Published : 08 Jun 2017, 11:31 AM
বকুল গাছের নিচ দিয়ে পথ। সবুজ ঘন ঘাসের ভেতর লম্বা হয়ে শুয়ে আছে মেটে রঙের চিকন রেখা। হঠাৎ দেখলে চুলের সিঁথির কথা মনে পড়ে যায়। আব্দুল করিম সিঁথি মাড়িয়ে ফজরের নামাজ পড়তে যাচ্ছে। আবছা আলো আবছা আঁধারের মিশেল চারপাশে। কোথাও মোরগ ডাকছে। আব্দুল করিমের মাথায় পাঁচকুল্লি টুপি। হঠাৎ কী ভেবে সে টুপিটা খোলে। দুই হাতে টুপির দুই প্রান্ত ধরে মুখের সামনে এনে জোরসে ফু দেয়। বাতাস পেয়ে টুপির পেট ফুলে উঠলে সে নতুন উদ্যমে টুপিটা মাথায় বসায়। টুপিটা ঠিকঠাক মাথায় সেট করতে গিয়ে তার ঘাড় উঁচু হয় আর তখন তার চোখ আটকে যায় বকুল গাছের ডালে। হাফপ্যান্টপরা এক ছেলে ঝুলে আছে ডালে।
ছুটিপুরে কয়টা ছেলে হাফপ্যান্ট পরা? পরে অনেকেই। তবে এই মুহূর্তে মনে পড়ে যায় কায়েসের কথা। কারণ, গত সপ্তায় কায়েস একটা ফুলপ্যান্টের জন্য বায়না ধরেছিল বাপের কাছে। বাপ মসলেম উদ্দিন ফুলপ্যান্ট কিনে দিতে পারেনি। কিংবা বলা যায়, কিনে দেয়নি। কারণ হিসেবে অনুমান করা যায় অভাব। কায়েস অবশ্য এইসব অভাব টভাবের ব্যাপারগুলো বোঝে না। বোঝার কথাও না। নিতান্তই সে এক বালক এখন। ছুটিপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাশ ফোরে পড়ে। এতটাই অবোধ সে, হিসি করার পর প্রায় সময় তার প্যান্টের জানালায় খিল তুলতে ভুলে যায়। তার বাবার কোন জমিজিরেত নেই। গ্রামে ধনী আর গরিব বোঝার মাপকাঠি জমি। যার জমি বেশি, সে বেশি ধনী। যার জমি কম, সে কম ধনী। যার কিছু নেই সে গরিব। কায়েসের বাবার যেহেতু জমি নেই তাই সে গরিব। কায়েস গরিব বাবার একমাত্র ছেলে। এরপর আর কোনো ভাইবোন তার হবে কি না জানা নেই। আপাতত মসলেম উদ্দিনের সংসারে কায়েস একাই এক ছেলে।
মসলেম উদ্দিনের যেহেতু জমি নেই, আমাদের কৌতূহল হওয়াটা স্বাভাবিক, তার সংসার চলে কীভাবে! তার সংসার চলে জন বেচে আর গরু পুষে। মনোয়ারাকে বিয়ে করার পর শ্বশুর মশাই তাকে গরু পোষার প্রতি লোভী করে তুলেছিল। বুঝিয়েছিল, অন্যান্য কাজের ফাঁকে এটাই এখন লাভজনক পেশা। প্রথমবার টাকা গুছিয়ে অল্প দামে রোগাশোকা একটা ষাড় কিনতে পারলেই আর ঠ্যাকায় কে! ছয়মাস যত্নআত্তি করে, একটু ভালোমন্দ খাওয়ালেই দাম উঠে যায় দ্বিগুণ। প্রয়োজনে ছালখুদ বাকিতে পাওয়ার দোকান আছে। পরিচিত পশু ডাক্তার আছে কয়েকজন। মোটরসাইকেলের পিছনে কালো ব্যাগ লটকিয়ে সারাদিন তারা ভটভটিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মানুষের চেয়ে নাকি আজকাল গরুর কল বেশি। এজন্য পশু ডাক্তারের সংখ্যাও দিনকে দিন বাড়ছে। তাদের মধ্যে গোপনে, কখনো প্রকাশ্যে প্রতিযোগিতাও আছে মানুষের কাছে ভালো ডাক্তার সাজার। আর এ জন্য বিল বেশি উঠে গেলে তাদের কাছে কিছু টাকা বাকিও রাখা যায়। তারপর গরু বেচে সব ঋণ একবারে শোধ করে দাও। কিছু টাকা সংসারে লাগাও আর বাকি টাকা দিয়ে আবার একটা গরু কেনো ছোট দেখে।
শ্বশুরের পরামর্শ মনে ধরেছিল মসলেমের। প্রথমবার গরু কেনার জন্য টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্যও করেছিল শ্বশুর মশাই। সেই থেকে মসলেম জমিওয়ালাদের জমিতে জন দেয় আর গরু পোষে। গরুর পেছনে তাকে সময় বেশি দিতে হয় না। তার জন্য মনোয়ারাই যথেষ্ট। শুধু গোসলের সময়টায় মসলেমকেও হাত লাগাতে হয় বউয়ের সাথে। কারণ গোসল দেয়াতে গেলে গরুরা একটু বেশি ত্যাড়ামি করে।
কায়েস বুঝতে শেখার পর থেকেই দেখে আসছে, তাদের বাড়িতে সব সময় একটা না একটা গরু থাকেই। এবং এই গরু নিয়ে বাবা-মার ব্যস্ততার শেষ নেই। মনে আছে কায়েসের, বছর চারেক আগের কথা, তখনো সে পায়খানা করে একা একা ছুচতে পারে না। কাজ শেষ হলে সে পায়খানার ভেতর বসে মাকে ডাক দেয়। মা গিয়ে ছুচিয়ে দিয়ে আসে। তারপর সে বেরোয় ছোট ঘর থেকে। একবার কায়েস পায়খানায় ঢুকলে গরু খুলে যায় গোয়াল থেকে। ষাড় গরু। সারাদিন বান্ধা থাকে। মন আনচান করে। যেন জেলের কয়েদি। কোনোভাবে একবার ছাড়া পেলে তাকে আর ঠেকানো যায় না। কায়েসের বাবা তখন বাড়ি নেই। মাঠে। মনোয়ারা একাই গরুর পেছনে ছোটে। চোখের পলকে গরু মণ্ডল পাড়া পার হয়ে মোল্লা পাড়ায় ঢুকে পড়ে। হারু মোল্লার উঠোনে গাই গরু বাঁধা ছিল। মনোয়ারার ষাড় মোল্লার গাই গরুর পিঠে লাফিয়ে ওঠে। ওদিকে কায়েস পায়খানায় বসে মাকে ডাকে ছোচার জন্য। মা নেই। সে অনেক বার চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে শেষে কান্না শুরু করে দেয়। তবু মায়ের সাড়া না পেলে সে গু পাছায় বাইরে বেরিয়ে আসে। বাড়িতে কাউকে না পেয়ে তার কান্না আরো বেড়ে যায়। ন্যাংটা কায়েস কাঁদতে কাঁদতে উঠোনে গড়াগড়ি খায়। তার সারা শরীরে লেগে যায় ধুলোর আস্তর। প্রায় বিশ মিনিটের প্রচেষ্টায় রাস্তার দুটো লোকের সহযোগিতায় গরু নিয়ে বাড়ি ফেরে মনোয়ারা। এমনিতেই তার মাথা গরম ছিল। গু আর মাটিতে মাখামাখি ছেলের কাণ্ড দেখে তার গরম মাথায় যেন আগুন জ্বলে ওঠে। গরুটা বেঁধে সে ছুটে যায় কায়েসের কাছে। গড়াগড়ি খাওয়া ছেলের পিঠে ধুপধাপ চারপাঁচটা কিল মারে। তারপর টানতে টানতে নিয়ে যায় কলপাড়ে। ছেলেকে পাকসাফ করে প্যান্ট পরিয়ে বারান্দার খুটির সাথে হেলান দিয়ে মনোয়ারা আয়োজন করে কাঁদতে বসে। এই সংসারে এসে শুধু খেটেই গেল সে। এক ফোঁটা সুখ পেল না। না পেল স্বামীর সোহাগ, না পেল ভাত। শুধু কি তাই, সমাজের মানুষের সামনে গরু তাকে আজ চূড়ান্ত অপমান করেছে। সে মেয়ে মানুষ। গরুর পিছনে ছুটতে গিয়ে তার কাপড় ঠিক থাকে না। শুধু এটুকু হলেও কথা থাকে না। কিন্তু গরুটা আজ মোল্লার গাই গরুর পিঠে চড়ে বসেছিল। মানুষ খুব খারাপ। বিপদের কালে তারা কাছে আসে না। দূর থেকে দেখে, হাসে আর মজা নেয়। সেদিন বিকেলে মসলেম বাড়ি আসলে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। এক পক্ষে মা আরেক পক্ষে বাবা। তুমুল ঝগড়া চলে। ঘরের এক কোণায় জড়সড় কায়েস ভয়ে কচ্ছপের মতো ঘাড় লুকিয়ে থাকে।
সংসারের হৈহাঙ্গামা আর ঝগড়াঝাটির ভেতর বড় হচ্ছে কায়েস। সে বড় হচ্ছে আর তার মনে হচ্ছে বাবা-মার কাছে তার দাম নেই। অন্তত গরুর যতটুকু দাম আছে ততটুকু দাম বাবা-মার কাছে তার নেই। ইদানীং তার পেট বড় হয়েছে। সব সময় খাই খাই করে পেট। গ্রামের রাস্তায় মাইক বাজিয়ে খাওয়ার কত রকম মজার মজার জিনিস বিক্রি করে লোকেরা। জলপাই আচার, মদন কটকটি, করিমন ভাজা, নসিমন ভাজা। মাইকের শব্দ কানে পড়লেই তার পেটের ভেতর খলবলিয়ে ওঠে খিদে। কখনো মায়ের কাছে, কখনো বাবার কাছে ছুটে যায়। টাকা চায়। তারা টাকা দেয় না। বাবা-মার একই কথাÑ টাকা নি। অথচ সেদিনই যদি গরুটা বিচালি খাওয়া কমিয়ে দেয়, বাবার কপালে ভাজ পড়ে চিন্তার। গরু কাবু হয়ে যাবে বলে তখনই ছোটে বাজারে। নতুন করে গমের ছাল আর বিটলবণ কিনে আনে। সেই ছাল আর লবণ বিচালিতে মাখিয়ে চাড়ি ভরে দেয় গরুর সামনে। নতুন স্বাদ পেয়ে গরু তখন গবগবিয়ে খায় আর বাবার ভাজ পড়া কপাল উজ্জ্বল হয়ে ওঠে খুশিতে। কায়েসের খটকা লাগে– টাকাই যদি না থাকবে তবে ছাল বিচালি কেনার টাকা আসে কোথা থেকে!
পায়ে পায়ে কায়েস বড় হতে থাকে। শীত ফুরিয়ে গরম আসলে ছুটিপুরে মশার উৎপাত বেড়ে যায়। পড়তে বসলে মশা, ঘুমাতে গেলে মশা, পায়খানায় গেলেও মশা। কায়েসদের মশারি নেই। মশার উৎপাতে রাতে তার ঘুম হয় না। সে বাবাকে কয়েল কিনতে বলে। তাদের ক্লাশের পল্টু কয়েল জ্বালিয়ে পড়াশোনা করে। সে যখন ঘুমায়, পায়ের কাছে জ্বলে কয়েল। পল্টুর কাছ থেকে সে কয়েলের গল্প শুনেছে। বাবা ধমক মারে কায়েসকেÑ কী আমার জমিদারের ছাওয়াল! কয়েল লাগবি তার! প্যাটে ভাত নি। পাছায় কয়েল ধরাবি! বাবার ধমক খেয়ে কায়েস বালিশে মুখ ডুবিয়ে কাঁদে। অভিমানে ফুলে ফুলে ওঠে বুক। তার অভিমান আরো বেড়ে যায় পরদিন। সে দেখে বাবা বাজার থেকে ধূপের গুড়ো কিনে এনেছে। সন্ধ্যা নামতেই বাবা গরুর গোয়ালে ধূপ দেয়া শুরু করে। যেন ধোঁয়ার অত্যাচারে মশারা গোয়াল ছেড়ে পালায় আর গরু ভালো থাকে।
কোরবানির ঈদ এগিয়ে আসলে গরু নিয়ে বাবা-মার তৎপরতা আরো বেড়ে যায়। ঈদের আগ দিয়ে গরু বেচে দিতে হবে। এর আগে গরুকে যতোবেশি মোটাতাজা করা যাবে ততবেশি লাভ। এরই মধ্যে অনেক দালাল বাড়িতে আসা যাওয়া শুরু করেছে। তারা গরুর পিঠে অথবা পাছায় চওড়া হাতের থাপ্পড় বসিয়ে বিভিন্ন দামের টোপ ফেলছে। মসলেম অতো পাগল নয়। বাড়ির উপর সে গরু বেচবে না। হাটে নিয়ে দাম যাচাই বাছাইয়ের পরেই বিক্রির প্রশ্ন।
কোরবানির দিন ঘনিয়ে আসলে কায়েসদের চুলায় একবেলার রান্না বন্ধ হয়ে যায়। সেই খরচটা ঢালা হয় গরুর খাবারে। পরিমিত খাবার না পেয়ে কায়েস রোগাটে হয় আর গরু হয় মোটাতাজা। এরমাঝে হঠাৎ একদিন গরুর পাতলা পায়খানা শুরু হলে বাবার দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। গরু খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দেয়। বাবা তখনই ছোটে লাভলু ডাক্তারের কাছে। কোরবানি সামনে। ডাক্তাররা ভয়ানক ব্যস্ত। অনেক ডাক্তার গরুর ব্যাপারীদের সাথে চলে গেছে ঢাকার গাবতলীর হাটে। কেউ আবার চিটাগং বা সিলেটে। বেশি টাকার টোপ দিয়ে লাভলু ডাক্তারকে বাড়িতে আনতে পারে বাবা। ব্যাপার তেমন কিছু না, খাবার বেশি খাওয়ানোতে বদহজম হয়ে পাতলা পায়খানা করছে গরু। ডাক্তার গরুর পেছনের রানে একটা সুই ফুটিয়ে আর দুই কথার পরামর্শ দিয়ে একগাদা পয়সা নিয়ে চলে যায়। পরদিনই সুস্থ হয়ে ওঠে গরু। কিন্তু অসুস্থ হয় কায়েস। বৃষ্টিতে ভিজে তার জর আসে দেহ কাঁপিয়ে। ঘরের কোণায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে পড়ে থাকে সে। মাথায় পানি ঢালে মা। বাবাকে ডাক্তার ডাকতে বলে। কিন্তু পয়সার অভাবে ডাক্তার আসে না বাড়িতে। কায়েসের মুখ তিতা হয়ে থাকে সব সময়। খাওয়ার রুচি নেই। ভাত গিলতে পারে না। তার পাউরুটি খেতে ইচ্ছে করে। ইসুব গুলের ভূসি দিয়ে মিসরির শরবত খেতে ইচ্ছা করে। আর ইচ্ছা করে টক টক আঙুর খেতে। মা সান্ত¦না দেয়। গরুটা বিক্রি হলেই ডাক্তারকে খবর দেয়া হবে। মিসরি আর পাউরুটিও কিনে আনা হবে। সঙ্গে এক থোকা আঙ্গুর। স্বপ্নের সেই দিনের জন্য কায়েসকে অপেক্ষা করতে হয় না। গরু বেচার আগেই এক সকালে সে জর সেরে ঝরঝরিয়ে ওঠে। তবে শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও মনের উপর একটা দাগ নিয়ে সে বিছানা ছাড়ে। তার কেবলই মনে হতে থাকে, এই সংসারে সে গরুরও অধম।
গরু হাটে নেয়ার দিন ছোটখাটো শোক নেমে আসে বাড়িতে। সকাল থেকেই মায়ের মুখ থমথমে। বাবা পুরুষ মানুষ। তার থমথমানি প্রকাশ না পেলেও বুকের ভেতর গোপন ভাঙন আঁচ করা যায়। একটা বছর গরুটা তার কাছে ছিল। এক বছরে তার সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা– সবকিছুতে ভাগ বসিয়েছে গরু। মায়া পড়ে যাওয়া খুব স্বাভাবিক।
সকালে খাওয়া দাওয়ার পর বাবা-মা দুজন মিলে গোসল করায় গরুকে। দুই হাত মাথায় লটকে বাঁ পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গরুর গোসল দেখে কায়েস। মাঝে মাঝে বাবা-মার এক আধখানা হুকুম শোনে। গরু আজ চলে যাবে অথচ একটুও তার খারাপ লাগছে না ভেবে সে অবাক হয়। তার মনে হয় গরুটা চলে গেলে আপদ বিদায় হয়। গরু তার জন্য আপদ ছাড়া আর কিছু নয়। গরুর জন্য সে বাবা-মার ভালোবাসা পুরোপুরি পায়নি এতোদিন। মনে মনে সে গরুকে হিংসা করতে শুরু করে।
সূর্য মাথার উপর উঠলে বাবা দড়ি ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে যায় গরুকে। বালিয়াপাড়া কোরবানির হাট সকাল সকাল শুরু হয়। দেরি করলে হাটের ভালো জায়গাটা পাওয়া যাবে না। বাবা তাই ব্যস্ত ব্যস্ত বিদায় নেয়। ওদিকে লুকানো মায়া আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না মা। ভাতের বলক ওঠার মতো ভেতর থেকে উপচে উঠতে থাকে মমতা। আঁচলে মুখ চেপে সে দেউড়ির মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখে টলমল করে জল। গরুও বুঝি টের পায়। সে বারবার মাথা ঘুরিয়ে বাড়ির দেউড়ি দেখে। হাম্বা হাম্বা ডাক ছাড়ে। এবার আর মা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না । স্বশব্দে কাঁদতে কাঁদতে সে ছিটকে আসে দেউড়ি থেকে। ঘরে ঢুকে বিছানায় শোয়। ওদিকে কায়েস বাবার সাথে হাটে যাওয়ার বায়না ধরে। বাবার সাথে হাটে গেলে জিলিপি বাতাসা পাওয়া যায়। সাপ খেলা, বাঁদর খেলা দেখা যায়। কিন্তু ঈদের আগে গরুর হাট খুবই ভয়ঙ্কর জায়গা। এমন হট্টগোল- বড় মানুষই সেখানে টিকতে পারে না। কায়েসের মতো ছোটদের সেখানে সঙ্গে রাখাটা তাই খুবই ঝামেলার এবং ঝুঁকিপূর্ণ। কায়েস মন খারাপ ফিরে আসে মায়ের কাছে। মা তখনো শুয়ে। কায়েস মায়ের মাথার কাছে নিঃশব্দে বসে। মায়ের চোখে পানি দেখে সে অবাক হয়ে যায়। অতোবড় মানুষ মা, একটা গরুর জন্য কাঁদতে পারে তার বিশ্বাস হয় না। তাছাড়া গরুর কারণে বাড়িতে ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকত। বাবা কিছুই দেখত না বলা চলে। সংসারের সব কাজ সেরে গরু সামলাতো মা। গরুর জন্য সংসারে টানাটানি চলত। মস্তবড় গরু, তার তিনবেলা ঘাসপানি জুটানো কি চাট্টিখানি কথা! সে গেছে ভালো হয়েছে। তবু মা কেন কাঁদে!
কায়েস উঠতে গেলে মা হাত চেপে ধরে। খড়ের মতো তার খাড়া খাড়া চুলে স্নেহের আঙুল ঢুকিয়ে বলে, মন খারাপ করিসনে। হাটে আইজ ম্যালা গরু উঠবি। গরু সামলাতি যায়েই তোর আব্বার হয়রান হয়ে যাতি হবি। ওর ভিতর তুই থাকলি তার হয়রানি আরো বাড়ে যাবে। বাড়ি খেলা কর, দেখিস, গরু বেচে আব্বা তোর জন্নি জিলাপি কিনে আনবিনি। তখুন মজা করে খাইস।
মায়ের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে না কায়েস। কারণ, এই বাড়িতে জিলিপি বাতাসা আসার ঘটনা সচরাচর ঘটে না। আর তাই, তার দুই চোখে বিশ্বাস অবিশ্বাসের আলোছায়া– সত্যি কচ্ছ মা?
হ, সত্যি। তুই এখুন খেলা কর গা।
কায়েস খেলতে চলে যায়। সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসে বাবা। মা মিথ্যা বলেনি। গরু বেচে বাবা জিলিপি আর কদমা কিনে এনেছে। আনন্দে বাবার কোমর পেঁচিয়ে ধরে কায়েস। কী মজা কী মজা বলে কতক্ষণ বাবার পেটের সাথে মুখ ঘঁষে। জিলিপি আর কদমা খেতে খেতে সে অবাক হয়ে দেখে, বাবার হাতে দুই বান্ডেল টাকা। বাবা আর মা চোকিতে মুখোমুখি বসে হেরিকেনের আলোয় টাকা গুণছে। দুজনের মুখেই ঝলমলে আনন্দ। কায়েস দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে এই সুন্দর ছবিটা দেখে। দেখে আর ভাবে, এই টাকাগুলো যদি তাদের হয়, তবে আর ভাত খাওয়ার অভাব থাকবে না তাদের। অসুখ করলে ডাক্তার আসবে। পাউরুটি আঙ্গুর আর মিসরির শরবত গুলিয়ে দেবে মা। মশা তাড়াতে পায়ের কাছে জ্বলবে কয়েল। পল্টুদের মতো সুন্দর জামাকাপড়ে সাজবে তার শরীর। কিন্তু কায়েসের আশা পূরণ হয় না। কারণ, দুই বান্ডেল টাকা তিনভাগে ভাগ করে বাবা। বড় ভাগটা তুলে রাখে ঈদের পর নতুন আরেকটা গরু কেনার জন্য। মাঝারি ভাগ চলে যায় ছালখুদ, চাল আর মুদি দোকানে, দেনা শোধ করতে। সবচে ছোট ভাগটা থেকে যায় বাড়িতে, সংসারে। সেই ছোট ভাগের টাকায় সাদামাটা ঈদ পার হলে বাড়িতে নতুন গরু আসে। আবার শুরু হয় গেল বছরের জীবন, যা তারা আগেই যাপন করে এসেছে।
বর্ষাকাল আসে। কায়েসের পড়ার টেবিলের জানলাটা ভাঙা। বৃষ্টি এলে ছাট লেগে বই ভিজে যায়। তাদের ঘর মাটির গাঁথুনির উপর পুরনো টিনের চালে ছাওয়া। চালের অনেক জায়গা ফুটো। বৃষ্টি এলে পানি পড়ে। কায়েস চাল সারাতে বলে বাবাকে। বাবা হ্যাঁ না কিছু বলে না। বাবার উপর তার বিরক্ত লাগে। এক দুপুরে সে দেখে, বাবা দুই ভ্যান ইট কিনে এনেছে। এবার খুশিতে তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পল্টুদের মতো তাদের বাড়িও পাকা হয়ে যাবে ভেবে সে মাটির বারান্দায় বানরের মতো লাফাতে থাকে। বাবার মনে মনে তাহলে এই ছিল! বলেনি তো আগে! সে চিৎকার করে ছুটে যায় ভ্যানের কাছে। হেইয়ো হেইয়ো বলে ভ্যান ঠেলতে লাগে। যেন তাড়াতাড়ি ভ্যান তাদের উঠোনে ঢুকতে পারে আর জলদি জলদি তাদের মাটির ঘর পাকা হয়ে যায়। ইট রেখে ভ্যান চলে গেলে সে খুশিতে বাবার হাত ধরে ঝাঁকা মারে। বলে, আব্বা, আমারে ঘর পাকা হবি আগে কওনি ক্যাঁ! পল্টুরে ঘর পাকা বলে কত ভাব মারে! কাইল স্কুলি যায়ে ওর ভাব ছুটা দেব। কায়েসের খুশি বাবাকে একটুও স্পর্শ করে না। আশ্চর্য শীতল চোখে বাবা কায়েসের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই শীতলতার রহস্য উন্মোচিত হয় পরদিন সকালে। যখন বাবা আর মা দুজনে মিলে গরুর গোয়ালের মেঝেতে ইট বিছাতে লাগে। কায়েস তখন স্কুলে। পল্টুর পাকাঘরের ভাব ছুটিয়ে দিয়ে ফিরে এসে সে দেখে, তাদের নয়, গরুর ঘর পাকা হয়ে গেছে। কায়েস, আমাদের কায়েস দেউড়ির মুখে বাজ পড়া তালগাছের মতো স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকে কতক্ষণ। দুচোখ তার ভেসে যায় অবাধ্য জলে। লজ্জা আর অপমানে এরপর সাতদিন সে আর স্কুলমুখী হয় না। বাড়ি থেকে স্কুলের নাম নিয়ে বেরোয়। মকবুলের চায়ের দোকানে এককোণে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। টিভিতে বাংলা ছবি দেখে। ছুটির ঘণ্টা বাজলে ফিরে আসে বাড়ি।
বৃহস্পতিবার ভোরে গোয়াল পরিষ্কার করতে গিয়ে মা দেখে, সাটাপাট পড়ে আছে গরু। মুখভর্তি ফেনা। নিথর। মা 'ও আল্লারে আমার কী হল রে' চিৎকার দিয়েই অজ্ঞান। বাবা তখনো শুয়ে। কায়েস ঘুম। মায়ের চিৎকারে বিপদের এমন সংকেত ছিল, বাবা ধড়মড় করে লাফিয়ে ওঠে বিছানা ছেড়ে। লুঙ্গিতে গিট্টু মারতে মারতে ছুটে যায় বাইরে। গোয়ালে ঢুকে বাবাও হয়ে যায় মায়ের মতো। 'কিডা কোনে আছিস রে, আমি শ্যাষ' বলে গোয়ালের খুটি ধরে ধপাস করে বসে পড়ে বাবা। ধীরে ধীরে পাড়া পড়শিরা জেগে ওঠে। জেগে ওঠে প্রকৃতি। লোকজন কায়েসদের বাড়িতে জড়ো হয়। তারা গরুর শরীর পর্যবেক্ষণ করে বোঝে, গরুকে সাপে কেটেছে। পেছনের বাম পায়ে দুই দাঁতের ছোট্ট ক্ষত। তখন কবে কার কোন আত্মীয়র গরু সাপে কেটেছিল, তার গল্প চলে ধুমছে। মহিলারা ধরাধরি করে বারান্দায় নিয়ে যায় মনোয়ারাকে। মাথায় পানি ঢালে। পুরুষেরা সান্ত্বনা দেয় মসলেমকে– সবই আল্লার ইচ্ছা।
কায়েস ঘুম থেকে উঠে দেখে বাড়িভর্তি মানুষ, বাবার হাহুতাশ, মায়ের বিলাপ। বাড়িতে সে কখনো মৃত্যু দেখেনি। সে দাদা-দাদিকে পায়নি। জন্মের আগেই তারা মারা গেছে। তবে গ্রামের বিভিন্ন মরা বাড়িতে তার যাওয়া আসা আছে। এখন বাড়ির যা পরিবেশ, তার মনে হচ্ছে কেউ একজন মারা গেছে। কে মরল!
ঘুম থেকে উঠেই তার খুব খিদে লেগে যায়। আজও লেগেছে। কিন্তু এই কান্নাকাটির ভেতর তাকে ভাত দেবে কে!
বেলা বেড়ে গেলে গরুর সৎকারের কাজে হাত দেয় প্রতিবেশিরা। কলপাড়ের পেছনে বড় গর্ত খুড়ে পুঁতে দেয়া হয় গরু। শুরু থেকে সবকিছু খুব আগ্রহ নিয়ে দেখে কায়েস। গরুটার জন্য তার নিজেরও মন খারাপ হয়। সৎকার শেষে আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে আসে বাড়ি। সকালকে সরিয়ে দিয়ে দুপুর চলে আসে ছুটিপুরে। তবু মায়ের কান্না থামে না। ইনিয়ে বিনিয়ে সে কেঁদে চলে। গতকাল গরুর সাথে কী কী ঘটনা তার ঘটেছে, সেসব উচ্চারণ করে আর কাঁদে। গতকাল দুপুরে হামু দিয়ে চাড়িতে বিচালি মাখাচ্ছিল মা। তার আঁচল খসে পড়েছিল মাটিতে। সেই আঁচলখানি পাড়া দিয়ে ধরেছিল গরু। কাদা করে দিয়েছিল আঁচল। সেই স্মৃতি মনে পড়ে মায়ের বিলাপ আরো বেড়ে যায়। বিলাপের মধ্যে সেই স্মৃতি ছবি হয়ে ভেসে ওঠে শ্রোতাদের চোখে আইজ আমার আঁচল পাড়া মারে কাদা করে দিবি কিডা রে…. আল্লাহ আল্লাহ!
খিদেয় পেটের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে কায়েসের। কিন্তু মায়ের কাছে ভাত চাওয়ার সাহস হচ্ছে না। আসলে সাহস না, ভাত চাওয়ার পরিবেশই নেই এখন। মা কেঁদে জারেজার। এই সময় কি ভাতের কথা বলা যায়!
দুপুরে নিগবারের বউ একবাটি ডাল আর এক থাল ভাত দিয়ে গেলে কায়েস ঘরের মধ্যে লুকিয়ে সবটুকু ভাত পেটে দিয়ে বেশ আরাম বোধ করে। শরীর ঝরঝরা হয়ে উঠলে বাড়ির এই মরা মরা পরিবেশ তার আর ভালো লাগে না। সে বেরিয়ে পড়ে। মকবুলের চায়ের দোকানে না গিয়ে সে খালাপাড়ে যায়। থমথমে মুখে বিকেল পর্যন্ত বসে থাকে। পাখি দেখে। ফড়িং দেখে। দুর্বাঘাস ছিড়ে ছিড়ে দাঁতের নিচে দিয়ে চাবায়। বিকেলে সে ফিরে আসে বাড়ি। দেখে, বিকেলের নরোম আলো ছড়িয়ে আছে উঠোনে। কিন্তু সেই আলো বাড়ির পরিবেশে কোন পরিবর্তন আনেনি। বাবা চৌকাঠে বসে আছে মূর্তির মতো। মা চোকিতে শোয়া। চোখের জল শুকিয়ে চোয়াল তার চটচট করছে। একটু পরপর ডুকরে ডুকরে উঠছে। কায়েসের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মরেছে একটা গরু, মানুষ তো আর না, তার জন্য এতো ন্যাকামির কী আছে! ধুত বলে সে আবার বেরিয়ে পড়ে। বিকেলটা টইটই করে ঘুরে রাতের পেটে সন্ধ্যা ঢুকে যাওয়ার পরেই সে চুপচাপ বাড়ি ফেরে। এর আগে সে কোনোদিন রাত করে বাড়ি ফেরেনি। কিন্তু আজ ভয় কিংবা অনুশোচনা অথবা খারাপ লাগা কিছুই তার হয় না। হাতমুখ না ধুয়েই সোজা সে বিছানায় যায়। বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। রাতেও চুলা জ্বলেনি বাড়িতে। মা আগের মতোই শোয়া। বাবা পিশাব করে এসে নিঃশব্দে শুয়ে পড়ে। অল্পক্ষণে তার নাকের গর্জন ঘরকে মুঠোবন্দী করে নেয়। বাবার পাশে ঘুমানোর চেষ্টা করে কায়েস। কিন্তু খিদে তার সর্বশক্তি নিয়ে কায়েসকে জাপটে ধরেছে। ঘুম আসে না তার। রাগ এবং অভিমান তার বুকের ভেতর দলা পাকিয়ে থাকে। মা-বাবা আজ তার কোনোই খবর নেয়নি। সে খায়নি, গোসল করেনি। রাত করে বাড়ি ফিরেছে। অথচ বাবা-মার কোন বিকার নেই। তার মনে হয়, এই সংসারে গরু যতটা দরকারি এবং আপন, সে ততটা নয়। যদি হতো, মা অবশ্যই তার জন্য ভাত রাঁধত। গরুর শোক ভুলে ছেলেকে কাছে টানত। হঠাৎ নিজেকে গরুর প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয় কায়েসের। আর তখন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গরুর কাছে হেরে যাওয়ার বিভিন্ন স্মৃতি একে একে ভেসে ওঠে জীবন্ত ছবি হয়ে। সেই ছবিগুলো ঘুরেফিরে বারবার অকাট্য প্রমাণ রেখে যায়Ñ এই সংসারে গরুই বেশি দামি। কায়েস নয়। কায়েসের হঠাৎ মনে হয়, গরুর মৃত্যুতে বাবা-মার যে শোক এবং কান্না, সে যদি কোনোদিন মারা যায়, বাবা-মা কি অমন করে কাঁদবে, কায়েসের জন্যে! সম্ভবত না। ভাবনার এই জায়গায় এসে অভিমানে তার পাতলা বুক ফুলে ফুলে ওঠে। ডুকরে উঠে বালিশের কোণা আকড়ে ধরে। চোখের জলে ভিজে যায় গাল। তবু সে একটুও নড়ে না চড়ে না। ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে বাবা-মার পাশে। রাত গভীর হলে ক্লান্ত মা-ও ঘুমিয়ে পড়ে নিসাড়, বাবার মতো। কিন্তু ঘুম আসে না কায়েসের। তার খুব কৌতূহল হয়। বাবা-মা কি আসলেই তাকে ভালোবাসে! হঠাৎ মেঘের মতো অচেনা এক ঘোর তাকে আচ্ছন্ন করে। চোখ মুছতে মুছতে নিঃশব্দ পায়ে বাবা-মাকে ডিঙিয়ে সে চোকি থেকে নামে। যন্ত্রের মতো হেঁটে যায় গোয়ালে। চাঁদনি রাত, সঙ্গে হেঁটে যায় তার ছায়া। কায়েস ছায়ার মাথার উপর একটা লাথি দিতে গেলে দ্রুত সরে যায় মাথা। বিরক্ত কায়েস গোয়ালে ঢোকে। মৃত গরুর দড়িটা খুটির সাথে ঝুলছে তখনও। দড়িটা খুলে নিয়ে সে চলে আসে বাইরে। বাড়ি থেকে একটু দূরে বকুল তলায় গিয়ে দাঁড়ায়। দীর্ঘ সময় সে দাঁড়িয়ে থাকে বকুল তলায়। রাতের ঠান্ডা বাতাস মিষ্টি গন্ধ ছড়ায়। একবার সে বকুলের ডাল আর একবার মাটির দিকে তাকায়। হঠাৎ তার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। গলায় ফাঁস নেয়ার কায়দাকানুন সে সিনেমায় দেখেছে। সিনেমার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে খুব সহজে সে বকুলের ডালে ঝুলে পড়ে।