চোখভর্তি অশ্রু টলমল করে, অথচ কেউ কাঁদে না
Published : 30 Jun 2024, 09:03 PM
যখন সময় থেমে যায়, ঘন অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ে, সুনসান নীরবতায় ভরে যায় চারপাশ, বোটা থেকে পাতা খসে গেলেও শব্দ শোনা যায়, নিঃশব্দে প্রাণিরা ঘুমিয়ে পড়ে, নিশাচর পাখিরা ডাকাডাকি ভুলে যায়, খোলস পাল্টাতে বেড়িয়ে পড়ে সাপ, পুরান থেকে উঠে আসে এক কালো জাদুকর, মুখ ঢাকা কালো কাপড়ে, তুড়ি মেরে জাগিয়ে দেয় মৃত মানুষের ঘুম, জীবন্ত মানুষ সব নাই হয়ে যায়, মৃতেরা হেঁটে চলে দলে দলে, এ কালো জাদু কুফরি কালাম, পাপীর কপালে ফোটে তৃতীয় নয়ন, ঈশ্বরে বিশ্বাস নাই যার— আস্থা রাখে সে, ধর্ম পালিয়ে যায়— উচ্চকিত হয় নাফরমান;
যখন খরায় মাঠের ফসল পুড়ে যায়, পুকুরে মরা মাছ ভেসে ওঠে, গাছের পাতা কালো হয়ে যায়, রস শুকিয়ে কচি ধান চিটা হয়ে যায়, সরিষা ফুলের মাঠ বিবর্ণ হয়ে যায়, গমের মাঠে ছড়িয়ে পড়ে সর্বনাশা রোগ, গাভির ওলানে দুধ আসে না, মাঠ থেকে পাকা ধান কেটে নিয়ে যায় বর্গিরা, বাগানে ফুল ফোটে না, বাহারি ফুলেতে মধু থাকে না, পাখিরা খাবার না পেয়ে পরিযায়ী হয়, নদীর পানি শুকিয়ে তলা দেখা যায়, প্রাণিকূলে মড়ক লাগে, প্রজাপতির দল ওড়াউড়ি ভুলে যায়, কালো মেঘে ঢেকে যায় আকাশ, লোকালয়ে ঘন ঘন বাজ পড়ে, তবু এক ফোটা বৃষ্টি পড়ে না;
যখন বছর বছর বন্যা হয়, ফসলের মাঠে হানা দেয় পতঙ্গপাল, মাছের বদলে পানিতে জোঁক কিলবিল করে, মঙ্গলগ্রহে আবিষ্কৃত হয় নতুন অণু, গ্রামের মানুষ অহেতুক ঝগড়া করে, আকাশে ওঠার সিঁড়ি হয়ে যায় বজ্র, ভয়ে মানুষের মুখ কেমন নীল হয়ে যায়, পশু হত্যার পর ভোজন উৎসবে খুব বেশি আমোদ হয়, পুরনো হিংসার কথা মনে পড়ে যায়, ভুলে যাওয়া আঘাতের স্থানে নতুন করে শুরু হয় ব্যথা, দেবী সরস্বতীকে বড় বেশি মুখরা মনে হয়, হাজার হাতের এক নারী স্বপ্নে আসে, পুরুষ কোয়ালা মৈথুনের খোঁজে খুব বেশি ব্যাকুল হয়ে ওঠে, তখন এক নাগিনী সম্মোহনের বিন বাজায়;
যখন গাছ থেকে বাকল খসে পড়ে, ধনুক থেকে বিযুক্ত হয় তির, সিংহের থাবা থেকে বেরিয়ে যায় হরিণ, সমুদ্র থেকে ধেয়ে আসে নতুন ঘূর্ণিঝড়, চোখের পলকে উড়ে যায় গ্রাম, মানুষ উড়ে উড়ে দূরে চলে যায়, সেই প্রচণ্ড শক্তির আরাধনা করি, হে দেবি— কুণ্ডলিনী— বায়ু বর্জ্র বৃষ্টি জলোচ্ছ্বাসের সখা, এসো এই মিথ্যার বেসাতি শহরে, চোখ ধাঁধানো আলো অট্টালিকার মূলোৎপাটন করো, মিথ্যা আর পাপে ভরা জনপদ ডুবে যাক, জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাক জুলুমের বাগান, ধ্বংসময়ীর হাতে চলে যাক সর্বক্ষমতা;
যখন লুসিফারের হাতে নরকের রাজত্ব চলে যায়, ভোরের জ্যোতিষ্ক দানব চোখ পেয়ে যায়, পৃথিবীতে এক দীর্ঘ দুঃশাসন শুরু হয়, নতুন করে শুরু হয় যুদ্ধ, গ্রিসের অ্যাম্ফিথিয়েটারের ওপর বোমা পড়ে, অ্যামাজন জঙ্গলে সহস্র গাছ কাটা পড়ে, মাথার ওপর কেবল যুদ্ধ বিমান ওড়ে, উজ্জ্বল দিন ঢেকে যায় কুয়াশায়, তরঙ্গমালা ঢেউ থেকে জলোচ্ছ্বাসে রূপ নেয়, একের পর এক উল্কাপিণ্ড আঘাত হানে পৃথিবীতে, আকাশে নতুন কোনো আলো দেখলে ভয়ে জড়সড় হয় মানুষ, যে আলো চিরকাল ছিল আশির্বাদ তাই হয়ে যায় বিপদের বার্তাবাহক, ছোটো আপদ থেকে মানুষ ক্রমে বড় বিপদে পড়ে যায়, অন্ধরা বসে থাকে রাজসিংহাসনে;
যখন ইঁদুরের রাজত্ব শুরু হয়, মেঘে মেঘে সংঘর্ষ বাঁধে, বৃষ্টি হয়না সূর্যও দেখা যায় না, মন বিষন্ন হয়ে যায়, ভয়ে সবাই তটস্থ থাকে, মাঠের ফসল খেয়ে সাবাড়, ঘরে গচ্ছিত সম্পত্তি দাঁতের ধার বাড়িয়ে তোলে, প্লেগ হানা দেয় জনপদে, ভাঙবে না ভাঙবে না বলেও ভেঙে যায় সবচেয়ে শক্তিশালী দেয়াল, দিনদুপুরে মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে, হাত ফসকে পড়ে যায় গ্লাসভর্তি পানি, কর্পুরের গন্ধ নাকে লাগে, আগরবাতির ধোঁয়া দেখা যায়, চোখভর্তি অশ্রু টলমল করে, অথচ কেউ কাঁদে না;
যখন পৃথিবীর সব মানুষ গোলকধাঁধায় পড়ে যায়, সরল কোনো রেখা হয়তো, বাঁকের পর বাঁক পার হয়ে সন্দেহ হয়, মনের কোণে মিট মিট জ্বলে আশা, একদিন দৈব বলে জটিল রেখাবহুল পথ মসৃণ হয়ে যায় যদি! বজ্রপাতে যদি জাদুকরের হাতের লাঠি ভেঙে যায়! ঈশ্বর যদি শয়তানের প্রভুত্ব মেনে নেন! মানুষ যদি আবার মায়ের জঠরে ঢুকে যায়! জীবনের বড় বড় ভুলগুলো এড়ানো যায় যদি! মধ্য রাতে শেষ জ্যোতিষ্কটিও নিভে যায়, সবাই জেনে যায়— জীবন, সময় ও স্থান অতীতের এক প্রহেলিকা ছাড়া আর কিচ্ছু নয়;
যখন দিনদুপুরে সূর্যগ্রহণ হয়, অন্ধকার নেমে আসে, সান্ধ্যকালীন আবহ তৈরি হয়, পাখিরা ঘরে ফেরে, প্রবল বাতাস ওঠে— প্রচুর বৃষ্টি হয়, হাড় ভাঙা রোগীরা ব্যথায় কাতরায়, নারীদের তলপেটে চিনচিনে ব্যথা হয়, হরিণ পাল নদী তীরে পানি খেতে আসে, মাথার ওপর শকুন ওড়ে, কাকেরা কা কা করে, বানরের দল খুনসুটিতে মেতে থাকে, একটা বাঘ ওৎ পেতে থাকে, শিকারের সম্ভাবনায় এক ঠ্যাং তুলে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা বক যেন, সময়ের পেটে অন্ধকার ঢুকে যায়, শাহানা রাগের ধ্রুপদী বাজে কোনো নবীন শিল্পীর ঘরে, মধ্যদুপুর কেউ ভাবে না;
যখন পূর্ণিমা রাতে চন্দ্রগ্রহণ লাগে, প্রাচীন গুহায় লুকানো জাদুর বাক্সগুলো খুলে যায়, মানুষের ভবিষ্যৎ বলে দেওয়া ৭২টি তাস আসর বসায়, রাশিফল নির্ণয়ে বসে যায় জ্যোতিষীরা, রাতারাতি ভাগ্য পাল্টে ফেলে কেউ, শনির বলয় বার বার হাতের রেখায় বিপদের পূর্বাভাস দিয়ে যায়, অত্যাচারী রাজার হাতে যে আংটি তাই তার ক্ষমতাকবচ, চিরকাল রাজপ্রাসাদ পাহারা দেয় অন্ধ দানবেরা, গির্জায় মধ্য রাতে বিপদের ঘণ্টা বেজে ওঠে, নরবলির মন্ত্র পাঠ করেন নতুন রাজা;
যখন অস্তগামী সূর্যকে তাড়া করে বেওয়ারিশ কুকুরের দল, জাদুকর বসে থাকে অমাবস্যার অপেক্ষায়, রেসের ঘোড়া হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়, উড়োজাহাজের পেছনে ছোটে পাখির দল, বেঁচে থাকার যন্ত্রণা আরো তীব্র হয়, প্রতি পলে পাল্টে যায় মন, মানুষ কি ক্রমে বুদ্ধিহীন প্রাণি হয়ে যাচ্ছে? মাংসাশী হায়েনার দল তৃণভোজী হওয়ার সাধনা করে, ক্ষুধার্ত বাঘের সামনে অহিংসার মন্ত্র পড়ে হরিণ, কেবল কবিতা নয়— মহাসময়ের কাছে সব কিছু মূল্যহীন হয়ে যায়;
যখন ইসরাফিল বাঁশিতে ফু দেন, কালো জাদুতে ছেয়ে যায় জগৎ, প্রকৃতির সব নিয়ম শেষ হয়ে যায়, পাহাড়গুলো মেঘের ন্যায় ওড়ে, মাটির নিচে থাকা সব সম্পদ বেরিয়ে আসে, সমুদ্র ফুলে ফেঁপে স্থলভাগ ডুবিয়ে দেয়, গানের পাখিরা সব চুপ হয়ে যায়, চাঁদ মঙ্গল সূর্যে সংঘর্ষ হয়, মানুষের করুণ পরিণতি দেখে ভয়ে কাঁপেন ঈশ্বর, নতুন রূপে প্রকাশ করেন শয়তান, কেউ স্বর্গে প্রবেশ করতে পারে না, নরকের দরজা সবার জন্য খোলা;
যখন তরুণেরা কালো সঙ্গীতে আবিষ্ট হয়, আটলান্টিকে আরো বরফ জমে, মরুভূমি আরো শুষ্ক হয়ে ওঠে, সন্ন্যাসীর চুলে আরো জট পাকে, বোমা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আত্মঘাতীর দল, প্রেমিকের একহাতে গোলাপ আর অন্যহাতে থাকে ছুরি, নেতারা ভুলে যান জনসেবা, ছোটো মাছ খেয়ে খেয়ে বড় মাছ আরো বড় হয়ে ওঠে, চারপাশে বয়ে যায় অসহিষ্ণু বাতাস, বাউলের একতারার তার ছিঁড়ে যায়, ধুলা জমে জমে সুর তোলা ভুলে যায় হারমোনিয়াম, কালো নেশায় আসক্ত হয় ভবিষ্যৎ, তখন দিনগুলো বন্দি হয় জাদুকরের শতচ্ছিন্ন কালো ঝোলায়;
নিষিদ্ধ কালাম এ— গোনাহের কথা, ভুল উচ্চারণে মুখে ওঠে রক্তফেনা, হাত অবশ হয়ে যায়, মুখ বাঁকা হয়ে যায়, পা হাঁটতে পারে না, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়, নাক বন্ধ হয়ে থাকে, কান শুনতে পায় না, জিহ্বা অবশ হয়ে যায়, শরীরে বিছুটি পাতা ঘষে দেয়, মায়ের বুকের দুধ শুকিয়ে যায়, শিশুরা হাসতে ভুলে যায়, কে যেন বাতাসে ফিস ফিস করে কথা বলে, বাসর রাতে মরার ন্যায় পড়ে থাকে নববধূ, কুমারী মেয়েরা সব পোয়াতি হয়, গর্ভের ভ্রুণ সব মরে যায়, শত শত শকুন ওড়ে আকাশে, হাতে খুলি নিয়ে হেঁটে যায় এক কঙ্কাল;
যখন বন্ধ হয় আসমানি ফরমান, চারপাশে কেবল তুকতাক বাণ মারা হয়, ছেলে-বুড়ো সবার গলায় ঝোলে তাবিজকবজ, সমাজ সম্মোহিত হয়ে থাকে, রাষ্ট্র পিছন দিকে হাঁটে, মানুষ কথা বলে তোতা পাখির ন্যায়, অদৃশ্য শত্রুরা ঘুরে বেড়ায়, বাদুরের দল পথ ভুল করে, অমাবশ্যার জোয়ারে ফুলে ফেপে ওঠে সমুদ্র, বাঁধ ভেঙে হু হু করে পানি ঢোকে, স্রোতে তলিয়ে যায় লোকালয়, গোলা ভরা ধান ভিজে যায়, পুকুর ভরা মাছ ভেসে যায়, মায়ের কোলে শুয়ে ছিল যে সন্তান তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না, শহরে বাড়ে অনাহারী মানুষের মুখ, কারো কারো কপাল খুলে যায়;
যখন মানুষ মনের কথা মুখে আনতে পারে না, পেটে চেপে রাখতে রাখতে সেই কথা একদিন পাখি হয়ে উড়ে যায়, সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা— সতত টলায়মান, কর্তব্য কর্ম স্থির করতে পারে না, ধরতে পারে না প্রিয় হাত, প্রিয়জনের মুখও অচেনা মনে হয়, দুঃখ-কষ্ট বুকে চেপে হাসি ফুটিয়ে রাখে মুখে, হঠাৎ করে গরম বেড়ে যায়, কখনো এমন তীব্র কুয়াশা নামে যা আগে দেখা যায়নি, মানুষের মন কোনো কিছুতে স্বস্তি পায় না, সব সময় ছটফট করে, দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে অচেনা জীবাণু, গণকবরে ভরে যায় সমাধিগুলো, মানুষ কষ্টে থাকে— তবু প্রতিবাদ করা ভুলে যায়;
যখন সন্ন্যাসীরা লোভের বশে গৃহী হয়, কাপালিক অমরত্বের পথ ছেড়ে কুমারিত্বের নেশায় পড়ে, বকধার্মিকে ভরে যায় সমাজ, মানবসেবা ব্যবসার কবলে পড়ে, পঞ্চেন্দ্রীয় বিভ্রান্ত করে মস্তিষ্ককে, যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে মানুষকে, রাজনীতি হয়ে যায় স্বর্গারোহণের সিঁড়ি, ডাকিনী রূপ পাল্টে মায়াবি স্বপ্ন দেখায়, ধূর্ত শেয়ালেরা সিংহ পোষার মন্ত্র জপ করে, যাত্রাপালার বিবেক রঙ্গমঞ্চ ভুলে যায়, বেনীআসহকলা দেখেও নগরবাসীর মন ভালো হয় না, জাতির ভাগ্যাকাশে ভর করে এক স্তব্ধ সময়, জ্যোতিষশাস্ত্রের সব ভবিষ্যৎবাণী ব্যর্থ হয়ে যায়, তখন এই গ্রহ এক কৃষ্ণবিবরের কবলে পড়ে;
যখন চোরাবালিতে আটকে যায় দেশ, অহেতুক ধসে যায় অট্টালিকা, উঁচু উঁচু পাহাড় কাটা পড়ে, হাসপাতালে অচেতন রোগী রেখে পালিয়ে যায় ডাক্তার, দুর্ঘটনায় মারা যায় বহু মানুষ, আত্মঘাতি তরুণেরা নিরুদ্দেশে যাত্রা করে, মানুষের চোখ উপড়ে ফেলার জন্য নতুন আইন তৈরি হয়, আগুন দিয়ে পোড়ানো হয় বন, নদীর পানিতে বিষ ছড়ানো হয়, ছদ্মবেশি ডাকাতকে পুরষ্কৃত করা হয়, মাথা বেচে বেঁচে থাকার ফন্দি আঁটেন বুদ্ধিজীবীরা, বন্যায় কৃষকের পাকা ফসল ডুবে যায়, তখন ডাকিনীর কবলে পড়ে নিরীহ মানুষ;
যখন পশুরা চলে যায় দেবতার কাতারে, কোথাও আলো থাকে না, সম্পর্কগুলো প্রেমহীন হয়ে যায়, রাতগুলো হয়ে যায় প্রবল মৈথুনময়, আঘাত লুকিয়ে রেখে পড়তে হয় সুখি মানুষের মুখোশ, পুরনো শত্রু নতুন করে হানা দেয়, ঘরের মধ্যে এক অদৃশ্য পুতুল সারা রাত নাক ডেকে ঘুমায়, স্বপ্নে সে দৌড়াদৌড়ি হইহল্লা করে, যেন উঁইপোকার দল দখল নিয়েছে পরিত্যক্ত প্রাসাদ, অশিতিপর বৃদ্ধার ন্যায় লাবণ্য হারিয়ে ফেলে, ভোরের আলো ফোটার সময় তানপুরা বেজে চলে, দায়িত্বের করাতকল সারাক্ষণ কাঠ চেরাই করে, সর্বত্র বিরাজ করেও কেউ কোথাও থাকে না, তখন মানুষ চলে যায় অদৃশ্যের খপ্পড়ে;
যখন সময়কে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়, খুনের সাজা মওকুফ করে পুরষ্কৃত করা হয়, নিরীহ জমায়েতে হামলা করে অস্ত্রধারীরা, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সন্তান চুরি হয়ে যায়, বনে বাঘ আর সিংহের লড়াই চলে, সাপের মুখে আটকে পড়া ব্যাঙ সারা রাত ডেকে চলে, শিকারীর গুলিতে জখম হরিণ প্রাণপণে ছুটে চলে গভীর বনের দিকে, বিভারের গর্তে ঢুকে যায় সজারু, মরুভূমির বুকে পথ হারায় এক বেদুইন, তখন নীল আকাশ পাল্টে হয়ে যায় লাল;
যখন দোহাই ঈশ্বর বলে মন্ত্র পাঠ শুরু হয়, ডাকিনির চোখ থেকে ঠিকরে পড়ে আগুন, তাঁর হাতে থাকে কুমারী খুলির তসবি, জটাধারী বুড়ির মুখের বলিরেখা আরো গভীর হয়, খোঁয়ারে বাঁধা ছাগরূপী মানুষের দল, এরা নিয়মিত তিন বেলা আহার করে আর নিদ্রা যায়, বলির জন্য জীবন উৎসর্গ করবে বলে তারা গর্ব প্রকাশ করে, মানুষের চামড়ার চাবুক হাতে পিশাচী অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, সিংহের পোষাক পড়া চাটুকার ভেড়ার দল হেসে ওঠে, মা মনসার দোহাই— আর দোহাই মায়ের জঠরের... মন্ত্র শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ উধাও হয়ে যায়, বজ্রবিদ্যুৎ নেমে আসে জনপদে, প্রাণিকুল ভয়ে ছোটাছুটি করে, তখন মানুষের ভাগ্য চলে যায় অন্য কারো হাতের মুঠোয়;
যখন ডাকিনী তুকতাক করে, অমাবশ্যার রাতে বাণ মারে, পোষা প্রাণির ন্যায় ফিরে আসে কাঙ্ক্ষিত মানুষের কাছে, রাসায়ণিক বিস্ফোরণ ঘটে কারখানায়, মানুষ ভুলে যায় কর্তব্য, খবরের কাগজ ভরে থাকে দুঃসংবাদে, হঠাৎ হু হু করে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়, টাঁকশালে সারাক্ষণ নতুন টাকা ছাপানো হয়, রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে কত শত মানুষ, এই কথা খুব গোপনে চেপে যাওয়া হয়, নীরবে কান পাতলে শোনা যায় একটা ঘুণপোকা সারাক্ষণ কেটে চলে, অসহায় মানুষের পাশে কেউ দাঁড়াতে চায় না, তখন সব মানুষের এক বিকট ছায়া তৈরি হয়;
আর যখন সম্মোহিত মানুষের দল কথা বলে, ভেড়ার পালের ন্যায় অগ্রগামীকে অনুসরণ করে কেবল, প্রথম জন খাদে পড়লে বাকিরাও খাদে পড়ে, এদের মুখ বলির পশুর ন্যায় করুণ দেখায়, যদি তাদের কণ্ঠে নতুন সুর শোনা যায়— সেই গান পোষা পাখির— শিকারের ফাঁদ হয়; অমাবশ্যায় বাদুড়ের হাড় হাতে শ্মশানের দিকে ছুটে যায়, কংকালের খুলিতে জলপান করে, ঘোর অন্ধকারে চারপাশে কেবল ফিসফাস শব্দ শোনা যায়, থেকে থেকে বিকট হাসির রোল ওঠে, শিশুর কণ্ঠ ভেসে আসে, তখন কোনো মানুষ দেখা যায় না— ছায়ারা ঘুরে বেড়ায়;
যখন ঈশ্বর বালিয়াড়িতে আটকা পড়েন, অসংখ্য চোরাবালি জনতাকে টেনে নেয়, পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় একটা গাংচিল ছো মেরে উড়াল দেয়, শিকারী ধনুক তাক করে দাঁড়িয়ে থাকে— একটা ছুটন্ত হরিণ হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়ে যায়, বলির আগে মানবপশুকে নিয়ে উলঙ্গ নৃত্য করে ডাকিনী, বাতাসে চৌরাশিয়ার বাঁশির সুর শোনা যায়, শিমুল তুলার ন্যায় উড়ে যায় জ্যোতিষ্করাজি, জননী পৃথিবী মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করে, তখন মহাবিশ্বের শেষ দিন শুরু হয়ে যায়;
যখন মানুষ বাতাসের ওপর হাঁটতে পারে, পানির ওপর দৌড়াতে পারে, আগুনের মধ্যে বসে থাকতে পারে, সমুদ্রের তলায় গিয়ে খুঁজে আনতে পারে হারানো আংটি, কোনো নভোযান ছাড়াই চাঁদের বুক থেকে ঘুরে আসতে পারে, কোটি মানুষকে কলুর বলদ বানিয়ে ফেলতে পারে, পৃথিবীর সব ভাষার অভিধান রচনা করতে পারে, সর্বরোগের বটিকা বানাতে পারে, সর্বজনীন কবিতাসমগ্র রচনা করতে পারে, সব মানুষের মুখ একই মুখোশে ঢাকা, সব মানুষের নামও এক, গণকবরে একের পর এক লাশ ফেলা হয়, তখন মানুষ সব অন্যায়-অত্যাচার নীরবে মেনে উট পাখির ন্যায় মুখ গুজে থাকে;
যখন গন্ধম খায় আশরাফুল মাখলুকাত, ছেলে বাবাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে, সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রাণীতে রূপান্তর ঘটে মানুষের, সহপ্রজাতি হত্যায় এমন নিপুণ চাল আর কে চালতে পারে? মানুষ ক্রমে ঈশ্বর থেকে দূরে সরে যায়, রাজকোষাগার থেকে হিরা-মানিক চুরি হয়ে যায়, ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে নিয়ে যায় গচ্ছিত অর্থ, শয়তান মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে, যিশুখ্রিস্টের পুনরুত্থান আর হয় না, আস্তিকতার টুঁটি চেপে ধরে নাস্তিকতা, যে আদি থেকে বিশ্বজগৎ সৃষ্টি হয়েছিল— সেই আদিতে পুঞ্জিভূত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়, তখন পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থ মিথ্যা হয়ে যায়;
যখন সারমেয়র হাতে চলে যায় সর্বময় ক্ষমতা, ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে শেয়াল, মুহূর্তে ধূর্ততা পাল্টে হয়ে যায় সাদাসিধে, কামড় বসাবার সুযোগের অপেক্ষায় থাকে, প্রাণিকুল তার ভয়ে তটস্থ, কখন কি বলে বসে কেউ আন্দাজ করতে পারে না, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যায় বিষাক্ত বাষ্প, নিঃশ্বাস নেয় আর তারা ঘুমিয়ে পড়ে, তারা সুখের স্বপ্ন দেখে, হঠাৎ সেখানে হানা দেয় এক অতিকায় দানব, সব কিছু ভেঙে তছনছ করে দেয়, বালুর ঘরের ন্যায় সুউচ্চ অট্টালিকা মাটিতে মিশে যায়, কীটের ন্যায় পতঙ্গের ন্যায় মানুষ সব চাপা পড়ে, তখন সব প্রতিবাদ শরতের মেঘের ন্যায় দূরে মিলিয়ে যায়;
যখন পুঁজি সবকিছুকে নষ্ট করে, পণ্যের ন্যায় বিক্রি হয় মানুষ, কেউ কেউ তোতা পাখির ন্যায় কথা বলে, তাদের মুখে সবসময় হাসির মুখোশ পড়া, সুখ আর সমৃদ্ধির গল্পকে তারা মিথের পর্যায়ে নিয়ে যায়, ভাঙনের কথা তারা সবসময় এড়িয়ে যায়; ক্ষুধার্ত মানুষের মুখ দেখলেই বোঝা যায়, অভুক্ত থাকতে থাকতে গলার স্বর ফ্যাস ফ্যাস করে কাশি ওঠে, এক কণ্ঠ চিৎকার করলে সহস্র কণ্ঠ সহজে মিলে যায়, অর্থ এমন এক ঐশ্বরিক ক্ষমতা রাখে যে সবাই তার কাছে মাথা নত করে, রঙ্গমঞ্চ থেকে বিবেক চিরতরে বিদায় নেয়, লোভ মানুষকে ক্রমে ইতরতর প্রাণিতে রূপান্তর করে, তখন অর্থকে সবচেয়ে বড় কালো জাদুকর বলে মনে হয়;
যখন শয়তান সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে, ফেরেশতারা ভয়ে কাঁপতে থাকেন, পাপে ভরে যায় পৃথিবী, মেয়ের সামনে মায়ের সম্ভ্রমহানি হয়, অকারণে মানুষ গুম হয়ে যায়, খুনে মেতে ওঠে নিরাপত্তারক্ষীরা, দুর্নীতিতে মজে যায় অফিসের বাবুরা, ঘুষ ছাড়া কেউ একটি কথাও বলে না, মানুষ মুখ খুললেই নোংরা গন্ধ বের হতে থাকে, আলাদিনের প্রদীপ পেয়ে কেউ কেউ রাতারাতি অট্টালিকা গড়ে তোলে, আইন-আদালত শিশুদের হাতের বাহারি খেলনার ন্যায় রং পাল্টায়, তখন কালু জাদুতে ভরে যায় দেশ;