এম এন রায়: মেক্সিকো-প্রবাসের স্মৃতি-৮

প্রেসিডেন্ট কাররান্সা যাতে মনরো ডকট্রিনের বিরুদ্ধে লাতিন আমেরিকান বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন সেজন্য তাঁকে তাতিয়ে দিতে হবে এবং সাহায্যও করতে হবে।

প্রিসিলা রাজপ্রিসিলা রাজ
Published : 1 March 2024, 08:04 AM
Updated : 1 March 2024, 08:04 AM

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার আরবেলিয়া গ্রামে শাক্ত ব্রাহ্মণ ভট্টাচার্য পরিবারে ১৮৮৭ সালে জন্ম নরেন্দ্রনাথের যিনি পরে এম এন রায় হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামী, কমিউনিস্ট বিপ্লবী ও তাত্ত্বিক মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সমধিক পরিচিতি উদার মানবতাবাদের (radical humanism) তাত্ত্বিক ও প্রবক্তা হিসেবে। বিপ্লবী জীবনে তাঁকে বহু ছদ্মনাম নিতে হয়েছিল। ১৯৫৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি প্রয়াত হন এই মনিষী।

মেক্সিকো সফর তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। এক অর্থে তার রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি এই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেও মানবেন্দ্রনাথের মেক্সিকো-সফর বড় ধরনের বাঁক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ইংরেজিতে লিখিত তাঁর স্মৃতিকথা Memoirs ১৯৬৪ সালে দিল্লী থেকে প্রকাশিত হয়। ৬২৮ পৃষ্ঠার এই দীর্ঘ স্মৃতিকথার শতাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে মেক্সিকো বাসের রোমাঞ্চকর ও ঘটনাবহুল স্মৃতি। মূল গ্রন্থের ৫ম অধ্যায় থেকে ২৯ অধ্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত সেই স্মৃতিচারণ। স্মৃতিকথার এই নির্বাচিত অংশ কলামিস্ট অনুবাদক প্রিসিলা রাজ-এর অনুবাদে ধারাবাহিকভাবে বাংলা ভাষায় প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আজ থাকছে মেক্সিকো সফরের অষ্টম পর্ব। এই অনুবাদে মূল বইয়ের পর্ব-বিন্যাস অনুসরণ ও উল্লেখ করা হয়েছে।

১২

চীনে অস্ত্র কেনার শেষ চেষ্টা

নৈশাহারে জার্মান মিনিস্টার ছাড়াও আমার সেই পুরানো বন্ধু দু’জনও উপস্থিত ছিলেন। বোঝাই যাচ্ছিল, এটা নিছক কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান নয়। তার আড়ালে কাজের বৈঠক। আহারপর্ব শেষ হওয়ামাত্র গৃহকর্ত্রী বিদায় নিয়ে ঘরে চলে গেলেন এবং ফ্রেইয়ার ভন শেন আমাদের ধূমপান কক্ষে নিয়ে চললেন। সবাই সিগারেট ধরালেন। আমিও একটা নিলাম। হাতে হাতে ব্র্যান্ডিও দেওয়া হলো। মিনিস্টার কথা শুরু করলেন। দূরপ্রাচ্যে দুর্ভাগ্যবশত যে কাজটি অসমাপ্ত রেখে চলে আসতে হয়েছে সে ব্যাপারে আমি কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছি? আমার উত্তর ছিল, যুক্তরাষ্ট্রে কিছু ভারতীয় বিপ্লবীর সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার। তাদের কয়েকজনের দ্রুততম সময়ের মধ্যে চীনে যাওয়া জরুরি। রাসবিহারীকে সাহায্য করার জন্য জাপানেও একজনকে পাঠাতে চাই। একজন বিপ্লবী সে উদ্দেশ্যেই আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন।

মিনিস্টার জানতে চাইলেন মেক্সিকো বা যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত চীনা বিপ্লবীদের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে কিনা। না নেই। উনি আমাকে কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন প্রয়োজনে যারা খুব কাজে লাগতে পারে। খুশি মনে প্রস্তাব গ্রহণ করলাম। এ কাজের জন্য উপযুক্ত কোনো ভারতীয় আদৌ পাব কিনা সে সন্দেহ আমার ছিল। সিদ্ধান্ত হলো আমার চিঠি নিয়ে একজন চীনা সওদাগর জাপানে রাসবিহারীর কাছে যাবেন। চিঠি দিয়ে কোনো কাজ হবে না সে বিষয়ে আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম। সে কারণে আমি ইউনানের লোকজনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের উপায় খুঁজছিলাম। চীনা সওদাগরটির ইন্দোচীনে ব্যবসাসূত্রে পুরানো যোগাযোগ ছিল। প্রয়োজনে তিনি ইউনান পর্যন্ত যেতে পারবেন।

তবে একইসঙ্গে চীনে অবস্থানরত জার্মানদেরও এ ব্যাপারে অগ্রসর হতে হবে। সেক্ষেত্রে মিস্টার এক্স (জার্মান ঔপনিবেশিক কর্মকর্তা) দূরপ্রাচ্যে ভ্রমণ করবেন। সেখানে তাঁর অসংখ্য যোগাযোগ আছে। তিনি কি জাপানে আমার বন্ধুটির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন? তাঁরা জানতে চাইলেন। একথা শুনে বিস্মিত হলাম। এই যুদ্ধকালে কী করে একজন জার্মানের পক্ষে জাপানে প্রবেশ করা সম্ভব? সম্ভব। ওঁরা আমাকে আশ্বস্ত করলেন। এসব করার উপযুক্ত প্রক্রিয়া রয়েছে। বুঝলাম খুব সম্ভবত জার্মান ভদ্রলোক অন্য দেশের জাল পাসপোর্ট নিয়ে জাপানে ঢুকবেন। আমার কাছে ওটা নতুন কিছু নয়। আমার বিশ্বাসযোগ্যতায় নিঃসন্দেহ ছিলেন মিনিস্টার। ফলে তিনি বলে ফেললেন, “জাপান আমাদের শত্রু নয়।” ক্রমে এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক জটিল জালটি আমার সামনে আরো উন্মোচিত হয়েছিল। তবে আপাতত সিদ্ধান্ত হলো, যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তার বেরিয়ে পড়বেন এবং অন্যান্য দূতকেও যাতে অচিরেই রওনা করানো যায় সেজন্য আমার হাতে আরো টাকা দেওয়া হবে।

জাভায় থাকার সময়ই দেখেছিলাম টাকা দেওয়ার ব্যাপারে জার্মানরা খুব উদার নয়। তবে এবার তারা যে উদ্দেশ্য থেকেই টাকা দিতে রাজী হোক না কেন, আমার নিজের মধ্যে একটা নৈতিক বাধা টের পেলাম। যে কাজের জন্য টাকাটা দেওয়া হচ্ছে সে কাজে যতটা দরকার তার চেয়ে বেশি কি নেওয়া উচিত? বিক্রয়যোগ্য ভারতীয় বিপ্লবীদের জার্মানরা ব্যবহার করেছে সেকথা মনে এল। এরকম কয়েক ডজন বিপ্লবীকে কিছু পিস্তল এবং একেকজনকে কয়েকশ’ করে ডলার দিয়ে মালয় অথবা শ্যাম-বার্মার সীমান্তে গণ্ডগোল পাকানোর জন্য পাঠিয়েছিল তারা। এই বিপ্লবীদের অধিকাংশ ছিলেন গদর্ পার্টির লোক। জার্মানদের উদ্দেশ্য ছিল, এসব ঘটনা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে তাদের পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রচারিত হবে যা জার্মানিতে উদ্দীপনা ধরে রাখতে সাহায্য করবে। জার্মান ষড়যন্ত্রের শিকার এই ভারতীয়রা আশার ফানুস উড়িয়ে ভাড়াটে অভিযানে বেরিয়ে পড়েন। তাঁরা ভেবেছিলেন সান ফ্রান্সিসকোয় নিরাপদ দূরত্বে বসে থাকা গদর্ পার্টির ডাকে সাড়া দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সীমান্ত প্রহরায় নিয়োজিত ভারতীয় সৈন্যরা বিদ্রোহ করবে। অভিযানে বের হওয়া বেশিরভাগ বিপ্লবী মাঝপথেই গ্রেপ্তার হন এবং যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত জেলবন্দী থাকেন। দুঃসাহসী কতিপয় বিপ্লবী গন্তব্যে পৌঁছাতে সক্ষম হলেও ধরা পড়েন। ফাঁসি হয় তাঁদের। যে সৈনিকরা বিদ্রোহ করবে বলে তাঁরা আশা করেছিলেন কয়েক জায়গায় তারাই বিপ্লবের দূতদের পরিকল্পনা ফাঁস করে দেয়। জার্মানদের ষড়যন্ত্রের শিকার ভারতীয় বিপ্লবীদের সেই করুণ ঘটনার বিস্তারিত আজও কোথাও প্রকাশিত হয়নি। এই ঘটনার শেষাঙ্ক অভিনীত হয় সান ফ্রান্সিসকোর আদালতে, যেখানে “হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার” বিচার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মামলার কতিপয় অভিযুক্ত দূরপ্রাচ্যে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁদের একজন জার্মান ষড়যন্ত্রের শিকার ভারতীয় বিপ্লবীদের মৃত্যুর শোধ নিতে কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান গদর্ পর্টির নেতাকে গুলি করে হত্যা করেন।

জার্মানদের কাণ্ডজ্ঞানহীন সেই আচরণের কথা স্মরণ করে আমার বিবেক নীরব হয়ে গিয়েছিল। চীনে আমি নিজেই তাদের কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণের সম্মুখীন হয়েছিলাম। সেই সময় আমার সামনে কার্যত ভারতীয় সীমান্তেই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র কেনার সুযোগ এসেছিল। জার্মানরা তখন আমায় টাকা দেয়নি। আমার মাথায় এবার দু’টো চিন্তা এল। প্রথমত, ভবিষ্যতের জন্য আমার কি টাকা জমিয়ে রাখা উচিত, বিশেষ করে যে সুযোগ আমার আর না-ও আসতে পারে? দ্বিতীয়ত, জার্মানরা এখন যেহেতু ভূমিকা নিতে প্রস্তুত আমি তখন অস্ত্র সংগ্রহের জন্য আরো একবার গুরুতর চেষ্টা করে দেখতে পারি। আর সেটা যদি করি, তাহলে তাদের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে থাকলে চলবে না। যদি আমার চীনে যেতেই হয় তাহলে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ আগে যোগাড় করে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সেই সুযোগ যখন এসেছে সেটা হারানো ঠিক হবে না। ভারতে আমাদের ডাকাতি করে অর্থ সংগ্রহ করতে হতো। তার ফলে প্রায় সময়ই নির্দোষ সাধারণ মানুষের মৃত্যু ঘটত। তবে, লক্ষ্যই পন্থাকে বৈধতা দেয়। বিপ্লব ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যেই সেই অর্থ ব্যয় করা হতো। এখনও আমি সেই লক্ষ্য অর্জনেই লড়াই করছি। সুতরাং সিদ্ধান্ত নিতে দেরী হলো না।

এক সপ্তাহের মধ্যে ৫০ হাজার পেসোর মজুদ গড়ে তুললাম। সবই স্বর্ণমুদ্রায়। সেসময় আমি মেক্সিকো সিটির প্রান্তবর্তী এলাকায় থাকতাম। আমার বাসা পার হয়ে একটি বিস্তৃত ভুট্টাক্ষেত যা শেষ হয়েছিল ১৫-২০ মাইল দূরে বরফঢাকা পাহাড়ের সারিতে। পাহাড়ের ঢালে তখন সাপাতিস্তাদের আনাগোনা। সেখান থেকে নেমে এসে শহরের প্রান্তীয় এলাকাগুলোয় চড়াও হতো ডাকাতির উদ্দেশ্যে। কে বলতে পারে ভুট্টাক্ষেতে কাজ করা লোকগুলোর মধ্যে কত জন ডাকাতদলটির দুর্দান্ত নেতার রেকিদলের সদস্য? কিন্তু বাড়িটা আমার খুবই পছন্দের ছিল। বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমব্যাপী সমগ্র দৃশ্যপট ছিল উন্মুক্ত। গর্বিত স্বামীর সতর্ক প্রহরায় “নিদ্রিতা নারী” সম্পূর্ণ সৌন্দর্য্য নিয়ে উদ্ভাসিত হতো আমার সম্মুখে।

অপ্রত্যাশিত অর্থের মজুদ বেড়ে চলল। একটা পর্যায়ে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা কিছু নিতেই হলো। একটা রাইফেল, দুটো মাউজার পিস্তল এবং একটা অ্যালসেশিয়ান কুকুর যোগাড় করলাম। খয়েরি কুকুরটি আমার মেক্সিকোবাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল স্মৃতি জুড়ে রয়ে গেছে। ওর গুরুগম্ভীর ডাক মুক্ত দিগন্তে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসত। তার ফলে ওর মনে হতো অন্যান্য কুকুররাও ওকে লক্ষ্য করে ডাকছে। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে ওর ডাকাডাকি আরো বেড়ে যেত। আমার বিছানার কাছে খোলা দরজার পাশেই মাটিতে ঘুমাত ও। সম্ভাব্য যে কোনো আক্রমণকারীকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে আমার কুকুর ভেবে নিশ্চিন্ত হতাম। সামনের দুই পা আমার বুকের ওপর রেখে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আমার মুখ চাটতে পছন্দ করত। আমার ছয় ফুটের ওপর উচ্চতা সত্ত্বেও ওর কোনো অসুবিধা হতো না। মাত্র এক বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ মারা যায় কুকুরটি। আর কোনো মৃত্যুতে এত কষ্ট পাইনি। আর কখনও কোনো কুকুর পুষিনি আমি। যে পশুর ডাক্তার ওকে দেখছিলেন, মৃত্যুর পর আমাকে ওর লোমগুলো রাখতে বলেছিলেন। আমি সম্মত হইনি। প্রাণপ্রাচুর্য্যে ভরা প্রিয়তম বন্ধুর হঠাৎ মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি আমি।

লোহার সিন্দুক যোগাড় হয়েছিল একটা যেটা কাজের চেয়ে যন্ত্রণার কারণ হয়েছিল বেশি। নতুন কেতার সিন্দুকটায় চাবির ব্যবস্থা ছিল না। তার বদলে ছিল একটা ডায়াল যেটা ঘুরিয়ে নম্বর মিলিয়ে খুলতে হতো। নম্বরের কম্বিনেশনটাকেই চাবি বলত। সেই চাবি, অর্থাৎ নম্বরের বিন্যাস আবার ইচ্ছামতো বদলানো যায়। কিন্তু সংখ্যার বিন্যাসটা লিখে রাখা যাবে না। মুখস্থ রাখতে হবে। সংখ্যা আমার কখনোই মনে থাকে না। ফলে আমার দশাটা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ফলে নিয়ম ভেঙে আমি নম্বর লিখে রাখতে শুরু করলাম। প্রতিদিন বদলাতাম আর লিখেও রাখতাম। এই যন্ত্রণা বেশি দিন অবশ্য পোহাতে হয়নি। তার কারণ, আমার জন্য বিপ্লবের কারণ কাছেই চলে এল। সেটা আর সাত সমুদ্র পার হয়ে দূরের কোনো দেশে নিহিত ছিল না। তাছাড়া, কতিপয় ভারতীয় বিপ্লবীও আমার ভার আংশিক লাঘবে এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁরা নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন লুটের মালের বৈধ দাবিদার তাঁরাও।

আমার প্রথম চিন্তা ছিল নতুন কমরেডদের স্বদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। সেই চেষ্টা আমি অব্যাহত রেখেছিলাম এবং কাজটা পেরে ওঠার বাস্তব সম্ভাবনাও ছিল। প্রস্তুতি গ্রহণের কাজে আশার নমুনা হিসেবে কিছু টাকা ওখানে পাঠাতে চাইছিলাম। কিন্তু আমার যোগাযোগগুলো হারিয়ে গিয়েছিল। রাসবিহারী তখন জানালেন ভারতের সঙ্গে ওঁর সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে। রাসবিহারীর ওপর নির্ভর করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। জার্মান মিনিস্টার যে চীনা ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর হাত দিয়ে রাসবিহারীকে ২০ হাজার টাকার সমমানের অর্থ পাঠালাম। সঙ্গে অনুরোধ জানালাম, রাসবিহারী যেন টাকাটা ভারতে নির্দিষ্ট কিছু বিপ্লবীর হাতে পৌঁছে দেন। টাকাটা যে জায়গামতো পৌঁছে গেছে সেটা জার্মানরা আমাকে জানিয়েছিলেন। রাসবিহারীর হাতে টাকা দিয়ে চীনা ব্যবসায়ী ইউনানের গভর্নরের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন, জার্মানরা আমাকে এরকমটাই জানালেন। বেশ কয়েক বছর পরে জানতে পেরেছিলাম সেই টাকা গন্তব্যে পৌঁছায়নি। টাকাটার কী গতি হয়েছিল আজও পর্যন্ত জানি না। অবশ্য জানার কোনো আগ্রহও নেই।

আমি অবশ্য চীনা দূতের ওপর পুরোপুরি ভরসা না করে আমেরিকায় কয়েকজন ভারতীয় বিপ্লবীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। এদের একজন এসে আমায় জানালেন, গদর্ পার্টির কয়েকজন সদস্য যারা আগে চীনে ছিল তারা আবারও যে কোনো কাজের ভার নিয়ে চীনে যেতে আগ্রহী। এই বিপ্লবী স্বেচ্ছাসেবীদের ব্যাপারে খুবই সন্দিহান ছিলাম আমি। খুব সম্ভব গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে তারা আমেরিকা ছাড়তে চায়। যে ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন তিনি নিজে যেতে পারবেন না। কারণ হিসেবে জানালেন, ইতিমধ্যে তিনি ওয়াশিংটনের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ স্থাপন করেছেন এবং ভারতের সপক্ষে মার্কিন দেশে জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে চলেছেন। উনি আমাকে বোঝালেন, আমার কাছে যে টাকা আছে তার সর্বোত্তম ব্যবহার হবে যদি তাঁর আন্দোলনকে অর্থায়ন করা হয়। তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে ওয়াশিংটনে তাঁকে ভাল ভাল কর্মীসমেত অফিস রাখতে হবে, সিনেটর ও কূটনীতিকদের জন্য নিয়মিত পার্টি দিতে হবে এবং তাঁর নিজেকে প্রচুর ভ্রমণ করতে হবে।

টাকাটা যেহেতু সুনির্দিষ্ট কাজের জন্য রাখা ছিল সেজন্য তাঁর আন্দোলনের পেছনে ব্যয় করা সম্ভব ছিল না। অবশ্য তাঁর আন্দোলনের ব্যাপারেও খুব একটা আস্থা ছিল না আমার। তাঁকে ‘না’ বলায় সাঙ্ঘাতিক ক্ষেপে গিয়ে আমার বিশ্বাসঘাতকতার কথা ভারতে লিখে জানাবেন বলে হুমকি দিলেন। উনি ওদেশে পুরানো প্রবাসী ছিলেন না। ভারতে আমি চিনতাম তাঁকে। পরে পড়াশোনার জন্য আমেরিকায় গিয়েছিলেন। তারপর অ্যাগনেস স্মেডলির প্রভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের মতো বড় বড় ব্যাপারে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। অ্যাগনেস স্মেডলির সঙ্গে আমার যখন নিউইয়র্কে দেখা হয় তখন তিনি বোহেমীয় ধরনের নৈরাজ্যবাদী আদর্শের অনুসারী ছিলেন। লাজপত রাইয়ের সেক্রেটারির কাজ করার সময় ভারত সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন অ্যাগনেস।

আমাদের পরিকল্পনার সঙ্গে ছেলেটির যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় আমি তাকে মেক্সিকোতেই থাকতে পরামর্শ দিলাম। কিন্তু না, তাঁকে আমেরিকায় ফিরতেই হবে। ম্যালা কাজ পড়ে আছে সেখানে। তবে ফেরার সময় তিনি সানফ্রান্সিসকো হয়ে ফিরবেন। সেখানে চীন যেতে প্রস্তুত দুজনকে রওনা করিয়ে দেবেন। সেজন্য আমার কাছ থেকে দু’হাজার ডলারও নিলেন। মেক্সিকো-আমেরিকার সীমান্তের প্রথম গন্তব্যে পৌঁছেই তিনি আমাকে অত্যন্ত অপমানজক ভাষায় চিঠি লিখলেন। তারপর সরাসরি নিউইয়র্ক চলে গেলেন। সানফ্রান্সিসকোর সেই দু’জন বিপ্লবীরও চীন যাওয়া হয়নি।

মহাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটা শেষমেশ ঘটল। কাইজারের প্রিভি কাউন্সিলর গোপন মিশন নিয়ে মেক্সিকো পৌঁছালেন। কয়েকদিন পরে তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটল। দেখলাম ইনি নতুন ধরনের জার্মান। বুদ্ধিজীবী ও বেসামরিকসুলভ। এর আগে যতজন জার্মানের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে সকলেরই হাবভাব ও আচরণে কমবেশি সামরিক প্রভাব ছিল। কারণটা সম্ভবত তরুণ বয়সের বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ। এই উচ্চপদের জার্মানকে সহজেই সংস্কৃতিবান ইংরেজ ভদ্রলোক বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। রীতিমতো অক্সফোর্ডের চৌকস যুবার মতো আচরণ। ভদ্রলোকের মধ্যে দেখানেপনা ব্যাপারটি একেবারে অনুপস্থিত। শুরু থেকেই তাঁর সাহচর্যে অত্যন্ত স্বস্তি বোধ হলো আমার। তাঁর মধ্যে করুণাব্যঞ্জক আচরণের ছিটেফোঁটাও নেই, যেটা প্রায় সময়ই আমার চরম বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

প্রথম বৈঠকে কোনো কাজের কথা হলো না। অধিকাংশ সময় জার্মানির পরিস্থিতি নিয়ে কথা বললেন তিনি। তবে এসব ক্ষেত্রে সাধারণত জার্মানদের মধ্যে যে গর্বের সুর থাকে সেটা তাঁর মধ্যে দেখলাম না। একা হাতে সারা পৃথিবীর সঙ্গে লড়া সহজ কথা নয়। জার্মানির মিত্রদের ব্যাপারে কিছু অপ্রীতিকর মন্তব্যও করলেন। যুদ্ধে আমেরিকার যোগদান জার্মানির জন্য পরিস্থিতি কিছুটা বিরূপ করে তুলেছে, সেটাও বললেন। তবে পূর্ব ফ্রন্টে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। রাশিয়ায় ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর ফ্রন্টে তাদের প্রতিরোধ পুরো ভেঙে পড়েছে। সৈন্যদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে কেরেন্স্কি যতই চেষ্টা করুন না কেন লাভ হবে না কোনো। আরেকদিকে লেনিনের শান্তির পক্ষে প্রচারণা সেনাবাহিনীর মধ্যে আরো চিড় ধরাচ্ছে। বিসমার্কের নীতি আক্ষরিকভাবে অনুসরণ করে জার্মানির উচিত এখনই পূর্ব সীমান্তে সর্বশক্তি নিয়োগ করে ঝাঁপিয়ে পড়া। সেটা করলে পরে কোনো বাধা ছাড়াই জার্মান বাহিনী ককেশাস পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। এখনই ইউক্রেন অবধি পৌঁছে গেছে তারা। তারপর ভারত থেকে ব্রিটিশদের তাড়াতে একটা ধাক্কাই যথেষ্ট। পুরো সময়টা ভদ্রলোক একইরকম ঠাণ্ডা নিচু স্বরে কথা বলে যাচ্ছিলেন। বোঝাই যায় একালের আলেকজান্ডারের বাহিনীর বিশ্বজয়ের চিত্রটি তাঁর চোখের সামনে ভাসছিল। কিন্তু সেই উত্তেজনার ছিটেফোঁটা আভাস তাঁর গলায় ছিল না।

আধবোজা চোখে আমার দিকে মিটিমিটি তাকালেন তিনি। “ইম্পেরিয়াল জেনারেল স্টাফ আপনার পরিকল্পনায় আগ্রহী হতে বাধ্য”। আমি কিছু বলার আগেই কিছুটা স্বগতোক্তির মতো করে বলে উঠলেন, “পশ্চিম ফ্রন্টকে কিছুদিন ধরে রাখতে হলে আমাদের আমেরিকাকে পেছনদিকে আক্রমণ করতে হবে। সেই অপারেশনের ভিত্তি হবে মেক্সিকো। প্রেসিডেন্ট কাররান্সা যাতে মনরো ডকট্রিনের বিরুদ্ধে লাতিন আমেরিকান বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন সেজন্য তাঁকে তাতিয়ে দিতে হবে এবং সাহায্যও করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় আমাদের বহু অন্তর্ঘাত ঘটাতে হবে।”

সামনের কোনো এক দিনে আবার মিলিত হওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়ে আমরা বিদায় নিলাম। কেন মেক্সিকোতে জার্মানরা এত ভিন্ন ধরনের আচরণ করছে সেটা আমার কাছে এখন পরিষ্কার হয়ে গেল। ভারতে বড় ধরনের সমস্যা ঘটাতে পারলে ইউরোপে যুদ্ধ জয়ের পথ সুগম হবে তাদের। কিন্তু এটা ছিল ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মরিয়া চেষ্টার মতো। জার্মানি অপরাজেয় - এই রহস্যময় ইন্দোআর্য বিশ্বাসে আমার আর আস্থা রইল না। তবে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে অংশ নেওয়ার উত্তেজনাই আলাদা। অতএব আমার খেলার ক্ষেত্রটা বেছে নিতে হবে আমাকে। ইয়াঙ্কি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লাতিন আমেরিকান ঐক্য তৈরির ভাবনাটা বেশ চিত্তাকর্ষক। এর মাধ্যমে দক্ষিণ আমেরিকার সরকারগুলোর মধ্যে আমাদের গুরুত্ব বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে। এই চেষ্টার শুরু হবে মেক্সিকো দিয়ে। কিছু মৌলিক সংস্কারের মাধ্যমে সরকারের অবস্থান শক্ত করার মধ্য দিয়ে সেটা করা যেতে পারে। এসব সংস্কারে সাধারণ মানুষ বিপুল সমর্থন দেবে। আমার সেই কাজের মূল ফলাফল দাঁড়াল এই যে, এর ফলে পুরো লাতিন আমেরিকায় সমাজতন্ত্রের দাবি ফ্যাশনেবল হয়ে উঠল। তার আগে পর্যন্ত এসব দেশে বামধারার আন্দোলন ছিল নৈরাজ্য-সিন্ডিকেটবাদীদের মধ্যে সীমিত। তাদের বক্তব্যে জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। ফলে আমেরিকার যে কোনো হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে, হোক সেটা প্রত্যক্ষ কি পরোক্ষ, অর্থনৈতিক কি রাজনৈতিক, তারা পুরোপুরি উদাসীন থাকত। দুই পুঁজিবাদী সরকারের মধ্যে যে কোনো একটাকে বেছে নেওয়ার আবার কী আছে? এই ছিল তাদের বক্তব্য। সাধারণ মানুষের উদাসীনতার কারণে বিদেশী শক্তির সামরিক আগ্রাসন বা শান্তিপূর্ণ অনুপ্রবেশ কোনোটার বিরুদ্ধেই জোরদার প্রতিরোধ গড়ে তোলা কার্যত সম্ভব ছিল না। উচ্চবর্গীয় মহলে সমাজতন্ত্রের আলোচনা হতো। এসব আলোচনা থেকে দেশের রাজনীতিতে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা যে ক্রমশ বাড়ছিল তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। যে নতুন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে আগাচ্ছিলাম তাতে আমার এই ভূমিকা ভাল করেছিল কি খারাপ করেছিল তা জানি না। তবে এতে আমার যে দায় ছিল তা অস্বীকার করতে পারি না।

আমার পরবর্তী ভবিষ্যৎ ঠিক হয়ে গেল জার্মান বন্ধুদের সঙ্গে পরের বৈঠকে। সেখানেও গেহেমরাটই কথাবার্তা শুরুর উদ্যোগ নিলেন তাঁর স্বভাবসুলভ মৃদু চালে। চীন থেকে অস্ত্র কেনার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আর দেরি করা চলবে না। চুক্তি করার পর এক বছরের ওপর পার হয়ে গেছে। এজন্য দরকারি অর্থ সংগ্রহ কঠিন হবে না। অ্যাডমিরাল ভন হিন্টজে পররাষ্ট্র মন্ত্রী হয়ে বার্লিনে ফিরেছেন। আমার চীনবাসের সময় ইনি সেখানে জার্মানির রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি পিকিংয়ে নিযুক্ত তাঁর উত্তরসূরীর কাছে জরুরি বার্তা পাঠাবেন যেন ডিউটশে অস্টাশিয়াটিশে (জার্মান ইস্টএশিয়াটিক) ব্যাংকের স্থগিতকৃত সম্পদের অংশবিশেষ বিক্রি করে দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু করার আগে আমাকে অবশ্যই সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে। হের কাপিটায়েন জেড (জাভায় আমার অন্যতম জার্মান বন্ধু) ইম্পিরিয়াল জেনারেল স্টাফের প্রতিনিধি হিসেবে দূরপ্রাচ্যে যাবেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী আমাকে সহায়তা করবেন। যেহেতু ওখানে সম্পদ বিক্রি থেকে প্রাপ্ত আয় পুরোটাই অস্ত্র কেনায় ব্যয় হবে সেহেতু এই বিপদসঙ্কুল যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে প্রাথমিক খরচাদির জন্য পঞ্চাশ হাজার ডলার দেওয়া হবে আমাকে। বিপদের কথাটা গেহেমরাটই বললেন। সত্যি সত্যি উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল তাঁকে। আর আমি তখন নতুন অভিযানের গন্ধে বিভোর...

কয়েকদিন পর তৃতীয় বৈঠকে মিলিত হলাম আমরা। সেখানেই আমার রাজনৈতিক জীবনের পরবর্তী পর্যায় সূচিত হলো। এর মধ্যে দূতাবাসের এক আনুষ্ঠানিক নৈশভোজ ছিল। সেখানে আমার উপস্থিতির কোনো কারণ নেই। কিন্তু ব্যারনেস ভ্যান শেনের কাছ থেকে রহস্যময় চিরকুট এল। তাতে তিনি বার্তা দিয়েছেন সন্ধ্যাবেলায় নিজে উপস্থিত হয়ে আমাকে কোনো এক অজানা গন্তব্যে নিয়ে যাবেন। তিনি যথাসময়ে একাকী উপস্থিত হলে আমি আরো বিস্মিত হলাম। সদর দরজা বন্ধ হলে পরে যেন আমার বিস্ময়ের কারণ অনুমান করেই হালকা চালে তিনি বলে উঠলেন, “ওরকম ভীরু খরগোশের মতো করে তাকাবেন না তো! আমি কোনো মার্কিন গুপ্তচর না বা আপনার সঙ্গে পালানোর মতলব করেও আসিনি।” তারপরই গম্ভীর হয়ে গিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ার জন্য তাড়া লাগালেন। জানলাম আমাকে দূতাবাসের নৈশভোজে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছেন তিনি। আনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রণ পাইনি বলে আমি যেন ইতঃস্তত না করি। ওখানে বিশেষ অতিথি হিসেবে যাব আমি। “আপনার এসকোর্ট কে তা দেখে নিশ্চয়ই গুরুত্বটা বুঝতে পারছেন,” কৌতুকচ্ছলে বললেন ব্যারনেস।

আমাদের বহনকারী বিলাসবহুল লিমুজিন ভোজসভাস্থলের খিড়কি দরজায় এসে থামল। এক সেকেন্ডের মাথায় আমরা একটা আলোকজ্জ্বল ঘরে পা রাখলাম। রীতিমতো গোয়েন্দা গল্পের ব্যাপারস্যাপার। বিস্ময় কাটতে না কাটতেই গেহেমরাট হেঁটে এলেন। আমার সুখ্যাত এসকোর্টকে সুপ্রচুর ধন্যবাদ জানালেন প্রথমে। জবাবে ফুট কাটলেন ব্যারনেস, “হুঁ, নিষ্ক্রান্ত হতে ইঙ্গিত! নাচ করিগে যাই।” এরপর বিনা বাক্যব্যয়ে আমার বাহুতে হাত রাখলেন গেহেমরাট। বললেন, তিনি আমাকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে যাচ্ছেন। কথা বলতে বলতেই আমায় নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন। করিডোর পেরিয়ে বিশাল এক দোরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দ্বার উদ্ঘাটিত হলো। অসামান্য রূপে সজ্জিত সুবিশাল এক কক্ষে পা রাখলাম আমরা। ঈষৎ লম্বা কাঁচাপাকা শ্মশ্রুশোভিত, অত্যন্ত সজ্জন মর্যাদাশীল মুখশ্রীর এক সুপুরুষ আমাদের এগিয়ে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। গণপ্রজাতন্ত্রী মেক্সিকোর মহামান্য রাষ্ট্রপতি জেনারেল ডন বেনুস্তিয়ানো কাররান্সা। রাষ্ট্রপতি করমর্দনের জন্য আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে সানন্দ গভীর স্বরে স্প্যানিশ ভাষায় শুভসন্ধ্যা জানালেন, “বুয়েনাস নোচেস”। জানলাম যুদ্ধমন্ত্রী তাঁকে আমার সম্পর্কে অবহিত করেছেন। লা সেনোরিতা অমুকও (আদতে লা মুহের মদের্না) জানিয়েছেন। মেক্সিকোতে আমি কিছুদিনের জন্য বাস করব জানতে পেরে প্রজাতন্ত্রের মহামান্য রাষ্ট্রপতি অত্যন্ত প্রীত হয়েছেন। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে, মেক্সিকোর জনগণের প্রতি সহানুভূতি ও শুভেচ্ছা বোধ করেন এমন যে কোনো ব্যক্তি সেদেশে স্বাগত এবং তিনি যাতে স্বস্তিতে এদেশে বসবাস করতে পারেন তার যাবতীয় ব্যবস্থা মেক্সিকোর মানুষ করবে। রাষ্ট্রপতির সদালাপের মধ্যেই আমার সম্বিৎ ফিরে এল। ফলে আমি যে কতটা কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ হলাম উপযুক্ত শব্দচয়নে তা তাঁর কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হলাম।

এরপর গেহেমরাটের কথা বলার পালা। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমার আসন্ন অভিযান সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবহিত এবং এ ব্যাপারে যাবতীয় ব্যবস্থা করার জন্য সানুগ্রহ প্রতিশ্রুতি জ্ঞাপন করেছেন। অভিযান শেষে যদি আমি মেক্সিকোতে ফিরে আসি তবে প্রস্তাবিত লাতিন আমেরিকান ইউনিয়ন বিষয়ে আমার ভূমিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সানন্দে প্রস্তুত থাকবেন।

রাষ্ট্রপতি করমর্দনের পর “শুভরাত্রি” ও “সৌভাগ্য হোক” সম্ভাষণে বিদায় জানালেন। দরজার বাইরে করিডোরে এসে গেহেমরাট বললেন, “আমরাও এখানে বিদায় নিই। আগামীকাল ফিরে যাচ্ছি আমি আর্জেন্টিনা হয়ে। আপনার সম্পূর্ণ সাফল্য কামনা করছি।”

পাদটীকা:

১. রাসবিহারী বসু। Rash Behari Bose. ১৮৮৫-১৯৪৫। মতান্তরে জন্ম ১৮৮৬। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার সুবলদহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কৈশোর থেকে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হন। গদর্ বিদ্রোহের অন্যতম সংগঠক ছিলেন এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় টোকিওতে “প্রথম ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী” প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪২ সালে এই বাহিনীকে তিনি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর হাতে তুলে দেন যার নাম হয় “ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি”। আজাদ হিন্দ ফৌজ নামেও এ বাহিনী খ্যাত। রাসবিহারী বসু ফ্রান্স ও জার্মানি থেকে চিকিৎসাবিদ্যা ও প্রকৌশলে ডিগ্রি নেন। কৈশোর থেকেই রাসবিহারী বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। ১৯১২ সালে দিল্লীতে লর্ড হার্ডিঞ্জকে হত্যার উদ্দেশ্যে যে বোমা হামলার পরিকল্পনা হয় তার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন রাসবিহারী। বোমা হামলাটি ব্যর্থ হলে অনেক বিপ্লবী গ্রেপ্তার হন কিন্তু রাসবিহারী লুকিয়ে পড়তে সক্ষম হন। এরপর প্রথম মহাযুদ্ধের সময় গদর্ বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন রাসবিহারী। এ বিদ্রোহও ব্যর্থ হয় এবং রাসবিহারীর সহযোগীদের অনেকে গ্রেপ্তার হন। রাসবিহারী জাপানে পালিয়ে যান। ব্রিটিশ সরকার রাসবিহারীকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য জাপান সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। জাপানে নির্বিঘ্নে বাস করার জন্য শুভাকাঙ্ক্ষিদের ব্যবস্থায় তিনি জাপানী নারী তোশিকো সোমাকে বিবাহ করেন। এই দম্পতির দু’টি ছেলেমেয়ে হয়। জাপানে সতীর্থ বিপ্লবী এ এম নায়ার এবং রাসবিহারী সেদেশের সরকারকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হন। জাপান সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পাশে দাঁড়াতে সম্মত হয়। ১৯৪২ সালে টোকিওতে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেন রাসবিহারী ও সতীর্থরা। সম্মেলনে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এখানেই রাসবিহারী ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী গঠনের প্রস্তাব করেন যা সে বছরই বাস্তবায়িত হয়। ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের ব্যাংকক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন রাসবিহারী। এই সম্মেলনেই সুভাষচন্দ্র বসুকে লিগে যোগদান এবং এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীকালে সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্বভার অর্পণ করেন। রাসবিহারী বসু যক্ষারোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে জাপান সরকার তাঁকে অর্ডার অব দ্য রাইজিং সান শীর্ষক দ্বিতীয় সারির রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ভূষিত করে।

তথ্যসূত্র: https://en.wikipedia.org/wiki/Rash_Behari_Bose দেখা হয়েছে - ৩রা মার্চ ২০২৩।

https://www.indiatoday.in/education-today/gk-current-affairs/story/rash-behari-bose-325390-2016-05-25 দেখা হয়েছে - ৩রা মার্চ ২০২৩।

২. গদর্ পাটি (ইংরেজি বানান - Ghadar, Ghadr or Gadar)। বিশ শতকের শুরুতে প্রবাসী ভারতীয়দের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন। পাঞ্জাবি ও উর্দু ভাষার শব্দ গদর্-এর অর্থ বিদ্রোহ। প্রতিষ্ঠাকাল ১৯১৩ সালের ১৫ই জুলাই। গদর্ আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূল ও কানাডায় বসবাসরত প্রবাসী ভারতীয়দের হাতে। এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মোহন সিং ভাকনা। এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন আরো ৩৩জন বিভিন্ন ভাষাভাষী, ধর্ম ও জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামী। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গদর্ আন্দোলনে সম্পৃক্তরা ভারতে অস্ত্র পাচার করে নিয়ে আসেন এবং বিদ্রোহ সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। গদর্ বিদ্রোহ নামে পরিচিত এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। ধৃতদের লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে বিচার করা হয়। এতে ৪২ জনের ফাঁসি হয়। ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ পর্যন্ত গদর্ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সংগ্রামীরা জার্মানি ও অটোমান শাসনাধীন তুরস্কের সহায়তায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র নামে খ্যাত এই আন্দোলনে জড়িতদের ১৯১৭ সালে সানফ্রান্সিসকোয় এক সাড়া জাগানো মামলায় বিচার হয়।

তথ্যসূত্র: https://en.wikipedia.org/wiki/Ghadar_Movement

৩. অ্যাগনেস স্মেডলি। Agnes Smedley. ১৮৯২-১৯৫০। মার্কিন সাংবাদিক, লেখক এবং অধিকারকর্মী। অ্যাগনেস স্মেডলি বিশেষভাবে খ্যাত চীনের কমিউনিস্ট বিপ্লব সংঘটনকালীন সেখানকার পরিস্থিতি এবং তাঁর অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে লেখা নিবন্ধ ও বইগুলোর জন্য। স্মেডলির বাবা ছিলেন খনিশ্রমিক। মিসৌরি ও কলোরাডোয় বড় হয়েছিলেন। কৈশোর থেকেই উপার্জনের পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছিলেন অ্যাগনেস। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় জন্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। এসময়ই তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রখ্যাত নেতা লালা লাজপত রাইয়ের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন লাজপত রাইসহ ভারতীয় বিপ্লবীদের একাংশ জার্মানিকে গোপনে সহযোগিতা করেন যা ফাঁস হলে সানফ্রান্সিসকোয় বিচারের মুখোমুখি করা হয়। “হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র” নামে খ্যাত সেই মামলার অন্যতম আসামী মানবেন্দ্রনাথ রায় ও শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ মেক্সিকোতে পালিয়ে যান। তাঁরা নিজেদের অনুপস্থিতির সময়টাতে অ্যাগনেস স্মেডলিকে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের কার্যক্রম সমন্বয় এবং মিত্রশক্তিবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যেতে নিয়োজিত করেন। এসব কার্যক্রম চালানোর অন্যতম আর্থিক উৎস ছিল জার্মান সরকার প্রদত্ত অর্থসহায়তা। স্মেডলির এসব তৎপরতায় মার্কিন ও ব্রিটিশ উভয় গোয়েন্দা সংস্থার নজর পড়ে এবং তিনি ১৯১৮তে গ্রেপ্তার হন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তিনি ১৯১৯ সালে মুক্তি পান। এরপর চলে যান জার্মানিতে। এখানে ভারতীয় বিপ্লবী বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ১৯১৯ থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত একত্র বসবাস করেন। ১৯২৯ সালে তাঁর আত্মজীবনীভিত্তিক উপন্যাস ডটার অব আর্থ প্রকাশিত হয়। ১৯২৮ সালেই জার্মানির Frankfurter Zeitung পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি হয়ে চীন যান। সেখানে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেন। ১৯৩০ পর্যন্ত এই পত্রিকার জন্য কাজ করেন। এরপরে বিভিন্ন পত্রিকার জন্য লেখালেখি চালিয়ে যান। তাঁর Battle Hymn of China  (১৯৪৩) বইটি যুদ্ধ সাংবাদিকতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে প্রশংসিত হয়েছে। ১৯৪১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন অ্যাগনেস এবং চীনের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমর্থনে লেখালেখি ও প্রচারণা চালিয়ে যান। এর ফলে গোয়েন্দাদের নজরে আসেন। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা তাঁকে ১৯৪৯ সোভিয়েত গুপ্তচর হিসেবে অভিযুক্ত করে, যদিও তা প্রমাণিত হয়নি। সেবছরই তিনি ইংল্যান্ড চলে যান। এখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অস্ত্রোপচারের পরে মারা যান। তাঁর চিতাভস্ম বেইজিঙের বাবাওশান বিপ্লবী সমাধিস্থলে রক্ষিত আছে।

তথ্যসূত্র: https://en.wikipedia.org/wiki/Agnes_Smedley  

https://www.britannica.com/biography/Agnes-Smedley

https://spartacus-educational.com/USAsmedleyA.htm

৪. লাজপত রাই। দশম অধ্যায়ের টীকা দেখুন।

৫. গেহেমরাট। Geheimrat. Privy councilor. রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত রাজ্যগুলোতে সম্রাট, রাজা বা রাজপুত্রদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের উপদেষ্টাদের গেহেমরাট বলা হতো। পরবর্তীকালে জার্মানভাষী ইউরোপীয় রাজতন্ত্র শাসিত বিভিন্ন দেশে পদবীটি চালু ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত।

৬. ডিউটশে অস্টাশিয়াটিশে (জার্মান ইস্টএশিয়াটিক) ব্যাংক। Deutsche Ostasiatische Bank.