ফ্ল্যনিয়র

সেদিনের পর থেকে আমি নিশ্চুপ হয়ে যাই। কেননা নির্বাণ লাভের পর আর কিছুতেই কোনো মোহ থাকে না। তবে আগের মতোই আমি শহরের পথে পথে ঘুরি।

সুধাংশু পূর্বস্বরসুধাংশু পূর্বস্বর
Published : 12 May 2023, 03:54 PM
Updated : 12 May 2023, 03:54 PM

আমার পুরো শৈশব কেটে গেছে অনাথাশ্রমের  শ্যাওলাধরা ও সোঁদা মাটির গন্ধে ভরা ভবনের ভেতরে মোমবাতির নরম আলোয়।  মায়াবী চক্রান্তে ভরা আবছায়া রাত্রির পৈশাচিক সুর ও সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ ছিলো আমার শৈশব, যে-শৈশবকে আমি ধীরে ধীরে ভারাক্রান্ত ক'রে তুলেছি অজস্র পাপ দ্বারা।  নিজের বিপর্যস্ত ও দুঃখভারাক্রান্ত জীবনের জন্যে আমি নিজেকেই দায়ী মনে করি। পাপকর্ম সাধনের ভয়াবহ প্রচেষ্টা এবং আমার অপরাধপ্রবণতাকে ক্রমাগত উসকে দেওয়ার জন্যে আমি আমার নফসকে ছাড়া আর কাউকেই দায়ী করবো না।

আমার সৌন্দর্যবোধ ছিলো অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। মানবাত্মার অতল গহীনে কালো যেইসব ছায়ামূর্তি, পাপবোধ, আতঙ্ক এবং নিষ্ঠুর বাসনা লুকিয়ে থাকে তা আমাকে আলোড়িত করতো, নিয়ে যেতো স্বপ্ন ও সহিংস সঙ্গীতের এক বিচিত্র নন্দনকাননে।

নিজেকে আমার মনে হতো ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ, অর্থাৎ এমনই এক মহামানব যে কীনা ঈশ্বরের প্রতিনিধি হয়ে তার আপন হৃদয় থেকে উৎসারিত বাণীর মাধ্যমে জগতের সব পাপ ও দুঃখরাশিকে মহীয়ান শিল্পকলায় রূপ দেয়।

আজো আমার মনে পড়ে কোনো এক নির্ঘুম রাত্রে জাগ্রতস্বপ্নে আমি ঈশ্বরের বাণী শুনতে পেয়েছিলাম, “তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না মরুনগরের খেজুরগাছগুলো কীভাবে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে? নিশ্চয়ই এতে রয়েছে মৃত্যু ও ধ্বংসের ইঙ্গিত। তুমি কি দেখোনি আমি কীভাবে তোমার সকল ভ্রাতা ও ভগ্নীকে ঢুকিয়ে দিয়েছি দর্পণের গোলকধাঁধায়, যেখানে তারা রক্তপাত ঘটানোর জন্যে একে অপরের সন্ধান চালাচ্ছে?”

মূসার কাছে যেমন প্রত্যাদেশ এসেছিলো তেমনই আমার কাছেও আসে। ঈশ্বর বলেন, “আমিই তোমাকে প্রেরণ করেছি জীবনের উদাসীন ও অনন্ত এই মরুর মাঝে এবং অবশ্যই তোমাকে ভোরের নীলিমার সৌন্দর্য ও রাত্রির নক্ষত্রমালা উপভোগ করার জন্যে আমি সঞ্জীবিত করিনি, বরং তুমি তো শুধু নারকীয় সঙ্গীতের জন্যে।”

“যে-নৃত্যকর মঞ্চের উপরে হত্যাকাণ্ড ও মৃত্যু ডেকে আনে তার মতোই তোমাকে ধ্বনিত ও রণিত হতে হবে। পরাবাস্তব সমুদ্রের কিনারে তুমিই সৃষ্টি করবে রাত্রি এবং তোমাকে দূর থেকে ছায়ার মতো অনুসরণ করবে শুশুকেরা।''

আমি আমার ছুরিতে শাণ দিতে দিতে আমার হিংস্র ঈশ্বর কিংবা শয়তানের কথা শুনে যাই: “তোমাকে খেয়াল রাখতে হবে যেনো তোমার সঙ্গীত তোমার শ্রোতার মনে একসাথে সকল অনুভূতির জাগরণ ঘটায়। মোমের মতোন যখন শেষ হয়ে যাবে রজনী, তখন যেনো সে অনুভব করে সে প'ড়ে আছে মহাশূন্যতার মাঝে। আর তোমার দৃষ্টি তখনো যেনো প'ড়ে থাকে পাতালের অতলে কোনো এক বিস্মৃত বাস্তিলের অন্ধকারে।”

অনাথাশ্রমে আমরা খেতাম ঠাণ্ডা স্যুপ এবং ভেড়া কিংবা শুয়োরের মাংস। আমাদের খাবার দেওয়া হতো যৎসামান্য, তবে আমার ভাগে কম পড়লে প্রায়ই আমি অন্য কোনো দুর্বল ছাত্রের খাবার ছিনিয়ে নিতাম।

প্রতিবন্ধী ও পঙ্গুদেরকে আমি মনে করতাম শয়তানের বিকৃত সৃষ্টি, যারা ঈশ্বরের অভিশাপ। তাই তাদেরকে হত্যা ও নিপীড়ন করাটা আমার মতে ছিলো একটি পবিত্র দায়িত্ব। অন্তত এরকমটাই আমি বিশ্বাস ক'রে এসেছি আশৈশব।

অনাথাশ্রমটিতে বীভৎস মুখশ্রীবিশিষ্ট একটা ছেলেকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিলো, যার চোখগুলো ছিলো একদম পাশুটে ও ভীতিপ্রদভাবে ছানি-পড়া। আমি তার ওপর প্রায়ই চড়াও হতাম এবং তাকে আঘাত করতাম। সে ছিলো বোবা ও মানসিক প্রতিবন্ধী, —এ-কারণে শুধুই গোঁ গোঁ শব্দ করতে পারতো সে, কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো অভিযোগ জানানো ছিলো তার পক্ষে অসম্ভব। তাই তার ওপর ঘটা অন্যায়ের কেউ কিছু টেরই পেতো না। আমি কাচ দিয়ে কেটে-ছিঁড়ে তার ত্বক থেকে রক্ত ঝরাতাম আর সে যন্ত্রণায় ক্রমাগত কুঁচকে যেতো।

আমি সব সময় স্বেচ্ছায় আমার প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে গিয়েছি। কেননা আমি চেয়েছি বিষাদময় এক জীবন, -সেই রোম্যান্টিক বিষাদ, যার নিগূঢ় রহস্য কেউ আজো ভাঙতে পারেনি। বিষাদকে ব্যবহার ক'রে আমি সৃষ্টি করতে চেয়েছি অনিন্দ্য শিল্পকর্ম। ফোটাতে চেয়েছি এমন এক পুষ্প, যা নান্দনিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

একটি ধুলো পড়া পুরোনো বইতে আমি পড়েছিলাম পারস্য পুরাণে উল্লেখিত এক পাখির কথা। তার বিশাল দুইটি ডানা সমগ্র পারস্য সাম্রাজ্যকে ঢেকে রাখতো আর সে সৃষ্টি করতো এমন এক সঙ্গীত, যা শ্রবণ করতেই গভীর বিষাদে মুহ্যমান হয়ে পড়তো সকলে। মানুষকে তার আত্মার অন্তহীন রহস্য জানার পথ ক'রে দিতো সেই পাখি, যার কথা আজকের দিনে সবাই ভুলে গেছে।

পুরাণের সেই পাখির মতোই প্রায়ই আমি ঘুমের ভেতরে দুঃস্বপ্ন দেখতাম। আলো-ছায়ার এক অতিজাগতিক খেলা আমার স্বপ্নের ভেতরে ফোটাতো বিষাদময় ফুল। অস্পষ্ট চিন্তা ও অন্তহীন আবেগ আমার স্নায়ুতন্ত্রে মাকড়শার মতো জাল বিস্তার করতো। কোনো কোনো রাতে আমি ঘুম থেকে ধড়ফড় ক'রে জেগে উঠতাম আর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতাম স্বর্গীয় জ্যোৎস্না।

আজ থেকে অনেক বছর আগের এমনই কোনো এক রাতে আমি আমার প্রথম খুনটি করি।  জরাথুষ্ট্রা নামের মহীয়ান ও বেদনাতুর সেই পারসিক পাখিই হয়তো সেই রাতে আমাকে শুনিয়েছে তার অন্তরের ভয়াল ক্রন্দন। জানিয়েছে পরম এক মুহূর্ত এসে গেছে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার।

মনে পড়ে সবাই যখন গভীর ঘুমে মগ্ন ছিলো তখন একটি শিশু  আমার বিছানার পাশে এসে আমাকে ডাক দিয়েছিলো। আমাকে সে ফিসফিস ক'রে বলেছিলো, “ছাদে যাই, চলুন। এখনই সময় আমাদের দৈহিকভাবে মিলিত হওয়ার।”

আমাকে সে চুপি চুপি পা টিপে টিপে ছাদে নিয়ে যায়।

আমি তাকে ভয়ানকভাবে ধর্ষণ করি এবং তার পায়ুপথ দিয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। আমার মধ্যে জেগে ওঠে নেক্রোফিলিয়ার গোপন এক বাসনা। আর তাই নিজেরও অজান্তে ছেলেটির গলা টিপে ধরি আমি। তবে সে মৃত্যুযন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে থাকলে দয়াপরবশ হয়ে আমি তাকে ছেড়ে দিই।

আর তখনই দখিনা হাওয়ার শিনশিনে শব্দ আমাকে গভীর বিষাদে আচ্ছন্ন ক'রে ফেলে। দস্তয়েভস্কি বলেছিলেন মানুষ স্বভাবতই দুঃখের দিকে ধাবিত। মানুষের শয়তানি প্রবৃত্তি চিরায়ত দুঃখের দিকে মানুষকে ঠেলে দেয়। যেহেতু মানুষের মধ্যে আছে পৃথিবীকে জানার ও অভিযানের কিংবা আত্মানুসন্ধানের এক তীব্র বাসনা, তাই অপরাধ, পাপ, উদ্বেগ স্বভাবতই মানুষকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে।

আমার হৃদয় থেকে উৎসারিত শয়তানি চিন্তায় সাড়া দিয়ে আমি শিশুটিকে হত্যা ক'রে ছাদ থেকে ফেলে দিই। আতঙ্ক ও অপরাধবোধ আমাকে গ্রাস ক'রে নেয়, তবে আমি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়িনি। হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পরে এক দৌড়ে আমি নিজের বিছানায় ফিরে আসি।

কেউ কেউ ভারী বস্তু পতনের শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠে মধ্যরাত্রির বিভ্রম মনে ক'রে আবারো ঘুমিয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই সকলে ধারণা ক'রে নেবে শিশুটি ছাদ থেকে কোনোভাবে প'ড়ে মারা গিয়েছে। ময়নাতদন্তে সত্যটা বেরিয়ে পড়লেও কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটা নিজেদের স্বার্থেই ধামাচাপা দিয়ে দেবে।

এভাবেই কেইনের যোগ্য উত্তরসূরী তার কৃত প্রথম অপরাধের শাস্তি থেকে বেঁচে যায়।

আমার যখন আঠারো বছর বয়স হলো তখন আমি একটি বইয়ের দোকানে কাজ ধরলাম। আত্মানুসন্ধানের তীব্র বাসনা আমাকে পেয়ে বসলো। মানুষের বিচিত্র মনোজাগতিক রহস্যকে জানার জন্যে আমি অবসরে শহরের পথে পথে ঘুরতাম। মাদক চোরাচালান, খুন এবং আরো বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম আমি।

প্রচুর যৌন-সংসর্গের ফলে নারীর প্রতি আমার কোনো আগ্রহ ছিলো না। তাই কোনো উত্তেজনা বা আবেগের স্থানই ছিলো না আমার জীবনে। জীবনের ক্লান্তি ও অবসাদকে ভুলে থাকতে ও নিরন্তর শস্তা উত্তেজনা লাভের জন্যে আমি ডুবে থাকতাম মাদক,  খুন ও বিচিত্র রকম অপরাধের সহিংস রাজ্যে।

সেই দিনগুলোতে আমার জীবনে একটি রহস্যময় ঘটনা ঘটে, যা আমার জীবন ও চেতনাকে আমূল বদলে দেয়।

প্রতিদিনের মতোই আমি পার্কে ব'সে পত্রিকা পড়ছিলাম সেদিন। আমার সামনে কিছু দূরে একটি কাঠের বেঞ্চে ব'সে একজন বৃদ্ধ প্রার্থনা করছিলেন। আমি তাঁর চেহারায় কিছু অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করি। এ-কারণে আমি তাঁর সাথে কথা বলার জন্যে এগিয়ে যাই এবং হাত বাড়িয়ে দিই।

তিনি আমাকে ক্যামেরা হাতে এগিয়ে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করেন, “আপনি কি কোনো স্ট্রীট ফটোগ্রাফার?”

কাষ্ঠ স্বরে আমি তাঁকে উত্তর দিই, “আমি শুধুই একজন ফ্ল্যনিয়র।”

বৃদ্ধ হেসে উঠে আমাকে বলেন, “তাহলে আমি বুঝে নিলাম যে আপনি একজন অনুসন্ধানী শিল্পী। মানুষের আত্মাকে নিরীক্ষণের জন্যে আপনি পার্কে এসেছেন।”

“আর আপনি? আপনি কেন এইখানে এসেছেন? আমি লক্ষ্য করছি অনেকক্ষণ ধ'রেই আপনি এক অজ্ঞাত সত্তার কাছে প্রার্থনা করছেন। আপনি কি শয়তানের পূজারী?” আমি কৌতূহলী হয়ে তাঁকে প্রশ্ন করি।

বৃদ্ধ উত্তর দেন, “আমি সুগন্ধি দ্রব্যের ব্যবসা করি। ব্যবসার কাজেই এখানে আসা। আর হোক শয়তান, কিংবা ভগবান, শাশ্বত সৌন্দর্যই আমার আরাধ্য।”

কেন জানি কোনো কারণ ছাড়াই আমার মনে হচ্ছিলো এই বৃদ্ধই আমার অজ্ঞাত পিতা, কেননা আমার পিতাকে আমি এমন রূপেই কল্পনা করেছি, যদিও আমার এই উদ্ভট এবং হাস্যকর দাবিটি আমি কখনোই প্রমাণ করতে পারবো না।  বৃদ্ধ লোকটি তাঁর চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলেন, এবং ধীরে ধীরে চশমার কাচ পরিষ্কার করতে থাকেন। ধীর স্বরে তিনি আমাকে বলেন, “নিজেকে মানুষের দৃষ্টি স্বচ্ছকারী মহান দার্শনিক স্পিনোজা ব'লে মনে হচ্ছে আমার। কিন্তু আমার পক্ষে কি আদৌ কোনো মানুষের দৃষ্টিতে স্বচ্ছতা আনা সম্ভব?”

আমি শুকনো কণ্ঠে শুধু তাঁকে এইটুকু বলার সুযোগ পাই যে তিনি তো ব্যাপারটা পরীক্ষা ক'রেই দেখতে পারেন।

বৃদ্ধ গম্ভীর গলায় আমাকে বলেন, “আমি জানি তুমি একজন খুনি। পৃথিবী ও জীবনের রহস্য জানার জন্যে তুমি অনেক কিছুই করেছ। কিন্তু আধ্যাত্মিক চূড়ান্ত পূর্ণতাকে পাওয়ার জন্যে তোমাকে আরো অনেক দূরে যেতে হবে। শার্ল বোদলেয়ার তাঁর correspondences  কবিতায় বলেছিলেন প্রকৃতি হচ্ছে এক কাবালিস্টিক মন্দির, আমরা আমাদের শিল্পকলা দ্বারা এই মন্দিরকে পেরিয়ে অসীম ও শাশ্বত সৌন্দর্যকে পেতে পারি।”

বৃদ্ধের কথা শুনে আমার হৃদয়ে ভীতির উদ্রেক ঘটে। বৃদ্ধ তাহলে আমার খুন-খারাবি সম্পর্কে সবই জানেন। এঁকে যদি এখনই আমি শেষ না ক'রে দিই তাহলে আমাকে সত্যিই বিপদে পড়তে হবে।

 আমার মনের কথা জানতে পেরেই হয়তোবা বৃদ্ধের কাশি উঠতে শুরু করে। আমি বুঝতে পারি তাঁর যক্ষা রোগ আছে। অসুস্থতার কারণে আমার কাধে ভর দিয়ে তিনি তাঁর বাসায় আসেন। ওই বিশাল বাসা আলমারিতে ভরা ছিলো। অগণিত বই আর সুগন্ধি দ্রব্যের শিশি ঠেসে রাখা হয়েছে তাঁর  আলমারিগুলোতে।

 বৃদ্ধের গলা থেকে কাশির সাথে রক্ত বেরুতে থাকে। তিনি খুব কষ্ট ক'রে আমাকে বলতে থাকেন, “ঈশ্বরের অস্ত্বিত্বের পেছনে আনসেলমের যুক্তি তোমার কি মনে আছে? সবচেয়ে নিখুঁত এবং সবচেয়ে মহান একটা কিছুই ঈশ্বর, যার থেকে মহান ও নিখুঁত অন্য আর কিছুই হতে পারে না। এমনই মহান ও পরম একটা কিছুর আমি খোঁজ পেয়েছিলাম  ইস্পাহানে। আমার বাসার বেসমেন্টে আছে এক গোলকধাঁধা, সেই গোলকধাঁধার কেন্দ্রে আমি লুকিয়ে রেখেছি ওই শাশ্বত সত্তাকে।”

 বৃদ্ধ তাঁর আলমারি থেকে একটি শিশি বের করেন, যার ছিপি খুলতেই এক অপার্থিব সৌগন্ধে ঘর ভ'রে যায়। তিনি আমাকে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু হঠাতই তাঁর হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়াতে তিনি মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন।

আমি বুঝতে পারি ওই শিশিতে ছিলো সেই শাশ্বত ফুলের সৌগন্ধ। বৃদ্ধের পোষা এক ব্লাডহাউন্ড কুকুরকে গন্ধটা শুকিয়ে এটাকে নিয়ে আমি নেমে যাই বেসমেন্টে। আর হাউন্ডটি দ্রুতই আমাকে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেয়।

ওই গোলকধাঁধার কেন্দ্রে আমি পরম গোলাপকে দেখতে পাই। ঐশী আলোতে তা উদ্ভাসিত ছিলো। তা সকল সঙ্গীতের উৎস, সকল সৌন্দর্যের উৎস, সকল আলোর উৎস।

কাবালিস্টরা চিরকাল একেই খুঁজে গেছে।

রাবাইরা এরই আরাধনা করেছেন।

গণিতবিদরা গাণিতিক সমীকরণ দ্বারা একেই ধরার চেষ্টা করেছেন।

তার রক্তিম পাপড়ি থেকে অশ্রুত সুর ধ্বনিত হয়, তা সকল শিল্পের জন্মদাত্রী।

সেই পরম সৌন্দর্য আমি সহ্য করতে পারি না, তাই সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

আমি সমস্ত রহস্য, সমস্ত সৌন্দর্য, সমস্ত নিগূঢ় প্রতিফলনকে দেখেছি।

সেদিনের পর থেকে আমি নিশ্চুপ হয়ে যাই। কেননা নির্বাণ লাভের পর আর কিছুতেই কোনো মোহ থাকে না। তবে আগের মতোই আমি শহরের পথে পথে ঘুরি। বিভিন্ন রকমের লেন্স সংগ্রহ করি। একটি সাধারণ চশমার দোকানে চশমার কাচ পরিষ্কার ক'রেই সারাটি জীবন কাটিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি আমি। আর এই হলো আমার সম্পূর্ণ জীবনবৃতান্ত।