানাতে পারে?
সন্ত্রাসীরা একে অপরের সাথে মিলেমিশে থাকে: রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীরা, সরকারের সম্মানিত সদস্যপদে আসীন হয় আর সাধারণ সন্ত্রাসীরা, উন্মাদের মতো একা একা কাজ করে যায়; অথবা যারা কোন গ্রুপে সংগঠিত হতে পেরেছে, তারা শীতল যুদ্ধের পর থেকে কমিউনিস্ট সর্বগ্রাসীবাদের বিরুদ্ধে প্রবল হয়ে লড়াই করছে। সকলেই বিভিন্ন দেবতাদের নামে কাজ করে, কেউ ঈশ্বরের নামে, কেউবা আল্লাহ কিংবা যিহোবার নামে।
আর কতকাল আমরা এই সত্যটিকে উপেক্ষা করব যে, সকল সন্ত্রাসীরাই মানব জীবনকে নিদারুণ ঘৃণা করে এবং একে অপরের খাদ্যের যোগান দেয়? এটা কি পরিষ্কার নয় যে, ইসরায়েল এবং হিজবুল্লাহর মধ্যে যুদ্ধে-বেসামরিক, লেবানিজ, ফিলিস্তিনি এবং ইসরায়েলিরাও মারা যাচ্ছে?
এবং এটিও কি পরিষ্কার নয়, আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধ, গাজা ও লেবাননে আগ্রাসন হল ঘৃণার একটি ইনকিউবেটর, যেটি অনবরত উগ্রবাদী উৎপাদন করে যাচ্ছে? প্রাণীকূলের মধ্যে আমরাই একমাত্র প্রজাতি যারা পারস্পরিক বিনাশে পারদর্শী।
আমরা সামরিক ব্যয়ের জন্য প্রতিদিন ২.৫ বিলিয়ন ডলার উৎসর্গ করি। দুর্দশা ও যুদ্ধ একই পিতার সন্তান। আর কতদিন আমরা মেনে নেব, এই পৃথিবীকে এত ভালোবেসে শুধু মৃত্যুকেই বরণ করে নিতে হবে?