আমাদের বন্ধু শহীদুল জহির

ফয়জুল ইসলামফয়জুল ইসলাম
Published : 28 March 2008, 10:21 PM
Updated : 28 March 2008, 10:21 PM

২১ মার্চ ২০০৮-এ দুপুর ১টার দিকে শহীদুল জহির তাঁর ইস্কাটনের বাসার চার তলা থেকে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এসেছিলেন বুকের ব্যথা নিয়ে। নিচে নামার পর তিনি আর চলতে পারছিলেন না; বসে পড়েছিলেন সিঁড়ির ওপরে। পাশের বাসার কোনো কাজের ছেলে তাঁকে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করেছিল, 'আপনি কি অসুস্থ?'

শহীদুল জহির তাকে বলতে পেরেছিলেন, 'আমাকে রিকশাতে তুলে দাও! হলিফ্যামিলি হাসপাতালে যেতে হবে।'

ছেলেটি তাঁকে কেবল রিকশাতেই তুলে দেয়নি; তাঁর সাথীও হয়েছিল। হলিফ্যামিলি হাসপাতালে যাওয়ার পথে শহীদুল জহির তাঁর মোবাইল ফোন থেকে ভাগ্নেকে ফোন করেছিলেন, 'আমার মনে হয় হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। তোমরা সবাই হলিফ্যামিলিতে আসো।'

হলিফ্যামিলি হাসপাতাল থেকে ল্যাব এইড-এ শহীদুল জহিরকে স্থানান্তরের পর তাঁর অত্যন্ত কাছের মানুষদের কেউ কেউ তাঁর অসুস্থতার খবর জেনেছিলেন। তাঁদের ভেতরে অন্যতম হলেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ও লেখক আমিনুল ইসলাম ভুইয়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় (যেখানে শহীদুল জহির সচিব হিসাবে কর্মরত ছিলেন)-এর উপ-প্রধান খলিলুর রহমান খান এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ-এর উপ-প্রধান জীবন রঞ্জন মজুমদার। শহীদুল জহিরের ভাগ্নের কাছ থেকে তাঁরা এ কথাগুলো জেনেছেন। শহীদুল জহিরের সাথে খলিলুর রহমান খান বা জীবন রঞ্জন মজুমদারের আর কথা হয়নি। তিনি তখন ল্যাব এইড-এর সিসিইউতে সংজ্ঞাহীন অবস্থায়। লেখক আনিসুল হকও সেখানে গিয়েছিলেন বলে জেনেছি।

২১ মার্চ হলিফ্যামিলি হাসপাতাল থেকে ল্যাব এইড-এ তাঁকে নিয়ে যাওয়ার পর রাতে তিনি ফোন করেছিলেন তাঁর বন্ধু আমিনুল ইসলাম ভুইয়াকে। এ বাদে তিনি আর কাউকে ফোন করার মত শক্তি পাননি। যতটুকু জানা যায়, পরিবারবৃত্তের বাইরে সেটাই ছিল তাঁর শেষ কথপোকথন।

এসব আমার শোনা কথা। অসুস্থ বা মৃত শহীদুল জহিরকে আমি দেখিনি। আমি তাঁর অসুস্থতার খবর জানতাম না। জীবন রঞ্জন মজুমদার ২৩ মার্চ রাতে ফোনে আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন, 'আসলে আমি এতটাই দিশেহারা ছিলাম যে, তোমাকে জানাতে পারিনি।' আমি কিছু মনে নেইনি কেননা মৃত্যুপথযাত্রীর সাথে নিশ্চয় জীবনের গল্প হতো না। শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে তাঁকে সমাহিত করার জন্য আমি যাইনি। শহীদুল জহিরের অন্যতম বন্ধু পরিকল্পনা কমিশন-এর যুগ্ম প্রধান খোরশেদ আলমও সেখানে যাননি। ২৩ মার্চ দুপুরে খোরশেদ আলমের অফিসরুমে আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। মৃতের পাশুটে মুখমণ্ডল, কাফনের সাদা কাপড়, খাটিয়া, লোবানের গন্ধ, কবর, কবরে মুর্দা নামছে–এসব কষ্টকর স্মৃতি আমি ধরে রাখতে চাইনি। অক্টোবর ২০০৭-এ শহীদুল জহিরের সাথে আমার শেষ আড্ডা হয়। ফেব্র"য়ারি ২০০৮-এ আমি তাঁকে শেষবারের মত দেখি। পরিকল্পনা কমিশন চত্বরে তিনি হেঁটে যাচ্ছিলেন। দূর থেকে আমি তাঁকে দেখতে পেয়েছিলাম।

২৩ মার্চ দুপুরে খোরশেদ আলমের রুমে চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে আমার মনে হয়েছিল, এভাবে একবারে একা-একা জীবন কাটানো উচিত হয়নি শহীদুল জহিরের। একা থাকার চাপ মনের ওপরে তো পড়েই, শরীরের ওপরেও পড়ে। তিরিশ বছরের মতো সময় ধরে সম্পূর্ণ একা থেকেছেন তিনি। যে কারণে শরীরের ওপর অনেক অত্যাচার হয়ে গেছে। শরীর এবার তার প্রতিশোধ নিল। এসব ভাবতে ভাবতেই বিকাল শেষ হয়ে গেল। গোরস্থানে আমি আর গেলাম না।

শহীদুল জহির আমাদের দেখা রহস্যময় একজন মানুষ। তিনি নিজে থেকে খুব একটা মানুষের সংসর্গে যেতেন না। আমার জানামতে কারো বাসায় তাঁর তেমন একটা যাতায়াত ছিল না। কেবল বাসা থেকেই নয়, অফিসরুম থেকেও তিনি খুব একটা বের হতেন না। শহীদুল জহিরের সাথে তাদেরই সবচাইতে বেশি দেখা হতো যারা তাঁর কাছে যেতেন। লক্ষ্য করেছি, মানুষের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি সবসময় একটা দেয়াল তুলে রাখতেন। সে দেয়াল ভাঙতে পারলেই বেরিয়ে আসবে খুবই মততাময় ও বন্ধুবৎসল একজন মানুষ। এ দেয়ালটাই বেশির ভাগ মানুষ ভাঙতে চায়নি বা পারেনি।

শহীদুল জহির নিজের হাতে তাঁর বন্ধু খলিলুর রহমান খানের বিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে অনেকবার বলেছেন, 'জোবায়েরের বিয়েশাদি হওয়া দরকার। ছেলেটা কেমন বিষণœœ, এলোমেলো।' আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, 'নিজের বিয়ের কথা বলেন না কেন?' হাসতে হাসতে তিনি বলেছিলেন, 'আমি তো বুড়ো হয়ে গেলাম! তাছাড়া বিয়ের অনেক দায়-দায়িত্ব আছে। আমি সেসবের যুগ্যি নই।'

মানুষের জন্য অসম্ভব মমতা ছিল শহীদুল জহিরের। তাঁর অন্যান্য ঘনিষ্ঠরা এ বিষয়ে একমত হবেন। আমি জেনেছি, কেউ কেউ তাদের খুবই ব্যক্তিগত বিষয় শহীদুল জহিরের সাথে আলোচনা করতেন; পরামর্শ নিতেন। এই হলেন আমাদের শহীদুল জহির–যিনি একাধারে সমাজ থেকে বিযুক্ত আবার যিনি বারবার ফিরে এসেছেন সেই মানুষেরই কাছে।

তিনি সাহিত্য নিয়ে বা নিজের কাজ নিয়ে তেমন একটা আলোচনা করতেন না কারো সাথে। ঘনিষ্ঠদের ভেতরে বেশির ভাগ মানুষই তাঁর লেখা পড়েননি। লক্ষ্য করে দেখেছি, ঘনিষ্ঠদের ভেতরে আমিনুল ইসলাম ভুইয়া, ইলিয়াস আহমেদ (অতিরিক্ত সচিব, শিল্প মন্ত্রণালয়), নয়াদিল্লির ইকনোমিক মিনিস্টার ওয়াসি আহমেদ আর খোরশেদ আলমের সাথে তাঁর সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হতো। ঘনিষ্ঠরা তাঁর সাথে যেসব বিষয় নিয়ে কথা বলতেন, তিনি তাতেই আগ্রহভরে অংশ নিতেন; হাসি-ঠাট্টাও করতেন অনেক।

তিনি কখনো নিজের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কারো সাথে কথা বলতেন না। শহীদুল জহির কেন মগবাজারে নিজেদের বাসায় থাকতেন না, কেন তিনি একেবারে একাকী আগারগাঁ কলোনি বা গ্রীন রোড কলোনিতে জীবন কাটিয়ে দিলেন, তার উত্তর আমরা জানি না। কেন তিনি বিয়ে করেননি–সেটারও উত্তর অজানা। আমাদের কেবল কিছু অনুমান আছে মাত্র। শহীদুল জহির একাই থাকতে চেয়েছিলেন। এটা একান্তই তাঁর পছন্দ। একা থাকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও তিনি সচেতন ছিলেন।

লেখালেখির মতো চাকরিজীবনেও খুঁতখুঁতে ছিলেন শহীদুল জহির। অফিসের কাজ ঠিক মতো না করলে খুব রেগে যেতেন তিনি। সাহিত্য ছাড়া তাঁর আর কোনো কিছুর ওপরে আগ্রহ ছিল না। তিনি চাকরি করতেন স্রেফ জীবনধারনের জন্য। এর বেশি কিছু তিনি কখনো যাচনা করেননি। বাংলাদেশ সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে তাঁকে কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ছাড়া আর কোথাও কাজ করতে তাঁর মন লাগেনি। অনেক তদ্বির করে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে চলে এসেছিলেন। বাংলাদেশ ট্রেডিং কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকেও তিনি একইভাবে পালিয়ে এসেছিলেন।

শহীদুল জহির বেঁচে নেই–এ সত্যটি এখনো আমাদের কারো বিশ্বাস হয় না। মনে হয়, এখনই যেন তিনি আমার অফিসরুমে ঢুকবেন; বসে বলবেন, 'এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম তোমাকে দেখে যাই।' আর কাজ ফেলে আমি তাঁর সাথে গল্প করতে বসে যাব।

তাঁর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় ১৯৯৪ সালে। তখন তাঁর বয়স ৪০-এর মতো। চেহারায় টলটলে ভাব। মাথায় ঘন চুল। গোঁফ ছিল। কালো ফ্রেমের চশমা। রীতিমতো সুপুরুষ। সাভারের বাংলাদেশ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং সেন্টার (পিএটিসি)-এ তিনি আমাদের ক্লাস নিতে এলেন। তখন তিনি সিনিয়র সহকারী সচিব। সেই প্রথম তাঁকে আমি সামনাসামনি দেখি। আমি চমকে গেলাম। আমি তাঁর লেখার সাথে ভালভাবেই পরিচিত ছিলাম, কিন্তু জানতাম না যে তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে কাজ করেন। বিশ্বায়ন এবং তার প্রভাব বিষয়ক তাঁর লেকচার সমাজ ও অর্থনীতি পেরিয়ে ব্যক্তিমানুষের জীবন পর্যন্ত ছুঁয়ে গেল। লেকচার দিলেন যেন তিনি নিজের সাথেই কথা বলছেন। এমনই তদগত। আমরা তেমন কিছুই বুঝলাম না।

ক্লাস শেষে পিএটিসি-র করিডোরে তাঁকে ধরলাম আমি। পরিচয় দিলাম–আমি গল্প লিখি। আমার নাম বল্লাম। তিনি সাথে সাথেই আমাকে চিনলেন; বল্লেন, 'ভোরের কাগজে তোমার একটা গল্প পড়েছিলাম। ঐ যে, একজন মানুষ চিলেকোঠায় একা-একা থাকে। কী যেন নাম গল্পটার? বল্লাম গল্পটার নাম। করিডোরে দাঁড়িয়েই অনেকক্ষণ কথা হলো।' তখন আমার পরের ক্লাসে যাওয়ার তাড়া। আড্ডা ভাঙলাম। তিনি বলেছিলেন, শীঘ্রই দেখা হবে।

দেখা হলো প্রায় এক বছর পর। কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠান হচ্ছে টিএসসি-র সামনে। পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে কবিতা শুনছি। আমার একটু সামনেই দেখি শহীদুল জহির দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কবিতা শুনছেন। আমি এগিয়ে গেলাম। তিনি বলে উঠলেন, 'আরে! তুমি?' কথা বলতে বলতে আমরা ধীরে ধীরে শাহবাগের দিকে হাঁটলাম। তিনি গ্রীন রোডের অফিসার্স কোয়ার্টারে ফিরে গেলেন। তারপর তাঁর সাথে একবার পথে দেখা হলো। বেইলি রোড থেকে বেরিয়ে আমি মগবাজার মোড়ের দিকে হেঁটে যাচ্ছি। তিনিও হাঁটতে হাঁটতে মগবাজার নয়াটোলা যাচ্ছেন তাঁর মা-র সাথে দেখা করতে।

তারপর আবার এক বছর মতো তাঁর সাথে দেখা নেই। ১৯৯৭ সালে তাঁর সাথে আবার দেখা হলো। আমি তখন পরিকল্পনা কমিশনে কাজ করি। শহীদুল জহিরের বন্ধু খোরশেদ আলমের পাশের রুমে আমি বসতাম। আমার ইন্টারকম বাজল। খোরশেদ আলম বল্লেন, জনৈক ভদ্রলোক আমাকে খুঁজছেন।

গিয়ে দেখি, শহীদুল জহির বসে আছেন। আমিও আড্ডায় যোগ দিলাম। তিনি তখন তাঁর প্রিয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে বদলি হয়ে এসেছেন। ভালই হলো। ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত দু'এক দিন পরপরই আমি তাঁর অফিসরুমে যেতাম হয় সকাল ১১টার দিকে চা খেতে অথবা লাঞ্চের সময়। তিনিও প্রায়ই আমার ওখানে আসতেন। কত কিছু নিয়েই না আমরা গল্প করতাম! চা খেতাম অনেক আর একের পর এক সিগারেট।

তখনই শহীদুল জহিরকে কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়। খুবই সাদামাটা একজন মানুষ। খুবই আধুনিক। রুচিসম্পন্ন। নির্মল তাঁর মন। খুবই স্পর্শপ্রবণ। খুবই বন্ধুবৎসল। খুবই নিভৃত। খুবই প্রচার বিমুখ। দক্ষ ও নিষ্ঠাবান একজন কর্মী। পরিবারের মানুষজনদের প্রতি মনোযোগী। খুবই একাকী একজন মানুষ।

লক্ষ্য করলাম, তিনি নতুন লেখকদের লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়েন। নতুনদের লেখা নিয়েই তিনি আলোচনা করতেন বেশি। অথচ লেখকবৃত্তের কারো সাথে তাঁর তেমন যোগাযোগ ছিল না। মোটামুটি যোগাযোগ ছিল সাজ্জাদ শরিফের সাথে। ব্রাত্য রাইসুর কথা প্রায়ই শুনেছি। একবার তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, আমি অদিতি ফাল্গুনীকে চিনি কিনা। আমি অদিতির লেখা পড়েছিলাম, কিন্তু আমি তাঁকে চিনতাম না। তাঁর মুখে আমি মামুন হুসাইন, শাহাদুজ্জামান, ওয়াসি আহমেদ, ইমতিয়ার শামীম এবং কাজল শাহনেওয়াজের কাজের প্রশংসা শুনেছি।

সে সময়ে তিনি আমাকে কেবলই খোঁচাতেন–তুমি এত কম লেখ কেন? বছরে একটা কি দু'টা গল্প লিখলে চলবে নাকি?

আমিও শহীদুল জহিরকে খোঁচাতাম–আপনিই বা এত কম লেখেন কেন? হাসতে হাসতে তিনি উত্তর দিতেন, 'আমি এক পাতা লিখে হয়রান হয়ে যাই। কষ্ট হয় লিখতে। আমার তো তাও ক'টা বই বের হয়েছে। তোমার তো একটাও বের হলো না।'

আমার প্রথম গল্পের বই বের হলো ১৯৯৮ সালে (হয়ত শেষ বই)। নাম নক্ষত্রের ঘোড়া। পুরানো লেখায় আমার কোনো উৎসাহ নাই। তাই দ্বিতীয় বইয়ের পাণ্ডুলিপি আর তৈরি হয় না। শহীদুল জহির বলেছিলেন, 'বই তোমার কাজের একটা রেকর্ড। পত্র-পত্রিকায় ছাপানো লেখা এদিক-ওদিক হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। তার চাইতে সবগুলো গল্প এক জায়গাতে রইল। মন্দ কী!' তাঁর সাথে আমার ঐকমত্য হয়েছিল। কিন্তু পাণ্ডুলিপি তৈরি হচ্ছিল না। তিনি বল্লেন, বইটা বের হওয়া দরকার। আমি বল্লাম, কাউকে কন্ট্রাক্ট দেব। তিনি হেসেছিলেন।

শহীদুল জহির খুব কম লিখতেন। একটা ছোটগল্প লিখতে তাঁর অনেক সময় লেগে যেত। প্রায় তিন-চার মাস। উপন্যাস লিখতে তাঁর সময় লাগতো আরো বেশি। কোনো রকমে এক পাতা লিখে কাজ বন্ধ করে দিতেন। তারপর চুপচাপ বসে থাকতেন, নয়ত বই পড়তেন, তা না হলে টেলিভিশন দেখতেন। বছর পাঁচেক আগে কম্পিউটার কিনেছিলেন তিনি। তখনো তিনি এক পাতার বেশি লিখতেন না। আর একটা গল্প বা উপন্যাস শেষ হয়ে গেলে তিনি তিন-চার মাস কিছু লিখতেন না; বলতেন, লেখালেখি ভুলে গেছি মনে হয়।

লিখছেন না তবে বাসায় গিয়ে কী করেছেন?

পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছি। টেলিভিশন দেখছি রাত জেগে। টেলিভিশনই আমাকে খাবে বুঝলে!

আমি হাসতাম। কেননা আমারো টেলিভিশন দেখার নেশা।

১৯৯৯ সালের মে অথবা জুন মাসে আমি শহীদুল জহিরের ২/১০ গ্রীন রোড গেজেটেড অফিসার্স কোয়ার্টারে যাই। সেই প্রথম ও শেষ লেখকের বাসায় যাওয়া। কোনো এক শুক্রবার সকালে তেজতুরি বাজারে একজন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম একটা মেডিকেল সার্টিফিকেট আনার জন্য। ডাক্তারকে না পেয়ে আমি শহীদুল জহিরের বাসায় গেলাম। তিনি আমাকে দেখে অবাক হলেন কেননা আমার যাওয়ার কথা ছিল না। গ্রীন রোডের কোয়ার্টারের ঘর মাত্র একটা। সাথে একটা বাথরুম আর রান্নাঘর। একা মানুষের জন্য এর চাইতে বড় আর কী আয়োজনের প্রয়োজন–বলতেন তিনি। ঘরটাতে আসবাব বলতে তেমন কিছু ছিল না বলেই মনে পড়ে। দক্ষিণ-পূর্ব কোণের জানালার কাছে একটা সিঙ্গেল চৌকি। ঘরের মাঝামাঝি একটা টেবিলের ওপরে টেলিভিশন। লেখার টেবিলটা কোথায় ছিল তা মনে পড়ছে না। একটা বুকশেলফ ছিল। বই দেখেছিলাম অনেকগুলো। এ বাদে আর কোনো আসবাব দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

অনেকক্ষণ বসেছিলাম আমি। শহীদুল জহির দুপুরে খেয়ে যেতে বলেছিলেন। তাঁর সাথে ইয়ার্কি করেছিলাম বলে মনে পড়েছে–আপনার নিজের খাবার আছে তো?

মনে পড়েছে তিনি এমনটা উত্তর দিয়েছিলেন–বুয়া এসে যাবে বারটার দিকে। ঘর ঝাঁট দিয়েই রান্না চড়াবে। সংক্ষিপ্ত রান্না। থেকে যাও তুমি।

কিন্তু আমি থাকিনি রান্নাবান্নার ঝামেলা হবে বলে।

তার ক'দিন পর আমি এক বছরের জন্য আমেরিকায় পড়তে যাই। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে দাপ্তরিক আদেশ পেতে দেরি হচ্ছিল। শহীদুর জহির কাজটাকে তরান্বিত করে দিয়েছিলেন। আমেরিকা থেকে আমি ফিরে আসার পর তাঁকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের আগের জায়গাতেই পেলাম। আবার ২০০০ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আগের মতো আড্ডা শুরু হলো। তিনি আলাওল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন এ কথাটা একবারের জন্যও বলতে পারলেন না আমাকে। আমার বন্ধু লেখক ইমতিয়ার শামীম সংবাদটা আমাকে দেয়ার পর আমি শহীদুল জহিরের ওপর চড়াও হলাম, 'এত ভাল খবরটা আমাকে জানালেন না কেন আপনি?' শহীদুল জহির লাজুক মানুষ। লাজুক হাসিতে তিনি বল্লেন, 'আরে বাদ দাও তো! আর কাউকে না পেয়ে আমাকে পুরস্কার দিয়েছে নিশ্চয়। তাছাড়া কিছু অর্থযোগও ছিল। খারাপ কী?' তার উত্তর শুনে আমি হেসেছিলাম।

২০০১ সালে আমার বদলি হয়ে গেল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। শহীদুল জহির অনেক আগে সেখানে কাজ করেছিলেন। তিনি আমাকে অনুপ্রাণিত করলেন। আমি সচিবালয়ে চলে গেলাম। যোগযোগ ক্ষীণ হয়ে গেল তাঁর সাথে। ব্যস্ততার কারণে পরিকল্পনা কমিশন চত্বরে যাওয়ার সময় পেতাম না আমি। মাঝেমাঝে ফোনে কথা হতো তাঁর সাথে। ফোনে তো আর জীবনের আলোচনা ভাল মতো হয় না! তাই দু'এক বার আমি তাঁর সাথে দেখা করতে গেছি। সচিবালয়ে গেলে তিনিও আমার সাথে দেখা করে গেছেন।

২০০২ সালে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে শহীদুল জহিরের বদলি ঘটল। তিনি যেতে চাইছিলেন না কিছুতেই। তাঁর যুক্তি হলো, এতো হাই প্রোফাইল জায়গাতে কাজ করা কষ্টকর। এর চাইতে ইআরডি-ই ভাল। নির্ঝঞ্ঝাট থাকা যায়। তাঁর বন্ধুরা তাঁকে বোঝালেন জয়েন করার জন্য। নইলে দাপ্তরিক ঝামেলা হতে পারে। বিরস বদনে তিনি যোগ দিলেন।

তার পরপরই জিনিভায় ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন (ডব্লিউটিও)-এ আমার চাকরি হয়ে গেল। তড়িঘড়ি করে আমি জিনিভা চলে গেলাম। ব্যস্ততার কারণে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করা হলো না; ফোনে কথা হলো মাত্র। জিনিভায় আমি ছিলাম দেড় বছর। আমি জেনেছিলাম, তিনি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে বদলির জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। অনেক চেষ্টার পর মুক্তি পেয়েছিলেন তিনি।

২০০৩-এর শেষে জিনিভা থেকে ফিরে পয়লাতেই আমি গেলাম শহীদুল জহিরের সাথে দেখা করতে। তিনি তখন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের যুগ্ম সচিব। অনেক গল্পের ফাঁকে লেখালেখির খবর নিলেন তিনি। জানালাম, গেল দেড় বছরে একটা গল্প লিখেছি। নাম 'আয়না'। গল্পটা তিনি পড়তে চাইলেন। তখনো গল্পটা চূড়ান্ত করা হয়নি বলে তাঁকে দেয়া গেল না। আবার দেখলাম, তিনি সিগারেট ছেড়ে গিয়েছেন। চা কম খাচ্ছেন। অফিসে আগের মতই পাউরুটি আর কলা দিয়ে লাঞ্চ করছেন। আরো লক্ষ্য করলাম, তিনি লিখছেন কম। কারণটা তিনি জানালেন, আর লেখা বের হচ্ছে না। কৌতুক করে উত্তরটা দিয়েছিলেন তিনি। আমি তাঁকে ভর্ৎসনা করেছিলাম। হাসতে হাসতে তিনি বলেছিলেন, 'তোমার অবস্থাও দেখি আমার মতো। দেড় বছরে মাত্র একটা গল্প লিখলে তুমি।'

সে সময়ে নূরুল আলম আতিক শহীদুল জহিরের ছোট গল্প 'চতুর্থ মাত্রা' নিয়ে টেলিভিশন-নাটক বানানোর প্রস্তাব দেন। শহীদুল জহিরের মন টানছে না তাঁতে। এত মানুষ থাকতে তাঁর গল্প নিয়ে নাটক বানানোর প্রয়োজন কেন পড়ল, তা তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না। আর শঙ্কাও ছিল, নাট্যকার এবং পরিচালকের হাতে পড়ে গল্পটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। শেষপর্যন্ত তিনি আতিককে অনুমতি দিয়েছিলেন বলে জানি। নাটকটা টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছিল বলে মনে পড়ছে। প্রোডাকশন নিয়ে শহীদুল জহির খুশি ছিলেন না।

সপ্তাহ তিনেক পরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আমার পোস্টিং হয়ে গেল। আমি ফের সচিবালয়ে চলে গেলাম। একটি ছোট কাগজে 'আয়না' নামের আমার গল্পটা বের হলে আমি পত্রিকার কপি নিয়ে শহীদুল জহিরের কাছে গেলাম। প্রতিক্রিয়া তিনি পরে জানিয়েছিলেন। গল্পটা ছুঁয়ে গিয়েছিল তাঁকে। একজন যুবক শেফালি নামের একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর যুবক আর কোনো মেয়ের কাছে যায়নি; বিয়েও করেনি। তার ভেতরে অস্বাভাবিকত্ব দেখা দেয় এবং সে সুযোগ পেলেই ছোট পকেট আয়নাতে নিজের চেহারা দেখতে থাকে।

'আয়না' কেন ভাল লেগেছিল শহীদুল জহিরের? সেখানে কি তিনি তাঁর নিজের ছবি দেখতে পেয়েছিলেন? কথাটা আর তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি। 'ছাঁই' নামের আমার একটা গল্প তাঁর ভাল লেগেছিল। সে গল্পে একজন খুব নিভৃত মানুষ সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় কোনো চার তলা বাসার চিলোকোঠায় থাকে। তার তেমন কোনো বন্ধু নেই। তার হাতঘড়িটা সারা রাত টিকটিক আওয়াজ করে চলে। মানুষটির মনে হয়, সে ঘরে ঘড়িটাই তার একমাত্র জীবিত সহচর। ঘড়িটা নষ্ট হয়ে গেলে সে খুব ভেঙে পড়ে। 'ছাঁই' গল্পেও কি শহীদুল জহির নিজেকে দেখেছিলেন? সে কথাও তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি। 'বাসুকিদের গল্প' নামে আমি একটি গল্প লিখেছিলাম। সে গল্পে সন্তানের জন্য একজন পিতার বরাভয় আঁকা হয়েছিল। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সেটা পড়েও তিনি খুব আবেগায়িত হয়ে গিয়েছিলেন। ২০০৭-এর শেষের দিকে একদিন শহীদুল জহিরের অফিসে গেছি। তখন আমার মাথায় একজন বাবাকে নিয়ে একটা গল্প ঘুরছে। সে মানুষটির দশ বছরের ছোট ছেলে মা-র ওপরে রাগ করে বাসা থেকে পালিয়ে যায়। বছর ছয়েক পরে সে ফিরে আসে। তবে ততদিনে সন্তানের শোকে কাতর হয়ে মানুষটি ইচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়েছে। গল্পের প্লট শুনে উত্তেজিত হয়ে গেলেন তিনি; বল্লেন, জলদি এটা লিখে ফেল। তার গুঁতো খেয়ে গল্পটা আমি লিখেছি; কিন্তু চূড়ান্ত করা হয়নি। চূড়ান্ত করা হয়নি বলে 'বাবা' নামের গল্পটা তাঁকে আর পড়তে দিতে পারিনি। আমি ভাবছি অন্য কথা। পিতা এবং সন্তানের সম্পর্ক নিয়ে লেখা এ দু'টি গল্প কেন শহীদুল জহির পছন্দ করেছিলেন? অকৃতদার এ মানুষটির ভেতরে সন্তানাকাক্সক্ষা ছিল কি? হতেই পারে। সেকথা আমরা জানি না। আমরা শুধু জানি, তিনি মনে করতেন, সন্তান এ পৃথিবার খুব সুন্দর একটি সম্পর্ক। এমন একজন মমতাময় মানুয় কেন সংসার আর সন্তানের বন্ধনে নিজেকে জড়াননি তা আমাদের কাছে বরাবরই অস্পষ্ট ছিল। তবে একাকী জীবন কাটাতে চেয়েছিলেন শহীদুল জহির!

২০০৪ থেকে ২০০৭-এর জুলাই পর্যন্ত সময়টা আমি সচিবালয়ে কাজ করেছি। ব্যস্ততার ফাঁকে কখনো তাঁকে দেখতে গেছি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে। এ সময়টাতে সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে শহীদুল জহিরের মিটিং থাকত। তিনি প্রায়ই আমাকে দেখতে যেতেন। আমি অফিসরুমে না থাকলে তিনি কখনো কখনো আমার জন্য অপেক্ষা করতেন। একদিন খুব মজা হলো। আমি কাজ করছি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রুমে বসে। তিনি ঢুকলেন; ঢুকেই বল্লেন, 'কী ব্যাপার? একজন অতিরিক্ত সচিব তোমার কাছে এসেছে আর তুমি তাকে পাত্তা দিচ্ছ না? চা আনাও জলদি।' আমি খুব হেসেছিলাম তার কৌতুকে। তিনিও হাসলেন অনেক। শহীদুল জহির এমন অনেক মজার মজার কথা বলতেন। তিনি প্রায়ই ব্যবহার করতেন ঢাকার কুট্টিদের ভাষা। আমিও তথৈবচ।

২০০৬-এ তিনি অতিরিক্ত সচিব হিসাবে পদোন্নতি পান। বাংলাদেশ ট্রেডিং কর্পোরেশন (টিসিবি)-এ তাঁর পদায়ন হয় চেয়ারম্যান হিসাবে। ডে ওয়ান থেকেই তিনি চেষ্টা শুরু করলেন কীভাবে আবার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে ফিরে যাওয়া যায়। একদিন ঠাট্টা করে তাঁকে বল্লাম, 'ভাল হয়েছে টিসিবি-তে কাজ করতে গিয়ে। এরপর আপনি চাল, গম, ডাল, তেল, পেঁয়াজ ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসমাগ্রী নিয়ে উপন্যাস লিখতে পারবেন।' দুঃখের ভেতরেও খুব হেসেছিলেন তিনি। অনেক দেন-দরবার করে তিনি ফের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে ফিরে গেলেন।

২০০৬ এর শেষের দিকে আমি শহীদুল জহিরের কাছে কাজে গেলাম। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘ তিন বছর কাজ করে ক্লান্ত আর একঁেঘয়ে হয়ে গিয়েছিলাম আমি। তাঁকে বল্লাম, আমাকে যেন তিনি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে বদলির ব্যবস্থা করে দেন। তিনি সাগ্রহে রাজি হলেন আমাকে সাহায্য করার জন্য। আমি একদিন তাঁর অফিসে গেছি চাকরিবৃত্তান্ত নিয়ে যেন তিনি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবকে আমি বিষয়ক তথ্য সহজে বলতে পারেন। চাকরিবৃত্তান্ত নিয়ে টেবিলের একপাশে রেখে তিনি মন্তব্য করলেন, 'ইআরডি-তে আসবে–সেটা ভাল। তবে তোমার আর আমার একসাথে কাজ করতে হলে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কাজেই আমাদের দু'জনকে সতর্ক থাকতে হবে।'

আমি তার মন্তব্য ফেলে দেইনি।

আমার প্যারেন্ট মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। কাজেই শহীদুল জহির আমাকে নিয়ে গেলেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন)-এর অফিসে। আমার বদলির ব্যাপারে তিনি ফলো আপও করছিলেন দায়িত্বের সাথে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে জানুয়ারি ২০০৭-এর রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় বদলির সব কেইস বন্ধ হয়ে গেল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আমি ইচ্ছার বিরুদ্ধে আটকে থাকছি দেখে তিনি খুব কষ্ট পেলেন। তাঁর কষ্টের লাঘব হলো যখন তাঁরই বন্ধু খোরশেদ আলম পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিবকে অনুরোধ করে আমাকে পরিকল্পনা কমিশনে নিয়ে গেলেন (যেখানে আমি এখন কাজ করছি)।

পরিকল্পনা কমিশনে কাজ শুরু করি অগাস্ট ২০০৭ থেকে। একই চত্বরে শহীদুল জহিরের অফিস। তাঁর সাথে দেখা করতে গেলাম । অনেক কথার ফাঁকে তিনি আমার দু' ছেলের এবং স্ত্রীর রাহনুমার খবর নিতে ভুল্লেন না।

শহীদুল জহিরের সাথে আমার শেষ দেখা হয় অক্টোবর ২০০৭-এর প্রথম দিকের কোনো একটা সময়ে। আমি তাঁর অফিসে গেছি দেখা করতে। তাঁর মুখ গম্ভীর। জিজ্ঞাসা করলাম, 'সমস্যা কী?'

কী সব ছাতামাথা ফাইলে লেইখ্যা রাখেছে!

আমি উঠে যেতে চাইলাম কেননা তখন তাঁর মেজাজ খারাপ। এবার শহীদুল জহিরের অনাবিল হাসিটা দেখা গেল। বসলাম আমি। কথার ফাঁকে যেটা বুঝলাম, তিনি দেশের রাজনৈতিক শূন্যতা নিয়ে বিরক্ত। সবকিছু কেমন নিঃস্ফল–দেখছ তো? এ বিরক্তি গিয়ে পড়েছে ফাইলের ওপরে। তারপর যথারীতি তিনি আমার নিঃস্ফলতা নিয়েও লাগলেন। ব্যাপারটা হলো, আমি কেন লিখছি না। তখন এক বছর মতো আমি কোনো গল্প লিখিনি। এক বছর আগেই যুগান্তরে পরপর দু'টো গল্প বের হয়েছে। দু'টোর বেশি গল্প লেখা কষ্টকর–এমনটা যুক্তি দিয়েছিলাম আমি।

শোন, তোমার অবস্থা কিন্তু আমার মতো হতে যাচ্ছে। এই যে দেখ, এখন আর আমি লিখতে পারছি না। তোমার আর লেখালেখি হয়েছে! হতাশ হয়ে বলেছিলেন শহীদুল জহির।

না লিখলেই বা ক্ষতি কী? পুরনো বাক্য ছাড়লাম সুযোগ পেয়ে।

শহীদুল জহির আমার মন্তব্যকে পাত্তা না দিয়ে আমার অকর্মণ্যতা এবং আলস্যকে সমালোচনা করে জিজ্ঞাসা করলেন, অন্ততঃ গল্পের কোনো প্লট ভেবেছি কিনা। আমি বাধ্য হলাম তাঁর সাথে নতুন ভাবনা নিয়ে কথা বলতে। 'বাবা' নামের গল্পটা (যেটা এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি) -র প্লট তখন তাঁকে আমি শোনাই। গল্পটা শুনে তিনি উচ্ছসিত হন–সেটা আমি আগেই বলেছি।

অক্টোবর ২০০৭-এর সেদিনের পর আর শহীদুল জহিরের সাথে আমার কথা হয়নি। নতুন অফিসে আমার কাজের চাপ ছিল, আলস্য ছিল। তিনিও অফিসরুমের বাইরে আড্ডা দিতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ফেব্র"য়ারি ২০০৮-এর প্রথম দিকে তিনি পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব হলেন। পরিকল্পনা কমিশন চত্বর ছেড়ে তিনি সচিবালয় চলে গেলেন। ২০ মার্চ ২০০৮-এ আমার অফিসে একটা বড় কাজ শেষ হলো। ভেবেছিলাম, ২৪ বা ২৫ তারিখে সচিবালয়ে যাব আড্ডা দিতে। সেই ফাঁকে শহীদুল জহিরের সাথেও আড্ডা মেরে আসব। সে কাজটা আর হলো না। ২৩ মার্চের সকালে তিনি মারা গেলেন।

সত্তর দশকের কথাশিল্পী শহীদুল জহির বাংলা সাহিত্যের একটি ভিন্ন কণ্ঠস্বর। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পর তিনিই আমার মনে বেশি দাগ কেটেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে আমরা আরো পরিণত কথাসাহিত্য পেতে পারতাম। সে সম্ভাবনা রুদ্ধ হয়ে গেল। আর তাঁর মৃত্যু আমার ব্যক্তিজীবনের ক্ষেত্রে মস্ত বড় একটি ক্ষতি। আমার মনে পড়ে, আহমদ ছফা মারা যাওয়ার পর আমি খুব ভেঙে পড়েছিলাম। আহমদ ছফার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল, কিন্তু দূরত্বও ছিল। শহীদুল জহির তখন আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। আজ তেমন করে সান্ত্বনা দেয়ার মত কোনো বন্ধু আমার পাশে অবশিষ্ট নেই।

বস্তুত, আমি অসামাজিক মানুষ। আমার জগত খুবই ছোট। শহীদুল জহিরের মৃত্যুতে সেই ছোট জগত আরো ছোট হয়ে গেল, কানা হয়ে গেল। আমার অফিসরুমে ঢুকে শহীদুল জহিরের মতো বড় মাপের একজন মানুষ স্মিতহাস্যে আর বলবেন না–তোমাকে দেখতে এলাম। কী খবর তোমার ?

শহীদুল জহির আমার আত্মার আত্মীয়। একই ধরনের কথা আমাকে বলেছেন শহীদুল জহিরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ খলিলুর রহমান খান, খোরশেদ আলম, জীবন রঞ্জন মজুমদার আর জোবায়ের আহমদ। আমি জানি, শ্রদ্ধেয় লেখক আমিনুল ইসলাম ভুইয়া, কবি ইলিয়াস আহমেদ এবং কথাশিল্পী ওয়াসি আহমেদও একই কথা আপনাদেরকে বলবেন।

২৩ মার্চ ২০০৮ এ বিকেলের দিকে ই-মেইলে শহীদুল জহিরের মৃত্যুর খবর জানালাম লেখক ইমতিয়ার শামীমকে। সে উত্তর দিল, এত তাড়াতাড়ি চলে গেলেন তিনি! আমার সাথে তো তার পরিচয়ই হলো না! সেদিন রাতে ফোন দিল কবি শুচি সৈয়দ; বল্ল, এটা খুব অন্যায় যে শহীদুল জহির হুট করে মারা গেলেন। কতদিন তুই আমাকে তার কাছে নিয়ে যেতে চাইলি। যাওয়াই হল না দেখ! কে জানত যে তিনি এমন করে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবেন?

নিভৃত একজন মানুষ আড়ালে থাকতে থাকতে একেবারেই আড়াল হয়ে গেলেন। মানুষের ভেতরে তিনি রেখে গেলেন তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্বের ছায়া। নারিন্দা, মগবাজার নয়াটোলা, আগারগাঁও কলোনি, বেইলি রোড বা গ্রীন রোড কলোনির পড়শিরা হয়ত কোনোদিন ভাবতে বসবে–শহীদ এত বড় লেখক ছিল, তা তো জানতাম না? গ্রীন রোড কলোনির ২/১০ নম্বর বাসার বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার বন্ধু কাজী দেলোয়ার হোসেন ভাবতে থাকবে–এ ঘরে শহীদুল জহির একদা থেকেছেন, তাঁর অনেক অসামান্য কীর্তি রচিত হয়েছে এ ছোট ঘরটায়, এ জানালায় দাঁড়িয়ে তিনি আকাশ দেখতেন…। দেলোয়ার ভাববে, ভদ্রলোকের সাথে কোনোদিন আলাপ হলো না এত কাছে থেকেও! আর আগারগাঁ কলোনিতে হয়ত কোনোদিন নয়নতারা ফুল ফুটবে, হয়ত কোনদিন 'বাবা' নামের একটা গল্প কোনো পত্রিকায় ছাপা হবে, কিন্তু তাতে আর কিছু যাবে-আসবে না শহীদুল জহিরের।