উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র ইয়ং-হাই নামের একজন নারী যিনি খাদ্য গ্রহণের নিয়ম মেনে চলতে অস্বীকার করেন
Published : 11 Oct 2024, 07:56 PM
১০ অক্টোবর, ২০২৪, এ বছরের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার স্বনামধন্য লেখক হান কাং এ সম্মানে ভূষিত হন। তিনিই প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ান লেখক যিনি এ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। হান কাং ১৯৭০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজু শহরে জন্মগ্রহণ করেন। নয় বছর বয়সে তিনি তার পরিবারের সাথে সোলে স্থানান্তরিত হন। তিনি একটি সাহিত্যিক পরিবারের উত্তরসূরি। তার বাবা একজন স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক। দক্ষিণ কোরিয়ার সোলে অবস্থিত ইওনসেই বিশ্ববিদ্যালয়ে হান কাং কোরিয়ান সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন।
১৯৯৩ সালে 'লিটারেচার অ্যান্ড সোসাইটি' ম্যাগাজিনে কিছু কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে তিনি তার লেখকজীবন শুরু করেন। পরের বছর গল্পকার হিসেবে তিনি আবির্ভূত হন, তার রচিত ছোট গল্প 'The Scarlet Anchor' 'সোল শিনমুন স্প্রিং লিটারেরি কনটেস্ট' এ বিজয়ী হয়। লেখার পাশাপাশি, তিনি নিজেকে শিল্প ও সঙ্গীতেও আত্মনিয়োগ করেছেন যার প্রতিফলন আমরা তার সামগ্রিক সাহিত্য রচনায় দেখতে পাই। তিনি তার প্রথম উপন্যাস 'দ্য ভেজিটেরিয়ান' এর জন্য সাহিত্য সমাজে সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং এ উপন্যাসটির জন্য তিনি আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি অর্জন করেন। উপন্যাসটি ২০০৭ সালে কোরিয়ান ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয় এবং ২০১৫ সালে বইটি ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ডেবোরা স্মিথ। ২০১৬ সালে উপন্যাসটি ইংরেজি অনুবাদে প্রথম কোরিয়ান ভাষার উপন্যাস হিসেবে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারে ভূষিত হয়। যার কৃতিত্ব লেখক ও অনুবাদক দুজনেরই। উপন্যাসটি নিউইয়র্ক টাইমস বুক রিভিউয়ের ২০১৬ সালের শ্রেষ্ঠ ১০ টি বইয়ের একটি হিসেবে স্থান পেয়েছিল।
উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র ইয়ং-হাই নামের একজন নারী যিনি খাদ্য গ্রহণের নিয়ম মেনে চলতে অস্বীকার করেন এবং নিজের খাদ্যাভাসে আমূল পরিবর্তন আনেন যার পরিণতি হয় খুব হিংসাত্মক।
তার অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে 'দ্য হোয়াইট বুক', 'হিউম্যান অ্যাক্টস', 'উই ডু নট পার্ট' ও 'গ্রিক লেসনস'। 'দ্য হোয়াইট বুক' উপন্যাসটি ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের জন্য শর্টলিস্টেড হয়েছিল। হান কাংয়ের "প্রগাঢ় কাব্যিক গদ্য যা ঐতিহাসিক আঘাতকে মুখোমুখি আনে এবং মানবজীবনের ভঙ্গুরতা প্রকাশ করে"—এ বিষয়টিকেই নোবেল কমিটি তার সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
তার বহুল আলোচিত উপন্যাস 'দ্য ভেজিটেরিয়ান' এর ইংরেজি অনুবাদ থেকে কিছু অংশ নমুনাস্বরূপ পাঠকদের জন্য বাংলায় তর্জমা করা হলো:
'দ্য ভেজিটেরিয়ান'
লেখক: হান কাং
ইংরেজি ভাষার অনুবাদক: ডেবোরা স্মিথ
বাংলায় তর্জমা: নীলিমা রশীদ তৌহিদা
অধ্যায় ১
আমার স্ত্রী নিরামিষভোজী হওয়ার আগে আমি সবসময় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাকে বিশেষত্বহীন মনে করতাম। অকপটে বললে, এমনকি প্রথমবার যখন তার সাথে আমার দেখা হয়, আমি তার প্রতি আকৃষ্টও ছিলাম না। মাঝারি উচ্চতা; বব কাটিং চুল যা লম্বা বা ছোট কোনোটিই নয়; জণ্ডিসে আক্রান্ত, রোগাক্রান্ত চেহারা; কিছুটা লক্ষণীয় গাল; তার ভীরু ও নমনীয় বৈশিষ্ট্য আমাকে সব জানিয়েছিল যা আমার জানার দরকার ছিল। আমি যে টেবিলে অপেক্ষা করছিলাম যখন সে সেখানে এলো আমি তার জুতোর দিকে না তাকিয়ে পারলাম না। সাধারণ কালো জুতো এবং তার হাঁটাচলা দ্রুত বা ধীর কোনোটাই ছিল না; না সে লম্বা পা ফেলে হাঁটে, না মিনমিনিয়ে।
যদি নির্দিষ্ট কোনো আকর্ষণ না থাকতো কিংবা কোনো নির্দিষ্ট অপূর্ণতা যদি নিজেদের মধ্যে না থাকতো, তবুও আমাদের বিয়ে না করার কোনো কারণ ছিল না। এই মহিলার কৌতূহলশূন্য ব্যক্তিত্ব যার মধ্যে আমি সতেজতা বা মাধুর্য কিংবা বিশেষভাবে সুরুচিসম্মত কিছুর খোঁজ পাই নি, আমাকে সম্পূর্ণভাবে তার সাথে মানানসই করেছে। তাকে জয় করার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতাকে প্রভাবিত করার কোনো প্রয়োজন ছিল না কিংবা সে আমাকে ফ্যাশন ক্যাটালগগুলোতে পরিপাটি হয়ে ছবি তোলা পুরুষদের সাথে তুলনা করতে পারে এরকম চিন্তা করারও কোনো কারণ ছিল না। তাছাড়া, আমি আমাদের কোনো সাক্ষাতে দেরি করে এলে সে উত্তেজিত হয়ে যেতো না। কুড়িতেই আমার যে ভূরি দেখা যেতে শুরু করলো, আমার হাড্ডিসার পা ও বাহুগুলো যা আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও বিশালাকারে বাড়তে দিল না, আমার লিঙ্গের আকারে আমি যে হীনমন্যতায় ভুগতাম—তার ক্ষেত্রে আমাকে এই ধরনের বিষয় নিয়ে অস্থির হতে হবে না জেনে আমি নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম।
সবসময়ই আমি জীবনের মধ্যপন্থার দিকে ঝুঁকেছি। স্কুলে, আমি আমার নিজের বয়সীদের সাথে মেশার পরিবর্তে আমার চেয়ে দুই বা তিন বছরের ছোট এবং যাদের সাথে আমি রিং-লিডার হিসাবে কাজ করতে পারি তাদের চারপাশে নিজের প্রভাব বিস্তার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং পরবর্তীকালে, আমার প্রয়োজনের চেয়ে যথেষ্ট বড় বৃত্তি পাওয়ার সুযোগ যেখানে আছে তার ওপর ভিত্তি করে আমি কোন কলেজে আবেদন করবো সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত, আমি একটি ছোটো-খাটো কোম্পানিতে এমন একটি চাকরিতে স্থায়ী হয়েছি যেখানে আমার ওপর ন্যস্ত কাজগুলো পরিশ্রমের সাথে সম্পন্ন করার বিনিময়ে আমাকে একটি মানসম্পন্ন মাসিক বেতন দেওয়া হবে এবং আমার বিশেষত্বহীন দক্ষতাকে মূল্য দেওয়া হবে।
আর সেজন্য এটাই স্বাভাবিক ছিল যে আমি বিশ্বের সবচেয়ে আটপৌরে মহিলাকে বিয়ে করব। কারণ সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, আকর্ষণীয়ভাবে কামুক, ও ধনী পরিবারের মেয়েরা শুধু যত্ন সহকারে সজ্জিত আমার অস্তিত্বটাকে ব্যাহত করত।
আমার প্রত্যাশার সাথে তাল মিলিয়ে, সে একজন সম্পূর্ণ সাধারণ স্ত্রী হয়ে উঠেছিল যে কিনা কোনও বিরক্তিকর তুচ্ছতা ছাড়াই জীবনযাপন করছিল। ভাত, স্যুপ ও সাধারণত কিছুটা মাছ প্রস্তুত করতে সে প্রতিদিন সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠত। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে অদ্ভুত সব খণ্ডকালীন কাজের মাধ্যমে সে তার পারিবারিক আয়ে অবদান রাখতেন। যে-কম্পিউটার গ্রাফিক্স কলেজে সে এক বছরের জন্য পড়াশোনা করেছিল, সেখানেই সে সহকারী প্রশিক্ষক হিসেবে একটি চাকরি পায় এবং একটি কমিকের প্রকাশকের সাথে তাদের বক্তৃতার জন্য শব্দ নিয়ে কাজ করার জন্য একটি উপচুক্তি করেছিল এবং কাজটি সে বাড়িতে বসেই করতে পেরেছিল।
সে ছিল স্বল্পভাষী। আমার কাছে কোনো কিছুই সে দাবি করতো না, এবং আমি যতই দেরি করে বাড়ি ফিরতাম তা নিয়ে সে কখনই কোনো হট্টগোল করতো না। এমনকি যখন আমাদের ছুটির দিনগুলি মিলে যেতো, তখনও সে আমাদের একসাথে কোথাও বেড়াতে যাওয়া নিয়ে কোনো পরামর্শ দিত না। বিকেলে যখন অলসভাবে আমি টিভির রিমোট নিয়ে বসে থাকতাম, সে তখন তার ঘরে নিজেকে গুটিয়ে রাখতো। অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে সে নিজেকে বই পড়ায় বেশি ব্যস্ত রাখতো যা বাস্তবিকই তার একমাত্র শখ ছিল। কিছু অপ্রত্যাশিত কারণে, বই পড়া এমন কিছু ছিল যাতে সে নিজেকে সত্যিকার অর্থেই নিমজ্জিত করতে পারতো। এমন সব সস্তা বই পড়তো যে ওগুলোর প্রচ্ছদ দেখারও আগ্রহ হতো না। শুধু খাবারের সময় সে দরজা খুলে নীরবে খাবার তৈরি করতে হাজির হত। নিশ্চিতভাবে, এ রকম এক স্ত্রী,এবং এ ধরনের জীবনযাপনের মানে হল যে আমার দিনগুলোতে বিশেষভাবে উত্তেজক কোনোকিছু খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল। অন্যদিকে, আমার যদি তেমন এক স্ত্রী থাকত যার ফোন সারাদিন বন্ধু বা সহকর্মীদের কলে বেজে উঠত, অথবা যাদের ক্রমাগত দোষারোপে স্বামীদের সাথে ক্রমশ চিৎকার-চেঁচামেচি হত, তাহলে সে যখন অবশেষে ক্লান্ত হয়ে যেত, তখন আমি কৃতজ্ঞতা বোধ করতাম।
একমাত্র যে-ক্ষেত্রে আমার স্ত্রী একেবারেই অস্বাভাবিক তা হলো সে ব্রা পরা পছন্দ করত না। যখন আমি সবেমাত্র কৈশোর পেরোনো এক যুবক ছিলাম এবং আমার স্ত্রী ও আমি প্রেম করছিলাম, তখন আমি তার পিঠে হাত রাখলে অনুভব করতাম যে তার সোয়েটারের নিচে কোনো ব্রা নেই। এবং এটা যখন আমি বুঝতে পারি তখন আমি খুব উত্তেজিত হয়ে উঠি। সে সম্ভবত আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছে কিনা তা বোঝার জন্য আমি দুই-এক মিনিট বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি এবং তার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করি। আমি লক্ষ্য করে বুঝলাম যে সে আসলে আমাকে কোনো রকম সংকেত পাঠানোর চেষ্টা করেনি। তাই যদি না হয়, তবে এটা কি শুধু অলসতা নাকি নিছকই উদ্বেগের অভাব? আমি এটা নিয়ে আর ভাবতে পারছিলাম না। এটা এমন নয় যে তার সুঠাম স্তন ছিল এবং ব্রা না পড়া তাকে মানাতো। আমি পছন্দ করতাম যদি সে ভালোভাবে বোনা কোনো কিছু পড়ে বাইরে চলতো যাতে আমি আমার পরিচিতজনদের সামনে মুখ রাখতে পারতাম।
এমনকি গ্রীষ্মকালে যখন আমি তাকে কিছুক্ষণের জন্য একটি ব্রা পরতে রাজি করাতে পেরেছিলাম,তখন সে বাড়ি থেকে বের হওয়ার এক মিনিটের মধ্যেই সেটি খুলে ফেলেছিল। ব্রার হুকটি তার পাতলা,হালকা রঙের শার্টের নিচে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান থাকতো যা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র মাথা ব্যাথা ছিল না।
আমি তাকে সেই উত্তপ্ত গরমে ভর্ৎসনা করে ব্রার পরিবর্তে একটি হাতাকাটা জামা বা ফতুয়া পরার পরামর্শ দিযেছিলাম। সে নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে বললো ব্রা পরে সে থাকতে পারে না কারণ এটা তার স্তন চেপে রাখে। সে বলেছিল যেহেতু আমি কখনো ব্রা পড়িনি তাই এটা যে কতটা সংকুচিত করে রাখে সেটা আমি বুঝতে পারি না।তথাপি, আমি জানতাম যে আরও অনেক মহিলা আছে যারা তার মতো ব্রার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় না, তাই আমি তার এই অতি সংবেদনশীলতা সম্পর্কে সন্দেহ করতে শুরু করেছিলাম।
অন্য সকল ক্ষেত্রে, আমাদের বিবাহিত জীবন মসৃণভাবে চলছিল। আমাদের বিবাহিত জীবন পাঁচ বছরের কাছাকাছি চলে এসেছিল এবং যেহেতু আমরা শুরু থেকেই প্রেমে পাগল ছিলাম না, তাই আমরা ক্লান্তি এবং একঘেয়েমির সেই পর্যায়ে পৌঁছানোর বিষয়টি এড়াতে সক্ষম হয়েছিলাম যা অন্যথায় বিবাহিত জীবনকে একটি পরীক্ষায় পরিণত করতে পারে।
একমাত্র বিষয় ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা নিজেদের জন্য একটি জায়গা সুরক্ষিত করতে না পারি ততক্ষণ আমরা বাচ্চার জন্য চেষ্টা করবো না। সেই সুরক্ষাটা সবেমাত্র শরতে সম্ভব হয়েছিল তাই আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম যে আমি নিজে কখনও নিশ্চিত 'বাবা' ডাকটি শুনতে পাব কিনা। গত ফেব্রুয়ারির এক নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত, যখন আমি আমার স্ত্রীকে সকালবেলা তার রাতের পোশাক পরে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম, তখনও আমি এ সম্ভাবনার কথা ভাবিনি যে আমরা একসাথে জীবনের এমন এক ভয়ংকর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে পারি।