Published : 11 Dec 2020, 11:02 PM
ছবি: আজকাল পত্রিকার সংগ্রহ থেকে নেয়া। নিজের ঘরের দরজায় বসে আছেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
লেখার কথা বলবে লোকে, লেখক নয়
'আমি বিপ্লব ও রাজমোহন গল্পটির বিষয়বস্তু বোঝাতে গিয়ে (যাতে উনি অবহেলা না করেন বা পড়তে প্রলুব্ধ হন) ওকে বলেছিলুম— দেখুন,এটা আসলে একজন লোক তার স্ত্রীর অবর্তমানে তার বুক সেলফটা জ্বালিয়ে দিচ্ছে, তারই বর্ণনা।
–যেভাবে খেলার রীলে হয় আরকি – কারণ খুব দ্রুত পুড়ে যাচ্ছে তো, তাই সেই দ্রুততা ভাষায়ও এসে যাচ্ছে,ভাষা আর সম্পূর্ণ হতে পারছে না। নায়কের রিলের ভাষাও জ্বলে যাচ্ছে আর কি-শুধু একটা বই ই শেষ পর্যন্ত পুড়ল না, সেটা হলো -'এই পর্যন্ত দ্রুত বলে নিয়ে প্রতিক্রিয়ার জন্য আমি চোখ তুলি।
—আমি চুপ ও তিনি চুপ। দেখলাম খর্বকায় হলেও খুব উঁচু হয়ে গেছেন কীভাবে, কোনো অলৌকিক উপায়ে আমাপেক্ষা উচ্চতাবিশিষ্ট হয়ে ঘাড় নেড়ে বললেন— অ্যাডভোকেসি কোরো না। লেখার কথা বলবে লোকে। লেখক নয়।
—তার মুখ থেকে শোনা দুটি কথাই জীবনের অমূল্য নির্দেশ হয়ে আছে।
উপরের "আমি" সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। আমরা যারা লিখছি তাদের জন্যও এটা অমূল্য নির্দেশ হতে পারে। বা এর বিপরীতটাও। কিংবা সন্দীপনের বলা—
—লেখার বিষয়?
—তা চলে আসবে ভাষার পেছনে।
— যেমন গরুর পেছনে লাঙ্গল?
—হ্যাঁ। লেখকের তখন কাজ কেবল শুধু লাঙ্গলের খোঁটা চেপে ধরে লক্ষ্য করে যাওয়া।
এই যা! 'তিনি' লোকটার কথা ত বলাই হয়নি। তিনি বাংলা সাহিত্যের মহীরুহ – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নামে সবাই তাকে চেনে।
(সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডায়েরী/ অদ্রীশ বিশ্বাস সম্পাদিত)
আর্টসের অনুরোধে গত কয়েকদিন ধরে যখন এই লেখা নিয়ে ভাবছি, সারাক্ষণ আমার মাথায় খেলছে— লেখার কথা বলবে লোকে, লেখক নয়। তবে আগেই ডিসক্লেইমার দিয়ে রাখছি, সন্দীপন আমার এতো প্রিয় লেখক যে, লেখা ছাপিয়ে দুটো একটা তাঁর কথাও চলে আসতে পারে, মমপ্রিয় পাঠক, অধমে করিয়া ক্ষমা, ধ্যান দ্যান অকিঞ্চিৎ এ লেখায়…
রিক্তের যাত্রায় জাগো…
আপনাদের, যাঁদের গল্পটা ভাল লাগল, তাঁরা অনুগ্রহ ক'রে আমাকেও ভালবাসুন, কেননা, আমি ও আমার গল্প একই।
(আবার পড়ুন)
আপনাদের, যাঁদের গল্পটা ভাল লাগল, তাঁরা অনুগ্রহ ক'রে আমাকেও ভালবাসুন, কেননা, আমি ও আমার গল্প একই।
দুইটা একই বাক্য,আপনি দুবার পড়েছেন, নিজেকে জিজ্ঞেস করুন তো, একই বাক্য পড়লেন?
একটা শব্দও উল্টেপাল্টে না দিয়ে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় পরপর দুবার পাঠ করলে ভিন্ন ব্যঞ্জনা কাজ করে পাঠকের মগজে। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের জন্য নতুন সাহিত্যভাষা নির্মাণ করেছেন সারাজীবন ধরে প্রায় কনুইবাঁকা তাচ্ছিল্যে লেখা, মাত্র ২১টি উপন্যাস, ৭০ গল্প— আর মোটামুটি অসংখ্যা সংবাদগদ্য ও মৃত্যুপরবর্তী সময়ে প্রকাশিত ডায়েরীতে। সন্দীপন সাহিত্য প্রস্তাবে অস্বীকার করেছিলেন সাহিত্যের ক্লিশে ভাষা আর প্রথাগত নির্মাণকে।
নিজের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের ভুমিকায় সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন— "তথাকথিত জীবনানুগ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ কত ঔপন্যাসিকের পসথুমাস মৃত্যু যে দেখলাম। শুধু ভাষা ছিল না বলে। আসলে হীরে থেকে যে আলো বেরোয় সেটাই হীরে। বহুকৌণিক পাথরটা নয়। তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না"।
কী কথা! যেনো প্রেমিকার শরীর নয়, তার যা আচরণ তার যা অন্তর্গত সুষমা, তাই হীরের দ্যুতি, তাই চাওয়া হচ্ছে। যেনো, ভাষা নয় ভঙ্গি। সুনীলের সরল সরস গদ্যের বিপরীতে, অনায়াসে কমার পর কমা আর অযাচিতপ্রায় কিন্তু অর্থপূর্ণ যতিচিহ্নের ব্যবহারের সন্দীপন তার গদ্যটা আলাদা করে নিয়েছিলেন তার প্রিয় মানিক, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণের থেকে।
কলকাতার দিনরাত্রি
সন্দীপনের সময়ে সাহিত্যে রাজত্ব করা কলকাতার জনপ্রিয়, বড়, আনন্দবাজারী হেডম (শব্দটি আপনারা জানেন কী! নইলে আমায় ইনবক্স করবেন) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও একদিন স্বাভাবিক আলাপে কষ্ট দিয়ে বসেছিলেন চির-অভিমানী সন্দীপনকে, যা এই এতোকাল পরে সন্দীপনের চিঠি পড়তে পড়তে মনে হয়, সন্দীপনের গদ্যভাষা আর এক্কেবারে আলাদা যাপনই গেল গেল রব তুলে দিয়েছিলো সাহিত্য মোড়লদের একনিষ্ঠ পাড়ায়। প্রথমে এক বাক্যের উদাহরণ দিয়েই দেখালাম, এমনকী গল্প বা উপন্যাস নয় কেবল, সন্দীপন বাক্যের মধ্যেও রেখে দিতে পারতেন নতুন নতুন পাঠ-সম্ভাবনা।
কাহিনী কথনের পরম্পরাকে অগ্রাহ্য করেও কিভাবে 'স্বর্গের নির্জন ঊপকূলে', 'অস্তিত্ব অতিথি তুমি' 'হিরোশিমা, মাই লাভ','আমি আরব গেরিলাদের সমর্থন করি','একক প্রদর্শনী','ধ্বংসের মধ্য দিয়ে যাত্রা', 'আমি ও বনবিহারী… (উপন্যাস সমগ্র থেকে নামগুলি পড়ে নিন, অনলাইনেও তালিকা পাওয়া যায়, কোন রচনাই পাঠ বাদ দেয়া যায় না এমন এক লেখক তিনি) এমন সব উপন্যাস লিখে ফেলতে পারেন কেউ, তা আশ্চর্য করে না শুধু চোখে কালো পট্টি বেঁধে পাঠককে প্রায় অন্ধভক্ত বানিয়ে ফেলতে চায়।
ছিলাম সুনীল এর আলাপে, কেননা সাপেক্ষ দিয়ে অপেক্ষ বিচার করতে হয়, সুনীল তখন পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের ভগবান, আনন্দবাজার ও নিজঅর্জিত জনপ্রিয়তার কল্যাণে। সেই গল্প আগ্রহী গোয়েন্দা পাঠক নিশ্চয়ই জেনে নিতে পারবেন, আমি শুধু সন্দীপন-এর লেখা সুনীলকে চিঠিটার একটু অংশ উদ্ধৃত করছি। সন্দীপন লিখেছেন সুনীলকে "…অপমান করা আপনার সঙ্গত হয়েছিল কি হয়নি, সে-কথা ভাবছি না। কারণ, এটাই ভাবছি যে, অপমান হচ্ছে অপমান।এবং বন্ধুকে কেউ অপমান করে না।…'
কী! জীবনানন্দের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে! ঐ যে কবিতা শুনতে নৌবিহারে ডেকে হো-হো হাসাহাসি ও রসিকতা! কীর্তিনাশা নদীর বাঁকা জল আর বন্ধুদের বঙ্কিম মুখ, সে-ও কাব্যজগতের বন্ধুরাই, জীবনানন্দের, কিন্তু করেছিলো।
সন্দীপন কেনো আমার, এমনকী তার গুরুতুল্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেয়ে প্রিয়— (মানিকের বই পুতুলনাচের ইতিকথা নিয়ে সন্দীপন বলেছিলেন, 'আমার উইলে আমি দুটি ইচ্ছা প্রকাশ করেছি। এক, আমার মৃত্যুর পর আমার কোনোরূপ শ্রাদ্ধ হবে না, বা, স্মৃতিসভা। দুই, আমার মৃত্যুর পর, মাথার বালিশের নীচে, গীতার বদলে, 'পুতুল নাচের ইতিকথা' বইটি রাখতে হবে'।)— মাঝে মাঝে নিজেকে এই জিজ্ঞাসা আমি করিনি এমন নয়। মানুষের ভালোলাগার আদিম সূত্রের কারণেই বোধহয় সন্দীপন আমার প্রিয়তম লেখক, মম প্রিয় গদ্যকবি। এতো অপমান, এতো প্রথা ও নিষেধ অগ্রাহ্য করে ভেঙেচুরে সন্দীপন লিখেছেন, আমি শুধুমাত্র তাঁর স্বপ্ন হয়তো দেখি, ফলে সন্দীপনকে যে ছিঁড়ে ছুরেও ফেলতে ইচ্ছে হয় না, এমন না। কিন্তু পারা যায় না। 'স্বর্গের নির্জন ঊপকূলে'র সাড়ে তিন কিলো সাঁতরে একবার সঙ্গমের জন্য আসা নায়ক আমার মাথার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে, কিংবা হিরোশিমা মাই লাভের সেই প্রেমিক যুগল, যাদের সঙ্গমের জায়গা নেই, কবরখানার নির্জনতা যাদের একমাত্র সম্বল বেঁচে থাকার শহরে।
অস্তিত্ব,অতিথি তুমি
সন্দীপন আমার প্রিয়তম, কারণ ভয়ে আতঙ্কিত জলের বূহ্য-বন্দী পিঁপড়ার আর্তচিৎকার কে আর শুনতেন এই আপাত ক্ষ্যাপাটে, জাতে মাতাল, তালেও স্বঘোষিত বেতাল এই বিরলপ্রজ লেখক ছাড়া!
টেবিলে হাতে আঁকা জলব্যুহ এর কথা মনে পড়তেই মাথায় এলো 'বিজনের রক্তমাংস'। পাঁচ বছর আগের অপমান মনে করে যে বিজন মুষড়ে পড়েছিলো মনিমালার জন্য। এই সেই বই,যে বই নিয়ে তাঁর প্রবেশ বাংলা সাহিত্যে, 'ক্রীতদাস ক্রীতদাসী'। গ্রন্থের দ্বিতীয় গল্পটি বাষট্টিতে লেখা, আট বছর আগের একদিন, জীবনানন্দ দাশের কবিতার থেকে ধার নেয়া নামে,সেই গল্পের শেষে প্রায় মৃত্যুর ভয়ে আতঙ্কিত জলের বূহ্যবন্দি পিঁপড়েটির আর্তচিৎকার শুনতে পায় বিজন। কারণ তার একটু আগেই পাঁচবছর পর একটা অপমান গিলে ফেলে পিঁপড়েটির সমান্তরালে এসে দাঁড়িয়েছে বিজন, যা তাকে পাঁচ বছর আগে বিয়ের কনে দেখতে গিয়ে হতে হয়েছিলো। বিজনকে কী ক্ষমাহীন প্রত্যাখ্যান না করেছিল মণিমালা সেই প্রাচীন এক সন্ধ্যায়। প্রত্যাখ্যান করেছিল সে অসত্য বলে নয়, নিজেকে লুকিয়ে। এতকাল পরে বিজন জানল তা। অথচ এখন বিজন বুঝতে পারছে, কী হারিয়েছে সে সেই সন্ধ্যায়। গোপনে কী অপমান না করেছিল সেই মেয়ে, মণিমালা। প্রতিশোধের ইচ্ছা জাগে বিজনের ভেতর। জল শুকিয়ে গেলে বিজন হত্যা করে পিঁপড়েটিকে ধীরে ধীরে। পা ছিড়ল বিজন তার। ছেড়ে দিল টেবিলে। লেংচাতে লেংচাতে পিঁপড়েটি কোনাকুনি পার হয়ে যাচ্ছে টেবিল। আহত পিপীলিকা। যতদিন যাবে পিঁপড়েটির প্রতিরোধ স্পৃহা বাড়বে, হিংসা বাড়বে। বাড়বে অবর্ণনীয় বেদনাবোধ। বিজন মনে মনে বলে, বাড়ুক। আত্মহনন ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে ওর প্রতিহিংসা চরিতার্থ হবে না কোনোদিন। মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত ওর সবই মনে থাকবে।
প্রতিক্ষণ প্রকাশিত সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের পঞ্চাশটি গল্প আমার হাতে আসে ২০০৫ এর ১২ ডিসেম্বর এর অনেক পর, অর্থাৎ সন্দীপন বেঁচে থাকতে ওঁর লেখা আমি পড়ি নাই। 'বিজনের রক্তমাংস'র পর 'ডবলবেডে একা' ধরে আমার ফিল্মমেকার কবিবন্ধু মেহেদী হাসানের সংগ্রহে থাকা সন্দীপনের উপন্যাস সমগ্র, যা আজকাল প্রকাশিত, প্রায়-আর্টপেপারে ছাপা,সপ্তাহ তিনেক লেগেছিলো একটানা, পড়ে ফেলিছিলাম সন্দীপন, এক পৃথিবীরমাদকভরা ঘোরে। এখনো সন্দীপনের লেখা মানেই, আমি ক্ষুধা-বোধ করি।
নিষিদ্ধ স্বপ্নের ডায়েরী
রচনাগুণ কোন লেখককে পছন্দ করবার জন্য, ভালোবাসবার জন্য জরুরী, তবে তারও চেয়ে অধিক মনে হয় অন্তর্গত কোন ঐক্য লেখকের সাথে বোধ করায়, পাঠকের। সন্দীপনের লেখা পড়লে আমার মনে হয়, আমি নামের একটা লোক আমার কথাগুলোই লিখে গিয়েছেন নিজসৃষ্ট চরিত্রের মুখগুলি দিয়ে। নিজের মনের সকল অন্ধকার সকল আলো একেবারে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে অনায়াস লিখে ফেলেছেন। অকপটে বলেছেন, উপমামাত্রই ছেনালিতে ভরা। মানে ছেনালি সহ্য না হলে বাবা, সাহিত্য পড়তে এসো না!
এই ছেনালি ছেনালিই, পারভার্সন এট ইটস বেস্ট, তবে যে লেখক আর্তনাদের কারণ ও উৎসসন্ধান করতে পারেন, তার বিবৃতিতে নয় আমি বরং সংশয়ে বিশ্বাস করতে চাই। সন্দীপন একটা স্বাভাবিক ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন— 'ভদ্রলোকের গায়ে দামী শাল, পাশে অতীতে ঘুঁটে দিয়েছেন এমন মধ্যবয়সী গম্ভীর স্ত্রী, শোফারও গাড়ি এগিয়ে এনে দরোজা খুলে দাঁড়িয়েছে'। পাঠক রসিক না হলে এই বয়ানের মর্মবাণী সে বুঝে নিয়ে মজাটা লুটতে পারবে না। বুঝবে না, কেন অয়দিপাউস, কেন সর্বনাউশ, কেন পৌষমাউস!
জীবনের দিকে এই কৌতুকপূর্ণ চাহনিতে তাকাতে পারেন বলেই সন্দীপন লিখতে পারেন— "সময় থাকতেই আমাদের প্রত্যেকের একা হয়ে যাওয়া উচিত। বড় ফাঁকা মাঠ বিশাল জনসমুদ্র একা পেরোনো উচিত। সবাই যদি নিজেকে এমন একা করে নেয় তাহলে কাউকে আর ভীড়ের মাঝখান থেকে তুলে নিতে হয়না। মৃত্যু একাকীত্বকে আলিঙ্গন করে, যদিও মৃত্যুকে এ কথা আমরা কোনদিন বলতে পারিনি…"।
'স্বর্গের নির্জন ঊপকূলে'-তে একটা এন্টি-ইডিপাস কম্প্লেক্সের গল্প বলেছেন সন্দীপন, এই উপন্যাস আমার এতোই পছন্দ যে পাঠকের সাথে শেয়ার করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না প্রায়, এর প্রায় প্রত্যেকটা লোকেশন আমি দেখে এসেছি, মালাবার হিলস, মুম্বাই-এর জুহু বিচের সৈকত, আন্দামান, শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডির ঊপকূলৃজীবনে কোনদিন সিনেমা বানালে এ গল্প বানিয়ে ফেলবো আমি, বলেছি কত প্রেমিকাকে আহা!
তাদের পড়ে পড়ে শোনাবো, 'মানুষের প্রবণতা যখন ডাকে, সে-ডাক নিশিডাকের মতন। সে ডাকে 'যাই' বলে আধোঘুমে সাড়া দিয়ে যারা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়, তাদের ঘুমঘোর আর ভাঙে না। প্রবণতার জন্ম আদিতে, অস্তিত্বে, যা পুরোপুরি প্রাকৃতিক। সামাজিক দায়দায়িত্ব, পারিবারিক কর্তব্য, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া' এসব মানুষের হিসেব। প্রকৃতি, বা, বিশ্বাসীরা যাকে ঈশ্বর বলেন, এ মানুষ তাঁর কাছে জারজ। 'আমরা শুধু প্রাকৃতিক নয়, সমাজবিজ্ঞান এবং সামাজিক ইতিহাসেরও'— এ-রকম অনুশাসন সত্ত্বেও, মৌলিক প্রবণতাগুলি চারিতার্থ করার অমোঘ আত্মধ্বংসী আকর্ষণ মানুষের মধ্যে ফিনিক্স পাখির মত বেঁচে আছে এবং চিরকালই থাকবে। মার্কস-এঙ্গেলসসহ মানুষের সামাজিক ইতিহাসে এমন একটা মুহূর্ত নেই, যখন মানুষ তার ব্যক্তিগত আনন্দের চরিতার্থতার জন্য—যে কোনও সমাজ-বিজ্ঞান বা দর্শনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেনি।
ছবি: গত বছর কোলকাতা বইমেলায় আজকাল-এর স্টলে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে ভেংচি কাটছেন লেখক
স্বর্গের নির্জন ঊপকূলে
স্বর্গের নির্জন ঊপকূল'র কথা যে কারণে মনে হলো, কন্যা পিতার যৌনতা, কিংবা কন্যার প্রেমিকের প্রতি পিতার দৃষ্টিভঙ্গি, ডাবলবেডে একা'র ঐ মর্ষকামিতা, আরব গেরিলাদের সমর্থণ করার মতো মানবিক সংকটে ফেলে দেয়া পাঠককে, বা 'ক্রিতদাস ক্রিতদাসী'র সেই অসামান্য প্রেমবর্ণনা, এমন এক মানুষের পক্ষেই সম্ভব লেখা যে তার জীবন থেকে যৌনবিবেচনা, প্রতিমুহূর্তে অপরা বা আদারকে বিচার করতে থাকার অভ্যাস বাদ দিয়েছে। যে আধুনিক মানুষ, যে মুক্তচিন্তার মানুষ, স্তনকে যে আদর করার কথাই ভাবে, যোনীকে কর্ষণ করার কথা কিংবা নারীকে ভালোবাসার কথা। যৌনতাকে অস্বীকার করার অশ্লীলতা যে করে না।
লেখার শুরুতে জীবনানন্দের কথা বলেছিলাম, জীবনানন্দের সাথে সন্দীপনের মিলের জায়গাটা ঐ, জীবদ্দশায় সহলেখকদের তাচ্ছিল্যই অর্জন তাদের, সমকাল চিরদিন বড়লেখকদের যে বুঝতে পারে না, পারলো না, পারছে না পারবে না তার এক প্রমাণ যেনো! (আহা! নিজের কথা ভেবে মায়া লাগে!)
তবে সন্দীপনের অর্জিত তাচ্ছিল্যের মাত্রাটা একটু বেশি। এমনকী তার মৃত্যুর পর অদ্রীশ বিশ্বাস সম্পাদনা করে ডায়েরী প্রকাশ করলেন, শুনতে হলো 'এ এক সেক্স-প্রিডেটরের ডায়েরী'। তবে আমার মনে হয়, পাহাড়ি ঝর্ণার সঙ্গে ওঁরাও রমণীর পিঠের ওপর লুটিয়ে থাকা বেণীর তুলনাকে যৌন আগ্রাসন বলে না, কাব্যসৌন্দর্য্য বলে, যেটা সন্দীপনের গদ্যে বহুজায়গায় নানাভাবে খুঁজে পাওয়া যায়, তার জন্য মুক্তমনপ্রাণ লাগে, প্রেমিক হৃদয় লাগে।
হ্যাঁ, সন্দীপন সেক্সিস্ট ছিলেন। নিঃসন্দেহে ছিলেন। স্বঘোষিত সেক্সিস্ট সেটি দ্বিধাহীনভাবে প্রকাশ করেছেন তার লেখার পরতে পরতে। কিন্তু মাথায় রাখা প্রয়োজন যে তিনি সেই দৃষ্টিভঙ্গি লুকোতে যাননি কোনোদিন, বরং ডকুমেন্ট করেছেন, নির্মমভাবে লিপিতে লিপিতে লিখেছেন, নিজের প্রতি সহানুভূতি না দেখিয়েই। যৌনতাকে স্বাভাবিক ভেবে স্বাভাবিক ভাবেই অ্যাপ্রোচ করেছেন নিজের নিরহংকার নোংরামি-সমেত। সুনীলদের মত পদতলে বসে কৃপাপ্রার্থী হতে চাননি নারীতনুর। এটাও মাথায় রাখা প্রয়োজন যে বাকিরা এই কাজটা করেননি; হাংরিরা যেমন পুরুষ ও প্রকৃতির বাইনারি টেনেছেন এটা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েই যে পুরুষ এবং তার "শক্তি"-ও আসলে প্রকৃতি থেকেই সৃষ্ট। এখানেই মনে পড়ে, রুবি কখন আসবে'র কথা, মনে পড়ে, ধ্বংসের মধ্য দিয়ে যাত্রা বা কলেরার দিনগুলিতে প্রেমের কথা। প্রেম যে আদতে ভাটার অমোঘ টানের মতো ভয়াবহ, তা সভ্যসমাজ অস্বীকার করতে করতে সমস্ত যাপন আজ পানসে করে ফেলেছে, এই ভদ্দরনোকদের জন্য লেখেন নাই সন্দীপন, সন্দীপন সেই প্রাণপূর্ণ প্রেমিকের জন্য লিখেছেন যে সমস্ত অবহেলা ও তাচ্ছিল্যের জবাবে মমতাকে চায়। এই মমতাকে, প্রিয় পাঠক, আপনি ভাবতে পারেন আক্ষরিক অর্থে, মমতা। আবার সমান্তরালে তাকে সন্দীপনের লেখা 'ভারতবর্ষ'র চরিত্র মমতার ধরে নিতে পারেন। যে মমতাকে সঈদুল বিবিসিতে বাবরী মসজিদ ভাঙার দিন প্রকারান্তরে ধর্ষণ করে। যে মমতা সঈদুলকে শারিরীকভাবে চায়, অথচ ঘর নেই বলে যাদের যৌনতা হয় না। মমতার ভেতরটা ভেঙে দিতে দিতে সঈদুল সেদিন বিবিসিতে বাবরী মসজিদ ভাঙা দেখে। ভারতবর্ষকে বুঝতে হলে, তার প্রান্তিক পিঁপড়েদলের মানুষের সুখ দুঃখ বুঝতে হলে সন্দীপন ছাড়া আর গতি কি? এ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তিনি, যিনি বাবরী মসজিদ যখন শিবসেনারা ভাঙছেন তখন মমতার সাথে মুসলমান সঈদুলকে শুইয়ে দিচ্ছেন হুট করে পাওয়া ঘরে।
এই মানুষের রিপুর পাশে দাঁড়ানো সন্দীপনকে পড়তে গেলে সজনীকান্ত বুঝতে হবে অনেকটা। ওই লেভেলের প্যারডি সেই সময় দাঁড়িয়ে সজনীকান্ত লিখেছিলেন। ভাবতে পারেন সজনীকান্ত প্রিয় বন্ধু মনোজ বসুকে একজায়গায় বর্ননা করছেন বনজ মোষ বলে। এই উইটটা সকলে নিতে পারেন না। যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে মাগীবাজ এবং শরৎচন্দ্রকে মাতাল আখ্যা দেওয়া হয় কিংবা জীবনানন্দকে অশ্লীল কবি, অনেকটা সেভাবেই এরা সন্দীপনকেও দাগিয়ে দেন, 'সেক্স প্রিডেটর'। তবে তাতে, যে সন্দীপনকে ভালোবাসতে পারে, বাসতে পারে নিজস্ব বেশ্যাকে ভালো, তার কিছু আসে যায় না! কারণ যে জেনেছে, সন্দীপন তার পাঠকের সমস্ত নন্দনকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন— এভাবে— 'আমি প্রায় সবকিছুকেই মিথ্যা ও ভুল বলে ধরে নিয়েছি। সবচেয়ে বড় ভুল ও মিথ্যা বলে ধরে নিয়েছি আমার আন্তরিকতাকে। কোন ভোর ভালো লাগলে, বা কোথাও গড়ের পিছনে সূর্যাস্ত দেখে মুগ্ধ হলে কোনদিন, কাঁধে হাত রেখেছি নিজের, সত্যি তো? নাকি বই পড়ে শিখেছো?' জানতে চেয়েছি, 'বা, এইরকম প্রচলিত বলে ভালো লাগছে?'
ডাবল বেডে একা
আমার একটা কবিতার লাইন অনেকের স্ট্যাটাসে স্ট্যাটাসে ঘুরতে দেখি। আমরা সবাই একলা কেবল যৌথ থাকার ভান করি। একা না হলে দেখা হয় না যে সন্দীপন এই নির্মম সত্য পাঠকের মগজে গজাল ঢুকিয়ে দিতে পারেন। সন্দীপনের উদ্ধৃতি দিয়েই শেষ করি, যেহেতু সন্দীপন মুগ্ধতার গল্প আমি আমার অনাগত প্রেমিকাদের জন্য ডাবল বেডে একা শুয়ে রাখতে চাই কিছু বাকী— 'এলিয়টের মৃত্যুর পর প্রকাশিত এক বিশাল কমমেমোরিয়াল ভলিউমে সবাই দিস্তে দিস্তে লিখলো! শুধু এজরা পাউন্ড লিখেছিলেন পাঁচ লাইন। যথা: কে আর লন্ডনের অলি-গলি দিয়ে হাঁটার সময় অমন শুখা হিউমার করবে! আর ওর কবিতা নিয়ে কি আবার বলব। শুধু বলতে পারি: রিড হিম।"
প্রিয় লেখকের প্রয়াণদিবসে, এই মোর অঞ্জলি, রিড সন্দীপন, ইফ ই্উ আর এট লিস্ট, ডাবলবেডে একা।