বৈষ্ণব আন্দোলনের সঙ্কটময় সময়ে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেয়া ও বৈষ্ণব সমাজকে এক সুতায় বাঁধার ক্ষেত্রে জাহ্নবা দেবীর অবদান অনন্য।
Published : 02 Dec 2024, 07:12 PM
রূপ লাগি আঁখি ঝুরে
গুণে মন ভোর
প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে
প্রতি অঙ্গ মোর
ধুলোবালি সরিয়ে বৈষ্ণব সমাজের ইতিহাসের পাতায় উঁকি দিলে চোখে পড়বে বাংলার প্রথম নারী গোঁসাই বা গোস্বামীনীর মুখ। নাম যাঁর জাহ্নবা দেবী। এখন থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় কবি জ্ঞানদাস। তিনি মন্ত্রদীক্ষা নিয়ে শিষ্য হয়েছিলেন এই নারী গুরুর। কেবল জ্ঞানদাসই নয়, তাঁর শিষ্য ও ভক্তের সংখ্যা অগণিত। ষোড়শ শতকের সমগ্র বৈষ্ণব সমাজের নেতৃস্থানীয় ছিলেন এই জাহ্নবা দেবী। বাংলায় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার ও প্রসারে অত্যন্ত প্রভাবশালী ভূমিকা ছিল তাঁর।
পনেরশো শতকে পুরো ভারতবর্ষ কাঁপিয়ে দেয়া ভক্তি আন্দোলনের ঢেউ এসে লেগেছিল বাংলাতেও। ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের উদার হাওয়া মানুষের প্রাণে আশা ছড়িয়েছিল। ভক্তি আন্দোলন এবং চৈতন্য আন্দোলন বাংলায় জন্ম দিয়েছিল নারী আন্দোলনেরও। সেসময়ে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে নারীকে অনেকটা পেছনে রাখা হলেও ব্যতিক্রম ছিল বাংলা। শ্রী চৈতন্য ও তাঁর শিষ্যরা নারীকে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে গণ্য করেছিলেন। নারীরা এমনকি বৈষ্ণব আখড়ার কর্তাও হয়ে উঠেছিলেন। জাহ্নবা দেবী ছাড়াও হেমলতা ঠাকুরাণী, সীতাদেবী, শ্রী ঠাকুরাণী ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ মা-গুরু। মধ্যযুগে এ ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
বৈষ্ণব আন্দোলনের সূত্র ধরে সমাজে অবিসংবাদিত নেতৃত্ব দেয়া নারীদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অগ্রগণ্য জাহ্নবা দেবী। আখড়ায় নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই তার শিষ্যত্ব মেনেছে, ভক্তের কাছে তিনি ছিলেন ঈশ্বরী। তার আবাস ও বৈষ্ণবতীর্থ খড়দহেই শুধু নয়,অখন্ড বাংলার বৈষ্ণব সমাজের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনিই।
মূলত চৈতন্য ও তার প্রধান সহচর নিত্যানন্দের তিরোধানের পর বৈষ্ণবধর্মের নেতৃত্ব সঙ্কটকালে স্ত্রী গুরুরা এগিয়ে আসেন। নিত্যানন্দের স্ত্রী জাহ্নবা দেবী ছিলেন প্রথম নারী, যিনি সেসময় মন্ত্রদীক্ষা দেয়ার ক্ষমতা পেয়েছিলেন। শুধু তাই নয়,সমগ্র বঙ্গে বৈষ্ণব আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখতে তার বিশেষ ভূমিকা ও অবদান রয়েছে।
জাহ্নবা দেবীর জন্ম আনুমানিক ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দে। বৈশাখ মাসের শুক্লানবমী তিথিতে।
জন্মেছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পূর্ব বর্ধমান জেলার অম্বিকা কালনায়। বৈষ্ণবসাধক নরহরি চক্রবর্তীর ভক্তিরত্নাকর বইয়ে জাহ্নবার বাবা-মার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে—
ভদ্রাবতী নাম শ্রীজাহ্নবার জননী।
অতি পতিব্রতা সূর্যদাসের ঘরণী।।
সূর্যদাস পণ্ডিত সেসময়ের শাসক সুলতানের, সম্ভবত হুসেন শাহর দরবারে কাজ করতেন। পেয়েছিলেন সরখেল উপাধি। সূর্যদাসের ভাই গৌরীদাস পণ্ডিত ছিলেন নিত্যানন্দের দ্বাদশ গোপাল বা ১২ জন ঘনিষ্ঠ সহচরের একজন। বৈষ্ণব তাত্ত্বিকরা বলেন,মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য গৃহী হয়ে ধর্ম প্রচারের নির্দেশ দিলে ১৫২১ সালে নিত্যানন্দ বিয়ে করেন। তার কাছে বড় মেয়ে বসুধা ও পরে ছোট মেয়ে জাহ্নবাকে সম্প্রদান করেন সূর্যদাস। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার শহর খড়দহে তারা আবাস গড়ে ধর্মপ্রচারের কাজ শুরু করেন। নিত্যানন্দের ও জাহ্নবার কথা নিত্যানন্দ দাসের প্রেমবিলাস এবং নরহরি চক্রবর্তীর ভক্তিরত্নাকর-এ পাওয়া যায়।
বৈষ্ণব ধর্ম আন্দোলনে জাহ্নবা দেবীর তাৎপর্য বুঝতে হলে কিছুটা দৃষ্টি দিতে হবে ষোড়শ শতকে বৈষ্ণব ধর্মের গতি-প্রকৃতিতে। ফিরে যাই মধ্যযুগে বাংলার প্রাণপুরুষ শ্রী চৈতন্যে।
১. চৈতন্যের জাগরণের ডাক
তিন পাগলে হলো মেলা নদেয় এসে
একটা পাগলামি করে
জাত দেয় সে অজাতেরে দৌড়ে যেয়ে।
আবার হরি বলে পড়ছে ঢলে ধূলার মাঝে
বাংলায় শ্রী চৈতন্যের ভাব-আন্দোলনের ছবি স্পষ্ট লালন ফকিরের এই গানে। এই তিন পাগল অর্থাৎ চৈতন্য-নিত্যানন্দ-অদ্বৈত নদীয়ায় যে জাগরণের ডাক দিয়েছিলেন এ তারই বর্ণনা। আর পাগল ডাকবে নাই-বা কেন? চরম বর্ণাশ্রিত সমাজে ‘অজাত’কে যে জাত দিয়েছিলেন চৈতন্য।
তাঁর ধর্মই ছিল ভক্তি ও প্রেমের নামে সব জাতভেদ মুছে দেয়ার। চৈতন্য, যাঁর অন্য নাম ছিল গৌরাঙ্গ বা নিমাই,তাঁর নেতৃত্বে নদীয়ার নবদ্বীপ ও শান্তিপুরে যে বৈষ্ণবগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল তাতে জাতবিচার ছিল না। চৈতন্যের পরিকরদের দিকে তাকালেও তা দেখা যায়। তাঁর ৪৯০ জন পরিকরের মধ্যে ২৩৯ জন ছিলেন ব্রাহ্মণ,৩৭ জন বৈদ্য,২৯ জন কায়স্থ, এমনকি দুই জন মুসলমান এবং নারী ছিলেন ১৬ জন। (রমাকান্ত চক্রবর্তী, বঙ্গে বৈষ্ণব ধর্ম,পৃ. ৩৪)
চৈতন্য জাতে ব্রাক্ষ্মণ হলেও, মিশতেন শুদ্র ও অন্য পেশাভিত্তিক জাতির সাথে। নবদ্বীপে বা পরে সন্ন্যাস নিয়ে পুরীতে যাবার পরও চৈতন্য জাতকে বিচার্য করেননি। শুধু তাই নয়, বৈষ্ণব ধর্ম নারীকে দিয়েছিল পূর্ণ ধর্মীয় অধিকার। এমন কী, সমাজের ফেলে দেয়া বেশ্যা ও জারজদেরও চৈতন্যের ধর্ম স্থান দিয়েছে। চৈতন্যের সবচেয়ে পুরোনো জীবনী চৈতন্যভাগবত-এর রচয়িতা কবি বৃন্দাবন দাস লিখেছেন:
দানেকুলে পাণ্ডিত্যে চৈতন্য নাহি পাই।
কেবল ভক্তির বশ চৈতন্য গোসাই।
শোভাযাত্রাসহ নগরকীতর্ন করে ধর্মপ্রচার করতেন চৈতন্য। তাঁর ভক্তি প্রচারের মাধ্যম ছিল লোকের মুখের ভাষা বাংলা। চৈতন্য ও তাঁর পরিকররা পঞ্চোপাসনার বিষ্ণু বা পৌরাণিক বৈষ্ণব ধর্মের কথা বলেননি। ভাগবতপুরাণের কৃষ্ণলীলা মিশ্রিত ভক্তিই ছিল তার মতাদর্শ।
ষোড়শ শতকের আরেক বৈষ্ণব কবি, চৈতন্যচরিতামৃতর লেখক কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখেছেন,পুরীতে সন্ন্যাস নিয়ে যাবার পর চৈতন্য নিত্যানন্দ ও অদ্বৈত আচার্যকে বঙ্গে বৈষ্ণবভক্তি প্রচারের দায়িত্ব দেন।
গৌড়াঙ্গের প্রধান পরিকর ছিলেন নিত্যানন্দ। তাদের একসাথে গৌর-নিতাই বা নিমাই-নিতাই ডাকা হয়।
বহু তীর্থ ভ্রমণ করেছেন নিত্যানন্দ। তার জন্ম আনুমানিক ১৪৭৩ সালে ও তিরোধান ১৫৪০ সালে। নবদ্বীপ থেকে পরে খড়দহে তিনি ভক্তি প্রচারে আসেন। বিয়ে করে এখানেই কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলেন।
নিত্যানন্দ প্রায় একক প্রচেষ্টায় চৈতন্যের ধর্মান্দোলনকে অর্থবহ করে তুলেছিলেন।
গ্রামে গ্রামে গিয়ে চৈতন্যভক্তি প্রচার করেছেন। আনুমানিক ১৫১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণার পানিহাটিতে ঐতিহাসিক চিড়ামহোৎসবের আয়োজন করেন। দই চিড়ার এ উৎসবে জাতবিচার না করেই সবাই এক পঙক্তিতে খেয়েছেন। সম্ভবত বাংলার সমাজে জাতভেদ প্রথা বিলোপের এটিই প্রথম বড় পদক্ষেপ। সেময়ের প্রেক্ষাপটে আরও অভিনব এই যে, এ উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন নারীরাও।
নিত্যানন্দের নেতৃত্বে বাংলায় গড়ে উঠেছিল জাতবৈষ্ণব সমাজ। এই সমাজ বর্ণাশ্রয়ী নয়। যে কোনো বর্ণের মানুষ আগের নাম, গোত্র, পদবী ত্যাগ করে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নিয়ে এ সমাজে প্রবেশ করতে পারে। তারা হতে পারে গৃহী অথবা সংসারত্যাগী বৈরাগী। জাত বৈষ্ণব সমাজ অবৈদিক। তাদের জন্ম থেকে অশৌচের কোনো আয়োজনে আগুনের ব্যবহার হতো না, তাই ব্রাহ্মণ পুরোহিতের প্রয়োজনও তারা বাদ দিতে পেরেছিলেন।
নিত্যানন্দ এবং তার ছেলে বীরভদ্র বা বীরচন্দ্র বৌদ্ধ তান্ত্রিক সহজিয়া ধারার নেড়া-নেড়িদের বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত করে নিত্যানন্দের এ ধারাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। বৌদ্ধ আশ্রমের আদলে এক সময় বাংলার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছিল জাতবৈষ্ণবদের আখড়া।
এই আখড়াগুলোই সমাজচ্যুত নারীদের সহায় হয়ে উঠেছিল।
জনশ্রুতি রয়েছে, নিত্যানন্দের ধারা থেকেই পরবর্তীতে দেহবাদী সাধনচর্চার সহজিয়া বাউল ধারার উদ্ভব হয়। নিত্যানন্দের ছেলে বীরভদ্র এই ধারাকে এগিয়ে নেন। লেখক সুধীর চক্রবর্তী বৈষ্ণব ধর্মের সাথে বাউলদের কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মিল খুঁজে একে বর্ণনা করেছেন বৈষ্ণববিশ্বাসী এক নতুন উপধর্ম হিসেবে। (সুধীর চক্রবর্তী,গহীন নির্জন পথে,পৃ.২৩)
এছাড়া অন্তজ বাগদি, ডোম,বাউরি জাতি ছাড়াও আদিবাসীদের মধ্যে বৈষ্ণব ধর্ম প্রসার পেয়েছিল। আদিবাসী হাজোং বৈষ্ণবরা নিত্যানন্দ শাখার বৈষ্ণব রূপে পরিচিত। সুসং-দুর্গাপুরের আদিবাসী হাজোং নেতা পাথুরা হাজোংকে নিত্যানন্দ দীক্ষা দেন, তিনি জগন্নাথ দাস নামে সুপরিচিত ছিলেন। এছাড়া ত্রিপুরার বৈষ্ণবরাও নিত্যানন্দ শাখার বৈষ্ণব।
২. বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামী
নিত্যানন্দ,অদ্বৈত এবং একই মতের অনুসারী গদাধর পণ্ডিত, অচ্যুতানন্দ, নরহরি সরকারসহ বাংলার অন্য বৈষ্ণব প্রচারকরা কোনো শাস্ত্র রচনা করেননি, চৈতন্যের ভক্তিকেই ভক্তের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজ করেছেন। তাদের তিরোধানের পর রাঢ়ে-বঙে বৈষ্ণবদের বিভিন্ন দল উপদল গঠিত হয়। এসময় বৃন্দাবনের ছয় গোস্বামী-সনাতন, রূপ, রঘুনাথ দাস, গোপাল ভট্ট, রঘুনাথ ভট্ট ও জীব গোস্বামীর নেতৃত্বে বৈষ্ণব ধর্মকে শাস্ত্রীয় আকার দেয়ার কাজ শুরু হয়।
এর ভাষা নির্বাচন করা হয় সংস্কৃত।
গোস্বামীরা জঙ্গলে ঘেরা বৃন্দাবনকে মূর্তি ও মন্দির নির্মাণ করে একটি প্রধান বৈষ্ণবতীর্থ হিসেবে গড়ে তোলেন। কেবল আবেগ বা ভাব থেকে বের হয়ে বৈষ্ণব ধর্মের কর্মকাণ্ড নির্দিষ্ট করেন তারা। গৌড়ীয় বৈষ্ণব স্মৃতিশাস্ত্র হিসেবে যে সব বই গ্রহণ করা হয় তারমধ্যে গোপালভট্ট গোস্বামীর লেখা হরিভক্তিবিলাস অন্যতম।
তবে গৌড়ীয় পণ্ডিতদের সেই শাস্ত্রে ব্রাহ্মণদের দেয়া হয় বিশেষ অগ্রাধিকার।
তারা ব্রাহ্মণভোজ বা দানের নির্দেশ দেন। চতুর্ভূজ বিষ্ণুকে গুরুত্ব দেন এবং চণ্ডাল ও যবনকে দূরে রাখেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখেছেন, চৈতন্য কিছু কৃত্যপালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু গোপালভট্ট গোস্বামীর নির্দেশগুলো মৌলিকভাবে তা থেকে ভিন্ন।
চৈতন্য নবদ্বীপে বাংলায় সহজে গেয় নামগান নগরকীর্তন গেয়ে বৈষ্ণবভক্তি প্রচার করেছেন।
কিন্তু অবাঙালি পণ্ডিতদের সংস্কৃত ভাষায় লেখা বৈষ্ণব তত্ত্বাবলী পরিভাষা না জানা বাঙালিদের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। লেখক অজিত দাস তার জাত বৈষ্ণব কথা বইয়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়কে চৈতন্য অনুসারী না বলে বরং বৃন্দাবনের গোস্বামী নির্দেশিত সম্প্রদায় বলাই শ্রেয় বলে মন্তব্য করেছেন।
সংস্কৃত ভাষায় শাস্ত্রগ্রস্থ লেখা বৃন্দাবনের গোস্বামীদের নিয়ে তিনি লিখেছেন, “যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বৃন্দাবনে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্ব উদ্ভাবিত হয় তার সাথে বঙ্গীয় সংস্কৃতির বিশেষ কোনও সম্পর্ক ছিল না। ক্রমশ বৃন্দাবনের সাথে নবদ্বীপ ও নীলাচলের সম্পর্ক অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে পড়ে।” (অজিত দাস, জাত বৈষ্ণব কথা, পৃ. ৭৩)
৩. ঐক্যের সুতো বাঁধলেন জাহ্নবা
বৃন্দাবন ও বাংলায় ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন বৈষ্ণব সম্প্রদায়কে এক ছাতার নিচে আনার এবং তাদের মধ্যে সংযোগসূত্র গাঁথার কাজটি করেন জাহ্নবা দেবী।
চৈতন্য,নিত্যানন্দ,অদ্বৈতের তিরোধানের পর বাংলায় বৈষ্ণব আন্দোলনের প্রথম পর্ব শেষ হয়।
নেতৃত্বের সঙ্কটে ভুগতে থাকা নিত্যানন্দের বিশাল শিষ্য ও ভক্তদের পরিচালনায় ধর্মগুরুর ভূমিকায় আসেন তিনি। বৃন্দাবন এবং বাংলার বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করেন ধর্ম প্রচারের গুরু দায়িত্ব নিয়ে। নাম-মন্ত্র প্রচারক নিত্যানন্দ বৃন্দাবনের গোস্বামীদের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেননি। কিন্তু পরে এই যোগাযোগ তৈরি করেন জাহ্নবা ও তার সহচররা।
আবার জাত বৈষ্ণবরা বেশিরভাগ নিম্নবর্ণের হলেও গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ব্রাক্ষ্মণ ও কায়স্থ জমিদাররা। তবে বৃন্দাবনী নির্দেশনার মঞ্জরী সাধনা (মধুরভাবের সাথে দাস্যভাব) তৃণমূলস্তরে জনপ্রিয় ছিল না। সেখানে বৈষ্ণব ধর্মের ভিন্ন ব্যাখ্যা প্রচার করেন অজ্ঞাতনামা গোঁসাইরা। কেউ সখ্যভাবে, কেউ রাধাভাবে, কেউ গৌড়াঙ্গকে নাগররূপে কল্পনা করে উপাসনা করতেন।
বৃন্দাবনে কমপক্ষে দুইবার গিয়েছিলেন জাহ্নবা। নিত্যানন্দের মৃত্যুর পর সম্ভবত ১৫৪৯ সালে প্রথম বৃন্দাবন যান তিনি।
নিত্যানন্দ দাসের প্রেমবিলাস বইয়ের ষোড়শ বিলাসে তার বৃন্দাবন যাত্রার উল্লেখ আছে। রাজবল্লব গোস্বামীর মুরলীবিলাস বই অনুসারে তিনি খড়দহ থেকে প্রথমে যান কণ্টকনগরী বা কাটোয়ায়।
গঙ্গা পার হই চলে গঙ্গা ধারে।
প্রভুর মুণ্ডন স্থান কণ্টক নগরে।।
জাহ্নবা বীরভূমের ময়ূরেশ্বর,একচক্রা, মালদহের গৌড় ও বিহারের গয়াধাম ঘুরে উত্তর প্রদেশের মথুরা জেলার বৃন্দাবনে পৌঁছান। বৃন্দাবনে তাকে স্বাগত জানান রূপ ও সনাতন গোস্বামী। সেখানকার গোস্বামীদের সাথে আলাপ আলোচনা করে ফিরে এসে প্রধান বৈষ্ণব নেতাদের সাথে কথা বলেন তিনি।
এরমধ্যে বর্ধমান জেলার শ্রীনিবাস আচার্য, রাজশাহী জেলার খেতুরির নরোত্তম দত্ত এবং মেদিনীপুরের শ্যামানন্দ অন্যতম। জাহ্নবা দেবীর শিষ্য নিত্যানন্দ দাসের প্রেমবিলাস বইয়ে এসব ঘটনার বিবরণ রয়েছে।
ছড়িয়ে থাকা সমস্ত বৈষ্ণব সমাজকে সংঘবদ্ধ করতে বৃন্দাবনের গোস্বামীদের তত্ত্ব ও দর্শনকে উপেক্ষা করেননি জাহ্নবা। বঙ্গীয় বৈষ্ণবদের একতা প্রতিষ্ঠিত করতে বৃন্দাবনের গোস্বামীদের শাস্ত্র গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ছিল। এ কাজে জাহ্নবা দেবীর তত্ত্বাবধানে শ্রীনিবাস আচার্য, নরোত্তম দত্ত, শ্যামানন্দ, রামচন্দ্র কবিরাজ এবং তাদের সমর্থকরা বাধা দেননি। এছাড়াও ছিল নিত্যানন্দ,অদ্বৈত আচার্য,গদাধর পণ্ডিত,নরহরি সরকারের সমর্থকরা। পুরীর চৈতন্যভক্তরাও তাদের বিরোধিতা করেননি। সমর্থন করেছিলেন বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী রাজা,ভূস্বামী, বনিকরাও। (রমাকান্ত চক্রবর্তী, বঙ্গে বৈষ্ণব ধর্ম, পৃ. ৮৮)
বৈষ্ণবদের নানা দল উপদল থাকলেও তাদের সম্মেলন ঘটেনি। তাদের এক করতে বৈষ্ণব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বড় সম্মেলন ঘটে। জাহ্নবা দেবীকে কেন্দ্র করেই রাজশাহীর খেতুরিতে বিশাল সম্মেলন করে গৌড়ীয় বৈষ্ণবতত্ত্বকে স্বীকৃতির আয়োজন করা হয়। প্রেমবিলাস অনুসারে জাহ্নবার নির্দেশে নরোত্তম দত্ত বা ঠাকুর নরোত্তম দাস, শ্রীনিবাস আচার্যরা এই উৎসব তত্ত্বাবধান করেন।
শ্রীঈশ্বরীর আজ্ঞায় আচার্য শ্রীনিবাস।
অভিষেক আরম্ভিলা যতেক উল্লাস।।
প্রথমবার বৈষ্ণবদের এই মহোৎসবে জাহ্নবা দেবীর সন্মানে খেতুরি সম্মেলনে হাজির হন নবদ্বীপ, শান্তিপুর, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর ও অন্যান্য জায়গা থেকে সে সময়ের অন্তত ২৯ জন শীর্ষ বৈষ্ণব নেতা। কবি জ্ঞানদাস, কমলকর পিপিলাই, মীনকেতন রামদাস, কবি বলরাম দাস, বৃন্দাবন দাস, অচ্যুতানন্দ, কবি গোবিন্দ দাস, কবি লোচন দাস, শ্রীনিবাস আচার্য ও নরোত্তম দাস এসব প্রধান বৈষ্ণবদের সাথে বহু সাধারণ মানুষ সে উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন।
লেখক-গবেষক রবীন্দ্রনাথ মাইতি তার চৈতন্য-পরিকর বইয়ে জাহ্নবা দেবী অংশে উল্লেখ করেছেন, খেতুরি উৎসবে জাহ্নবা দেবীর স্থান ছিল সর্বোচ্চ। তার আজ্ঞা নিয়েই শ্রীনিবাস বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার আগে প্রার্থনা করেন ও খোল-করতাল নিয়ে পূজা সম্পন্ন হয়। বিগ্রহের সামনে ভোগ দেন জাহ্নবা এবং স্বহস্তে ভক্তদের খাদ্য পরিবেশন করেন।
“ঐতিহ্য অনুসারে খেতুরিতেই সুস্পষ্টভাবে বৃন্দাবনের গোস্বামীদের দ্বারা রচিত গ্রন্থাবলী শাস্ত্র হিসেবে টিকে গেল এবং এই শাস্ত্র সর্ববৈষ্ণবগ্রাহ্য হয়েছিল। রাধাকৃষ্ণের যুগলমন্ত্রে চৈতন্যের মূর্তিপূজনের সঙ্গে বৃন্দাবনের গোস্বামীদের দ্বারা পরিকল্পিত কৃষ্ণপূজনের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা হয়েছিল।” (রমাকান্ত চক্রবর্তী, বঙ্গে বৈষ্ণব ধর্ম,পৃ ৮৮)
প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে,পাঁচশ বছরের ঐতিহ্য মেনে বাংলাদেশের রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী এলাকার খেতুরিধামে আজও এ মহোৎসব হয়ে আসছে। প্রতিবছর উৎসবকে ঘিরে সেখানে দেশের বিভিন্ন জেলা এবং ভারত, নেপালসহ বিভিন্ন দেশ থেকে কয়েক লাখ ভক্তের সমাগম হয়। ২০২৪ সালের ২১-২৩ অক্টোবর নরোত্তম ঠাকুরের তিরোভাব তিথি স্মরণে সেখানে তিন দিন ব্যাপী মহোৎসব হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, লীলাকীর্তন বা পদাবলী কীর্তনের গড়ানহাটি ধারার প্রবর্তক ছিলেন এই বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারক।
৪. নারী, বিধবা,বেশ্যা ও পিতৃপরিচয়হীনদের ঠাঁই
ঘরে ঘরে করিমু কীর্তন পরচার
মোর যশে নাচে যেন সকাল সংসার
অদ্বৈত বোলেন যদি ভক্তি বিলাইবা
স্ত্রী শূদ্র আদি যত মূর্খেরে সে দিবা
অদ্বৈতর বাক্য শুনি করিলা হুংকার
প্রভু বোলে সত্য যে তোমার অঙ্গীকার।।
পণ্ডিতদের আইনে সাধারণত শূদ্র ও নারীজাতির বেদপাঠ,শাস্ত্রচর্চা ও পূজার অধিকার নেই।
তবে ব্যতিক্রম ছিল বৈষ্ণব সমাজ। জাহ্নবা ছাড়াও অদ্বৈত আচার্যের স্ত্রী সীতা দেবী বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তার একটি ভক্তগোষ্ঠীও ছিল। তার জীবন সীতাচরিত্র লিখেছেন লোকনাথ দাস। অন্য একটি জীবনীর নাম সীতাগুণকদম্ব। এছাড়া শ্রীনিবাস আচার্যের মেয়ে হেমলতা ঠাকুরানী, হরিপ্রিয়া ঠাকুরানী স্ত্রী-গুরু হিসেবে প্রভাবশালী ছিলেন। স্মৃতিশাস্ত্রের বিধান তাঁদের রান্নাঘরে রেখে দিতে পারেনি।
জাহ্নবা দেবী গ্রামে গ্রামে আখড়া স্থাপন ও শিষ্য তৈরির মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারীদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উদারতার বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। নারী গোঁসাইদের নিয়ন্ত্রণে বহু আখড়া, শ্রীপাট গড়ে উঠেছিল সেসময়। বিষ্ণুপুর অঞ্চলে অবন্তিকা,মেবালা,দ্বারিকায় সীতাদেবীর পাট; মুর্শিদাবাদ জেলায় বুধাইপাড়াকে কেন্দ্র করে কুমারপুর, মহুলা রায়পুরে হেমলতা ঠাকুরাণীর পাট এবং বোরাকুলি, চুনাখালি,বাজিতপুরে জাহ্নবাদেবীর আখড়া ছিল। সীতাদেবীর দুই শিষ্য নন্দিনী ও জঙ্গলী মালদহের জঙ্গলীটোলায় একটি আশ্রম গড়ে তুলেছিলেন। এখানে অবিবাহিত বৈষ্ণব বাবাজীরা স্ত্রী বেশ ধারণ করতেন।
কেবল গুরু মা নয়,সাধারণ বৈষ্ণব নারীরও ছিলেন সন্মানীয়। যেহেতু রাধা-কৃষ্ণ,পুরুষ ও প্রকৃতি দুটোই গুরুত্বপূর্ণ, তাই বৈষ্ণব নারী-পুরুষ উভয়েই উভয়কে মান্য করে। তারা সখা-সখি,প্রেমিক-প্রেমিকা। সংসারত্যাগী বৈরাগীরা একসাথে বসবাস ও ধর্মচর্চা করত। ভিক্ষাবৃত্তি বা মাধুকরী করে চললেও তারা ছিলেন স্বাধীন ও স্বাবলম্বী। কেবল পুরুষ নয়, নারীরাও ইচ্ছামতো সঙ্গী বদল করতে পারতেন। ছিল না কোনো বাধ্যবাধকতা। (অজিত দাস, জাতবৈষ্ণব কথা,পৃ. ৭৪)
সামাজিক জাতভেদ দূর করা বা সমাজ সংস্কারেও জাহ্নবার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল।
সে যুগে রাঢ়ী ও বারেন্দ্রী ব্রাহ্মণদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কে বাধা থাকলেও জাহ্নবা সেই নিষেধ ভেঙে সপত্নী কন্যা গঙ্গাদেবীকে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ মাধবাচার্যের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে পরে আরও এমন বিয়ে হয়েছে। সে যুগের প্রেক্ষাপটে প্রথাভাঙার এ এক বিস্ময়কর ঘটনা।
ব্রিটিশরা এদেশে বিধবাবিবাহ চালু করেছে এমন ধারণা প্রচলিত থাকলেও ১৮৫৬ সালে তারা বিধবাবিবাহ আইন করার বহু বছর আগেই বৈষ্ণবদের মধ্যে বিধবাবিবাহ সামাজিকভাবে স্বীকৃত ছিলো। সহমরণের চিতায় না উঠে বৈষ্ণব বিধবারা পুনর্বিবাহ করতে পারতেন।
এ নিয়ে সামাজিক বাধা ছিল না।
এমনকি উভয়ের সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদেরও চল ছিল। এর ফলে বৈষ্ণব সমাজের নারীরা কোণঠাসা অবস্থা থেকে অনেকটা বেরিয়ে আসেন।(রমাকান্ত চক্রবর্তী, বঙ্গে বৈষ্ণব ধর্ম,পৃ. ১৪৪)
কেবল তাই নয়, যে বিধবা, বেশ্যা ও জারজদের সমাজের মূলধারায় স্থান মেলেনি, তাদেরও অপাঙতেয় করে রাখেনি বৈষ্ণব ধর্ম।
গণিকাকে অনেক শাস্ত্রে মন্ত্রদানে বাধা থাকলেও বৈষ্ণব ধর্মে তাদের দীক্ষা দেয়া হতো। দরিদ্র বিধবা,স্বামী পরিত্যক্ত, আশ্রয়হীন ও অভিভাবকহীন অবিবাহিত মেয়েদের জন্য সেকালে আখড়াই ছিল সম্বল। পতিতালয়ে না গিয়ে সমাজেই সহজ, স্বাধীন জীবনের দরজা খুলে দিয়েছিল এই আখড়া।
তারা আখড়ায় এসে বোষ্টুমীর ভেক নিয়ে মাধুকরী করে বাঁচতে চেয়েছেন। বোষ্টমরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে অভিভাবকহীন কুমারী ও বিধবাদের নিজেদের দলে টেনে আনতেন। অনেক বিবাহিত নারীও সে দলে যোগ দিতেন। এজন্য অবশ্য সমাজের উপর তলা থেকে বৈষ্ণবদের নানা অপবাদও জুটত। হতো কুৎসা রটনাও। এই উদারতা পছন্দ না হওয়ায় রক্ষণশীল ব্রাহ্মণরা অপপ্রচার চালাতেন।
বৈষ্ণব আন্দোলনের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট ছিল নারীশিক্ষার প্রসার।
ব্রিটিশরা আসার আগেই এদেশে মেয়েদের জন্য শিক্ষার দুয়ার খুলে দিয়েছিল বৈষ্ণব ধর্ম। নিম্নবর্ণে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার ও সাক্ষরতা প্রসারে মা গোঁসাইদের প্রশংসনীয় ভূমিকা ছিল।
এতে পথিকৃত ছিলেন জাহ্নবা। তিনি নিজে নারীদের বাংলা ও সংস্কৃত শিক্ষা দিয়েছেন। খড়দহের শ্রীপাটে তার হাতে গড়া শিক্ষিত গোস্বামীনীরা তাদের শিক্ষাকে নানা অঞ্চলের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। সে সময়ে চন্দ্রাবতী, ঈশ্বরীসহ বৈষ্ণব নারীরা কবিতা,পদ ও গীতিকা রচনায় পারদর্শিতা দেখিয়েছেন।
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতার বনেদি সমাজে শিক্ষিকা হিসেবে বৈষ্ণবীদের কদর ছিল। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে কলকাতায় পোস্তার রাজা শিবচন্দ্র বাহাদুরের কন্যা হরসুন্দরী দাসী এক বৈষ্ণবীর সাহায্য নিয়ে লেখাপড়া শিখেছিলেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির মেয়েদেরও শিক্ষক হিসেবে রাখা হত বৈষ্ণবীদের। কলকাতায় মিস কুক পরিচালিত ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটির স্কুলেও শিক্ষয়িত্রী হিসেবে বৈষ্ণবীদের নিয়োগ দেয়া হতো। উচ্চবর্ণের বর্ণাশ্রমী মানুষরা তাদের প্রয়োজনেই বৈষ্ণবীদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন, এসব তারই দৃষ্টান্ত।
৫. শেষের দিনগুলি
নিঃসন্তান জাহ্নবা দেবী তার বড় বোন ও সপত্নী বসুধা দেবীর ছেলে বীরচন্দ্র ও মেয়ে গঙ্গামণিকে নিজ সন্তানের মতোই লালন-পালন করেছেন। পরবর্তীতে বৈষ্ণব ধর্মের অন্যতম প্রধান প্রচারক বীরচন্দ্রকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা দিয়েছিলেন জাহ্নবাই। বীরচন্দ্রকে আদর্শ জননেতা হিসেবে গড়ে তুলতেও তার ভূমিকা ছিল। বৃন্দাবন ও বাংলার বৈষ্ণব নেতাদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটিয়ে ছিলেন তিনি। এছাড়া তারই উদ্যোগে যদুনন্দন আচার্যের দুই মেয়ে শ্রীমতি ও নারায়ণীর সাথে বীরচন্দ্রের বিয়ে হয়। পুত্রবধূদেরও মন্ত্রদীক্ষা দেন জাহ্নবা। রামচন্দ্র নামে পালকপুত্রকেও প্রতিপালন ও মন্ত্রদীক্ষা দিয়েছেন। ভ্রমণে গেলে বীরচন্দ্রের পাশাপাশি রামচন্দ্রকেও সাথে নিতেন। নিত্যানন্দের বংশ পরিচয়ে বীরচন্দ্র,গঙ্গামণির পাশাপাশি তাই রামচন্দ্রের উত্তরপ্রজন্মকেও মান্য করা হয়।
জাহ্নবা দেবীর তিরোভাব বিষয়ে তথ্য সামান্য। তবে তার অর্ন্তধানের সাথে বৃন্দাবনের গোপীনাথ মন্দিরের রাধিকা-বিগ্রহের সম্পর্ক আছে। একবার বৃন্দাবন ভ্রমণে রাধা-গোপীনাথ দর্শনকালে জাহ্নবার মনে হয় শ্রীরাধিকার বিহগ্র আরেকটু উচ্চ হলে ভালো হয়। গৌড়ে ফিরে এসে ভক্ত নয়ন ভাস্করকে দিয়ে একটি রাধিকা বিগ্রহ নির্মাণ করান তিনি। পরমেশ্বরীদাসসহ কয়েকজন ভক্তের সাথে সেই বিগ্রহ বৃন্দাবনে পাঠালে গোস্বামীরা তা গোপীনাথের বাম পাশে স্থাপন করেন। (নিত্যানন্দ দাস, প্রেমবিলাস, ১৯শ বিলাস, পৃ. ৩৪১)
নিত্যানন্দ প্রভুর বংশবিস্তার বইয়ে বলা আছে, রাধিকা-বিগ্রহ পাঠানোর পর ভক্তসহ জাহ্নবা দেবী আবার বৃন্দাবন গিয়েছিলেন। তার সন্মানে রূপ ও সনাতন গোস্বামী স্তুতিপাঠ করেন। এরপর একদিন জাহ্নবা রাধা-গোপীনাথের মন্দিরে প্রবেশ করলে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। এবং —
গোপীনাথ জাহ্নবার বস্ত্র আর্কষিয়া।
বসাইল আপনার বাম পার্শ্বে লইয়া।।
পরে সেবকরা মন্দিরের দরজা খুলে দেখতে পান —
সবে দেখে কাঞ্চন প্রতিমা মূর্তি হইয়া।
বিরাজয়ে গোপীনাথের দক্ষিণে বসিয়া।।
বামপার্শ্বে শ্রীরাধিকা দক্ষিণে জাহ্নবা।
মধ্যে গোপীনাথ ইথে উপমা কি দিবা।।
মুরলীবিলাস-এ এই অবিশ্বাস্য বর্ণনার সমর্থন পাওয়া যায়। জাহ্নবা দেবীর তিরোভাব নিয়ে প্রেমদাসের বংশীশিক্ষা বইয়েও একই কথা বলা হয়েছে। ভক্তিরত্নাকর-এ জাহ্নবার তিরোভাব নিয়ে তথ্য নেই আবার বৃন্দাবনেই যে তিনি অন্তর্হিতা হননি, এ কথাও জোর দিয়ে কোনো বইয়ে উল্লেখ নেই।
বৈষ্ণব তত্ত্ব ও সাহিত্য জাহ্নবাকে কৃষ্ণের ব্রজলীলার অনঙ্গমঞ্জরির অবতার, শ্রীরাধার ছোট বোন এবং বলরামের লীলাসঙ্গিনী বারুণী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বৃন্দাবন বা ব্রজলীলার বিভিন্ন চরিত্র কলিযুগে এসে আবার বিভিন্ন রূপে নদীয়ায় লীলা করেছেন। এতে মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য রাধা-কৃষ্ণ যুগল রূপে, নিত্যানন্দ বলরাম ও জাহ্নবা বারুণী রূপে ভক্তদের কাছে ধরা দিয়েছেন।
জাহ্নবা দেবীকে নিয়ে মধ্যযুগে যতগুলি জীবনী ও স্তুতিকাব্য লেখা হয়েছে তা আর কোনো বাঙালি নারীকে নিয়ে হয়নি। জাহ্নবাকে নিয়ে লেখা বইয়ের মধ্যে রয়েছে রামচন্দ্র গোস্বামীর অনঙ্গমঞ্জরী সম্পূটিকা,গতিগোবিন্দের জাহ্নবাতত্ত্ব মর্মার্থ,জীব গোস্বামীর জাহ্নবাষ্টকম্। এছাড়া মধ্যযুগে এক নারীর লেখা আরেক নারীর মাহাত্ম্যকাহিনী হলো জাহ্নবাকে নিয়ে সুভদ্রা দেবীর লেখা অনঙ্গকদম্বাবলী।
বৈষ্ণব পদাবলী ও কীর্তনেও জাহ্নবার বন্দনা রয়েছে। রামচন্দ্র দাস গোস্বামী মা জাহ্নবাকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছেন:
ইষ্টদেব নিত্যানন্দ কেবল আনন্দকন্দ
সেই তনু অনঙ্গমঞ্জরী।
রাধার অনুজ এই বলরাম শক্তি সেই
গুরুরূপে হন অধিকারী।।
বৈষ্ণব আন্দোলনের সঙ্কটময় সময়ে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেয়া ও বৈষ্ণব সমাজকে এক সুতায় বাঁধার ক্ষেত্রে জাহ্নবা দেবীর অবদান অনন্য। বাংলায় গুরুত্বপূর্ণ সমাজ পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। শুধু নারীর ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকার এবং শিক্ষা-সংস্কৃতির বিস্তারই নয়, জাতপাতের ভেদ দূর করতেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
নারী অধিকার, মানবাধিকার শব্দগুলি প্রচলনের কয়েক শতাব্দী আগেই বাংলার মাটিতে তার সরল সুন্দর প্রয়োগ করেছেন জাহ্নবা দেবী।