দুঃখজনক হলেও সত্যি, একই মহাদেশের দুটি দেশে হলেও বাংলা ভাষায় জাপানি সাহিত্যের প্রবেশিকা স্বরূপ প্রতিনিধিত্বকারী প্রবন্ধের বড্ড অভাব, সেখানে অভিজিৎ মুখার্জির লেখা ভূমিকা ও প্রবন্ধগুলো পাথেয় হতে পারে।
Published : 06 Apr 2025, 06:27 PM
ভাষার সাংকেতিকতা বিষয়ে দার্শনিক এর্নস্ট কাসসিরের মতামত নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী ‘ভাষা অর্থ সত্য’ বইতে বলেছেন— ‘ভাষা, শিল্প, বিজ্ঞান ইত্যাদি মননের এক-একটি ক্ষেত্র কেবল বাহ্যজগতের নথি নয়; সেগুলি এক-একটা স্বকীয় সাংকেতিক মণ্ডল, নিজের নিজের বিশেষ পদ্ধতিতে নিজস্ব জগৎ নির্মাণ ও নির্দেশ করে। এই সাংকেতিক সৃষ্টিগুলি বাস্তবের অনুকরণ নয়, বলা চলে বাস্তবের ব্যাখ্যা: একমাত্র এদের মাধ্যমেই বাস্তব কোনও কিছু আমাদের চেতনায় উপলব্ধ হয়, আমরা তা দেখতে জানতে বুঝতে পারি।’ ভাষার এই সাংকেতিকতার জন্য বস্তু অনুপস্থিত থাকলেও, না দেখেও তার প্রতিচ্ছবি আমাদের মস্তিষ্কে জেগে ওঠে। আমাদের ভাবের আদান-প্রদানে বাধা তৈরি করে না।
এদিকে বিনোদন ছাড়াও মানুষের সাহিত্য পাঠের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো— সাহিত্য একজন পাঠককে পরিচিতের জগতের বাইরে নিয়ে নতুন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করবে, যা তার আশপাশের জগৎকে উপলব্ধিতে সহায়ক হবে। এটা যেন ভাষার মতোই সাংকেতিকতার প্রকাশ। এর একটা নমুনা হতে পারে জেন গল্প। ভিক্ষুদের জেন গল্পগুলো নেহায়েত গল্প নয়, বরং আপাত গল্পের ভেতরে দ্বৈতভাবে বুদ্ধ দর্শনের বিস্তার, প্রজ্ঞার বাহন।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত জাপানের সাহিত্যেও এর বিস্তার দেখা যাবে। কাহিনির অভ্যন্তরীণ বার্তা (ইনার মিনিং) এক্ষেত্রে সাহিত্যের বড় শক্তি। সাহিত্যের ওপর-কাঠামোর ভেতর ‘চিন্তা’ না থাকলে তা সময়কে অতিক্রম করে না, টিকেও থাকে না। সেই বিচারে লেখিকা ইয়োকো ওগাওয়া আমাদের কী বার্তা দিলেন, সেটাই খতিয়ে দেখা যেতে পারে। তথ্যের খাতিরে জেনে রাখা ভালো, ভারতবর্ষে যা ‘ধ্যান’ বলে প্রতিভাত, বৌদ্ধ অধ্যুষিত চীন-জাপান-কোরিয়ায় তা ‘জেন’ বলে খ্যাত হয়েছে।
ইয়োকো ওগাওয়ার উপন্যাস ‘অঙ্কের জগৎ ও অধ্যাপকের প্রেম’ (হাকাসে নো আইশিতা সুউশিকি) বাঙালি পাঠকের অভিজ্ঞতায় অনেকটাই নতুন। বিশেষ করে কাহিনির দৃশ্যমান যে ভর— অঙ্ক বা গণিত— সেটা নতুন বটেই। ফলে তা ঘিরেই কাহিনি বয়ানে উপমা-উৎপ্রেক্ষা কঠোর সংযমে আবর্তিত হয়েছে। লক্ষ্য করার ব্যাপার হলো, গণিতের জগৎ বাঙালির কাছে যতটা বিরস মনে হয়, প্রেম সেখানে সুখময় মনে হলেও অধ্যাপকীয় ভারিক্কির কারণে তাঁর সঙ্গে বেঢপ শোনাবে!
ওগাওয়ার ঝুলিতে আরো কিছু উপন্যাসের সঙ্গে একাধিক আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কারও আছে। যেমন ‘অঙ্কের জগৎ…’ অনুবাদের সুবাদে অধ্যাপক অভিজিৎ মুখার্জি ঢাকা থেকে সম্মানজনক বাংলা ট্রানস্লেশন ফাউন্ডেশন (বিটিএফ) পুরস্কার পেয়েছেন। তারও আগে অনুবাদের জন্য তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ লীলা রায় স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছিলেন। ‘অঙ্কের জগৎ…’ উপন্যাসটি নিয়ে আলোচনার আগে আন্তর্জাতিক বাজারে জাপানিজ ভাষার সাহিত্যের অবস্থা কি, তা একটু ঘুরে দেখা যেতে পারে। তাতে এর বিশ্বজনীনতা খানিকটা টের পাওয়া যাবে।
সম্প্রতি দুবছরের পূর্ব-পর ব্রিটেনে দুটি পাঠক জরিপে দেখা গেল— অনুবাদে পঠিত বইয়ের মধ্যে একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে এগিয়ে আছে জাপানি সাহিত্য। নিঃসন্দেহে আগে যারা জাপানি সাহিত্য প্রভাবিত করেছেন ও নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের ধারা থেকে এখনকার সাহিত্যের বিষয়বস্তু অনেকটাই আলাদা। তারপরও পাঠক ঐতিহ্য ও বৌদ্ধ দর্শন প্রভাবিত জাপানি সাহিত্যেই আত্মার মুক্তি, মানসিক স্বস্তি, বৌদ্ধিক স্বীকৃতি পেয়েছে।
জাপানের শতবর্ষ আগের সাহিত্যিকদের মধ্যে সেনসেই য়োকোমিজো, সেইকো মাৎসুমোতো, ওগাই মোরি, কিংবা অধিক পরিচিতদের মধ্যে রাওনোসুকে আকুতোগাওয়া, ওসামু দাজাই, জুনিচিরো তানিজাকি, নৎসুমে সোসেকি, কোবো আবে এবং অবশ্যই ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার কথা বলতেই হবে। পরে শতবর্ষে সাহিত্যে তিনটি নোবেল জয় তারই ধারাবাহিকতার অর্জন। অবশ্য মিশিমা ইউকিও সাহিত্যে নোবেল না পাওয়া আরেক গল্প, আর হারুকি মুরাকামি বেশ কয়েকবছর ধরে পুরস্কার ঘোষণার আগে আলোচনার তুঙ্গে থাকছেন। এসবই হচ্ছে অনুবাদের সুবাদে।
অনুদিত ফিকশনের (গল্প-উপন্যাস) চাহিদা সম্পর্কে জানতে ২০২২ সালে যুক্তরাজ্য জুড়ে একটা জরিপ চালায় বুকার প্রাইজ ফাউন্ডেশন। তাতে দেখা যায়, বিক্রির তালিকার শীর্ষে থাকা ৩০টি ফিকশনের মধ্যে ১৪টিই জাপানি ভাষায় লেখা। এমনকি অনুদিত ফিকশন সেদেশে ইংরেজিতে লেখা গল্প-উপন্যাসের চেয়েও বেশি জনপ্রিয়। একই বছর নিলসেন বুকস্ক্যান সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে, যুক্তরাজ্যে বিক্রি হওয়া মোট অনুবাদ ফিকশন বইয়ের ২৫ শতাংশই জাপানি। এর চেয়েও চমকে দেওয়ার মতো ফলাফল পাওয়া গেছে সাম্প্রতিক জরিপে। ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ান বলছে— ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত অনুবাদ হওয়া ৪০টি সর্বাধিক বিক্রিত ফিকশন বইয়ের ৪৩ শতাংশই জাপানি লেখকদের দখলে।
পত্রিকাটি বলছে— গত কয়েক বছরে জাপানি ফিকশন বইয়ের চাহিদার ‘বুম’ (বিস্ফোরণ) হয়েছে। ইউরোপ তো বটেই, বিশ্বের অনেক দেশে জাপানি ফিকশন বইয়ের অনুবাদ দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। লেখিকা ইশোমিতো বানানার বিখ্যাত ‘কিচেন অ্যান্ড লিজার্ড’ উপন্যাস দিয়ে ১৯৮০ দশকের শেষ নাগাদ থেকে শুরু করে ১৯৯৮ সালে হারুকি মুরাকামির ‘উইন্ড-আপ বার্ড ক্রোনিকলস’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে জাপানি সাহিত্যের এই উলম্ফন শুরু।
হালে জাপানি আরোগ্যমূলক (হিলিং), হৃদয়ের উষ্ণতামূলক (হার্টওয়ার্মিং), মোটাদাগে আরামদায়ক বই (কমফোর্ট বুকস) এখন ইউরোপসহ অনেক দেশে অনুবাদ বইয়ের বাজার ধরে রাখছে। এগুলো নিয়ে তেমন আলোচনা সমালোচনা লেখা হয় না, তবে বিক্রি হয় হয় দেদার! পাঁচ-দশ লাখ কপি শুধু ইংরেজিতেই বিক্রি হয়! তবে বিক্রির শীর্ষে থাকলেও হারুকি মুরাকামি মোটেই কমফোর্ট বুকসের লেখক নন, বরং উপরি গল্পের ভেতর গভীর— অবশ্যই তা বুদ্ধদর্শন-তাড়িত— বার্তা দিয়ে যান। আর উপজীব্য বিষয়ের বিচারে ইয়োশো ওগাওয়ার ‘অঙ্কের জগৎ…’ একেবারেই আলাদা। বিস্তর রিভিউ-সমালোচনা পেয়েছে।
২.
সাহিত্যচিন্তকদের ভাষায়— ‘গল্পকে কখনও মিথ্যা প্রতিপন্ন করা যায় না, কারণ তা সত্যতাই দাবি করছে না।’ তাহলে গল্পের সব চেয়ে শক্তিশালী দিক কী? তা হলো, গল্প কেবল ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলে না, যেটা ঘটার সম্ভবনা ছিল তারও ইতি-নেতি তুলে বিশ্লেষণ করতে পারে। এই সমস্ত কিছুই হয় বাস্তবতার সঙ্গে সংযোগ রেখেই। এ ক্ষেত্রে গল্প বাস্তবতা থেকে কল্পে পৌঁছে (সিন থেকে আনসিন); বিপরীতভাবে কল্প থেকে বাস্তবে (আনসিন থেকে সিন) আসতে পারে।
ইয়োকো ওগাওয়ার আগে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের কাছে অনুবাদে জাপানি লেখকের মধ্যে সব চেয়ে যিনি জনপ্রিয় হয়ে আছেন, সেই হারুকি মুরাকামির লেখার ধরন ‘দেখা থেকে অদেখা’ (সিন থেকে আনসিন) কাহিনি যাত্রা পদ্ধতি। ‘অঙ্কের জগৎ…’ বইয়ে লেখিকা দেখা বা অভ্যস্ত জগতের ভেতর আরেক মানসিক অবস্থার মানুষের গল্প বলে গেছেন, তাকে অপরিচিত লাগলেও অস্বীকার করার উপায় থাকেনি। উপর-কাঠামোর ভেতর যে কেউ সাহিত্যে বহুল-চর্চিত যাদুবাস্তবতা (ম্যাজিকরিয়ালিজম), পরাবাস্তবতা (সুরিয়ালিজম) খুঁজে পেতে পারেন, তবে সাহিত্য কখনোই এই সব কলাকৌশলে আটকে থাকেনি। জাপানি সাহিত্য তো নয়ই। যেমন উপন্যাসের নামের মধ্যে ‘প্রেম’ শব্দটা থাকলেও সেটা ইউরোপীয় বাস্তবতায় যৌনতাতাড়িত সম্পর্কের কথা বলছে না, বরং গোটা উপন্যাসে প্রেমবিষয়টা বুঝতে হবে প্রতিশ্রুতি, নির্ভরতা, আস্থা, যত্ন, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, আগলে রাখা, মানসিক স্বস্তির নিরিখে।
অস্বীকার করার সুযোগ নেই, পশ্চিমা পুঁজি (পুরুষতন্ত্রও) তাড়িত যৌন বাণিজ্যের এই বিশ্বায়িত দিনে অজৈবিক ওই সব গুণাবলির অভাবেই ‘প্রেম’ নামক অপার্থিব বোধহীন আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত জীবনযাপন করি। এই সংকট এতই গভীর যে ‘প্রেম’ ও ‘ভালোবাসা’ শব্দের ভিন্নার্থ করে স্বাতন্ত্র্য রক্ষার চেষ্টা করা হয়! এর বিপরীতে খ্রিস্টিয় প্রভাবান্বিত ‘প্লেটোনিক লাভ’ বলতে যা বোঝানো হয়, এই অধ্যাপক ও গৃহপরিচায়িকার মধ্যে তার প্রভাব বা মিল খোঁজা হয়তো ঠিক হবে না। বরং পরস্পর নির্ভরতা, প্রচন্ড আত্মসংযম ও যত্নের প্রেক্ষিতে দেখা যেতে পারে।
৩.
‘অঙ্কের জগৎ ও অধ্যাপকের প্রেম’ উপন্যাসটা আবর্তিত হয়েছে ১৯৭৫ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনার পর স্বল্প সময়ের (৮০ মিনিট) স্মরণশক্তিওয়ালা গণিতের অধ্যাপক, তাঁর গৃহপরিচায়িকা সিঙ্গেল মাদার, পরিচায়িকার শিশুপুত্র ‘রুট’ এবং অধ্যাপকের বিধবা বৌদিকে কেন্দ্র করে। কেবল মনুষ্য বিবেচনায় পাঠকের চোখ এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়— উপন্যাসে গণিত নিজেই একটা বিরাট চরিত্র, যেমন ঘটনাক্রমে খুব উপস্থাপিত না থাকলেও বিরাট প্রভাব বিস্তার করে আছেন অধ্যাপকের বৌদি। একইভাবে বেসবল খেলার খুঁটিনাটি ও বিভিন্ন টিমের রেকর্ড এবং অবশ্যই ২৮ নম্বর জার্সি পরা খেলোয়াড় এনপিৎসু কাহিনিকে অনেকটা এগিয়ে নিয়েছে।
‘অঙ্কের জগৎ ও অধ্যাপকের প্রেম’ এর বিষয়গত দিক নিয়ে আলাপ করতে গেলে আমাদের লেখিকা ইয়োকো ওগাওয়ার অগ্রজ লেখক মুরাকামির ‘নারী বিবর্জিত পুরুষেরা’ (ওন্না নো ইনাই ওতোকোতাচি) বইয়ের প্রসঙ্গ সামনে চলে আসে। তথ্যের খাতিরে জানানো যেতে পারে, বাজারে এই বইটির জাপানি থেকে অনুদিত বই রয়েছে অভিজিৎ মুখার্জির অনুবাদ-সম্পাদনায়। এই বইয়ের গল্পগুলোতে তিনি দেখাতে চেয়েছেন— কোনো কারণে নারীরা ছেড়ে গেলে বা নারীরা ছেড়ে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলে পুরুষদের জন্য কী দুরাবস্থা তৈরি হতে পারে। পাঠক লক্ষ্য করবেন, মুরাকামি কিন্তু নারীহীন শুধু পুরুষের জগতের কথা বলছেন না, বরং উল্টো বার্তাই দিচ্ছেন। সেই বার্তারই যেন বিস্তৃত ও ভিন্ন প্রেক্ষাপটের কাহিনি বলছেন ইয়োকো ওগাওয়া। ‘অঙ্কের জগৎ…’ উপন্যাসে তিনি দেখান, এক দুর্ঘটনায় একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত স্মৃতি আটকে যাওয়া গণিতের অধ্যাপকের জীবনে নারীর উপস্থিতি-যত্ন না থাকলে কী দুর্বিসহ হয়ে উঠতে পারত। গৃহপরিচারিকার যত্ন আর শিশুসমেত পরিবারিক আবহ অধ্যাপকের স্বচ্ছন্দ, সাবলীল হয়ে ওঠা ও জটিল গাণিতিক সমস্যা সমাধান করার মধ্যদিয়েও তা বোঝা যায়।
একইভাবে ‘নিজস্ব-নির্ভরতার পুরুষ’ পাশে না থাকায় গৃহপরিচায়িকা ও অধ্যাপকের বৌদি কী দুরাবস্থায় পড়েছিলেন। সন্দেহবশত গৃহপরিচায়িকাকে একবার দেখভালের দায়িত্ব ছাড়া করার পর যেমন অধ্যাপকের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল, একইভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন পরিচায়িকার জীবন। সেই সময়ে অধ্যাপকের অনুপস্থিতিতে হৃদয়ে শান্তি পাওয়ার জন্যইবা গৃহপরিচারিকা উৎসাহি হয়ে (অধ্যাপকের চর্চিত) গাণিতিক সূত্রের সুলুক খুঁজতে গিয়েছিলেন আর্কাইভে। এটা যে অধ্যাপকের সাহচর্য ও একাত্মতা বোধ থেকেই হয়েছে তা বোঝার বাকি থাকেনি।
পুরো উপন্যাসে প্রায় স্মৃতিহীন হয়ে যাওয়া অধ্যাপকের গণিতের প্রতি প্রবল অন্বেষা, একটা সাধারণ সামাজিক সংবেদন পাওয়া যায়। আবার অধ্যাপকের প্রতি গৃহপরিচারিকার যত্ন, সহানুভূতি, অনুরক্ত মুগ্ধতাই যেন উপন্যাসের মূল সুর মনে হতে পারে। পাঠের শুরুতে গত শতাব্দীর সত্তুর-আশির দশকের বাংলা সিনেমার মেলোড্রামায় আক্রান্ত পাঠকের কাছের গৃহপরিচারিকা ও অধ্যাপকের মধ্যে মুহুর্মুহু প্রেমের সম্ভাবনা ভেবে ফেলাও অস্বাভাবিক ছিল না। তবে উপন্যাসের নামানুসারে খুঁজতে চাইলে— প্রচলিত প্রেম ঠিক কোথায়, তা এক লহমায় বুঝে ওঠা যাবে না। গোয়েন্দা কাহিনির মতো লেখিকা যেন সেই ইঙ্গিতগুলো উপন্যাসের নানা বাঁকে ছড়িয়ে দিয়েছেন, সচেতন পাঠকের তা চোখও এড়াবে না। তা-ই একটু খতিয়ে দেখা যেতে পারে এখানে।
উপন্যাসে (প্রথম পরিচ্ছেদে) সিঙ্গেল মাদার একজনকে অধ্যাপকের দেখভালের দায়িত্ব দেয়ার সময় বৌদির অবস্থা বর্ণনায় লেখক ইঙ্গিত দেন— “মহিলার মুখনিঃসৃত ‘ঠাকুরপো’ শব্দটাতে কী যেন একটা ইতস্তত ভাব ধ্বনিত হচ্ছিল।” অধ্যাপকের স্মৃতিভ্রমের কারণ খুঁজতে গিয়ে পাওয়া পত্রিকার যে প্রতিবেদন আছে (সপ্তম পরিচ্ছেদে)— দুর্ঘটনার সময় অধ্যাপকের পাশে হেল্পারের সিটে ছিলেন তাঁর বৌদি। ব্যাপারটা নিতান্তই ঘটনাসাপেক্ষে মনে হতে পারে। তবে (নবম পরিচ্ছেদে) বাড়ির পাটাতনের নিচে লুকিয়ে রাখা থিসিসের পাতা উল্টাতে গিয়ে বেরিয়ে আসা সাদা-কালো ছবিতে অধ্যাপকের দিকে সলজ্জভাবে মাথা ঝুঁকে থাকা নারীটি যে ‘সেই বিধবা মহিলা’ বুঝতে পারেন গৃহপরিচায়িকা। এমনকি সেই ছবির পেছনে হাতে লেখা—‘চিরকালের ভালোবাসার জন N-কে উৎসর্গ করলাম, কোনোদিন যাকে ভুলব না’— খুঁজে পাওয়ার মধ্যদিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। গণিতের দুর্জ্ঞেয় সূত্রের মতো এই N নির্দেশিত নারী তাঁর বিধবা বৌদি বৈ কেউ নয়! যার স্বীকৃতি পাওয়া যায় অধ্যাপকের স্মরণশক্তি (স্মৃতি নয় কিন্তু) একেবারে ধসে যাওয়ার পর গৃপরিচারিকাকে বলা বৌদির কথা—‘আমার দেওর এই জীবনে আর তোমাকে মনে করতে পারবে না। কিন্তু আমাকে সারা জীবন ভুলবে না।’ যেকারণে, পাঠকের মনে পড়ে, এক ঝড়ের রাতে জ্বরাক্রান্ত অধ্যাপকের বাড়িতেই গৃহপরিচারিকা ও তাঁর শিশুপুত্রের থেকে যাওয়ার ঘটনায় ‘বিধবা মহিলা’ কেন অমন ক্ষেপে গিয়ে চাকরিচ্যুত পর্যন্ত করেছিলেন! (অবশ্য পরে ফিরিয়েও আনা হয়েছিল পুরোনো দায়িত্বে।)
নর-নারীর এই সব প্রেমের মীমাংসা দিয়ে উপন্যাসের আবেদন শেষ হয় না, বরং কাহিনির বৌদ্ধিক বুনন, জীবনের গভীর অন্বেষার দিকটি সামনে নিয়ে আসে। যেমন উপন্যাসের শেষের দিকে অধ্যাপকের স্মৃতিশক্তি যখন উনিশশ পঁচাত্তর থেকে আর এক মিনিটও এগুচ্ছে না, ভুলেই যান গৃহপরিচারিকা যত্নের স্মৃতি, তাঁর যত্নের চেয়ে চিকিৎসা নির্ভরতা বেড়ে যায় বলে পরিবারের কাছে সমর্পণ করে চাকরিটা ছেড়ে দিতে হয়, তারপরও প্রায় ১০ বছর অধ্যাপককে দেখতে যাচ্ছেন মা-ছেলে। তখনও রুটের সঙ্গে— যদিও ততদিনে সে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র— শিশু বৎসল্যে মিশছে, বাড়ির উঠানে খেলছেন অধ্যাপক। উপন্যাস জুড়ে গৃহপরিচারিকার ওপর একটা অদৃশ্য নজরদারি— যেমনটা ঝড়ের আগে গোপনে দেখতে গিয়েছিলেন— থাকলেও শেষ পর্যন্ত আন্তরিক যত্ন, দায়িত্বশীলতা, বিশ্বস্ততা এবং চাকরিচ্যুতির আগে পরিচারিকাকে সম্পদে লোভী বলে তিরস্কারের পরও তাঁর নির্লোভে আশ্বস্ত হয়ে অধ্যাপকের প্রতি সমান তাঁর অধিকার মেনে নিতে দ্বিধা করেন না বিধবা বৌদি।
৪.
কাহিনির এই মূল সুরের বাইরেও লক্ষণীয় অনেক খুঁটিনাটি উপন্যাসটিকে পাঠকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলে। যেন ঘরের এমন সব কৌণিক অবস্থানে জানালা খুলে দেয়, যেখান দিয়ে তাকালে ভেতরের অনেক প্রান্ত দেখা যায়! সেখান থেকে কয়েকটি নিয়ে একটু আলোচনা করলে এই প্রস্তাবের বিস্তৃতি বোঝা যাবে।
উচ্চকিত না হলেও লক্ষ্যণীয় হলো যে দুর্ঘটনায় অধ্যাপকের স্মৃতি স্থির ও স্মরণশক্তি সীমিত হয়ে যাওয়ার সময়। বছরটা— ১৯৭৫। এই ঘটনা নিয়ে গৃহপরিচারিকা আলোচনা করছেন ১৯৯২ সালে, ইতিহাস বলে যখন সবে ‘বাবল ইকোনমি’ বিপর্যয় থেকে বের হচ্ছে জাপান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিপুলভাবে বিপর্যস্ত জাপান দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের তলে থেকেও নিজেকে দ্রুত অর্থনৈতিকভাবে গুছিয়ে তুলতে চাইছে। নিজের আত্মশক্তি ভুলে মার্কিন প্রেসক্রিপশনে নেয়া ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রামের’ ফলে সংকট যেন বাড়িয়েই তুলছে। সাল হিসেবে ‘৭৫ সালেই ইসরায়েল-আরব যুদ্ধের কারণে জাপানে তেল সংকট এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনের মুক্তবাজার নীতি মেনে অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত করে তুলে। যার চূড়ান্ত ফল হিসেবে ‘৮০ দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে পরের দশকের প্রথমার্ধে ‘বাবল ইকোনমি’ (১৯৮৬–‘৯১) যুগে ঢুকে পড়ছে জাপান। এই সময় জুড়ে পেশাগত উন্নতির জন্য দীর্ঘ বছর অবিবাহিত থাকা, বিয়ের পরও সন্তান জন্মদানের হার কমে যাওয়া, স্বতন্ত্র পরিবারের ঝোঁক, নিজস্ব মূল্যবোধ ভেঙে পড়ে জাপান রীতিমত জেরবার অবস্থা। মনে করিয়ে দেয়া যেতে পারে, জাপানের এই সংকট আঁচ করতে পেরে ঐতিহ্যবাহী রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ফেরার আহ্বানে করা এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর দেশটির অন্যতম সাহিত্যিক মিশিমা ইউকিও ১৯৭০ সালে সম্মানজনক হারিকিরি করেন।
অনুসন্ধানী পাঠকেরা জানেন, জাপানি লেখকেরা সাহিত্যের ভেতর দিয়ে ইতিহাসের গুরুতর সংকট ও সমাধানের আত্মসমীক্ষা হাজির করেন। সেটা জাপানি ভাষার প্রথম নোবেল জয়ী ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা থেকে শুরু করে মিশিমা ইউকিও, কজু ইশিগুরু, হারুকি মুরাকামির লেখায়ও সত্য। সেই চর্চার ধারাবাহিকতা ও ইতিহাসের ওই সময়ের কথা মনে রেখে বলা যায়— ভেঙে যাওয়া দুটি (অধ্যাপক ও গৃহপরিচারিকা) জাপানি পরিবারের চিত্র এঁকে সেই বিপর্যয়ের ইঙ্গিতই কি দেন, লেখিকা ইয়োকো ওগাওয়া? একইভাবে বিপর্যয়ের চিত্রের বাইনারি হিসেবে প্রবলভাবে ফুটে ওঠা পরিবারিক বন্ধনের প্রয়োজনীয়তা, শেষপর্যন্ত দেশটির ঐহিত্য অনুযায়ী দুজনের সহৃদয় একাত্মতা বোধ। স্মৃতির কণ্টকহীন কাজমগ্ন অধ্যাপকই যেন জাপানের গভীরতম সমস্যা উত্তরণের ইঙ্গিত দেয় বৈ কি!
৫.
অধ্যাপকের স্মৃতি হারানোর ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, চরিত্রগুলোর ভেতর কিছু একটা অবগুণ্ঠন রয়ে গেছে (হয়তো তা জাপানের জীবনেরই অংশ), তবে চরিত্রগুলো পরস্পরকে উন্মোচন করেছে। কয়েকটি ঘটনার মধ্যে এই অবগুণ্ঠনের আশ্চর্য মুক্তি ঘটে। যেমন প্রথমে অধ্যাপকের বইয়ের তাক গোছাতে গিয়ে শেলফের নিচে বিস্কুটের বয়ামের ভেতর বেসবল প্লেয়ারদের কার্ড আবিষ্কার (পৃষ্ঠা ৮৩) করেন গৃহপরিচারিকা। পরে একে একে অধ্যাপককে উপহার দেয়ার জন্য স্যুভেনির স্টোরে খুঁজে হন্যে হয়ে শেষে এক সহকর্মীর বন্ধ হয়ে যাওয়া পারিবারিক স্টোরের গুদামে পেয়ে যান পুরোনো কার্ড। একইভাবে আর্কাইভের গণিতের সূত্রের সুলুক পেয়ে যান গৃহপরিচারিকা। শেষে অধ্যাপকের ঘরের কাঠের পাটাতনের নিচে আবিস্কার করেন সেই উনিশ বছর বয়সে লেখা গণিতের জটিল থিসিসের সমাধান। গণিতমগ্ন স্মৃতি ভোলা অধ্যাপকের ভেতরও সংরক্ষিত ছিল আশ্চর্য সহৃদয়তা, তাও এক আবিষ্কার বটে। এগুলো কি শুধুই ঘটনা মাত্র, নাকি জীবনে গভীর নির্দেশ? আসলে সমাজে বাহ্যিক যে মানুষকে খুবই পরিশীলিত দেখি, বহু প্রবৃত্তি লুকিয়ে রাখার ফলেই সেটা হয়েছে। এসব ঘটনা আমাদের সামনে মেলে ধরে জীবনে গুরুতর গূঢ় এক রহস্য।
গোপন স্থানে (নিচে লুকানো) খুঁজে পাওয়ার ঘটনা ফিউদর দস্তইয়েভস্কির ‘অজ্ঞাত বাসের কড়চা’ (ইংরেজিতে: নোট ফ্রম আন্ডার গ্রাউন্ড) উপন্যাসে অবদমিত মনের ধারণার সঙ্গে মিলে যায়। দস্তইয়েভস্কির লেখার প্রায় শত বছর পরে ওই উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করেই জগৎ খ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড খুঁজে পেয়েছিলেন বিখ্যাত ‘অবদমন তত্ত্ব’। তিনি দেখান, বাহ্যিক মানুষের ভেতরে একটা অবদমিত মন থাকে, যাকে নিজেই মনের গভীরে ঠাঁই দিয়ে বহন করে চলেন।
এই বিষয়টাকে, মনের গহনকেই যেন প্রকাশ্য করে দেখানো হয়েছে অস্ট্রেলিয়ান চলচ্চিত্রকার জেনিফার কেন্টের (Jennifer Kent) ‘দ্য বাবাডুক’ (The Babadook) নামক মনস্তাত্ত্বিক ভৌতিক ফিল্মে। তাতে দেখা যায়, একটা ঘরের তলকুঠুরিতে বন্দি ‘অশুভ’ সন্তানকে আহার দিয়ে পুষে রাখছেন এক মা। যেন খাবারের অভাবে, পোষাদর না পেয়ে সেটা বাইরে বেরিয়ে না আসে, যথেষ্ট ক্ষিপ্ত হয়ে না যায়— সেই চাহিদাও পুরণ করতে হয় মাকে। এটা তারই গর্ভে জন্ম নিয়েছিল একদিন।
‘অঙ্কের জগৎ…’ উপন্যাসে যেমন দেখি, গৃহপরিচারিকার আবিস্কৃত বিষয়গুলোই অধ্যাপকের সব চেয়ে আগ্রহের ও সেরা অর্জন। মানে, এই মনে গহনে লুকিয়ে রাখা তেজ মানুষের বাহ্যিকতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, লেখিকা আমাদের সেই ইঙ্গিতই দেন।
৬.
এবার অধ্যাপকের গণিত অভিনিবেশের দিকে চোখ ফেরানো দরকার। গণিত নিয়ে মানুষের উৎসাহ বহু পুরো; এটা গণনা বা সংখ্যায় আটকে নেই, সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। যেমন চীন-জাপানে আটকে (৮) সৌভাগ্যের সংখ্যা মনে করা হয়। পশ্চিমা দুনিয়ায় সাতকে (৭) যেমন সৌভাগ্যের সংখ্যা মনে করে, আবার খ্রিস্টীয় প্রভাবে তেরোকে (১৩) দুর্ভাগ্যের সংখ্যা মনে করে। মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১, ৩, ৭ কে সৌভাগ্যের প্রতীক করে অনেক মিথ আছে। আমাদের মনেই আছে, আজকের দিনে বিষয় হিসেবে দর্শন সায়ম্বর হয়ে ওঠার আগে সেটা জ্যামিতির সঙ্গে সমতালে চর্চা হতো, যেমন তার আগে জ্যামিতি চর্চা হতো গণিতের সঙ্গে। একেবারে আধুনিককালে মার্কিন আমেরিকানদের কাছে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ও জন এফ কেনেডি মৃত্যুর মধ্যে কাকতালীয় মিল কিংবদন্তী হয়ে আছে।
সংখ্যাতত্ত্বীয় এমন বহু মিথ এখনো ছড়িয়ে আছে আমাদের আশপাশে। তবে গণিতের অধ্যাপকের আগ্রহ আরো গভীরে। অধ্যাপক বলেছিলেন— ‘নতুন কিছু তৈরি করছি না। আমার জন্মানোর অনেক আগে থেকেই যে গাণিতিক সত্যগুলোর অস্তিত্ব রয়েছে, সেগুলোই খুঁজে বের করছি। ঈশ্বরের খাতায় যে সত্যগুলো লেখা আছে, সেগুলোই একেক লাইন করে টুকে রাখার মতো আর কি। সেই খাতা কোথায় আছে, কবে কখন খুলবে, কারো জানা নেই।’
গণিতের আবিষ্কার যতই মুখ ফেরানো মনে হোক, এর ফলাফল জগতের কাজেই লাগে। উপবৃত্ত সংক্রান্ত গবেষণা গ্রহদের কক্ষপথের হদিস দিয়েছে। যেমনটা অধ্যাপক বলছিলেন— ‘সেই মহান ভারতীয় শিক্ষক ঈশ্বরের খাতায় লেখা 0-টিকে (শূন্য) আবিষ্কার করেছিলেন বলেই, খাতার যে পাতাগুলো তখন পর্যন্ত খোলা হয়নি, সেগুলো খুলে খুলে পড়তে পারা গেছে বলে বলা যায়…।’
অর্থাৎ অধ্যাপকের গণিতে প্রচেষ্টা যতখানি ঈশ্বর চিন্তানিষ্ঠ, ততটাই ইহজাগতিক। তিনি যেন এতেই ধ্যানমগ্ন থাকতে চান। যেমনটা ব্রিটিশ-ভারতের মুসলিম দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল বলেছেন— ‘হে খোদা, যে বেহেশত বানিয়েছো ওটা মোল্লাদের দিয়ে দাও, আমি তোমার রহস্যের মধ্যে ডুবে থাকতে চাই।’
স্মৃতির থেমে যাওয়া অধ্যাপক কোন উদ্দীপনায় গণিতের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে পারছেন? তিনি বলছেন— ‘কিন্তু আমি তো খুব একটা খুশি হতে চাইছি না। আমি যেটা করেছি সেটা হল ঈশ্বরের খাতায় উঁকি দিয়ে দেখে, নেহাতই সেটাকে লিখে রেখেছি আর কি…।’ গণিতের অর্থময়তা যে তাঁর কাছে ধরা দিয়েছে, এতেই তিনি সার্থক বোধ করেছেন।
আমাদের মনে পড়ে, শ্রীমদ্ভাগবত গীতায় এমন একটা কথা আছে। এতে অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন—কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন, অর্থাৎ, একমাত্র কাজেই তোমার অধিকার, ফলের কথা কখনো ভেবো না। গীতার সেই দর্শনের প্রভাবেই অধ্যাপক যেন এমন নির্মোহ, কর্মনিষ্ঠ হয়েছে। এটা জাপানিদের যে কোনো কাজে সফল হওয়ার মূল মন্ত্র, লেখক যেন আমাদের সেই কথা মনে করিয়ে রাখেন।
গণিতের অধ্যাপকের বিরাট কৌতুহলের জায়গা ‘পারফেক্ট নাম্বার’, মানে যা ফ্যাক্টরগুলোর যোগফল ওই সংখ্যার সমান। সেই বিবেচনায় তার কাছে সব চেয়ে পারফেক্ট নাম্বার 28 (আটাশ)। সব চেয়ে ছোট পারফেক্ট নাম্বার 6 (ছয়)। তবে সংখ্যার পরিমাণ যত বাড়তে থাকে, পারফেক্ট নাম্বার তত দূরে সরে যায়। যেমন 28, এরপর 496, 8128, 33550336 এভাবে। অধ্যাপক এ-ও জানান, পারফেক্ট সংখ্যা না হলে ফ্যাক্টরগুলোর যোগফল সেই সংখ্যার চেয়ে হয় বড় হবে, নয়তো ছোট হবে। বড় হলে তা ‘অ্যাবন্ড্যান্ট নাম্বার’, ছোট হলে তা ‘ডেফিশিয়েন্ট নাম্বার’।
সংখ্যা বিষয়ে এই সব আলাপের ভেতর দিয়ে লেখিকা যেন জীবনের গূঢ অর্থের দিকে ইঙ্গিত করেন— পারফেক্ট জীবনের কোনো বস্তু কীভাবে সমন্বিত থাকে, যার বেশি-কম হলেই তা যুত্সই থাকে না। যেভাবে তাঁর অগ্রজ লেখক হারুকি মুরাকামি গল্প-উপন্যাসে কোনো প্রাণীর, ইতিহাসের ঘটনার, পানির নিচের ছোট্ট মাসের ভেতর দিয়ে মানুষের স্বভাবের গুঢ় অর্থ বুঝিয়ে থাকেন।
৭.
গণিতের প্রধান্য উপন্যাসের একমাত্র ভর হিসেবে দাঁড়িয়ে না থাকলেও, এই দিকটা স্মৃতিহীন অধ্যাপকের চরিত্রের বাইনারি (দ্বিমুখী) যৌথতা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রায় উসকে দেয়। যেমনটা দেয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের হোসেন মিয়া কথিত ময়না দ্বীপের অবস্থান। গোটা উপন্যাসটাই যেন আটকে আছে এই কল্পলোক দ্বীপে। কেতুপুর গ্রামের ক্লিষ্ট মানুষগুলোকে কায়িকশ্রম থেকে মুক্তির জন্য ওই দ্বীপের স্বপ্ন দেখান হোসেন মিয়া। এই কল্পলোক দেখানোর কাজটা যেমন সমাজতন্ত্র করে, পুঁজিবাদও দেখায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বলে হোসেন মিয়ার ‘ময়না দ্বীপ’ সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের প্রতীক হয়ে আছে, তবে ওটা পুঁজিবাদের কল্পলোক হিসেবে বিবেচনাও উবে যায় না।
আজকের দিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই উলম্ফনের যুগে পাঠকমাত্রই জানেন, এসব আমরা দেখি গাণিতিক (অ্যালগরিদম) নানান হিসেবের পরিপ্রেক্ষিতে। এটা এই প্রযুক্তির ব্যবহারকারীদের কাছে শুধু পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপন নয়, মতামত তৈরি ও নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখছে গাণিতিক নানান পরিসংখ্যান। আরেক দিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (রোবটিক টেকনোলজি) উত্থানের পেছনেও গণিতের নানান ব্যবহারের কথা আর অবিদিত নয় আজ। এমনকি ডিস্টোপিয়ান লিটারেটার যেমন দেখায়— রোবটিক টেকনোলজি ভবিষ্যতে আমাদের অনেককিছুই নিয়ন্ত্রণ করবে। আবার বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর (সাইন্সফিকশন) সুবাদে কল্পনায় করতে পারি— রোবটিক টেকনোলজির কাছে আমরা প্রত্যেকে একটা সংখ্যা মাত্র। আধুনিক জীবন-ব্যবস্থায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ফোন-বাসা নম্বর, এনআইডি কার্ডের নম্বরের মতো ভবিষ্যতে নির্দিষ্ট মানুষের পরিচয় দাঁড়াবে কিছু সংখ্যার সমাহার।
ফলে ইয়োকো ওগাওয়ার উপন্যাসে অধ্যাপকের গণিত বা সংখ্যার মাধ্যমে কাউকে পায়ের মাপ, উচ্চতা, জন্মতারিখ যাচাইয়ে পদ্ধতি আমাদের মধ্যে একধরনের ফ্যালাচি তৈরি করে। এটা একইসঙ্গে স্থানুবথ, যা স্মৃতিহীন হওয়ার আগের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে; আবার স্মরণের রোবটিক ভবিষ্যতের নির্দশন হাজির করে।
৮.
‘ভালো’ সাহিত্যের গুণের একটি হচ্ছে তা বহু চিন্তার সঙ্গে পাঠকের সংযোগ ঘটিয়ে দিতে পারা। উত্তর-আধুনিক দার্শনিক মিশেল ফুকো বিখ্যাত ‘discipline and punish’ বইয়ে দেখিয়েছেন— ইতিহাসের একটা সময় মানসিকভাবে অসুস্থ— পাগল, মস্তিষ্ক বিকৃত, স্মৃতিহীন— ব্যক্তিদের আধ্যাত্মিক মানুষ মনে করা হতো। পরে যখন রাজ্য শাসনের জন্য বিচার-শৃঙ্খলাবিধান চালু হলো, তখন ওই সব মানুষকে ক্ষতিকর বিবেচনা করে সমাজ থেকে দূরে রাখতে হরেদরে কারাগারে বন্দি (আদতে নজরদারি) ও শাস্তি (আদতে বিনা পারিশ্রমিকের কাজ করানোর) শুরু হলো। কিন্তু আজকের চিকিৎসা ব্যবস্থা বলছেন— তাঁরা ছিলেন মূলত বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী— বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন এই সব মানুষেরা কোনো কোনো বিষয়ে সাধারণ ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি জ্ঞান ধারণ করতে পারে। ফলে দুর্ঘটনার পর স্মৃতি থেমে গেলেও ম্যাগাজিনের গাণিতিক জট খোলার প্রতিযোগিতায় নেমে প্রথম পুরস্কার পেয়ে যান অধ্যাপক। তবে এই অর্জন বিষয়ে তিনি নিদারুণ উদাসীন। তিনি এটি উদযাপনও করতে চান না। তাই কৌশল হিসেবে শিশু রুটের জন্মদিনের সঙ্গে মিলিয়ে রেখে করাতে হয়। অধ্যাপকের এই উদাসীনতার কারণ কী?
পাঠকের মনে থাকার কথা, জগৎখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী নীলস বোর একবার বলেছেন— ‘যা কিছুকে বাস্তব (ধরাছোঁয়ার মধ্যে) বলে গণ্য করি, সেগুলো তৈরি হয়েছে এমন কিছু দিয়ে, যেগুলো আদতে বাস্তব (ধরাছোঁয়ার মধ্যে) কিছু নয়।’ (অনুবাদ: অভিজিৎ মুখার্জি)। এর বহু আগে একইভাবে উপনিষদে বৃহদারণ্যক বলেছেন, ‘স্বয়ং হলেন অবিনশ্বর যা অদৃশ্য এবং সমস্ত বাস্তবতাকে পরিব্যাপ্ত করে লুকিয়ে আছে।’ এভাবেই ব্রহ্ম ও আত্মকে বুঝে থাকেন উপনিষদের অনুসারীরা।
আর এসব কথারই যেন একটা অনুরণন পাওয়া যাবে ‘অঙ্কের জগৎ ও অধ্যাপকের প্রেম’ উপন্যাসে অধ্যাপকের কথায়।
সত্যিকারের সরল রেখা কোথায় পাওয়া যাবে—প্রশ্নের উত্তরে সত্যিকারের রেখাংশ আঁকতে পারা অসম্ভব বুঝিয়ে অধ্যাপক বলছেন, ‘ কোনো বস্তুর কারণে, কিংবা কোনো প্রাকৃতিক ঘটনায়, অথবা কোনো আবেগের কারণে এর হেরফের হয় না, শাশ্বত সত্য চোখে দেখার জিনিস নয়। একমাত্র গণিতই সত্যের সেই রূপকে স্পষ্ট করে তোলে, বাস্তব করে তুলতে পারে। কোনো কিছুই সেখানে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে না।’
ফলে অধ্যাপকের অঙ্ক ছাড়া অন্যকিছু স্মৃতি না থাকা, একার্থে অধ্যাপকের জ্ঞান সাধারণ ব্যক্তি স্তরের উর্ধ্বে থাকাকেই ইঙ্গিত করে। একইভাবে ব্রহ্ম ও আত্মকে বুঝে থাকেন অধ্যাপক। পাঠক সেখানে কী বুঝবেন, সেটা তাঁর জ্ঞানগম্যির ওপরই নির্ভর করছে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, একই মহাদেশের দুটি দেশে হলেও বাংলা ভাষায় জাপানি সাহিত্যের প্রবেশিকা স্বরূপ প্রতিনিধিত্বকারী প্রবন্ধের বড্ড অভাব, সেখানে অভিজিৎ মুখার্জির লেখা ভূমিকা ও প্রবন্ধগুলো পাথেয় হতে পারে। এবিষয়ে ‘যেটুকু জাপান’ নামে তাঁর চমৎকার প্রবন্ধ সংকলনের কথা বলা যেতে পারে। ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যাপনা ছাড়াও দীর্ঘ দিন জাপানি ভাষা শিক্ষা বিভাগের নেতৃত্ব দেয়া, জাপানের কানাযাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন অধ্যাপনা ও বহুবার জাপান ফাউন্ডেশনের বৃত্তিতে সে দেশটি ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। ফলে শুধু ভাষাগত দক্ষতাই নয়, তাঁর অনুবাদে দেশটির সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি যেন অনেকটাই আসতে পারছে। কোনো কোনো দীর্ঘ বাক্য শব্দের সৌকার্য রক্ষা করেই চমকে ওঠার মতো ভাষার সঙ্গতি রক্ষা করেছে। গণিতের মতো জটিল প্রেক্ষাপটেও সাহিত্য পাঠের সৌন্দর্য হারিয়ে যায় না। অনুবাদে মূল সাহিত্যের যা কিছু হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে, তার মধ্যেও অর্জনের যে সম্ভাবনা, তার সবটাই যেন পাওয়া যায় ‘অঙ্কের জগৎ ও অধ্যাপকের প্রেম’ উপন্যাসে।
বই তথ্য:
অঙ্কের জগৎ ও অধ্যাপকের প্রেম
মূল: ইয়োকো ওগাওয়া
অনুবাদ: অভিজিৎ মুখার্জি
প্রকাশক: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা
মূল্য : ৩৫০ রুপি