নাগরিক শিল্পী এবং বুদ্ধিজীবী বিষয়ে কয়েকটি কথা

দেবাশিস চক্রবর্তী
Published : 5 Sept 2011, 05:59 AM
Updated : 28 Jan 2022, 10:52 AM


বাংলাদেশে একটা চল তো আছেই, আমরা প্রায়ই এমন কি শুনি না যে আমাদের কেউ বলছে বা একজন আরেকজনকে বলছে, "আপনি এই বিষয়ে প্রতিবাদ করলেন না কেন? বা গতকাল ঐ বিষয়ে প্রতিবাদ করলেন কিন্তু আজকে এই বিষয়ে করছেন না কেন?"। এইভাবে কোন ব্যক্তিকে আক্রমণ করা যে কাজের কিছু না বরং নিম্নশ্রেণীর কথাবার্তা সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন ব্যক্তি তো একজন নাগরিকও। আর নাগরিকের আছে কিছু অধিকার এবং দায়িত্বও। নাগরিক রাষ্ট্রের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা মেকানিজম আর এটা ঠিক মত ফাংশন না করলে কি হয় সেটা আমাদের বাংলাদেশের দিকে তাকালেই কি আমরা টের পাই না? আমরা রাষ্ট্রসহ আর আর বহু প্রযুক্তি যেমন গণতন্ত্র, পার্লামেন্ট, নির্বাচন কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয়, আইন-আদালত ইত্যাদি ইউরোপ থেকে ধার করেছি। আর আমরা দেখতে পাচ্ছি সেগুলি খোদ ইউরোপে বেশ কাজে দিয়েছে। কিন্তু কেন? কিভাবে? তার একটাই কারণ সেখানে নাগরিক সমাজ বা সিভিল সোসাইটি আরও তৎপর ভূমিকা পালন করে। আবার এই তৎপর ভূমিকা পালন করার পেছনে তাদের নিজস্ব এবং স্থানিক একটা ইতিহাসও আছে। যার সাথে আমাদের ইতিহাসের প্রায় কোন মিল নাই। ইউরোপের বাস্তবতার সাথে আমাদের কোন মিল ছিল না। কারণটাও পরিষ্কার, ইউরোপ উপনিবেশক আর আমরা উপনিবেশিত। এই উপনিবেশক শক্তির কাছে থেকে আমরা যে প্রযুক্তি ধার করেছি তার সবটাই যে প্রযুক্তির উৎকৃষ্টতার বিচারে, এমনও নয়। ইউরোপ ঘরের বাইরে গিয়েছিলো নিজের লাভের আশায়, উন্নতি আর সাম্রাজ্যের খায়েশে। এইসব খায়েশ যাতে আরামসে হাসিল করতে পারে তার জন্য বন্দুকের ভয়ের পাশাপাশি বিস্তর জ্ঞানগত আগ্রাসন চালাতে হয়েছে। সেই জ্ঞানতাত্ত্বিক আলাপে আপাতত আমরা যাচ্ছি না। শুধু খেয়াল রাখবো যে এই সব ইউরোপীয় প্রযুক্তি বহুলাংশেই চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং ঘটনাচক্রে এই প্রযুক্তি এখন আমাদের দৈনন্দিন বাস্তবতা। একদম অস্তিত্বের সাথে মিলে মিশে আছে। এখন তো চাইলেই, আগামীকালই এসব প্রযুক্তি নাই করে দেয়া যাচ্ছে না। তাই প্রযুক্তিগুলি নিজেদের মতো করে নিজেদের বিকাশের জন্যই আমাদের কাজে লাগাতে হবে। এখন এই কাজে লাগানোর জন্য জনগোষ্ঠী হিসাবে আমরা তৎপর হয়ে উঠবো কিনা? নাগরিক হয়ে উঠবো কিনা? এই আলাপ উঠবেই। তাছাড়া নাগরিকের এই তৎপরতা সোজা কোন কাজ না। খাটনির কাজ। আবার এই তৎপরতায় নাগরিক একা কাজ করে না বরং তার আগে পিছে আরও কুশীলব থাকে যারা সময় সময় নাগরিকদের প্রতিবাদে, নিজেদের বুঝটা বুঝে নেয়ার পরিস্থিতি তৈরি করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের নিজেদের মতন তৎপর হয়ে ওঠার ইতিহাস কেমন হতে পারে এই লেখায় অল্প কথায় সেটা খুঁজে দেখার একটু চেষ্টা আমরা করব। কারণ, অল্প করে হলেও যার যার জায়গা থেকে বলতে হবে।


বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে বাংলাদেশ বোঝাপড়া ভীষণ অপরিচ্ছন্ন এবং শিক্ষিত সমাজ বলতে যে সমাজ অধিষ্ঠিত হয়ে আছে, তাদের মধ্যেও এই বোঝাপড়ার অবস্থা খুব খারাপ। এখানে কোন একক ব্যক্তিকে দোষারোপ না করে বরং পরিস্থিতিটাকে আমরা একটা সামস্টিক প্রবণতা হিসাবে দেখতে চাই। কিন্তু বুদ্ধিজীবী নিয়ে কথা বলার আগে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীর দিকে আমাদের নজর দেয়া দরকার। এখন আপাতত বুদ্ধিজীবীতা থেকে আলগা রেখে আমরা শিল্পিতা'র কথা বলবো। পরে হয়তো দেখা যাবে যে, যেই উপায়ে আমরা বুদ্ধিজীবীতা বুঝতে চাই, কর্মতৎপরতার দিকে থেকে তার সাথে হয়তো শিল্পীতা'র কোন বিরোধ থাকবে না।

একজন কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীও একজন নাগরিক। কিন্তু একজন শিল্পী যদি কোন বিশেষ সময়ে প্রতিবাদে ফেটে না পড়েন বা সারা জীবনেও যদি কোন রকমের প্রতিবাদ না করেন, তাতে কি তিনি সম্পূর্ণরূপেই খারিজ হয়ে যান? মনে হয় না। শিল্পীর আবিষ্কার, শৈলী, বোধ সবই আমলে নিতে হবে, সেই অভিযানের ন্যায্য হিস্যা তিনি পাবেন। আর্ট-ই মনে হয় মানবিক কর্মতৎপরতার একমাত্র অঞ্চল—বাকি সব মানবিক তৎপরতা সামস্টিক—যেখানে শিল্পীর ব্যক্তিগত মহিমা এই ২০২২ সালেও কিছুটা অবশিষ্ট আছে আর ক্রিয়েটিভিটি বলে যে অচিহ্নিত ব্যাপার সেটা ব্যক্তি শিল্পী পরিস্থিতি এবং সময় থেকে আলগোছে নিজেকে সরিয়ে রেখে প্রতিবাদ না করার জন্য কখনোই খারিজ হয় না। আর সময়ের প্রেক্ষাপট থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার যে রাজনীতি তাকেও আমলে নিয়ে শিল্পীকে পড়বে, যার পড়ার দরকার। আর্ট তো কোন ছাড়ের জায়গা না। সময়ের দারুণ চাপ থেকে পালিয়ে যদি থাকে, যদি পালিয়ে থেকে জ্ঞানে-অজ্ঞানে নিপীড়কগোষ্ঠীর সহায়ক শক্তি হিসাবেই কাজ করতে থাকে, তবে তাকে এই পলায়নপরতা সমেত পড়তে হবে। কিন্তু বুদ্ধিজীবী বলতে কি বলে তা তো আমরা জানি ভাই। বুদ্ধিজীবী নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব নেয়, এই বিষয়ে সারা দুনিয়ায় কিছু প্রতিষ্ঠিত বুঝজ্ঞান আছে।

সক্রেটিসকে আমরা চিনি। এই চেনাটা আজকের আলাপের জন্য কাজের। কারণ সক্রেটিসের জীবনের দিকে তাকালেই আমরা টের পাই যে বুদ্ধিজীবী সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে তাদের প্রতিনিধিত্ব করেন, কিন্তু তিনি মূলত একা। তাছাড়া ক্ষমতা বা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীর সংগ্রাম চলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এবং এই সংগ্রাম চলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। এই সংগ্রামে বুদ্ধিজীবী দায়িত্ব নেয়, এর জন্যই সে বুদ্ধিজীবীর মহিমা ভোগ করে। কি সেই দায়িত্ব? তার দায়িত্ব ক্ষমতার হিংস্রতার সামনে দাঁড়িয়ে সত্য উচ্চারণ, মিথ্যার প্রতিবাদ এবং এইভাবে ঐ প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি/সম্প্রদায়কে সচেতন করে কার্যকর প্রতিবাদের রাস্তা পরিষ্কার করা। এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর Representation of the Intellectual বইয়ে বুদ্ধিজীবীর পরিচয় নিয়ে বিস্তর বলেছেন, বুদ্ধিজীবীর স্বভাব-প্রকৃতি, দায়দায়িত্ব ও কর্মতৎপরতা দেগে দিয়েছেন। সাঈদের মতে, বুদ্ধিজীবী সেই গুণের অধিকারী, যার তাড়নায় তিনি জনসমাজের জন্য জনসমাজেই কোন বক্তব্য, মনোভাব দর্শন বা মতামত উচ্চকিত করেন, উচ্চারণ করেন আর প্রতিনিধিত্ব করেন। বুদ্ধিজীবীর মধ্যে এমন এক আত্মসচেতনতা কাজ করতে হবে যে তার দায়িত্বই হল ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিব্রতকর প্রশ্ন তোলা, কর্তৃত্ব ও অন্ধবিশ্বাস মোকাবেলা করা। বুদ্ধিজীবী নিজেই বুঝবেন যে সরকার বা করপোরেশেনের কাছে বিকিয়ে যাওয়ার মতন কেউ নন তিনি। বরং বুদ্ধিজীবী নিজেই ঐ ঐ সব ব্যক্তি, ঘটনা বা বিষয়াবলী তুলে ধরবেন যা নিয়মিত বিভিন্ন বিচিত্র কারণে তলিয়ে যাচ্ছে বিস্মৃতির অতলে। বুদ্ধিজীবী এসব করবেন এই সাধারণ নীতি মেনে যে সব মানুষ বৈশ্বিক যেকোনো শক্তি ও জাতিসমূহের কাছ থেকে স্বাধীনতা ও ন্যায় বিচারের ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য মানের আচরণ আশা করেন এবং তা পাওয়ার অধিকার রাখেন। কেউ ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে এই মানের বরখেলাপ করলে বুদ্ধিজীবীকে তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে এবং লড়াই করতে হবে সাহসের সাথে।


বিদেশি উপনিবেশক আর পরাধীনতা থেকে প্রশাসনিক স্বাধীনতা মিললেও, বাংলাদেশের উপনিবেশিক ইতিহাস আমলে নিলে বুদ্ধিজীবীর দায়দায়িত্বের জটিল পরিস্থিতিকে আমাদের আরও আগ্রহের সাথে খুঁজে দেখার দরকার পড়বে। ইঙ্গিত হিসাবে আমরা মনে করতে পারি ফরাসি উপনিবেশ মার্তিনিকে জন্ম নেয়া বুদ্ধিজীবী—আরও সক্রিয় পরিচয় আছে—ফ্রানৎস ফানোঁর কথা। ফানোঁ নিজে উপনিবেশমুক্ত রাষ্ট্রে নিঃশ্বাস নিতে পারলেও ব্যক্তিত্বের সাথে উপনিবেশ পরবর্তী পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই ফানোঁর The Wretched of the Earth বইয়ের কথাগুলি বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেমন প্রাসঙ্গিক তেমন স্পর্শকাতর। কি দারুণ প্রজ্ঞা নিয়ে ফানোঁ আমাদের বলছেন, স্থানীয় নেতৃত্ব গণমানুষকে উপনিবেশকের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করে না, জাতীয় উৎকর্ষ অর্জন করা তাদের লক্ষ্য না বরং উপনিবেশকের গদিতে বসাটাই তাদের আসল ইচ্ছা। স্বাধীনতার পর মানুষের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা বা মানুষের রুটি-রুজি, জমির অধিকার তার কাছে আর মুখ্য থাকে না, উল্টা তারা আলগা মুখোশটা খুলে নিজের আসল চেহারাটা প্রকাশ করে। যেই চেহারাটা আসলে একটা কোম্পানির সিইও'র মতোই, যে কোম্পানি শুধু খেয়াল রাখে সুবিধাভোগী মধ্যবিত্তের, যে কিনা পরিস্থিতি বুঝে লাভের গুড়টা খেয়ে নেয়। ফলে তারা আসলে আরেকটা নিপীড়ক-উপনিবেশকই হয়ে ওঠে।

সূত্র
১. Edward W. Said, Representation of the Intellectual, Vintage Books, New York, 1996, p. 11-12
২. Frantz Fanon, The Wretched of the Earth, Grove Press, New York, 2004, p. 112