Published : 03 Sep 2014, 07:28 PM
স্বল্প জীবনকালের কবি আবুল হাসান আমাদের কাব্যজগতে ৬০ দশকের কবি । মাত্র ১০ বছর তাঁর কাব্য জীবন। ২৯ বছর তাঁর জীবনকাল। আবুল হাসানের কবিতায় উদ্দাম যৌবনের গান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আবুল হাসান তাঁর সৃষ্টিতে আজো স্বতন্ত্র। তার স্বর ভিন্ন। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো আরও ঋদ্ধ প্রকাশ ও নির্মাণ লক্ষ করতে পারতাম, তার অকাল মৃত্যুতে নিশ্চয়ই আমরা সে প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এ কথার অর্থ এই নয় যে যৌবনের এই প্রকাশ তার কবিতায় শিল্প সংহতিতে বাঁধা হয়েছে। মূলত যৌবনই হলো সকল সৃষ্টির উৎকৃষ্ট সময়, যৌবনের উদ্দাম গতিধারা স্ব-স্বভাবে পৃথিবী বদলানোর স্বপ্ন দেখে, অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, রক্ত দেয়, দুর্দমনীয় প্রকাশের মধ্যদিয়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, কি শিল্পে, কি সাহিত্যে, জীবন সংগ্রামে যৌবন হলো সংগ্রহের কাল, আর বার্ধক্য হচ্ছে বিবেচনা, অভিজ্ঞতার প্রয়োগ– বিশুদ্ধির।
কবি হাসানের কবিতার বাক্য ও স্বর ভিন্ন, ব্যাঞ্জনাময় শব্দ যা প্রায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার কবিতায় চুমকির মতো বসে গেছে। কখনো কখনো তা যেন আকস্মিক, স্থিতিস্থাপকতায় খানিকটা অসামঞ্জস্য, সম্পাদনার অভাব থাকলেও মনে করে নেয়া ঠিক হবে না যে এতে কবিতার দারুণ ক্ষতি হয়েছে,তা কিন্তু নয় । পরিণত সময়ের বিবেচনা একজন তরুণ করতে পারেন না, যৌবনের তা ধর্মই নয় । তিনি স্বভাব কবিও নন, যদিও কবি হিসেবে যে মৌলিকত্ব প্রয়োজন বলে অনুভব করা হয়, তিনি তেমনই, তার শব্দ প্রয়োগের বল্লম কখনো কখনো বগ্লাহীন হয়েছে কিন্তু তারপরও তিনি অনেক বেশী মৌলিক এবং কাব্য নির্মাণে ৪০ ও ৫০-এর প্রতিষ্ঠিত গণ্ডির বাইরে নতুন স্বরের সংযোজক। আবুল হাসানের প্রকাশিত কাব্যের সংখ্যা ৩টি, রাজা যায় রাজা আসে,যে তুমি হরণ করো, আর পৃথক পালঙ্ক। এ ছাড়া তার অগ্রন্থিত কবিতা রয়েছে অনেক যা পরবর্তীতে তার প্রিয় বন্ধুরা গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করে বন্ধুর স্মৃতির প্রতি যথার্থ মর্যাদা দিয়েছেন, একজন কবির প্রতি তো বটেই । এতে যৌথ পরিচিতি লিখেছিলেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ও অন্যান্য। এই মুখবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে যে 'আবুল হাসান শব্দ ব্যাবহারে ছিলেন অতি সচেতন। শব্দকে প্রচলিত অর্থ থেকে মুক্ত করে নতুন অর্থে ঋদ্ধ করা ও নতুন ব্যঞ্জনায় অভিষিক্ত করা ছিলো তাঁর মৌলিকতা। কিন্ত এই কাজটি করতে গিয়ে তিনি ক্ষেত্র বিশেষে অতিমাত্রায় শব্দনির্ভর হয়ে পড়েছেন। এর ফলে তাঁর প্রায় প্রতিটি কবিতা সুখপাঠ্য হলেও কোনো কোনো পংক্তি বা কবিতাংশ সর্বাংশে অর্থময় বলে প্রতিভাত হয় না।' কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা ছিলেন কবি আবুল হাসানের উন্মূল যৌবনের ঘনিষ্টতম বন্ধুদের একজন। আবুল হাসানের কাব্য সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে তার তিরোধানের পরে । কবি শামসুর রাহমান ভূমিকা লিখতে গিয়ে বলেছেন ''আবুল হাসান, আবুল হোসেন নামে লিখতে শুরু করেছিলেন; পরবর্তিকালে তিনি যখন জানতে পারলেন এই নামে ৪০ এর একজন কবি, আবুল হোসেন আছেন, তখন তিনি তাঁর নাম আবুল হাসান-এ পরিবর্তিত করে লিখতে শুরু করলেন, এবং জন্ম হলো একজন খাঁটি কবির। প্রতিটি মুহূর্তে কবিতায় ভরপুর ছিলেন। হাওয়া, ধূলোয়, গাছের পাতায়, পাখির ডানায়, নদীর জলে, দিনের কোলাহলে, রাত্রির নিস্তব্ধতায় তিনি কবিতা পেয়ে যেতেন অবলীলায়।''
০২.
আবুল হাসান গতানুগতিক কবি নন। তিনি ছিলেন ভিন্ন মাত্রার অন্যরকম কবি। তার শব্দাবলী, বিষয় নির্বাচন, কবিতা কাঠামোর বিন্যাস, ব্যাঞ্জনাময় শব্দশর, সৃষ্টির কৌশল, সব কিছুতেই ভিন্নতা রয়েছে। তিনি ঐতিহ্যবিরোধী কবি ছিলেন না, তবে ঐতিহ্যকে টায় টায় ব্যবহার করেন নি,বরঞ্চ তাকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টায় নিবেদিত ছিলেন। ফলে তার কবিতায় উঠে এসেছে নানা মাত্রিক সংশয়, সন্দেহ, উত্তেজনা, ভালো-মন্দের নানা চিত্রাবলী যা যৌবনেরই জয়গান। যদিও আবুল হাসানের কবিতায় নিঃসঙ্গতা, দীর্ঘশ্বাস, বহমান জীবনের দহন দাহ, নানাভাবে ছড়িয়ে আছে, তারপরও বলা যাবে না যে তিনি বিষণ্নতার কবি, নির্জনতার কবি, সমাজবিমুখ কবি। তিনি কবি, যা কিছু দেখেছেন অনুভব করেছেন, ভেবেছেন তাকে রূপ দিয়েছেন প্রতীকে, উপমায়, চিত্রকল্পে। তিনি জীবনের পক্ষের কবি। ' উদিত দুঃখের দেশ, হে কবিতা হে দুধভাত তুমি ফিরে এসো!' লক্ষ করবার মতো ' 'উদিত দুঃখের দেশ' কবিতাটি রচনাকাল উল্লেখ না থাকলেও এটি তাঁর যে তুমি হরণ করো কাব্যের দ্বিতীয় কবিতা যার প্রকাশ কাল ১৯৭৪, তখন আলোর উদয়ের দেশ নয়, তখন মহা-দুর্ভিক্ষ চলছে, ধেয়ে আসছে অনাহার, মৃত্যু, মারী; মরছে মানুষ। সেই সময়ের অর্থাৎ 'দুঃখ উদয়ের দেশে' তিনি প্রত্যাশা করছেন শাশ্বত জীবনের চাওয়াই ' আমার সন্তান যেনো থাকে দুধে ভাতে' হে দুধভাত তুমি ফিরে এসো! এবং তারপরই তিনি বিস্ময়সূচক ছেদচিহ্ন দিয়ে তার শঙ্কা, সন্দেহ, প্রত্যাশাহীনতার রেখায় সমান্তরাল করে বলছেন 'মানুষের লোকালয়ে ললিত লোভনকান্তি কবিদের মতো তুমি বেঁচে থাকো, তুমি ফের ঘুরে ঘুরে ডাকো সুসময়! এই বক্তব্যের মাধ্যমে ছেদ টেনে দিয়ে সচেতনভাবেই তিনি চলমান সত্যকে বিদ্ধ করেছেন কাব্যিক বয়নে।
কবি আবুল হাসান প্রসংগে সলিমুল্লা খান একটি প্রবন্ধ লিখেছেন তাঁর আমি তুমি সে গ্রন্থে। তাতে তিনি কবি আবুল হাসানকে দক্ষ যোগ্য এবং সমর্থবান কবিতা ভাবনায় পরিপক্ক একজন কবি হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যদিও তার আলোচ্য বিষয় একটি মাত্র কবিতা– 'রাজা যায় রাজা আসে' কাব্যগ্রন্থে স্থান পা্ওয়া 'আবুল হাসান' নামক কবিতাটি। তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে এই একটি কবিতা থেকে যে কোন আলোচক, পাঠক অনুমান করে নিতে পারবেন আবুল হাসান কোন মাপের কবি । যা হোক আবুল হাসান হ্রস্ব-আয়ুষ্কালের কবি হয়েও যতোগুলো ভালো কবিতা রেখে গেছেন তা প্রশংসার যোগ্য।
রাজা যায় রাজা আসে কবিতাটি অসাধারণ, অনন্য, এবং শিল্পঋদ্ধিতে নিটোল গাঁথুনির– সব সময় ভালো কবিতাগুলোর সংগে তুলনীয় হয়ে থাকবে। আবুল হাসান-এর কবিতার বিষয়াবলী, গঠন কাঠামো, শিল্প প্রকরণ এবং নান্দনিকতা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, তার দু'একটা পাঠের সুযোগ হয়েছে, কোন কোনটি থেকে গেছে অজানা। কবি ওমর শামস-এর একটি আলোচনা কিছুদিন আগে পড়তে পেরেছিলাম। প্রবন্ধটি আবুল হাসানকে জানবার জন্য সহায়কই। তিনি শেষমেশ কতোগুলো কবিতার পঙক্তি উল্লেখ করে সমাপ্তি টেনেছেন। এতে তাঁর কাছ থেকে আবুল হাসান-এর কাব্য কৃতির পূর্ণতা খানিকটা পাওয়া যায়,অতৃপ্তিও থেকে যায়। কেউ কেউ আবুল হাসান-এর কবিতায় জীবনানন্দের প্রভাবের কথা বলেছেন, আমার মনে হয় সকলেই স্বীকার করবেন শিল্প হচ্ছে অভিন্ন অভিজ্ঞতা, অগ্রজদের অভিজ্ঞতা অনুজরা কাজে লাগাবে–তাতে দোষের কিছু নেই, তেমনটা হয়তো আছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, না জীবনানন্দের ভাবধারায়ই কেবল তিনি বর্তমান ছিলেন না, তিনি নিজের স্বকীয়তায় ক্রমশই উজ্জ্বল হয়ে উঠছিলেন নিজস্বতা তৈরির মধ্য দিয়ে। যদিও তাঁর অধিকাংশ কবিতায় বিক্ষিপ্ততা আছে কিন্তু আমরা একটু লক্ষ করলে দেখতে পাবো যে ব্রোঞ্জের নির্মিত ভাস্কর্য যেমন প্রাকৃতিকভাবে বহু বছর পরে যে নীলচে রং ধরে অন্যরকম এক লাবণ্য তুলে ধরে তেমনি পুরো পঙক্তিগুলোর সন্নিবেশ ওই সব বিক্ষিপ্ততাকে একটা সমন্তরাল রেখায় উপনীত করে নতুনতর সৌন্দর্য শোভা দেয়।
০৩.
'সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র, মায়াবী করুণ'। বাক্য নির্মাণের ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায় 'সে এক পাথর আছে' এই চারটি শব্দ দিয়ে শুরুর কবিতাটি [ যেমন আমরা রূপকথার গল্প পড়ি অনেক অনেক দিন আগে.. ] সকল শরীরে দিয়েছে এক রহস্যময়তা এবং শুরুতেই পেয়ে গেছে লোকজ মায়া–অন্যরকম ঔৎসুক্য, এক জিজ্ঞাসা, তারপর.. তার পর এসেছে আরও তিনটি শব্দ কেবলি স্বল্প শ্বাসের [ কেবলই ] নয় , 'লাবণ্য ধরে', এবং তার পর যতি, ক্ষাণিকটা মূল থেকে বিচ্ছিন্ন করে সেই পাথরের অন্তরগত এক প্রকাশ তিনটি শব্দে 'উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র,' [নরম অর্থে, এই উজ্জ্বলতা ঝাঝালো নয়, কটকটে কটু নয়, নরম পেলবতাযুক্ত যা পাথরকে পাথরের স্থিতির বিপরীত, কারণ পাথর নরম নয়, আর্দ্রও নয়] এবং শেষ দুটি শব্দে 'মায়াবী করুণ' অর্থাৎ তার অবস্থানটাও সংশয়ের সংকটে পড়ে কারন সে মায়াবী, আবার 'সে করুণ' [ বস্তু ও তার বাস্তবতা যা নানা অবলোকনে নানাভাবে ভাবনায় দৃষ্টগ্রাহ্য হতে পারে] । পঙক্তিটি যে কোন পাঠককে নিয়ে যায় এক গুঢ় জ্ঞানের দিকে যে পাথর, যে কেবলি লাবণ্য ধরে, আবার উজ্জ্বলতা তার আর্দ্র স্নিগ্ধ, আবার মায়াবী করুণ। এভাবে বিষয়কে বিশেষ করে তোলা এবং ধীরে ধীরে সেই পাথরকে মনস্তাত্ত্বিক দ্বৈরথে তুলে দেয়া এবং এর সংগে যুক্ত করে তার রূপ, দর্শন, নানা মাত্রার অবলোকন- শিল্পসত্তাকে পরমে মিলিয়ে দেয়া 'আলোর ইশকুল?' [ জ্ঞানের প্রতিষ্ঠানে, অর্থাৎ এক জ্ঞান যা রয়েছে অজ্ঞানে] এই কবিতাটি নিয়ে সলিমুল্লাহ খান ফ্রয়েডের মনবিজ্ঞানের তত্ত্বের বিশ্লেষণে সংযুক্ত করে একটা চমৎকার ব্যাখ্যা প্রদান করলেও বিষয়টি সাধারণ পাঠকদের কাছে কবিতার মতোই 'খানিকটা জানা গেল, খানিকটা জানা গেল না'-এর মতো মনে হতে পারে [ কারণ ভাষ্যটি তত্ত্বের মতোই কঠিন । তবুও যারা প্রবন্ধটি পড়েছেন বা পড়বেন তারা এর থেকে আবুল হাসানের ওজনটা আন্দাজ করে নিতে পারবেন। কবিতাটি তার অন্যান্য কবিতার মতো সহজ পাঠের নয়, জীবনের রহস্য দ্বারা কবিতাটি রাঙিয়েছেন, এবং নানা অনুষঙ্গে তার শরীর নির্মিত হয়েছে যা পাঠককেও গভীর অনুধ্যানের মধ্য দিয়ে একটা আনন্দ হাসিল করতে দেবে। কবিতাটিতে প্রশ্ন প্রশ্ন প্রশ্ন আর আশ্চর্য্যবোধক চিহ্ন দ্বারা নানা মাত্রিকতায় এক ধরণের সংশয় সৃষ্টি করা হয়েছে, জিজ্ঞাসা জীবনমুখী করে তার আইডেন্টিটি সামনে এনে আবার প্রশ্ন এবং প্রশ্ন নিজের মধ্য থেকে উত্তোলন করে একটা পটভূমির সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষের সারা জীবনের এবং অতিক্রমের প্রান্তে রয়েছে 'আলোর ইশকুল',[ ইস্কুল,স্কুল শব্দটিকে' ইশকুল' ব্যবহারে অন্যরকম মাত্রায় স্থাপন করে।]। প্রকৃত অবস্থায় প্রতিটি মানুষের অস্তিত্ব এক বৃহৎ সত্তার সাথে যুক্ত যা একক ও অভিন্ন। সলিমুল্লাহ খান এ বিষয়ে দার্শনিক তত্ত্ব হাজির করে যে আলোচনা করেছেন কবিতাটির শরীর নিয়ে আলোচনা না করলে তা বিচ্ছিন্ন আলোচনার মতোই মনে হতে পারে। তিনি অবশ্য ফ্রয়েডের তত্ত্ব দিয়েই এই কবিতার গঠনগত আলোচনা করেছেন, এবং বলতে চেয়েছেন যে আবুল হাসান [ শামসুর রাহমান যেমন বলেছেন আবুল হাসান পৃথক পালঙ্ক থেকে প্রকৃত কবি হয়ে উঠছিলেন, তার বিপরীত] শুরু থেকেই কবি, এবং একজন মাপযোগ্য কবি হিসেবেই উঠে এসেছিলেন। আবুল হাসান কবিতাটির শেষ তিন পঙক্তিতে 'তবে কি সে মানুষের সাথে সম্পর্কিত ছিল, কোনোদিন/ ভালোবেসেছিল সেও যুবতীর বাম হাতে পাঁচটি আঙ্গুল?/ ভালোবেসেছিলো ফুল, মোমবাতি, শিরস্ত্রাণ, আলোর ইশকুল? [ ইশকুল বানানটি অভিধান সংলগ্ন নয় তবুও ব্যবহারে অন্যরকম ভাবে মানিয়ে যায়] শেষ তিন পঙক্তি উল্লেখিত আলোচনায় একটা কাঠামোগত রূপ পায়।
কেবল মাত্র এই কবিতাটি যদি আবুল হাসান লিখতেন, আর কিছু নাও লিখতেন তাহলেও কাব্য জগতে কাব্যপ্রেমীরা , আলোচকগণ নিশ্চয়ই এ কথাটি বলতেন আবুল হাসান নামে একজন কবি আমাদের মাঝে ৬০-এর দশক থেকে লেখালেখি শুরু করে ৭০ দশকের মাঝামাঝি সময় বেঁচে ছিলেন। 'আবুল হাসান' কবিতাটি তারই রচনা।
০৪.
'ব্লেড' পণ্যের বাজারে কি করে সব কিছু পণ্য হয়ে যায়, জীবনবোধ, ভাব, অনুভব মহানুভবতা কি করে ইস্পাতের দৃঢ় মোড়কে আটকা পড়ে এবং সমস্ত অনুভূতি কি করে একটা বাস্তব ও অবাস্তবতার মধ্যে পড়ে আবেগ অনুভূতিহীন হয়ে ওঠে, চারপাশের সব কিছু নকল হয়ে যায়, তার চমৎকার শিল্পরূপ আমরা পাই এভাবে 'বলি তাই এসেছি তোমার কাছে ইস্পাতিনী/শুশ্রুষার সবুজ চুম্বনে স্নিগ্ধ করে দাও তুমি এ হেন মলিন মুখ'। কবিতাটির মধ্যে দুরূহতা আছে আবার বিক্ষিপ্ততা, যেমন 'মোড়কের মায়াবী অন্দর থেকে মুখ তুলে তাকায় সে' খুবই সুন্দর অভিব্যক্তিময় পঙক্তি, তারপর 'বলে আরে,' সেটুকুও মিলিয়ে নেয়া যায়, কিন্তু পরের সংযোজনটুকু 'এসে সেই ইতর নাগর' ব্যবহার ভাবগত, অর্থগত, বাচনগত দিক থেকে অসামঞ্চস্যপূর্ণ, তবুও পুরো স্তবকের সাথে মিলিয়ে পড়লে সেই অসংগতি যেনো চোখেই পড়ে না-এটাই তার সৌন্দর্য সৃষ্টির বৈশিষ্ট।
' অসভ্য দর্শন' কবিতা যা তার প্রিয়বন্ধু নির্মলেন্দু গুণকে উৎসর্গ করা। মনে করা যায় কবি তার সময়ে চলমান রাজনীতির [ যা এখনো চলমান] প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েই খুব সঠিকভাবে নামকরণটি করেছিলেন বন্ধুর উদ্দেশ্যে। কবিতাটি পড়লে বলতে ইচ্ছে করে সত্যদর্শনও হতে পারতো ] কারণ যখন তিনি বলেন 'দালান উঠছে তাও রাজনীতি, দালান ভাঙছে তাও রাজনীতি'–তা তিনি যেমন করেই বলুন, কোনো কিছুই যে রাজনীতির বাইরে নয়, দালান ওঠা প্রতীকী অর্থে সকল কর্মের যে বয়ান তা রাজনীতির মধ্যেই পড়ে, যে ভাবে 'তরুণেরা অধঃপাতে যাচ্ছে তাও রাজনীতি পুনরায়' এরকমভাবে কবিতাটি বিবৃত হয়ে হয়ে 'বেদনার বিষবাষ্পে জর্জরিত এখন সবার চতুর্দিকে খাঁ খাঁ খল/তীব্র এক বেদেনীর সাপ খেলা দেখছি আমি; রাজনীতি তাও কি রাজনীতি?' তখন তো আর তাকে 'অসভ্য দর্শন' বলা যায় না। বা এটাও ভেবে নেয়া যায় যে এই দুঃখময় অধপতিত রাজনীতি তিনি দেখে গেছেন যা অসভ্য দর্শনেরই সামিল।
সৌন্দর্য প্রসংগে প্লেটোর মত ছিলো সৌন্দর্য স্বর্গীয় আর তার শিষ্য অ্যারিস্টেটল-এর মত সৌন্দর্য নির্বস্তুক নয়, শৃখংলা,সামঞ্জস্য ও স্পষ্টতা-এই তিনটি তার প্রধান উপাদান। কান্ট মনে করতেন বিশুদ্ধ আনন্দ উদ্দেশ্যনিরপেক্ষ যা ক্রোচো-র মতেরই প্রতিধ্বনি । রবীন্দ্রনাথও তেমন অভিমত দিয়ে গেছেন সাহিত্য প্রবন্ধে, কিন্তু তলস্তয় ধিক্কার দিলেন সৌন্দর্যরসিক বিলাসী শিল্পীদের, যাদের রূপ-পিপাসা শিল্পকে ধনীর বিলাসের উপকরণ করে তোলে। আবুল হাসানের কাব্য-সৌন্দর্যের বিষয়ে নানারূপ বিচার-বিশ্লেষণ হতে পারে, তবে তার সৃষ্ট কাব্য-আনন্দ কেবলমাত্র ভাব-বিলাস নয়, বরং অনেক খানি তলস্তয়ের মতামতের সংগে সম্পৃক্ত করে নেয়া যায়, যেমন: 'কালো কৃষকের গান' কী অদ্ভুত সুন্দর পঙক্তি দিয়ে শুরু " দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও আমি অনাবাদী রাখবো না আর আমার ভেতর!" " আমার বুকের কাছে তাদেরও দুঃখ আছে, পূর্বজন্মের পরাজয় আছে" 'অপেক্ষায় থেকো' কবিতায় "আমরা আসবো ঠিকই ফিরে আসবো অপেক্ষায় থেকো" ' ধুলো' কবিতায় "ধুুলো কি দগ্ধ কয়লা? ধুলো কি বারুদ" কবিতাটি সাদামাটা বলে প্রতীয়মান হলেও এর অন্তর ধারায় রয়েছে অন্যরকম নির্মাণ। কারণ যখন তিনি জিজ্ঞাস্য সূত্রে বলেন 'ধুলো কি দগ্ধ কয়লা?' তখন বহির অঙ্গনের সহজ প্রকাশটি ভিন্নতা নিয়েই ভাবনায় চলে আসে, আবার 'ধুলো কি বারুদ?' প্রশ্নটি ধুলোকে বৈশিষ্ট দেয়, যার বিষ্ফোরণ ক্ষমতা আছে এবং যা বিধ্বংসে পারঙ্গম। 'নিঃসঙ্গতা'-য় "অতোটুকু চায়নি বালিকা! অত শোভা, অত স্বাধীনতা! চেয়েছিল আরো কিছু কম/… একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী " এই যে আকুলতা মানবের মানবীর তা এক অবিচ্ছিন্ন নষ্টালজিয়ায় পাঠককে আকৃষ্ট করে। এমনি ' অস্থিরতা' কবিতায় "একটু খানিক তন্দ্রাতে সে একটু খানিক জেগে বুকের কাছে হাতটি ছিলো/ হঠাৎ সে উদ্বেগে.." 'সে আর ফেরে না' কবিতায় "বহুদূরে ট্রেনের হুইসেল, যায় দিন যায়/বোনের মতোন এক লাজুক পাড়া গাঁ তার/ডাক শুনে থাকে অপেক্ষায়/তবু ভাই ফেরে না , ফেরে না!" তৃতীয় কাব্যগ্রন্থে "মারী ও মড়কে যার মৃত্যু হয় হোক আমি মরি নাই-শোন… তার পর বিশুদ্ধির বিরল উত্থানের মধ্যে আমি আছ " কিংবা "ঝিনুক নীরবে সহো/ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও" ছোট্ট তবে এর যে ধ্যান তা জানতে হলে আবুল হাসানের জীবন, জীবন বোধ, তার পারিপার্শ্বিকতার জটিলতা, সমকালীর রাজনীতি, স্বাধীনতার স্বপ্ন এবং স্বাধীনতা-পরবর্তি সময়ের হতাশা তাকে বুঝতে হবে। আবুল হাসান কেবল যৌবনের উদ্দামতাকে শব্দে সাজান নি, শিল্পজগতের নানা জিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে এমন কিছু বলে গেছেন যা পরিপূর্ণভাবে এখনো আলোচিত হয়নি।