Published : 28 Sep 2016, 08:43 PM
সৈয়দ শামসুল হক বহু কিছু লিখেছেন – ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা-স্ক্রিপ্ট, প্রবন্ধ, কলাম, কবিতা। এখানে বিবেচ্য তাঁর কবিতা। তাঁর প্রথম কবিতার বই, বুনোবৃষ্টির গান, ১৯৫৯ সনে ছাপা হলেও বাজারজাত হয় নি। তাঁর অন্যান্য কবিতা গ্রন্থঃ একদা এক রাজ্যে (১৯৬১), বিরতিহীন উৎসব (১৯৬৯), বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা (১৯৬৯), প্রতিধ্বনিগণ ( ১৯৭৪ ), অপর পুরুষ (১৯৭৮), পরাণের গহীন ভিতর (১৯৮১), নিজস্ব বিষয় (১৯৮২), এক আশ্চর্য সঙ্গমের স্মৃতি (১৯৮৮)। এই গ্রন্থগুলোর থেকে সঞ্চয়নে তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯০), যার ভিত্তিতে এই আলোচনা। এর পরের কবিতাগ্রন্থের আলোচনা এখানে নেই। তিনটি পর্যায় – ১৯৫৯-৭৪ (পরাণের গহীন ভিতর –এর আগে) ; ১৯৮১ (পরাণের গহীন ভিতর –) ; ১৯৮২-৮৮ (পরাণের গহীন ভিতর –এর পরে) নিয়ে এই এই নিবন্ধ।
১ পরাণের গহীন ভিতর –এর আগে
প্রথম বইয়ের প্রথম কবিতাটি নাম-কবিতা, ১০ পংক্তির অমিল মাত্রাবৃত্তে প্রেমের কবিতা। ১৯৫৯-র জন্য এই কবিতার চলন অনেকখানি আধুনিক, এই অর্থে যে সেকালের প্রচলিত নজরুলী অনুকরণ বা পুঁথি, উর্দু মেশানো কায়দাও এটি নয়। 'তার মৃত্যু', বিমান পতনে ইজদানীর মৃত্যু নিয়ে লেখা গদ্য-কবিতাটি আরো সতেজ। ইজদানীর "স্পর্ধা ছিলো পৃথিবীকে মুঠো করে ধ'রে নরম সুগোল এক কমলালেবুর মতো"। সে এখন মৃত। তার বন্ধুরা যথারীতি চায়ের বিকেলের আড্ডায়। 'লন্ঠনবাহীদের উদ্দেশ্যে' ১৪ মাত্রার মাত্রাবৃত্তে লেখা। শেষ ৪ লাইনেই কবিতার গন্তব্য : "এবং তারা উঠুক ক্রমাগত / ততোক্ষণে আমরা করি পান / মদ্য, নারী, কামুক ঠোঁটের লাল, / বয়স হলে ঈশ্বরের গান" /। হক-এর ছন্দের হাত আছে। পরের কালে ছন্দোবদ্ধ আরও লিখেছেন সনেট ফর্মে।
বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা পর্যন্ত তাঁর প্রায় সব কবিতাই সরল, বিরল-সান্দ্র, বেশির ভাগ গদ্য-কবিতা, গঠন সাধারণ, চমৎকৃত করবার মতো চিত্রকল্প বিরল। কবিতার শিরোনাম – 'কি মুহূর্ত', 'কয়েকটি তাস', 'না নির্বোধ না মহাপুরুষ', 'সাপ', 'একা একজন কবি', 'প্রেম, উত্তর-তিরিশে', 'একটি গাথার সূচনা ও মৃত্যু', 'অনুজাকে কবর দিয়ে ফেরা' – হক-এর বিষয়বস্তুর ধারণা দেয়। দুটি কবিতা দিয়ে আমার বক্তব্য স্পষ্ট করবো। 'একটি গাথার সূচনা ও মৃত্যু' – ৫ অংশে প্রায় সাড়ে ৪ পৃষ্ঠার কবিতা। 'হে জননী, তোমার প্রশংসা-গাথা রচনায় আজ আমি আগ্রহী আবার', – এই বাক্য দিয়ে শুরু। কখনও দেশ-মাতৃকার জন্য বন্দনা , আশা মনে হয় আবার মনে হয় কোন ভালো কবিতা লেখার জন্য আবেগ, উদ্দীপনা যা সম্ভবত এসে চলে গেছে ( 'দরোজা খোলার আগে আগন্তুক চ'লে গেছে')। এতো দীর্ঘ কবিতায় বাগবিস্তার আছে, কিন্তু সান্দ্রতা নেই – বোধ এবং সংবেদনকে চিত্রকল্পের মধ্যে দিয়ে সারবত্তা-লক্ষ্যর দিকে নিয়ে যাওয়া। " কিন্তু কি নিজেই করুণা করবো না ? – যখন নিভৃতে পাজামা তুলে দেখবো পাজামার নীচে চকচকে কাঠের পা, মোজা শুদ্ধ, জুতো পরা, বাঁকা রোদ ঠিকরোচ্ছে মসৃণ বার্ণিশে?"- এই ধরণের চিত্রকল্প, বর্ণনা যার মধ্যে চিন্তা-কল্পনা এবং তার গ্রন্থনা শিথিল । 'অনুজার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে', আরেকটি ৩ পৃষ্ঠার কবিতা। অনেক সরল কথা, কিন্তু সংবেদনার তীব্রতার অভাব।
' বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা', আরেকটি ২৪ পৃষ্ঠার ১৪ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত কবিতা যা গ্রন্থ হিশেবে ১৯৬৯-তে প্রকাশিত । কবিতার বিষয় কবিতা নিজে – কবিতা লেখার উদ্দীপনা, স্মৃতি, অবলোকন, আরাধনা। কুড়িটি স্তবকের প্রথম পঙক্তিগুলোঃ "বহুদিন থেকে আমি লিখছি কবিতা … / বুঝি না অক্ষরগুলো বলতে কি চায় … / বহুদিন থেকে আমি লিখি না কবিতা … / আমারও কি তাই ছিল? শূন্য পরিণামে? … / যখন একাকী থাকি সন্তর্পণে খুলি আমার পুরনো বই … / কি করেছি আমি সেই দিনগুলো নিয়ে… / ইস্টিশনে আমি একা দাঁড়িয়েছিলাম … / ফেরা তো সহজ নয় ফিরতে কে পারে… / সরল রৈখিক নীল কঠিন ইস্পাত হয়তো নোয়াতে পারে… / অথবা রাখতে চায়, সত্য এই বটে … / আমারও সংসার হবে – শিল্পের সংসার… / জলমগ্ন মাছের উপমা ফিরে ফিরে আসে বারবার … / কিন্তু চাই ব্যতিক্রম কখনো কখনো… / চুলে গুঁজে কৃষ্ণচূড়া লাল্পেড়ে তাঁতশাড়ি পরে দলে দলে … / বহুদিন থেকে আমি লিখছি কবিতা … / রাস্তায় বেরিয়ে আজ দেখলাম… / সকালে উঠবে তুমি, খাবে কালো কফি… / রোজ দাঁড়িয়ে থেকেছ। বিউটির মোড়ে… / বহুদিন থেকে আমি লিখি না কবিতা … / ইউ আর স্যাড টুডে। … / বিশ্বাস করি না … / বহুদিন থেকে আমি লিখি না কবিতা … / "। এই কবিতার স্রোত এবং পরিণতি এই : " বহুদিন থেকে আমি লিখি না কবিতা … আমি বারবার সাধবো কবিতা … কত কাল লিখবো না, আবার জেগে উঠবো খরা চৈত্রে চর হয়ে তোমার পদ্মায়। পিঙ্গল জটায় স্রোতের প্রপাত নিয়ে হেঁটে যাবো আমি, স্মৃতির সাগরে। জন্মে জন্মে বার বার কবি হয়ে ফিরে আসবো আমি বাংলায়"। "এ এক বিশাল ফেনা, যার তলের জলের গভীরতা কম, প্রকাশ সাধারণ। ২৪ পৃষ্ঠায় হক যা বলেছেন, জীবনানন্দ দাশ ৫-৬ পংক্তিতে তার চেয়ে অনেক বেশি সারবত্তা গভীরতর সংবেদন নিয়ে একই কথা বলেছেন রূপসী বাংলা-র বহু কবিতায়।
বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা থেকে পরাণের গহীন ভিতর–র অন্তর্বর্তীকালীন দুটো কবিতার বই, প্রতিধ্বনিগণ ( ১৯৭৪ ), অপর পুরুষ (১৯৭৮)। প্রতিধ্বনিগণ-এর প্রধান বিষয় মুক্তিযুদ্ধের কবিতা। 'খাদ্য ও খাদক', 'পহেলা মার্চ ১৯৭১', 'হঠাত দুপুরে কারফিউ', 'একাত্তরের পঁচিশে মার্চের অসমাপ্ত কবিতা', 'এ কেমন মহামারী', 'অবরুদ্ধ শহরে চতুর্থ মাস', 'ফেলে আসা গ্রাম', 'গেরিলা', কবিতার শিরোনামই বিষয়ের সংকেত। বেশির ভাগ কবিতার ভাষা জেনেরিক, বিস্তার অতিকথনপূর্বক, চিত্রকল্প সামান্য ও ব্যঞ্জনাবিরল । সনেটে বাধ্যতামূলকভাবেই বাগ্মীতার সুযোগ কম, তাই 'খাদ্য ও খাদক / এক, দুই' আকর্ষণীয় :
একই স্বাদ। নিয়মিত খেতে বড় শখ।
তবে যদি প্রশ্ন করো উত্তম কোথায় ? –
সবচেয়ে খেতে ভাল বাংলার কৃষক ।
( খাদ্য ও খাদক / এক )
এবং একটি ছোট কবিতা ব্যতিক্রম, যার শেষ লাইনটি ১৯৭০-৭১-এর বাংলাদেশের নগর-গ্রামের দৃশ্যকে ধারণ করেছে :
ছিল তার দরোজা, ছিল জানালা, দেয়াল ছিলো, দেয়ালে ছিলো ছবি,
ছবিতে ছিল যাদের ধরে রাখতে চাওয়া, ছিল বাড়ির বাইরে গাছ,
ছিল যে কোনো পূর্ণিমায় গাছের অবাক একটা হাত বাড়িয়ে দেয়া।
এখন ধীরে ধীরে বাড়িটার চোখে জলের ফুল ধরছে একটি দুটি করে,
এখন তার দেহে পুঞ্জ পুঞ্জ শ্যাওলা রেখে যাচ্ছে দিগন্তের নীল ঠোঁট,
কড়া নাড়লে মাথার গুলির গর্ত থেকে অন্ধকার টসটস করে পড়ছে।
( একটা বাড়ি ছিল )
২ পরাণের গহীন ভিতর
পরাণের গহীন ভিতর-এর ৩৩টি সনেট সৈয়দ শামসুল হক-এর জনপ্রিয় কবিতা। প্রত্যেকটি ১৮ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত, বিষয় প্রেমের কবিতা। লোকজ শব্দমিশ্রিত একটি ভাষা তৈরী করেছেন হক যা প্রেমের বিষয় – বিশেষ করে গ্রামীণ হৃদয়ের – নারীর ও পুরুষের – ভালোবাসার বাসনা, স্মৃতি, ঈর্ষা, আকুতি, অভিমান, কাম চমৎকারভাবে প্রকাশ করেছে। ভাষাটি ঠিক কোন আঞ্চলিক ভাষা নয়, হক-এর হাতে মিশ্র ভাষা। এখানে তিনি বাগ্মী নন, সান্দ্র এবং নারী-পুরুষের মনোবিকলন দিয়ে উদবুদ্ধ। অনুভূতিগুলো নাগরিক, সংস্কৃত চরিত্ররাও ঠিকই বোধ করে, কিন্তু তাদের প্রকাশ এ-রকম হবে না। অন্য দিকে, প্রকাশভঙ্গী এমন কি ভাষাও মফস্বলী হলেও, এই কবিতা গ্রামবাসীদের পড়ে শোনালে তারা বুঝবে না।
৬
তোমার খামাচির দাগ এখনো কি টকটাকা লাল,
এখনো জ্বলন তার চোৎরার পাতার লাহান।
শয়তান, দ্যাখো না করছ কি তুমি কি সোন্দর গাল,
না হয় দুপুর বেলা একবার দিছিলাম টান?
না হয় উঠানে ছিল লোকজন কামের মানুষ,
চুলায় আছিল ভাত, পোলাপান পিছের বাগানে,
তোমারে পরান দিছি, তাই বইলা দেই নাই হুঁশ,
আমি তো তোমারে নিতে চাই নাই ঘরের বিছানে।
হ, জানি নিজের কাছে কোনো কথা থাকে না গোপন।
দিনের দুফুর বেলা যেই তুমি আসছিলা ঘরে
আতখা এমন মনে হইছিল- আন্ধার যেমন,
আতখা এমন ছায়া সোহাগের আর্শির ভিতরে।
আবার ডাকলে পরে কিছুতেই স্বীকার হমু না।
বুকের পাষাণ নিয়া দিমু ডুব শীতল যমুনা।।
১৫
আমারে সোন্দর তুমি কও নাই কোনো একদিন,
আমার হাতের পিঠা কও নাই কি রকম মিঠা,
সেই তুমি তোমারেই দিছি আমি যুবতীর চিন-
চোখ-কানা দেখ নাই বিছানায় আছে লাল-ছিটা?
তয় কি তোমারে আমি ফাঁকি দিয়া পিছন বাড়িতে
যামু তার কাছে কও আমারে যে দিতে যায় পান?
অথবা জিগার ডালে ফাঁসি নিয়া নিজের শাড়িতে
ভূত হয়া তোমার গামছায় দিমু আন্ধারে টান?
তখন আমারে তুমি দেখি হেলা করো কি রকম,
শরীল পাথর হয়া যায় কি না পানের ছোবলে,
আমারে হারায়া দেখি জমিহারা চাষী হও কি না?
এমন দেখতে বড় সাধ হয় আল্লার কসম,
দেখার বাসনা করে কালপোকা তোমার ফসলে,
অথচ ঘরেই থাকি, পোড়া ঘরে থাকতে পারি না।।
এইসব কবিতায় হক কিছু যথার্থ চিত্রকল্প দেখিয়েছেন।
ক.
চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,
বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পুন্নিমার চান,
নিজেই তাজ্জব তুমি একদিকে যাইবার চাও
অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান।
খ.
পরানের ভিতরে সুরাখ-
সেখানে কেবল এক ফরফর শব্দ শোনা যায়,
পাখিরা উড়াল দিয়া গ্যাছে গিয়া, এখন বিরান,
এখন যতই আমি ছড়া দেই কালিজিরা ধান,
সে কি আর আঙিনায় ফিরা আসে?
গ.
বুকের ভিতর থিকা লাফ দিয়া ওঠে যে চিক্কুর,
আমি তার সাথে দেই শিমুলের ফুলের তুলনা,
নিথর দুফুর বেলা, মরা পাখি, রবি কি নিষ্ঠুর,
আগুন লাগায়া দিবে, হবে খাক, তারি এ সূচনা।
ঘ.
য্যান এক উত্তরের ধলাহাঁস দক্ষিণের টানে
যাইতে যাইতে শ্যাষে শুকনা এক নদীর কিনারে
ডাক দিয়া ওঠে, 'আগো, চেনা কেউ আছো কোনোখানে?'
পরাণের গহীন ভিতর – এর কবিতা পড়লে আল মাহমুদ-এর সোনালি কাবিন-এর কবিতা স্বভাবতই মনে পড়ে। সেগুলোও বাংলার গ্রামীণ প্রেমের কবিতা , সনেট এবং ১৮ মাত্রার অক্ষরবৃত্তে লেখা। তার ভাষা পুঁথি, আরবি মেশানো – চরিত্রে আলাদা। এবং মাহমুদ বৌদ্ধ ঐতিহ্য এবং সাম্যবাদ মিশিয়েছেন কবিতার বোধে। হক-এর কবিতায় সে-সব নেই, তিনি বরং প্রেমের আকাংখা, স্মৃতি, ঈর্ষা, আকুতি, অভিমান, কাম – এ-সব মনের কথাকেই ঝাঁপি খুলে বলেছেন। দুটো পৃথক। তবু, আমার মনে হয়েছে সোনালি কাবিন না থাকলে পরাণের গহীন ভিতর হতো না। এর কোন প্রমাণ দিতে আমি অপারগ কিন্তু এ-কথা মনে আসে।
৩ পরাণের গহীন ভিতর –এর পরে
নিজস্ব বিষয় (১৯৮২) এর পরের গ্রন্থ। এর প্রধান বিষয় প্রেম এবং এর বাইরে দেশ, স্বাধীনতা, কিছু স্বগত ডায়ালগ এবং 'ব্রহ্মপুত্রর প্রতি' একটি বহিঃস্থ বিষয়ের কবিতা। প্রথম ৩টি কবিতা, 'নান্দী', 'সংহিতা' এবং 'ব্রহ্মপুত্রর প্রতি' দীর্ঘ প্রলম্বিত বাক্যে, কিছু তৎসম গ্রন্থিত। এগুলোর সুর কিছুটা আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ-র 'আমি কিংবদন্তির কথা বলছি'-র মতো। 'সংহিতা' কবিতায় কিছু ভালো উপমা আছে। কবিতাগুলোকে ছোট এবং সান্দ্র করলে সংবেদনের তীব্রতা বাড়তো বলে আমি মনে করি। বাকি সব কবিতার প্রধান টেকনিক হচ্ছে পুনরাবৃত্তি – বাইবেল থেকে প্রচলিত হয়ে বহু পুরোনো। আধুনিক কবিতায় হুইট্ম্যান বহুল ব্যবহার করেছিলেন। বাংলায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং শামসুর রাহমান (এলুয়ার অনুসরণ করে) অনবরত প্রয়োগ করেছিলেন। পরবর্তীরাও একই কোরাস গেয়েছেন। সৈয়দ শামসুল হক-ও ব্যতিক্রম নন। কয়েকটি উদাহরণ দি:
আমি যেতে চাই
…………
আমি যেতে চাই তোমার বাড়ির ভিতরে,
তমার দেহের ভেতরে,
তোমার আত্মার ভেতরে,
তোমার অস্তিত্বের ভেতরে,
আমি যেতে চাই
………
…আমি দৌড়ে যেতে চাই।
… আমি হেঁটে যেতে চাই।
… আমি উদ্গ্রীব হতে চাই।
… আমি দাঁড়াতে চাই।
…………
আমি তোমার ভেতরে যেতে চাই, আমি তোমাকে আমার ভেতরে চাই।
/ ( যেতে চাই )
"চাই আমি তোমাকেই, রক্তের ভেতরে চাই " এই শুরু দিয়ে 'চাই আমি তোমাকেই' আশলে শহীদ কাদরী-র 'তোমাকে চাই' কবিতার রূপান্তর মাত্র।
এবং এখন এই বই বন্ধ
ঐ জানালাগুলো বন্ধ ঐ দরোজা বন্ধ
ঐ বাড়ি বন্ধ …
/ ( এই বর্তমান )
এ-কবিতা ( X বন্ধ ) করে করে আড়াই পৃষ্ঠা।
আমি এখন তোমার মুখ দেখছি
আমি তোমার মুখ দেখছি এখন
আমি তোমার এখন দেখছি মুখ
আমি দেখছি তোমার এখন মুখ
আমি তোমার দেখছি এখন মুখ
/ ( সম্মোহনসূত্র )
এই কবিতা শব্দের পারমুটেশন-কম্বিনেশন মাত্র। নিজস্ব বিষয়- এর পরেকার বহুল পঠিত কবিতা, 'আমার পরিচয়'-এর গড়ন একই রিপিটেশন। এই কবিতা আবৃত্তি হয়, এর সুযোগও নানাবিধ, কিন্তু
কবিতার স্থান একমাত্র সময়ই বলে দেবে :
আমি জন্মেছি বাংলায়
আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে ?
………………
আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হ'লো ইতিহাস।
এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন
সন্তান ?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।
/ ( আমার পরিচয় )
সারমর্মে সৈয়দ শামসুল হক-এর কবিতা সমগ্রের মধ্যে পরাণের গহীন ভিতর –এর কবিতাগুলোই পাঠ্য, যেখানে গ্রাম-বাংলার ঘর-কন্নার সুখদুঃখ গ্রামীণ মনোবিকলনসহ একটি লোকজ ভাষায় রূপাশ্রিত। এর সুর-দরদ ময়মনসিংহ গীতিকা, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়ার। গুণমান মেনেও, কবিতার বিচারে এইসব চিন্তা কালের প্রেক্ষিতে এক জায়গায় মন্থর।