খোন্দকার আশরাফ হোসেনের তিরোধানের একদশক পেরিয়ে গেছে, এখনও তাঁর রচনাসমগ্র প্রকাশিত হলো না।
Published : 05 Jan 2025, 01:00 PM
৪ জানুয়ারি ছিল কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেনের জন্মদিন। কেউ কেউ মনে রেখে ৪ তারিখে ফেসবুকে শ্রদ্ধাসূচক পোস্ট করেছেন। এ-সবই হয়েছে ব্যক্তিগত পরিচয়, স্মরণ বা আন্তরিক কোনো অনুভূতি থেকে। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগ, মিডিয়া বা সাহিত্যের কাগজগুলো থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই। কখনোই তেমন হয় না। ২০১৩ সালে তাঁর আকস্মিক তিরোধানের পরও তেমন প্রাতিষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। অনলাইনে কিছু লেখা বা স্মৃতিচারণ প্রকাশ পেয়েছিল। প্রায় মাসখানেক পর আমরা কয়েকজন বিশেষ করে অধ্যাপক কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, নিসর্গ-সম্পাদক সরকার আশরাফ, কবি কামরুল হাসান মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার অডিটরিয়ামে একটি স্মরণসভা করেছিলাম। সে-সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, কবি বেলাল চৌধুরী, অধ্যাপক আহসানুল হক, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কবি বেলাল চৌধুরী, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, অধ্যাপক রফিকুল্লাহ খান, বগুড়া থেকে এসে যোগ দিয়েছিলেন কবি ও কথাকার শোয়েব শাহরিয়ার। এরপর সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘নিসর্গ' খোন্দকার আশরাফ হোসেন সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে সরকার আশরাফের উদ্যোগে। কবিতা ও অধ্যাপনার পর খোন্দকার আশরাফ হোসেনের শিলমোহরযুক্ত কাজ হলো তাঁর সম্পাদিত কবিতার কাগজ ‘একবিংশ’। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণের পর ‘একবিংশ’ প্রকাশনা অব্যাহত রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করি মূলত খোন্দকার আশরাফ হোসেনকে সাহিত্যমহলে পরোক্ষভাবে হলেও হাজির রাখার উদ্দেশ্যে। ২০১৪ সাল থেকে তখনকার ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক কবি প্রবন্ধিক অনুবাদক কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় কিছুটা অনিয়মিতভাবে একবিংশ প্রকাশিত হচ্ছে। আমি পালন করছি নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব। সম্পাদনা পরিষদে আছেন `একবিংশ’র বিভিন্ন সময়ের সহকারী সম্পাদকগণ- কবি বদরুল হায়দার, সৈয়দ তারিক, কামরুল হাসান, দাউদ আল হাফিজ (এর মধ্যে তিনিও প্রয়াত হয়েছেন)। ‘একবিংশ’ থেকেও খোন্দকার আশরাফ হোসেনের উপর একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়।
খোন্দকার আশরাফ হোসেনের সাথে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্টতা ‘একবিংশ’কে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। মনে পড়ে ১৯৯৩ সালে প্রথম আমার একটি কবিতা ‘একবিংশ’-এ প্রকাশ পায়, এবং খুব দ্রুত সাহিত্যমহলে পরিচিত হতে শুরু করি। এরপর নিরবচ্ছিন্ন ছিল আমাদের যোগাযোগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ, নিচের টিচার্স লাউঞ্জ, বিকেলে কখনো আজিজ সুপার মার্কেট, কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিচার্স ক্লাবে আমাদের আড্ডা চলমান ছিল। স্যারের বাসায়ও যাতায়াত ছিল আমার প্রায় নিয়মিতই। কলাভবনের একই ফ্লোরের পার্শ্ববর্তী বাংলা বিভাগে পড়ার কারণে তাঁর সাথে আমার প্রতিনিয়ত যোগাযোগ হতো। পরে এই ঘনিষ্টতা এমনই বেড়েছিল যে, কোনো কারণে একটা দিনেরও অনুপস্থিতি আমাদের দুজনেরই ভালো লাগতো না, কৈফিয়ত দিতে হতো। মনে পড়ে কলাভবনের পেছনের দিকের রাস্তা মানে লেকচার থিয়েটারের সামনের রাস্তা থেকে তাকিয়ে খোন্দকার আশরাফ হোসেনের রুমের জানালাটা বন্ধ দেখলে আমার মন খারাপ হয়ে যেতো। বুঝতে পারতাম তিনি ক্যাম্পাসে নেই। কোনো কোনো দিন এমনও হয়েছে তাঁকে তাঁর রুমে না পেয়ে ইংরেজি বিভাগের অফিসে সেই বিখ্যাত ‘সূত্রধর’ মহাশয়ের কাছে খোঁজ নিয়েছি খোন্দকার এসেছেন কি না। হয়তো কোনো ক্লাশ নিচ্ছেন, হাতের বা চোখের ইশারায় ক্লাশরুমের পেছনে বসে অপেক্ষা করতে বলতেন। এ-সুবাদে তাঁর ক্লাশের বক্তব্য শোনার সুযোগ হতো। দারুণ একজন শিক্ষক ছিলেন তিনি। পড়াতেন শেকসপীয়র ও আধুনিক ইংরেজি কবিতার একাংশ। ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যেও ব্যাপক দখল ছিল তাঁর। বিশেষ করে কবিতা বুঝতেন একদম ভেতর থেকে। এজন্যই তাঁর ‘একবিংশ’ কবিতাপত্রটি এমন সমৃদ্ধ হয়েছিল। তখন, মানে নব্বইয়ের দশকে ‘একবিংশ’র এমন ক্রেজ ছিল যে, প্রকাশের আগে থেকেই লোকজন খোঁজ করতে থাকতো। এ ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করেই আমাদের একটা চক্র গড়ে উঠেছিল তখন। তুষার গায়েন, দাউদ আল হাফিজ, কামরুল হাসান, রণক মুহম্মদ রফিক, বায়তুল্লাহ কাদেরী (অনিয়মিত হলেও), সুহিতা সুলতানা, চিত্রশিল্পী দেওয়ান মিজান- আজিজ মার্কেট ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিচার্স ক্লাবে খোন্দকার স্যারের আতিথ্যে আমাদের অনিয়মিত আড্ডা হতো। এ সময় শিলচর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তপোধীর ভট্টাচার্যের সাথে আমাদের সখ্য গড়ে ওঠে, পাশাপাশি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঞ্জন সেন, বগুড়ার নিসর্গ-সম্পাদক সরকার আশরাফ, শোয়েব শাহরিয়ার, চট্টগ্রামের ‘লিরিক’-গ্রুপের এজাজ ইউসুফী, জিললুর রহমানসহ প্রমুখ কয়েকজনের সাথে। মঈন চৌধুরীর সাথেও একবিংশ-কেন্দ্রিকই যোগাযোগ শুরু হয়।
একবার, সম্ভবত ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারি, পশ্চিমবাংলা থেকে কবি বিভাস রায়চৌধুরী ও অশোক শর্মা এসেছিলেন, মূলত ঢাকার একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে অংশ নেবেন বলে। ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকেই ওঁরা আমাদের সাথে আড্ডা ও হাঁটাচলার সঙ্গী ছিল। রাত ৯টা পর্যন্ত তো বইমেলায়ই। রাত ১২টার পর সরকারি আনুষ্ঠানিকতার পর আমরা জগন্নাথ হলের দিক থেকে লাইনে করে শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়েছিলাম। মনে পড়ে, খোন্দকার আশরাফ হোসেনসহ আমরা প্রায় ৮/১০ জন ছিলাম একসাথে। দাউদ আল হাফিজ, রাজু আলাউদ্দিন, বায়তুল্লাহ কাদেরী, তুষার গায়েন প্রমুখ। শহীদ মিনারের বেদীতে ওঠার পরপরই হঠাৎ মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ। লোকজন দিগ্বিদিক ছড়িয়ে-ছটিয়ে যাচ্ছিল।এ অবস্থায় আমি বললাম, শুয়ে পড়ুন সবাই। তৎক্ষণাৎ দেখলাম খোন্দকার স্যার আমার পাশে উপুড় হয়ে ঘাসের উপর শুয়ে পড়লো। এরপর কালবিলম্ব না করেই স্যারকে ইঙ্গিত করলাম হামাগুড়ি দিয়ে সামনে চলে যেতে, স্যারও বাধ্য শিশুর মতো আমাকে অনুসরণ করলো। আমরা বুয়েটের পাশ দিয়ে বের হয়ে গেলাম। অন্যরা কে-কোন দিকে গেলো তখন দেখতেও পারিনি। পরে আবার টিএসসিতে এসে সবাই জড়ো হই। ছাত্রদলের সাথে জাতীয় পার্টির ছাত্রসমাজের কোন্দলের ফলে গুলাগুলির সুত্রপাত। খোন্দকার আশরাফ স্যার মাঝরাতে বাসায় চলে গেলেও কবি বিভাস রায়চৌধুরীসহ আমরা কয়েকজন প্রায় ভোররাত পর্যন্ত টিএসসি, শাহবাগ এলাকায় ছিলাম। আরেকবার, হয়ত পরের বছরই, ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ৮টা/৯টা হবে, বাংলা একাডেমি বইমেলায় পুকুরের অপর পাড়ে আমাকে এসে ধরলেন খোন্দকার আশরাফ স্যার, কাঁধে বাংলা একাডেমির পাটের ঝোলা ব্যাগ। বললেন, তোমাকে খুঁজে হয়রান হয়ে গেলাম, দুবার পাক দিয়েছি পুরো মেলা। ব্যাগ থেকে একটা বিরিয়ানির প্যাকেট বের করে দিলেন আমাকে। বললেন, এটা নিয়ে যাও, তুমি খেয়ো, হল-এ তো আর ভালো-মন্দ কিছু খেতে পাও না। আমি তখন জিয়া হলে থাকতাম। লোকজনের সামনে খাবারের প্যাকেটটা নিতে আমার একটু সংকোচ হলো। বললাম, স্যার এটা আপনাকে দিয়েছে শহীদ মিনারের প্রোগ্রামের জন্য, আপনিই নিয়ে যান। কিন্তু তিনি আমার হাতেই দিয়ে দিলেন। অগত্যা আমি বললাম, আসুন স্যার সামনে গিয়ে প্যাকেট খুলে দু’জন ভাগ করে খাই। তিনি রাজি হয়ে গেলেন। গেটের কাছাকাছি বাংলা একাডেমির একটা ফুড কর্নার হতো তখন, এর পাশ দিয়ে পেছনে গিয়ে রাস্তার পাশের সাইড-ওয়ালের ভেতরে পাতার স্তুপের উপর বসে পড়লেন স্যার। ভালো আড়াল পেলাম, তখন রাস্তার দিকেও স্টল হতো, বিভিন্ন্ ধরনের ক্যাসেট বিক্রি হতো, কবিতা আবৃত্তির ক্যাসেট তো বাজতো সারাক্ষণই। সেদিন ঐ ধুলোমাটির উপর বসে দুজন মিলে কী তৃপ্তিসহকারেই না মোরগ-পোলাও খেলাম। আমার প্রতি তাঁর ভেতরে একটা গভীর টান ছিল, আমি অনুভব করতাম। এমন হয়তো সমসাময়িক অন্য কারোর সাথেও ছিল। তবে আমার মনে হতো আমার চেয়ে বেশি অন্য কারোর সাথে তাঁর ঘনিষ্টতা ছিলো না। একদম সাংসারিক কথাও শেয়ার করতেন আমার সাথে।
খুব ঘনিষ্টভাবে মেশার সুবাদে দেখেছি খোন্দকার আশরাফ হোসেন ছিলেন খুরধার মেধার একজন মানুষ। কবিতাকে ভালোবাসতেন, কবিদেরকেও। ভেতর থেকে বুঝতেন কবিতা। কবি শামসুর রাহমানের মৃত্যু সংবাদ শোনার সাথে সাথে তিনি আজিজ মার্কিটে ‘লোক’-এর সামনের লবিতে স্মরণসভার আয়োজন করলেন। শামীম ভাইসহ যারা তখন আজিজে ছিলেন সবাইকে ডেকে জড়ো করলেন।
বাংলা একাডেমি পুরস্কারটা তিনি আশা করেছিলেন। মনে মনে খুব চাইতেন, কিন্তু কোনোবারই তাঁর নাম আসেনি। আমি পাশে থেকে তাঁর এই যন্ত্রণাটা টের পেতাম। এটা আমাদের সময়ের একটা পাপ হয়ে থাকলো। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের মতো একজন সমৃদ্ধ কবি, নিজস্ব ভাষা ও বিশ্লেষণ ক্ষমতাসম্পন্ন একজন প্রাবন্ধিক, অতুলনীয় একজন অনুবাদক এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন শিক্ষক- এত যোগ্যতা নিয়েও তিনি কোনো ক্যাটাগরিতেই বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হলেন না, অথচ বছর-বছর দলীয় বিবেচনায় কত অপাত্রেই না যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় এই পুরস্কারটি!
খোন্দকার আশরাফ হোসেনের তিরোধানের একদশক পেরিয়ে গেছে, এখনও তাঁর রচনাসমগ্র প্রকাশিত হলো না। কবি মুহম্ম্দ নূরুল হুদা, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে খোন্দকার আশরাফ হোসেনের সহপাঠী ছিলেন, তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক থাকা অবস্থাতেও একাডেমি থেকে তাঁর রচনাবলী প্রকাশিত হলো না, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছি যে, উদ্যোগ নেয়ার পরও অজানা কারণে কার্যক্রম থেমে গেছে। বর্তমানে খোন্দকার আশরাফ হোসেনের রচনাসমগ্র প্রকাশ করা আমাদের জন্যই জরুরি। বাংলাদেশের তরুণ লেখকদের জন্য বিশেষভাবে জরুরি। তাঁর প্রবন্ধগুলো সমৃদ্ধ, অনুবাদসমূহও প্রয়োজনীয়, তাঁর কবিতা বৈশ্বিকবোধ সম্পন্ন, নিজস্ব ভাষা শৈলীতে উজ্জ্বল। এ সময়ের তরুণদের কাছে তাঁর লেখাগুলো সহজলভ্য করা আমাদের দায়িত্ব। কোনো প্রকাশক এগিয়ে এলে আমি নিজে বা আমরা কয়েকজন মিলে খোন্দকার আশরাফ হোসেনের রচনাবলী প্রকাশের জন্য সম্পাদনার কাজ করতে পারি। বাংলা একাডেমি না করলেও আশা করি স্বনামধন্য কোনো প্রকাশক এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
নিজের মেধা ও প্রজ্ঞা, সৃজনশীলতা দিয়েই খোন্দকার আশরাফ হোসেন আমাদের মধ্যে টিকে আছেন। প্রায়শই বিভিন্ন কারণে, বিভিন্ন প্রোগ্রামে, লেখায়, পাঠে তিনি স্মৃত হন। এ কারণেই শুরুতে বলেছি যে, চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয় (অন্তত খোন্দকার আশরাফ হোসেনের মতো সৃষ্টিশীল মানুষের ক্ষেত্রে এ কথা বলাই যায়)।