Published : 12 May 2024, 09:14 PM
আমেরিকা— কারো কাছে স্বপ্নের এক দেশ, কারো কাছে আধুনিক পৃথিবীর বর্বর এক রাষ্ট্র। আদিবাসীদের গণহারে হত্যা করে ইউরোপীয় সেটেলাররা যেখানে আবাস গেড়েছিল মূলত ষোড়শ শতাব্দীর শুরু থেকেই। তারপর আফ্রিকা থেকে মানুষ ধরে ধরে এনে ক্রীতদাস বানানো। তারপর প্রথমে তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ গ্রেট ব্রিটেনের বিরুদ্ধে, অস্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে, তারপর নিজেরা নিজেরাই যুদ্ধ লেগে যায় উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি দাসপ্রথা থেকে বেরোতে। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে, প্রথম মহাযুদ্ধ ও রুশ বিপ্লবের পর থেকে দেশটি গণতন্ত্রের ব্যবসায় নামে বিশ্বব্যাপী। গণতন্ত্রের মুরব্বি সাজতে গিয়ে তারা শুরু করে নয়া সাম্রাজবাদ বিস্তার। আজও পৃথিবীব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাদের বিপুল সামরিক শক্তি নিয়ে। এটা এক দিক, তাদের বর্বরতার ইতিহাস, আরেক দিকও না বললে নয়; গত একশ বছর ধরে আমেরিকা জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ধারক-বাহক-প্রচারক-বণিক। বিশ্বসাহিত্যে, শিল্প-সংস্কৃতিতেও তাদের অবদান কম নয়। পৃথিবীর সেরা সেরা মনীষীর জন্ম হয়েছে এই বিস্তীর্ণ ভূমিতে। শুধু তা-ই নয়, পৃথিবীর অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী-চিন্তক-লেখক-বিজ্ঞানীকে আমেরিকা নানা সময়ে-অসময়ে আশ্রয় দিয়েছে। এ-কথা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নাই, আজকের পৃথিবীতে জ্ঞানচর্চার প্রধান সূতিকাগার আমেরিকা।
আমরা, বাঙালিরা, বাংলাদেশীরা, যারা পঞ্চাশ-ষাট দশকের পর বেড়ে উঠেছি; এবং এখনো যাদের ওই পূন্য বা পাপের ভূমিতে পা ফেলার সৌভাগ্য হয় নাই, তারা মূলত আটলান্টিকের ও-পারের বিশাল মহাদেশটিকে চিনেছি প্রথমত হলিউডের ফিল্ম দেখে, আর; বলাই বাহুল্য, অগণিত অবিরাম অবিরল ধারায় আমেরিকার জাজ, রক, পপ আর কান্ট্রি সং শুনে শুনে।
এর বাইরে আমেরিকা চিনেছি কিছু বিখ্যাত উপন্যাস পড়ে, কিছু কবিতায়, আর লোকমুখে, আর কখনো-বা বাংলাদেশী কারো ভ্রমণকাহিনীর বদৌলতে। এতে অন্ধের হস্তিদর্শনের মতো একটা ব্যাপার হয়েছে।
এবার আমেরিকা দেখা হলো আরেকটু বিস্তৃত চোখে— বাংলাদেশী এক সাইক্লিস্ট মুনতাসির মামুনের সঙ্গে। মুনতাসির মামুনের জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৮২ সালে। পড়াশোনা শেষ করেছেন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। প্রকৌশলী চাকরি ছেড়ে যিনি দুনিয়া দেখতে বেড়িয়ে গেছেন সাইকেলে করে। ভ্রমণের পাশাপাশি লেখালেখি ও ছবি তোলায়ও তার শখ। ভ্রমণ, অভিযান এবং পরিবেশ নিয়ে লেখালেখি করছেন দুই দশক ধরে। দেশ-বিদেশে তার ছয়টি আলোকচিত্র প্রদর্শনী হয়েছে। প্রকাশিত বই চারটি— এভারেস্ট (২০০৫), দ্য টাটেল নেক (২০০৮), পৃথিবীর পথে বাংলাদেশ— সাইকেলে আলাস্কা থেকে টরন্টো (২০২২), পৃথিবীর পথে বাংলাদেশ—সাইকেলে আমেরিকার সিয়াটল থেকে ওয়াশিংটন ডি.সি (২০১১)
আমরা আজ শেষোক্ত বইটি নিয়ে কিছু কথা বলব। লেখক আমেরিকা ভ্রমণে যান ২০১১ সালে। একটা ট্যান্ডেমে (দুজন চালানোর সাইকেল, সঙ্গী তার এক বন্ধু উজ্বল ভাই) করে তারা ভ্রমণ করেন সিয়াটল থেকে ওয়াশিংটন ডি.সি। তাদের এ-যাত্রায় সময় লেগেছিল দুমাসের কিছু বেশিদিন। আমেরিকায় তাদের ভ্রমণ অবশ্য শুরু হয়েছে নিউ ইয়র্ক থেকে। সেখানে কদিন থেকে বেড়িয়ে প্রস্তুতি নিয়ে তারা সিয়াটল পৌঁছেছেন প্লেনে। সিয়াটল থেকে তারা সাইকেল যাত্রা শুরু করেছেন। সড়ক পথে সিয়াটল থেকে ওয়াশিংটন ডি.সির দূরত্ব প্রায় সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যাত্রাপথে তারা দেখেছেন কত শহর-বন্দর-গ্রাম। বইটি প্রতিদিনের ডায়রি লেখার ভঙিতে লেখা। সিয়াটল থেকে তাদের সাইকেলযাত্রা শুরু হয়েছে ১১ জুন।
১১ জুন প্রথম দিনের ডায়রিতে লেখক লিখেছেন— বড় কোনো কাজের আগের দিন আমার ঘুম বেশ পাতলাই হয়। এবারো নিয়মের ব্যাতিক্রম হলো না। সারারাত এপাশ-ওপাশ। বেশ সকালেই বিছানা ছাড়লাম। কেননা, জুনের এই সময়ে এখানে যথেষ্ট ঠান্ডা। সকালের মিষ্টি রোদ আসার আগে বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। তবে যা করতেই হবে তার জন্য অপেক্ষা করেই বা লাভ কী? আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া ভালো। কাচের স্লাইডিং ডোর খুলে বারান্দায় যখন গেলাম তখনো পার্কিং লটে আলো জ্বলছে, হাড়-কাঁপানো হাওয়া বইছে। ভেতরটা একটু মোচড় দিয়ে উঠল। পারব তো?
তারপর প্রথম দিনের যাত্রার বর্ণনা দিয়েছেন বেশ বিস্তৃতভাবে। ৮ পৃষ্ঠা জুড়ে। রাস্তার বর্ণনা দিয়েছেন সুন্দরভাবে—প্রথমটায় ভালোই লাগল। বেশ চওড়া আর ফাঁকা রাস্তা। তবে যখন বড় ট্রাকগুলো পাশ দিয়ে যাওয়া শুরু করল, তার ভয়াবহতা থেকে যাচ্ছিল বাতাসে। এক একটা দমকা হাওয়ার তাণ্ডবে আমরা বেশ কয়েকবার থামতে বাধ্য হয়েছিলাম। আর রাস্তার সঙ্গে গাড়িগুলোর চলার শব্দটা প্রথমে ভালো লাগলেও খানিক বাদে অসহনীয় বোধ হলো। আরো আছে। শোল্ডারগুলো আবর্জনা ভাগাড়ের মতো। ভাঙা কাঁচ, খাবারের প্যাকেট, গাড়ি থেকে খুলে পড়া নাট-বোল্টু, টায়ারের টুকরো শুরু করে জংপড়া টিন—কী না দেখতে পেলাম।
সঙ্গী উজ্জ্বল ভাইকে নিয়ে সফর চলছে মুনতাসির মামুনের। পথে যেতে যেতে দেখে তারা কত কিছুই না দেখছেন। তাদের ট্রিপের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পথে পড়ে থাকা আবর্জনার অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা। ওই কাজ করতে করতে দীর্ঘ পথ যেতে যেতে তারা দেখতে থাকেন উত্তর পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতি-মানুষজন। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেলে কোথাও বসে বিশ্রাম নেন, খেয়ে নেন। খুশি হন দিনশেষে যখন রাস্তার পাশে ক্যাম্প গ্রাউন্ড দেখেন। অস্থায়ী অতিথিদের জন্য সুন্দর থাকার জায়গা। রাতে ঘুমিয়ে দিনে আবার যাত্রা শুরু করেন। দিনের পর দিন কোনো বাঙালি চোখে পড়ে না। ক্যাম্প গ্রাউন্ড না পেলে অনেক সময় বিদেশী কারো বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়। কখনো-বা রাত কাটাতে হয় গ্যাস স্টেশনে। আর যদি কোথাও আশ্রয় না পাওয়া যায় তাহলে জঙ্গলেই তাঁবু খাটাতে হয়। সত্যিই এক রোমাঞ্চকর যাত্রা। পড়তে পড়তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে অচেনা এক দেশের তৃণাচ্ছাদিত ভূমি। তখন মনে হয়, বই নয়, দেখছি যেন এক ডুকুফিকশন।
নিজেদের যাত্রাপথের কথা বলতে বলতে লেখক মাঝে মাঝে লিখেন সেই সব ভ্রমণরত স্থানের বর্ণনা। তখন পাঠকের আমেরিকা না গিয়েও যেন সব দেখা হয়। যেমন, ডিলন কেওিএ থেকে এলডার কেওএ যাওয়ার দিনের কথা লেখক লিখছেন ভ্রমণের ১৪তম দিন, ২৪ জুনের কথা—উত্তর আমেরিকার ছোট শহরগুলো গল্পের মতো সুন্দর। বিশেষ কিছু যে থাকে তা নয়। তবে এক ধরনের অপরিচিত সিমপ্লিসিটির আবহ থাকে। মূল সড়কের ওপরেই শহরের যাবতীয় সব। আপনি একলপ্তে দেখে ফেলবেন যেন। দূর থেকে সাপ্লাই ওয়াটারের পানির ট্যাঙ্কটা নজরে আসে। এতদিনে বুঝে উঠতে শিখেছি কোন লোকালয় কত বড় তার পরিমিতি এই ট্যাঙ্ক থেকেই বোঝা যায়। অনেক সময় একের অধিক ট্যাঙ্ক যখন দেখা যায় তখন বুঝতে হবে আগে জনবসতি কম ছিল কিন্তু এখন বেশি।
এভাবে, লেখকের সাথে ভ্রমণ করতে করতে যারা আমেরিকা যাননি তাদের আমেরিকার কিছু অঞ্চল ঘুরে দেখা হয়ে যায়। তবে, এ-কথাও বলতে হয়, লেখক যদি তাদের দৈনন্দিন ভ্রমনকথার খুঁটিনাটি বর্ণনা কমিয়ে ওইসব অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য, প্রাণ-প্রকৃতি-সংস্কৃতির আরো বেশি বর্ণনা দিতেন তাহলে বইটি পাঠ আরো বেশি উপভোগ্য হতো, পাঠক আরো বেশি লাভবান হতো। প্রতিদিনই, তাদের একের পর এক দিনের একইরকম যাত্রাবর্ণনা খাওয়াদাওয়ার বর্ণনা অনেক সময় একঘেয়ে ঠেকেছে। তবে, সে-অধ্যায়গুলো ছোট। যে-অধ্যায়ে প্রসঙ্গক্রমে কিছু ইতিহাস-পরিচিতি এসেছে, সে অধ্যায়গুলো তুলনামূলকভাবে কিছুটা বড়। এমনই একটি অধ্যায়— স্বাধীনতা দিবস; স্থান— মিলস, ক্যাসপার; সময়— ২-৪ জুলাই; দিন—২২, ২৩ ও ২৪।
আগামীকাল স্বাধীনতা দিবসের বিরতি। এখানে শুনছি নাকি দারুণ আতসবাজি সমারোহ হয়। তাও দেখা যাবে।
এই অঙ্গরাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হলো এই ক্যাসপার। শহরের শুরু সেই ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে উত্তর-পশ্চিম আমেরিকার রাজ্যগুলো থেকে দলে দলে লোকজন আসার মাধ্যমে। খনিজ পদার্থ আর তেলকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠা এই নগরের ডাকঘরকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আর্মি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। আদিবাসী আমেরিকানদের সঙ্গে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ তখনো চলমান। আর তাই আদিবাসীদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য এই আর্মি ক্যাম্পের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। আদিবাসীদের আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচানোর নাম করে গড়ে ওঠা এই আর্মি ক্যাম্প বা গ্যারিসনগুলো ছিল মূলত এই আদিবাসীদের দমন করার আস্তানা।
আপন ভূখণ্ডে অভিবাসীদের আগ্রাসন রোধে আদ্যিকালের গোলাবারুদ আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নেটিভ আমেরিকানরা যে-যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত অভিবাসী নিও আমেরিকানদের বিরুদ্ধে— সে একেবারেই একতরফা ছিল। যদিওবা ইতিহাসে বলার চেষ্টা করা হয়েছে দুদলের রক্তক্ষয়ী নানান যুদ্ধের কথা। কিন্তু ১৮৬৪-র কলোরাডোতে ঘটে যাওয়া ‘স্যান্ড ক্রিক ম্যাসাকার’রের ঘটনা এতটাই অবিশ্বাস্যরকম পাশবিক ছিল যে খোদ সাদা আমেরিকানদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।
একটু বিস্তৃত উদ্ধৃতি দেয়ার কারণ পাঠক যেন বইটির আমেজ-মেজাজ-ভঙি বুঝতে পারেন। এভাবে ইতিহাস-প্রকৃতির ওপর দিয়ে ভ্রমণ করতে করতে তারা তাদের যাত্রা শেষ করেন ৬৮তম দিন ভার্জিনিয়ার অ্যাশবার্নে পৌঁছে। দীর্ঘ ভ্রমণের পরিসমাপ্তি টেনেছেন বিদায়ের বিষাদময় সুরে— ইতি, বিদায়— সবসময় তাই বুঝি বেদনার? পোড় খেয়েও? চলমান সময়কে যতই কষ্টের মনে হোক, গত হয়ে গেলে এর মায়া আটকে থাকে মনে। তবে কি অতীতেই বেঁচে থাকা হয়? রোমন্থনে? স্মৃতির পাতায়? জীবনের বনভোজনে তাই না হয় ফুটে থাকুক!
বইটির শেষে সংযুক্ত হয়েছে তাদের ভ্রমণের কিছু সুন্দর ছবি। ছবি ছাপা ভালো হয়েছে। ঝকঝকে। বইটির সামগ্রিক উপস্থাপন, প্রোডাকশন ভালো। যত্ন নিয়ে বইটি প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশনস। প্রচ্ছদ করেছেন ইমন ওবায়দুল্লাহ। ২১৬ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য ৬০০ টাকা। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ২০২২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে।