মুঘল আমলে ঈদ

সম্রাট হুমায়ুনের প্রিয় খাবার ছিল খিচুড়ি ও শরবত। সপ্তাহে তিনদিন নিরামিষ খেতেন আকবর, বাকি চারদিন আমিষ।

মোস্তাক শরীফমোস্তাক শরীফ
Published : 22 April 2023, 07:17 AM
Updated : 22 April 2023, 07:17 AM

১০৩৭ হিজরি। খ্রিস্টীয় ১৬২৮। আগ্রার সিংহাসনে আসীন পঞ্চম মুঘল সম্রাট শাহাবুদ্দিন মুহম্মদ শাহজাহান। মুঘল ইতিহাসবিদ হামিদুল্লাহ লাহোরির কলমে সে বছরের রমজান ও ঈদুল ফিতরের বর্ণনা: ‘রমজানের প্রতিদিন বিকেলে সদর (সম্রাটের পক্ষ থেকে ধর্মীয় অনুদানের বিষয়টির দেখভাল করতেন যে কর্মকর্তা) মুসাভি খান সম্রাটের উপস্থিতিতে দরিদ্র মানুষদের জন্য একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। ১০৩৭ হিজরির ৩০ রমজান শনিবার (৩ জুন ১৬২৮) বিকেলে ত্রিশ হাজার রুপি দরিদ্রদের মধ্যে দান করেন সম্রাট, এর সঙ্গে যোগ হয় দৈনিক ভাতা আর জায়গা জমি দানও। সেদিন সন্ধ্যায় আকাশে উঠল ঈদের চাঁদ, সম্রাটের বাদকদল বাদ্য বাজিয়ে ঈদের আগমন ঘোষণা করল। পরদিন সকালে যুবরাজ, আমীর ওমরাহ, অভিজাত ব্যক্তিবর্গ ও অন্যান্য রাজকর্মচারি দিওয়ান ই আম-এ সমবেত হলেন সম্রাটকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে। রাজন্যবর্গ সমভিব্যহারে ঈদের নামাজ পড়তে চললেন সম্রাট। ঈদগাঁহে যাওয়া ও আসার পথে অকাতরে স্বর্ণমুদ্রা বিলালেন।’ শাহজাহানের দরবারের আরেক সভাসদ মুন্সি চন্দ্রভান ব্রাহ্মন ঈদগাঁহের উদ্দেশে রাজকীয় শোভাযাত্রার বিবরণ দিয়েছেন এভাবে: রাজপ্রাসাদ থেকে ঈদগাঁহের উদ্দেশে সম্রাটের যাত্রা ছিল জাঁকজমকে পরিপূর্ণ। গোটা শহরই যেন এ উদ্দেশ্যে নতুন সজ্জায় সেজে ওঠে। ঘরবাড়ি, হাটবাজার সবকিছু কারুকাজ করা নানা রঙের রেশমি কাপড়ে সাজানো হয়। আশেপাশের শহর ও গ্রাম থেকে হাজার হাজার লোক আগ্রায় জড়ো হয়--সবার উদ্দেশ্য একটাই--সম্রাটকে এক নজর দেখা। রাজকীয় আচার অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা মীর-ই-তুজুক-এর তত্ত্বাবধানে শোভাযাত্রার পথ এবং আশেপাশের সব এলাকা নয়নকাড়া সাজে সাজানো হয়। নানা রঙের পোশাক পরা অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যের কুচকাওয়াজে উৎসবমুখর এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। খানিকদূর পরপর নানারকম প্রদর্শনীর আয়োজন থাকে, যাতে রণভেরী, বিউগল, ঢাকঢোল ইত্যাদি সহযোগে বিভিন্ন ধরনের খেলা দেখানো হয়। এ সবের মধ্য দিয়ে সম্রাটের বহর ধীরে ধীরে ঈদগাঁহের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। সুসজ্জিত ঘোড়া বা রাজকীয় হাতি ছিল সম্রাটের বাহন। শোভাযাত্রার সময় সমবেত লোকজনের মধ্যে বিপুল পরিমাণে অর্থ বিতরণ করা হয়।

গোটা পথ জুড়ে শান্তিশৃঙ্খলা ও সম্রাটের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত থাকে অস্ত্রধারী সেনারা। বহরে যোগ হয় সম্রাটের রাজকীয় আসন তখ্ত-ই-রাভান ও স্বর্ণ ও মণিমুক্তায় খচিত পালকি। এভাবে বিশাল আয়োজনের মাধ্যমে ঈদগাঁহে পৌছে সম্রাট বাকি সবার সঙ্গে ঈদের নামাজে অংশগ্রহণ করেন। ইমাম সাহেব খুতবা পড়ার সময় সম্রাটের রাজকীয় উপাধিগুলোর প্রতিটি উচ্চারণের সময় সম্রাটের পক্ষ থেকে নগদ অর্থ ও খিলাত (সম্মানসূচক বহুমূল্য পোশাক) পান। ঈদের অন্যতম অনুষঙ্গ লোভনীয় খাবারদাবার। বাখরখানি, পরোটা মাংস, লাচ্ছা সেমাই, জর্দা পোলাও-এসব খাবার ছিল জনপ্রিয়। উচ্চবিত্ত মুঘলরা রাতের খাবারের সঙ্গে সুরা পান করতেন। এছাড়াও ছিল অন্যান্য খাবার ও পানীয়ের আয়োজন। মুঘল আমলের প্রধান খাবারগুলোর মধ্যে ছিল বিরিয়ানি, কাবাব, কোপ্তা, পোলাও ও তান্দুর। মালাই কোপ্তা, রেশমি কাবাব, কড়াই গোস্ত ও মুর্গ তান্দুর ছিল অভিজাতদের প্রিয় খাবার। মূল খাবারের পর পরিবেশ করা মিষ্টান্নের মধ্যে অন্যতম ছিল শাহী তরকা, বরফি, কালাকান্দ ও ফালুদা। প্রথম মুঘল সম্রাট বাবুরের জন্ম বর্তমান উজবেকিস্তানের আন্দিজান শহরে। জীবনের অধিকাংশ সময় জন্মস্থান থেকে দূরে কাটালেও স্বদেশী খাবারের কথা ভুলতে পারেননি কখনও। সেখানকার মজাদার খরমুজ, আঙ্গুর আর অন্যান্য ফল হিন্দুস্তানে পাওয়া যেত না-এ আক্ষেপ সবসময়ই করতেন তিনি। বাবুরনামায় এক জায়গায় লিখেছেন, ‘বরফ, ঠান্ডা পানি, ভালো খাবার, ভালো রুটি কিছুই পাওয়া যায় না এখানে!’ তবে ভারতবর্ষের স্বাদু ও নোনা পানির মাছ পছন্দ করতেন তিনি। তাঁর বংশধরদের জন্য অবশ্য হিন্দুস্তানই ছিল জন্মস্থান, ফলে ক্রমশ এদেশের আবহাওয়া ও খাবারের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেন তাঁরা। উদাহরণস্বরূপ, সম্রাট হুমায়ুনের প্রিয় খাবার ছিল খিচুড়ি ও শরবত। সপ্তাহে তিনদিন নিরামিষ খেতেন আকবর, বাকি চারদিন আমিষ। তাঁর প্রিয় খাবার ছিল মুরগি মাসাল্লাম ও নবরতন কোরমা। জাহাঙ্গীরের প্রিয় খাবারের তালিকায় উপরের দিকে ছিল দই আর নানারকম মিষ্টি। মুঘল সম্রাটদের মধ্যে সুরাপানের দিক দিয়ে জাহাঙ্গীর ছিলেন শীর্ষে। শাহজাহান ছিলেন মসলাপ্রেমী। জিরা, ধনিয়া, হলুদ এসব মসলা বিশেষভাবে পছন্দনীয় ছিল তাঁর। শাহজাহানের আরেক প্রিয় খাবার ছিল নেহারি। কাবুলি নামে এক বিশেষ বিরিয়ানির ভক্ত ছিলেন আওরঙ্গজেব। চাল, পুদিনা, দই, খোবানি, কাঠবাদাম সহযোগে তৈরি হতো এই বিশেষ বিরিয়ানি। মুঘল অভিজাত ও অর্থশালী ব্যক্তিরা সারাবছরই বিলাসব্যসনে ব্যস্ত থাকলেও দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষদের জন্য ঈদ ছিল ভালো খাবারদাবার, পোশাক-ইত্যাদি উপাচারের স্বাদ নেবার একমাত্র সুযোগ। সম্রাট এমনিতেই সারাবছর দানধ্যান করলেও ঈদের সময় এ দানের পরিমাণ বেড়ে যেত। দানধ্যানের আরেকটি সময় ছিল কোনো শাহজাদা বা শাহজাদী অসুস্থ হলে। উদাহরণস্বরূপ, শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ কন্যা জাহানারা বেগম একবার অগ্নিদুর্ঘটনার শিকার হয়ে ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে সম্রাট কন্যার সুস্থতা কামনায় বিপুল পরিমাণে অর্থ দান করেছিলেন। বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান ও আওরঙ্গজেব-এই ছয় কীর্তিমান সম্রাটের মোটামুটি দেড় শতাব্দীর শাসনকাল শেষে শুরু হয় মুঘর সাম্রাজ্যের পতনের পথে যাত্রা। এই যাত্রা অব্যাহত ছিল আরো প্রায় দেড়শো বছর। এই সময়কালে একের পর এক দুর্বল সম্রাটের শাসন, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এবং মারাঠা, আফগান, ইংরেজ প্রভৃতি জাতির দাপট বাড়ার পরিণতিতে মুঘল সাম্রাজ্য টিকে থাকে কেবল নামে, বাস্তবে শাহজাহানাবাদ তথা পুরান দিল্লীর কিয়দংশ ছাড়া মুঘল শাসনের অস্তিত্ব আর কোথাও ছিল না। সম্রাটরা পরিণত হন অন্যদের ক্রীড়নকে। শেষের দিকেতো ইংরেজদের মাসোহারা নিয়ে চলতে হতো সম্রাটকে। তারপরও, রাজকোষের অবস্থা যতই খারাপ হোক, মুঘল সম্রাট বলে কথা। উৎসব আয়োজনের বহিরাবরণের ঠাঁটবাট বজায় রাখার ক্ষেত্রে চেষ্টার কমতি ছিল না শেষদিকের মুঘল সম্রাটদের। শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের কথাই ধরা যাক। যেহেতু চাঁদ দেখে ঈদের আগমন ঘোষণা করার দায়িত্ব স্বয়ং সম্রাটের, সেহেতু শহরের নানা দিকে অশ্বারোহী সৈন্যদের পাঠানো হতো চাঁদ দেখার জন্য। আকাশে মেঘ থাকলে সৈন্যরা চলে যেত শহরের সীমানা ছাড়িয়ে আরো দূরে, পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলে। সেখান টিলাটক্কর বা উঁচু কোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে ঈদের চাঁদ দেখার চেষ্টা করত। চাঁদ যে সত্যি সত্যি দেখা গেল সেটি নিশ্চিত করার জন্য নির্ভরযোগ্য সাক্ষীর সইসাবুদ দরকার হতো। নির্ভরযোগ্যতার বিচারে সবচেয়ে এগিয়ে থাকতেন কাজী বা বিচারকেরা। চাঁদ দেখার খবর সম্রাটের কানে পৌঁছানোর পর ‘নাকাখানা’ থেকে তোপধ্বনি করার মাধ্যমে সেটি জানিয়ে দেয়া হতো শহরবাসীকে। সকালে স্নান সেরে রত্নখচিত বাদশাহী পোশাক পরতেন সম্রাট। দস্তরখানে বসে মিষ্টি, দুধ, শুকনো ফল আর পোলাও খেতেন। তারপর পূর্বপুরুষদের রীতি অনুসরণ করে সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর শোভাযাত্রা সহকারে যেতেন দিল্লী জামে মসজিদে। সম্রাট পৌঁছানোর পর মসজিদের সিঁড়ির ধাপে নামিয়ে রাখা হতো তাঁর হাওদার- রূপার কারুকার্য করা সুদৃশ্য চেয়ার। সেই চেয়ারে বসতেন সম্রাট, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হতো ওজুখানায়। পেছনে যুবরাজ ও অভিজাতবর্গ। ইমামের ঠিক পেছনে বিছানো হতো সম্রাটের জায়নামাজ। নামাজশেষে ফের প্রাসাদে ফিরে যেতেন সম্রাট, সেখানে দিওয়ান-ই-আমে রাজসিংহাসনে বসে গ্রহণ করতেন সবার ঈদের শুভেচ্ছা। পুরুষদের শুভেচ্ছাপর্ব শেষ হলে ফিরে যেতেন নিজের মহলে। সেখানে রৌপ্যখচিত সিংহাসনে বসে গ্রহণ করতেন নারীদের শুভেচ্ছা।