কুপিয়ে খুন হওয়া রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিমের স্ত্রী হোসনে আরা শিলা বলেছেন, বাজারে আলু পটল বিক্রি করলে অধ্যাপক রেজাউল খুন হতেন না; বুদ্ধিজীবী হওয়ায় তাকে হত্যা করা হলো।
Published : 25 Apr 2016, 06:09 PM
সোমবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের উদ্যোগে অধ্যাপক রেজাউল করিমের হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে আয়োজিত এক শোকসভায় তিনি বলেন,“আজ আমার স্বামী যদি বাজারে আলু পটল বিক্রি করত, তাহলে তিনি খুন হতেন না। সে বুদ্ধিজীবী ছিল সেই জন্যেই তাকে হত্যা করা হলো।
“বিচার হবে, বিচার হবে এটা শুধু মুখের কথা নয় এর প্রমাণ দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে বলব বাংলাদেশ কত উন্নত হয়েছে, আপনি সিদ্দিকীর হত্যাকারীদের শাস্তি দিয়ে তার প্রমাণ করুন।”
যে দেশে সাগর রুনির বিচার হয় না সে দেশে কি সিদ্দিকীর বিচার হবে- এমন প্রশ্নও করেন তিনি।
শনিবার সকালে নিজের বাড়ি থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ইংরেজি বিভাগের এই শিক্ষককে। মোটর সাইকেলে আসা দুই যুবক তাকে কুপিয়ে পালিয়ে যায়।
স্বামী সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “মানুষটাকে এভাবে চলে যেতে হলো। তিন দিন আগেও ভাবিনি তার জন্য আমাকে কথা বলতে হবে।
“কিছুদিন আগে সিদ্দিকী ওর মাকে নিয়ে রাতে একটা কবিতা লিখেছিল। তারপর কবিতার ওই কথাগুলো নিয়ে ও আমার সামনে শিশুর মতো কাঁদছিল।
“অনেকে বলছে তার সেইসব লেখা নাকি নাস্তিকদের লেখা। তার বানানো একটা গানের স্কুল নিয়েও অনেক কথা হচ্ছে। আপনারা এলাকায় গিয়ে দেখুন, কেমন সেই স্কুল। কেমন মানুষ ছিলেন তিনি।”
গ্রামের গরিব ছেলেমেয়েগুলো শুধু টিভিতেই গান দেখত। তারা যাতে বাস্তবে হারমনিয়াম ধরে গান শিখতে পারে সেই জন্যেই তিনি ওই স্কুল তৈরি করেছিলেন বলে জানান হোসনে আরা শিলা ।
‘প্লিজ দয়া করে বন্ধ করুন’
শোকসভায় অধ্যাপক সিদ্দিকীর মেয়ে রেজোয়ানা হাসিন প্রথমেই সাংবাদিকদের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “বিভিন্ন মিডিয়ায় আমার বাবাকে নাস্তিক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। উনি নাকি ব্লগার, ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না।
“আমার বাবার প্রযুক্তি সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই ছিল না। ব্লগার হওয়ার প্রশ্নই আসে না। প্লিজ আপনারা এইসব বন্ধ করুন। আমার বাবা হয়তো ঠিক মতো নামাজে পড়তেন না। কিন্তু তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। তিনি কখনোই কোনো ধরনের ধর্মবিদ্বেষী কথা বা লেখা লিখতেন না।”
তিনি আরো বলেন, “আমাদের সমাজে এখন একটা মিথ দাঁড়িয়ে গেছে। টুপি মানেই বিএনপি, জামাত-শিবির। আর মুক্তমনা মানেই আওয়ামী লীগ। আপনারা এসব বন্ধ করুন। আমার বাবার পিছনে ট্যাগ লাগানো বন্ধ করুন। এসব মিথ থেকে আপনারা বেরিয়ে আসুন।”
কান্নায় চেপে আসা গলায়, ঝাপসা চোখে প্রিয় বাবার স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “বাবা বাইরে বাড়তি কোথায় চাকরি না করায় খুব টাকা পয়সা আমাদের ছিল না। আমরা নতুন বাড়ি তৈরি করতে পারিনি। যে ঘর ছিল সেগুলো সংস্কারের কাজ চলছে।এখন এই ঘরগুলো আর লাগবে না।
“আমার বাবার বয়স ৬০ বছর হয়েছিল বটে কিন্তু মনের দিক থেকে সে একটা বাচ্চা ছিল। আমি আমার এই বাচ্চাটার হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।”
এ সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লে শোক সভায় উপস্থিত বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সবার মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যায়।
এরপর অধ্যাপক রেজাউলের ছেলে রিয়াসাত ইমতিয়াজ সৌরভ কথা বলতে আসলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লে কথা বলতে পারেননি।
শোক সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন রাবির উপাচার্য অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিন, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান, ইংরেজি বিভাগের সভাপতি ড. এ এফ এম মাসউদ আখতার।
রাবি শিক্ষক সমিতির মানববন্ধন
সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের সামনে মানবন্ধন করে শিক্ষক সমিতি।
মানববন্ধনে আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসিবুল আলম প্রধান বলেন, “আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনেক দুর্ভাগা। ২০০৪ সালে ২৪ ডিসেম্বর রাবি শিক্ষক ইউনুস হত্যার মধ্য দিয়ে রাবিতে শুরু হয় শিক্ষক হত্যার ষড়যন্ত্র।
“গত ১২ বছরে একের পর এক সংস্কৃতিমনা, মুক্তবুদ্ধি চর্চা, প্রগতিশীল শিক্ষকদের হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু কোন হত্যাকাণ্ডেরই সুষ্ঠু বিচার সম্পন্ন হয় নি।
“তবে কি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তবুদ্ধি চর্চা করা অপরাধ?”
মানববন্ধন শেষে রাবি উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ মিজানউদ্দিনকে একটি স্মারক লিপি প্রদান করে রাবি শিক্ষক সমিতি।
ইংরেজি বিভাগের কর্মসূচি
ইংরেজি বিভাগ সকাল ১০টায় শহীদুল্লাহ কলা ভবনের সামনে থেকে শোক মিছিল শুরু করে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে।
চতুর্থদিনের মতো মঙ্গলবার তাদের বিভাগে ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন বিভাগের সভাপতি ড. এ এফ এম মাসউদ আখতার। এছাড়া এক সপ্তাহব্যাপী মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি করার কথাও জানিয়েছে তারা।
বাগমারা থানা সমিতি
শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের এই ঘটনায় দুপুর সাড়ে ১২টায় শোক র্যালি ও রাবি গ্রন্থাগারের সামনে মানববন্ধন করেছে বাগমারা থানা সমিতি।
তারা বাগমারার সন্তান রেজাউল করিমের এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত এবং জড়িতদের শাস্তি দাবি করে।