Published : 28 Jul 2020, 11:00 PM
এটি কোনো পাদটিকা নয়, বরং সিদ্ধান্তের সমান্তরাল এক উপসংহার, ক্লিনটন বি সিলির 'আ পোয়েট অ্যাপার্ট' বইটিকে অনুবাদ করে বাংলা ভাষায় জীবনানন্দ দাশ চর্চাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন ফারুক মঈনউদ্দীন। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো মানুষ তিনি; নানা জাতের নানা মনের মানুষের সঙ্গে মিশে, নানা নদী-সমুদ্র-বন ঘুরে নানা বাতাসের স্রোতে ভেসে অভিজ্ঞতার ঝুলিতে যা জমা হয়, সেসবের প্রত্যক্ষ না হোক, খানিকটা পরোক্ষ আস্বাদও আমরা পাই তাঁর লেখাজোকা থেকে। মুশকিল হলো, তাঁর ভ্রমণ কাহিনী আর ব্যাংকিং অর্থনীতি বিষয়ক লেখালেখির ডামাডোলে আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি যে, তিনি এক অগ্রগণ্য গল্পকারও। ১৯৭৮ সালে বা গত শতাব্দীর সত্তর দশকের শেষদিকে সাহিত্যের জগতে তিনি এসেছেন গল্প লেখার মধ্য দিয়েই। যদিও প্রতিনিধিত্বশীল গল্পগুলোকে এক মলাটের মধ্যে নিয়ে আসতে, গল্পসংকলন প্রকাশ করতে লেগে যায় একযুগ। প্রথম বই-ই বলি আর প্রথম গল্পসংকলনই বলি, তাঁর সেই গ্রন্থ 'বৈরী স্রোত' বের হয় ১৯৯০ সালে, দেশ প্রকাশন থেকে। কিন্তু সেখানেই তিনি থেমে থাকেননি, ২০১৮ সালে বেরিয়েছে তাঁর সর্বশেষ ও চতুর্থ গল্পগ্রন্থ 'যেই সব শেয়ালেরা'।
এই গল্প কিংবা গল্পের বইয়ের নামের মধ্যে দিয়ে ফারুক মঈনউদ্দীন অকস্মাৎ আবারও আমাদের নিয়ে যান জীবনানন্দ দাশের কাছে, মনে করিয়ে দেন তাঁর 'যেইসব শেয়ালেরা' কবিতাটিকে :
যেই সব শেয়ালেরা জন্ম-জন্ম শিকারের তরে
দিনের বিশ্রুত আলো নিভে গেলে পাহাড়ের বনের ভিতরে
নীরবে প্রবেশ করে,—বার হয়,— চেয়ে দেখে বরফের রাশি
জ্যোৎস্নায় প'ড়ে আছে;— উঠিতে পারিত যদি সহসা প্রকাশি
সেইসব হৃদযন্ত্র মানবের মতো আত্মায় :
তা হলে তাদের মনে যেই এক বিদীর্ণ বিস্ময়
জন্ম নিতো;— সহসা তোমাকে দেখে জীবনের পারে
আমারও নিরভিসন্ধি কেঁপে ওঠে স্নায়ুর আঁধারে।
এই কবিতা জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন ১৯৪৮ সালে–ভারত বিভক্তির পরে, এক বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে এবং অবশ্যই তার ব্যক্তিগত টানাপড়েনের ভেতরে, যদিও কবিতার অন্তরীক্ষে তা একাকার হয়ে গেছে সমসাময়িক ইহজাগতিক, পারিপার্শ্বিক কর্কশ ও হিংস্র অন্ধকারময় ভারতবর্ষের সঙ্গে। ফারুক মঈনউদ্দীনের বই কিংবা নামগল্পের সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের যোগাযোগ আপাতদৃষ্টিতে শুধু এমন–তিনিও এক অস্থির সময়ের কথা শুনিয়েছেন আমাদের, বলেছেন শুধু ব্যবস্থা এবং প্রকৃতিই নয় মানুষের জীবনযাপন, ব্যক্তিগত নৈতিকতা এবং যুথবদ্ধ শুভেচ্ছাও ভেঙে পড়ছে বিকৃত পুঁজি ও উন্নয়নের আগ্রাসনে; কিন্তু গভীর চোখে তাকালে আমরা আটকে যাই জীবনানন্দীয় ওই অবিরাম ঝরে পড়া ক্ষরণের পাঁকে।
১৯৭৮ সাল থেকে ফারুক মঈনউদ্দীনের যে পথপরিক্রমার শুরু, তিনটি বই– 'বৈরী স্রোত' (১৯৯০), 'আত্মহননের প্ররোচনা' (১৯৯৯), 'অপরিচয়ের কালবেলা' (২০০৯) ও 'সেইসব শেয়ালেরা' (২০১৮) মিলিয়ে তাঁর লেখার বিষয়আশয়, গদ্যের প্রকরণ এবং কনটেন্ট ও ফর্মের খেলার সামগ্রিক একটা রূপরেখা নিশ্চয়ই খুঁজে পাই আমরা। প্রথম বই প্রকাশের পর বলতে গেলে প্রায় এক দশকের বিরতি, তার পর ছাপা হতে দেখি তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থকে, আবার একদশক পূর্ণ হওয়ার মুখে ছাপা হতে দেখি তৃতীয় গল্পগ্রন্থকে। তার পর এই চতুর্থ গল্পগ্রন্থটিও ছাপা হয়েছে আরেকটি দশক পূর্ণ হওয়ার আগে। এইভাবে তিনি স্পর্শ করেছেন পরবর্তী প্রতিটি দশককে, হয়ে উঠেছেন প্রত্যেক দশকের। সত্তরের লেখকরা পল্লবিত হয়েছেন ষাটের দশকের আলোছায়ায়, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি গৌরবজ্জ্বল কালপর্বের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হওয়ার পরও যেন নিমজ্জিত হয়েছেন ভয়াবহ এক বন্ধ্যাত্বে। এটি ঠিক, দীর্ঘ টালমাটাল সময় অতিক্রম করেছেন তারা, কেননা সত্তরের দশক মানেই বিশেষত তরুণ সমাজের অস্থিরতার কাল, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে পাহাড়সমান স্বপ্নে বিভোর তরুণদের হতাশা ও অস্থিরতায় বিবর্ণ ও ফিঁকে হয়ে ওঠার কাল এবং লেখাই বাহুল্য রাজনৈতিক হত্যারও কাল। সাহিত্যের ইতিহাসে দেখা যায়, দেশে দেশে এমন ক্রান্তিকালে সাহিত্যিকরা সৃজনশীলতায় আরও মুখর হয়ে উঠেছেন। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সত্তরে যারা কথাসাহিত্য চর্চায় এলেন নতুন করে, তাদের সৃষ্টির মগ্নতা ও ক্রোধের প্রকাশ তেমন ঝাঁঝালো নয়। যদিও সময়টা ছিল ভয়াবহ ক্ষরণের: যুদ্ধ শেষ হয়েছে, বিধ্বস্ত দেশে জাতীয় বুর্জোয়া হয়ে ওঠার সুবর্ণ সুযোগের মুখে লাঠি মেরে রাষ্ট্র পরিচালনাকারীরা উন্মত্ত লুটেরা হতে, দেশ পরিচালনার গতিমুখ নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা, বামপন্থীদের একাংশ মনে করছেন স্বাধীনতা আসেনি বরং দেশ চলে গেছে বিদেশি আধিপত্যবাদীদের হাতে, নিষিদ্ধ প্রতিক্রিয়াশীলরাও মহাসক্রিয় নিজেদের পুরানো আসন ফিরে পেতে, পাশাপাশি দুর্ভিক্ষ-ক্ষুধা-দুর্নীতি বিবশ করে ফেলেছে গোটা দেশকে। এমন পরিপ্রেক্ষিত থাকার পরও সত্তরের শিল্পী-সাহিত্যিকরা ছিলেন ভয়ানক ম্রিয়মান। আশি ও নব্বইয়ের দশকে এসে অবশ্য এদের বেশ কয়েকজনকে আমরা ক্রমশই উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখি, যাদের মধ্যে রয়েছেন সুশান্ত মজুমদার, মইনুল আহসান সাবের, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মঞ্জু সরকার, হরিপদ দত্ত, ফারুক মঈনউদ্দীন প্রমুখ। যদিও সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করতে গেলে সত্তরের আগের বিভিন্ন দশকে যারা কথাসাহিত্য চর্চা শুরু করেছিলেন সেই সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, মাহমুদুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রাহাত খান, আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখও পরবর্তী কয়েক দশকজুড়ে তুরীয়ানন্দে বিচরণ করেছেন। তাদের উদ্দাম সৃজনশীলতার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার ক্ষমতা সত্তরের দশকে যাদের অভ্যুদয় ঘটল, তাদের কতটুকু ছিল, সে প্রশ্নের নিষ্পত্তি নিশ্চয়ই একদিন সাহিত্যসমালোচকরা করবেন।
সত্তর দশকের যারা এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও হাল ছাড়েননি, বরং তীব্র প্রতিযোগিতায় নেমেছেন নিজেদেরই ছাড়িয়ে যেতে, ভেতরে জমে ওঠা বহ্নিদাহকে ছড়িয়ে দিতে, তাদেরই একজন ফারুক মঈনউদ্দীন। 'সেই সব শেয়ালেরা' তাঁর অভিজ্ঞানের প্রকাশ, নিরীক্ষারও বটে। দুর্বিনীত এই সময়কে তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন এবং তার সেই প্রশ্নময়তার ধার এত তীব্র যে, অনুভব করি, নিরেট মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গতানুগতিক পাঠরুচিতে আবদ্ধ হয়ে থাকার মোহ অতিক্রান্ত এক লেখক তিনি। ১০ টি গল্প তাঁর এই বইয়ে– ১০ রকম কাহিনী, ১০ রকম মানুষ, সময়ও বোধকরি ১০ রকমের। কিন্তু অভিন্নতাও আছে। আর বড় কর্কশ সেই অভিন্নতা। সেই মধ্যবিত্ত সমাজের কথা বলেছেন তিনি যারা বিকৃতির মধ্যে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে; এই মধ্যবিত্ত সমাজের অন্তর্গত তেমন সব পুরুষ, প্রতারণা করতে, লোলুপতা দেখাতে আর উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণী সোপানের দিকে নিজেদের অর্থনৈতিক শ্রেণীযাত্রা উদ্যাপন করতে যারা কেবলই নারীভূক হয়ে ওঠে। এমন একটি শ্রেণীর ক্রূঢ়তা ও জটিলতা দেখানোর জন্যে যাদের উপস্থিতি প্রয়োজন হয়, সেই নিম্নবর্গের মানুষও আছে তাঁর গল্পে। সব মিলিয়ে তাঁর গল্পগুলো এ কথাই বলে ওঠে, তাঁর পাঠক আসলে প্রচল পড়ুয়া কেউ নন। সেই অর্থে বলতে গেলে, তিনি শুধু সময়কে নয়, কাহিনীকে নয়, চরিত্রকে নয়,পাঠককেও নির্মাণ করেছেন। তার গল্পের কর্কশ অভিন্নতাগুলোর সঙ্গে শেষ পর্যন্ত পথ চলা ভীষণ কষ্টকর।
প্রথম গল্পের কথাই ধরা যাক; 'কোথায় শরণ' নামের এই গল্প ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত দারিদ্রে মথিত নুরীর যার মাতৃআকাঙ্ক্ষা কতটুকু প্রবল, তা জানার কোনও সুযোগই হয় না আমাদের। পাঠক হিসেবে আমরা বরং উত্তম পুরুষের সেই 'আমি' কিংবা রোকনদাকে নিয়েই বড় বেশি ব্যস্ত থাকি। আমাদেরই জাতভাই তারা, কাজের মেয়েকে অন্তঃসত্বা করে ফেলেছে রোকনদা, সে কীভাবে দায়মুক্ত হয়, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হব না, সে কী করে হয়! সবচেয়ে বড় কথা, নিজেরাও তো হঠাৎ করে ওই কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতে পারি, অতএব রোকনদাই বড় উদ্বেগের বিষয় আমাদের। সেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে পাঠক হিসেবে আমরা এগোই বটে, কিন্তু অনেকটা অনুপস্থিত আর একেবারেই নিম্নকণ্ঠী হয়েও নুরীই যেন বার বার উপস্থিত হয় বড় প্রবলভাবে, উপস্থিত হয় বড় একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে। রোকনদার জন্যে নিশ্চয়ই এটি একটি বড় বিপদ: একজন হাজীর সন্তান হলেও এবং হাজীবাড়িতে অত লোকজন থাকলেও কীভাবে সে একজন কাজের মেয়ের সঙ্গে এরকম সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে, তা একটা বড় প্রশ্নই বটে; কিন্তু বিপদে পড়লেও সে বেশ নির্বিকারভাবেই বলতে পারে, 'অত হিস্টরি কতি পারব নানে, ঘইটে গেসে, বাস। আরে তুমি শালা খুব সাধু মারায়ো না। ভাল কইরে দেহিছিস মাইয়েডারে? দক্ষিণির মাল, ভাইটেল চাউলের ভাত খায়ে বড় হয়েসে না? পুষ্ট ধানের গোছার মতো ও রহম হাত ভর্তি এইরে ধরার মতো।' তার রূক্ষ্মতাও খুবই স্পষ্ট, 'শোন, বিপদে পড়িসি বইলে খুব ভাব নিচ্ছিস? তোরে কলাম ক্যান জানিস? তোর মাথাডা খুব পরিষ্কার, আর ভাবলাম তোরে বিশ্বেস করা যায়। আরও আছে না কতজন আমারে তেল মাইরে চলে, এক খানকির ছাওয়ালরেও বিশ্বেস করি না আমি।' রোকনদা যে বিপদে পড়েও কত সুপরিকল্পিতভাবে, নিষ্ঠুরতার সঙ্গে চিন্তা করতে পারে, তা আমরা টের পাই এর একটু পরেই। ক্লিনিকে যখন নুরীর গর্ভপাত ঘটানোর প্রস্তুতি চলছে, বাইরে নুরীর অসহায় বাবা অপেক্ষা করছে, ভেতরে রোকন তখন ডাক্তার মিনতি মণ্ডলকে খুব ঠাণ্ডা ও নিচুকণ্ঠে বলছে, 'আচ্ছা, একসাথে লাইগেশন করায়ে দেওয়া যায় না দিদি?'
সারা জীবন, নূরীর সারাটা জীবন নির্বিঘ্নে ধর্ষণ করে যেতে চায় রোকনদা। বিপদে পড়লেও তাই এমন একটা সুপ্ত বিকৃত সুখের ঘোরে ঘুরপাক খেতে একটুও বাঁধে না তার। খুব অল্প দু-একটি সংলাপে আর নির্লজ্জ হাসিতেই ফারুক মঈনউদ্দীন আমাদের এভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন দুর্বিনীতি এই কালের নির্লজ্জ, নিষ্ঠুর, লোলুপ মানুষগুলোর সঙ্গে। যে মেয়েটিকে তার বাবা ঢাকায় গার্মেন্টসে পাঠায়নি, কী না কী ঘটে–সেই ভয়ে, আর নগরের বদলে কাজ করতে দিয়েছে গ্রামের হাজীবাড়িতে, সেখানে এমন একটি ঘটনা ঘটার পর তার বাবার স্বগতোক্তি শুনি, 'অ্যাহন বুঝতি পারলাম ভাইজান, আল্লার দুনিয়ায় গরিবির জন্যি নিরাপদ কুনো জায়গা নেই।'
গরিবের জন্যে অনিরাপদ এই পৃথিবীতে কেবল নুরীর অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্ক ও গর্ভই হয় না, বিল্লালের দাদী সফুরা একটা কম্বলের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, ক্যামেরার দিকে আর তাকাতেই পারে না, মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া ঠেকাতে সে তার দুর্বল শরীরে কম্বলের এককোনা ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে, কিন্তু তার মুখের ওপর যেন বিদ্যুৎ খেলতে থাকে। দরিদ্রকে পুঁজি করে জনপ্রতিনিধিরা তাদের রাজনৈতিক অবস্থান নির্মাণের যে খেলায় নামেন, তার বলি হতে হয় সফুরার মতো মানুষদের। ফারুক মঈনউদ্দীনের বিত্তের সন্ধানে মরিয়া মধ্যবিত্তের নষ্টামী, ভ্রষ্টামী গাঁথা অনিবার্যভাবে তাদের লুণ্ঠনের ক্ষেত্র নিম্নবিত্ত শ্রেণীরও সুলুকসন্ধান করে। নিম্নবিত্ত,যারা কোনওদিনই এইসব গল্প পড়বেন না, জানবেন না তারা কী দরদের সঙ্গে ধরা পড়েছেন মঈনউদ্দীনের কলমে। সেই সব মানুষগুলোকে বার বার কাটছাট করে বনসাই বানানোর প্রবণতার পরও কী করে যেন তারা বড় বেশি তীব্রভাবে উন্মোচিত হয় তাঁর গল্পে। 'কোথায় শরণের' কথা তো আগেই বলেছি। মনে হয়, নেহাৎ রোকনদা কত বিপদাপন্ন হয়ে পড়েছে আর তা থেকে মুক্তির চেষ্টায় মরিয়াও হয়ে উঠেছে, সেটার বয়ানই শুনছি আমরা উচ্চকিত লয়ে। কিন্তু কার্যত পুরো গল্পজুড়ে সমান স্রোতেই প্রবাহিত হয়ে চলে নুরি ও তার পিতা; গল্পজুড়েই আমাদেরকে স্পর্শ করে তাদের ক্ষরণ এবং একেবারে শেষে এসে যা তীব্র হয়ে ওঠে, আমাদের নিঃস্ব করে ফেলে।
আর নারীরা, ফারুক মঈনউদ্দীনের নারীরা? কেমন তারা? পুরো নারী সমাজই যেন নানা দোলাচলের পরও একটি মাত্র শ্রেণীতে পরিণত হয় তাঁর গল্পে। পুরুষদের মতো তারা নানা শ্রেণীতে বিভক্ত নয়,তাদের শ্রেণী একটাই: শোষিত, নিপীড়িত। পুঁতু-পুঁতু মধ্যবিত্ত সমাজকে নিয়ে যারা গল্প লিখছেন, যাদের গল্পে নারীও পুঁতু-পুঁতু মধ্যবিত্ত– এইখানে এসে ফারুক মঈনউদ্দীন তাদের লেখার সঙ্গে তাঁর নিজের লেখার একটি সুস্পষ্ট ও উচ্চকিত বিভাজন তৈরি করেন। এইখানে এসে মনে পড়ে যায় বিশেষত তাঁর 'সম্পর্ক' গল্পের কথা। সাধারণভাবে বিবেচনা করতে গেলে এই গল্পের নাইমা মধ্যবিত্তই বটে, মামার সংসারে বড় হয়েছে, কলেজে শিক্ষকতা করে, শিক্ষা-রুচি-সংস্কৃতি মিলিয়ে তাকে এই শ্রেণীগোত্রের বাইরে রাখা ন্যায্য হয় না। কিন্তু যে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তাকে সাফল্যের পথে এগোতে হয়, কলেজের শিক্ষক হওয়ার পরও যেভাবে জীবনযাপন করতে হয়, তা তাকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীসোপানে বেঁধে রাখতে পারে না; তিনি পরিণত হন আসলে একজন আপাদমস্তক শোষিত মানুষে। 'কোথায় শরণের' নুরীর সঙ্গে 'সম্পর্কের' নাইমার আসলে কোনো পার্থক্য থাকে না শেষমেষ। নুরীকে গর্ভপাত ঘটাতে হয়েছিল, কারণ তখনও তার বিয়ে হয়নি; সদ্য স্বামী হারানো নাইমার কাছেও দেখি তার মামা এই বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন, এখনও সময় আছে, দ্রুত পেটের সন্তানটাকে নষ্ট করে ফেলুক। ভালো ছেলে দেখে আবারও বোনের মেয়েকে বিয়ে দিতে চান তিনি।
ফারুক মঈনউদ্দীন যে সময়ের মানুষ, তাতে তাঁর গল্পে যে মুক্তিযুদ্ধও থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাঁর আরেকটি বইয়ের নামগল্প 'আত্মহননের প্ররোচনা' মুক্তিযুদ্ধেরই এক অনবদ্য গল্প। এ বইটিতেও তেমন একটি গল্প আছে। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি প্রতিস্থাপন করেছেন নতুন এক সময়ে, বর্তমান সময়ে যখন মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবসায় পরিণত করেছে কতিপয় মানুষ আর যার মাশুল দিতে হচ্ছে অসংখ্য নির্মোহ মুক্তিযোদ্ধাকে। 'মানসম্মান' নামের গল্পটির কাহিনী শাদাসিধাভাবে এমন এক প্রেক্ষাপটের যেখানে লোভলালসা আর ক্ষমতার মোহ থেকে গা বাঁচিয়ে গাঁয়েগঞ্জে কোনোমতে বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধা রেহানউদ্দীন হঠাৎ এই ভেবে আশাবাদী হয়ে ওঠে, মন্ত্রণালয়ে গিয়ে পিওন মনিরুলকে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা অন্তপ্রাণ সচিবের কাছে চেষ্টাতদবির করলে তার সন্তানের চাকরিবাকরি একটা কিছু হয়ে যাবে। রেহানের ছেলের একটা কিছু হলে তার ছেলেরও কিছু একটা ব্যবস্থা হবে, এই আশায় তার সঙ্গে সঙ্গে যায় মুক্তিযোদ্ধা নাজের আলী। কিন্তু বেশ কয়েকদিন থাকার পর অকস্মাৎ তারা জানতে পারে, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের যে সচিবের কাছে তারা ধর্ণা দিতে এসেছে, সেই সচিবই একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। আজই সে ওএসডি হয়েছে এই কারণে। তড়িঘড়ি করে মন্ত্রণালয় থেকে বেরিয়ে আসে তারা দু'জন মিশে যায় আর ব্যস্ত জনারণ্যেও প্রাণখুলে হাসার পর থম ধরে মুক্তিযোদ্ধা রেহানউদ্দীনকে আমরা বলতে শুনি, 'আল্লা যা করে ভালর জন্যি করে, ঠিক না? আমরা দুই আসল মুক্তিযোদ্ধা আইছিলাম এক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার কাছে তদবির করতি। মানীর মান আল্লায় রাহে, কি কও নাজের মিয়া?' এই গল্প এই প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে, যে নৈতিকতা আর সম্মানবোধের ধারণা নিম্নবর্গের মানুষ ধারণ করে, তাদের শোষণের জাঁতাকলে ফেলে নিষ্পেষণ করার পেছনে কি তা হলে সেটাও একটা হাতিয়ার হয়ে ভূমিকা রাখে না? ফলে সমাজের শিক্ষিত অংশের সবচেয়ে শীর্ষ সোপানের মানুষগুলো যে অন্যায়-অনিয়মগুলো করে চলেছে, তা যেন ঠিক পুরোপুরি প্রত্যাখ্যাত হয় না; নৈতিকতা ও আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষগুলোর এই পলায়নপরতা ও বিচ্ছিন্নতা শেষমেষ তাদেরকেই যেন বিজয়ী করে রাখে। ওএসডি হওয়া কিংবা সম্মানের সঙ্গে পদত্যাগ করে সবেতন চলে যাওয়া অথবা পুনর্তদন্তের মধ্যে দিয়ে স্বমহিমায় ফিরে আসা– এসবই তার লক্ষণ। ফারুক মঈনউদ্দীন রেহানউদ্দীন ও নাজের আলীর আত্মসম্মানবোধকে উজ্জ্বল করতে চেয়েছেন এবং পেরেছেনও বটে; কিন্তু যে পরিমাণ ঘৃণা এমন মুক্তিযুদ্ধব্যবসায়ীদের ওপর পাঠকের জেগে ওঠার কথা, তা বোধকরি ওঠে না।
এ বইয়ের নামগল্প এবং শেষগল্প 'সেই সব শেয়ালেরা'ই বোধকরি তেমন এক গল্প যা আমাদের তীব্রভাবে ছুঁয়ে যায়, রক্তাক্ত করে; অবচেতনে এর দীর্ঘ বিস্তারী রেশ রয়ে যায়, ঠিক তেমনই সচেতনে এর কাহিনী, গদ্যশৈলী, রূপকের প্রয়োগ, সমসাময়িকতা, মহাকালীনতা সব কিছুই নতুন এক মাত্রা যুক্ত করে। এ বইয়ে এর আগের দু'টো গল্প 'চাওয়া পাওয়া' এবং 'অপ্রণয়' গল্প দুটো হয়তো যে পরিমাণ গতানুগতিক আস্বাদ দেয় ও পাঠের ক্লান্তি জাগায়, অবসাদগ্রস্ত করে, এই গল্পটি সেসব গতানুগতিকতা ও ক্লান্তি মুছে ফেলে তীব্র এক বিলোড়ন তৈরি করে।
বিদেশি কোম্পানি গ্রামে উন্নয়নের ঠিকাদারি নিয়ে এসেছে, রাস্তা নির্মাণ করবে তারা। যেভাবেই শুরু হোক না কেন, আমরা যেন এ গল্পে খানিকটা পথ চলার পরেই নিশ্চিত জেনে যাই, আসলে গ্রামীণ সমাজ নির্মাণেরই নতুন এক পালা শুরু হতে চলেছে এর মধ্যে দিয়ে। প্রথমে মনে হয়, শুধু বিদেশি তো আসেনি, সঙ্গে সঙ্গে এসেছে তাদের খাদ্যাভাসও। তাই উজাড় হয়ে যাচ্ছে এলাকার কুকুরের দল। কিন্তু শুধু খাদ্যাভাসই তো আসেনি, সবচেয়ে দাপটের সঙ্গে এসেছে পুঁজি, বিশ্বায়িত অর্থনীতির দাপট। বিদেশিদের এই খাদ্যাভাস চর্চার মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে তাই পাল্টে যেতে থাকে পুরো গ্রাম। বিশ্বায়িত নতুন এক ভুবনে প্রবেশ করে তারা, তাও আবার যত না চিন্তা ও মননে, তার কয়েকশ' গুণ বেশি উচ্ছিট্টভোগী হিসেবে। কে না উচ্ছিট্টভোগী এখানে? উচ্ছিট্টভোগী রাষ্ট্র, উচ্ছিট্টভোগী সরকার, উচ্ছিট্টভোগী প্রতিটি শ্রেণী। রাতের কুকুর আর শেয়ালের ডাকাডাকির সঙ্গে এক হয়ে যায় দু'পেয়ে মানুষরূপী কুকুর ও শেয়ালের হাকাহাকি। বিশ্বায়নের জালে আটকানো একটি গ্রামকে ছটফটাতে দেখি আমরা যেখানে এসেছে সেইসব শেয়ালেরা, যারা 'জন্ম জন্ম শিকারের তরে/দিগন্তে বিশ্রুত আলো নিভে গেলে পাহাড়ের বনের ভিতরে/নীরবে প্রবেশ করে'; আর কুকুর যেন এখানে কুকুর হওয়ার পরও স্বদেশি মানুষের প্রতিবিম্ব, যারা প্রতিদিন উজাড় হওয়ার মধ্যে দিয়ে শেয়ালের আগ্রাসনকে আরও অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। সন্ধ্যায় কিংবা রাতে চারপেয়ে বেপরোয়া শেয়াল এসে হানা দেয় আখক্ষেতে, হানা দেয় খোঁয়াড়ে; কিন্তু তারও চেয়ে ভয়ানক দুপেয়ে শেয়াল স্বচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করে দিনেরাতে পুরো গাঁয়ে, পুঁজির আগ্রাসন আর ভোগবাদী সময় নড়বড়ে করে ফেলে একটি গ্রামের সনাতন রূপকে। সেখানে সংক্রমিত হয় কত যে ক্ষুধা: পুঁজির, উচ্ছিট্টের, সুরেন দাশদের মেয়ে সরলাদের শরীরের। সরলাকে, শহিদুলকে কিংবা বিশ্বায়নের জালে আটকানো একটি গ্রামকে, একটি দেশকেই যেন আমরা স্থবির কিংবা মুণ্ডুহীন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি আর রাতভর চিৎকার শুনি সেইসব শেয়ালদের, যাদের মনে কখনোই জন্ম নেয় না 'বিদীর্ণ বিস্ময়'।
এর চেয়ে ভালো গদ্যরূপ আর কি-ইবা হতে পারে জীবনানন্দ দাশের 'যেইসব শেয়ালেরা' কবিতার? সেই সব মানুষদের এই সব রূপ আমরা আর কোথায়ই-বা পেতে পারি, যেমনটা পেয়েছি ফারুক মঈনউদ্দীনের 'সেইসব শেয়ালেরা' গল্পে?