মিশন দারফুর: শয়তান ও ‘উল্টো পোঁতা’ গাছ!

চায়ের দোকানদার স্টিলের গ্লাসে করে ঠাণ্ডা পানি দিলেন আমাদের। আমরা শাঁই অর্থাৎ চায়ের অর্ডার করলাম।

মোহাম্মদ আশিকুর রহমান, সুদানের দারফুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 May 2017, 04:32 AM
Updated : 22 May 2017, 01:38 PM

সাথে খোবুজ (পাউরুটি) আর ফুল (সিমের বিচি) অর্ডার করলাম। চা খেতে খেতে পাউরুটি আর সিমের বিচি রান্না চলে আসলো বড় একটা সসপ্যানে। সিমের বিচি রান্নায় ঝাল নেই, ঝাল চেয়ে নিলাম। দোকানি সাথে পেঁয়াজ আর লেবু কেটে দিলেন। আমি ও আমার কলিগরা খেতে থাকলাম, সত্যিই অসাধারণ স্বাদ। খেতে খেতে এক কাপ জাবান (লোকাল কফি) অর্ডার করলাম।

সুদানিজ বাজারের মধ্যে এসব দোকান কাম হোটেল বেশ বড় হয়। চারদিকে বাঁশের মতো বেড়া, উপরে ভূট্টার খড় দিয়ে ছাওয়া। বসার জন্যে খাটিয়া, যার বসার ছাউনি প্লাস্টিক বা নাইলন বা দড়ি দিয়ে তৈরি। যথারীতি দোকানি একজন নারী। দোকানের খরিদ্দার সব পুরুষ। এসে চা খাচ্ছে, গাল-গপ্পো মারছে।

আমরাও তাই করলাম। চা, কফি,পাউরুটি, সিমের বিচি খেলাম আর গাল-গপ্পো শুরু করলাম। খেয়ে বাজার থেকে ঢেঁড়স কিনলাম, দুই প্যাকেট ১০ পাউন্ড দিয়ে, ওজন অনুমান আধ কেজি। দুই প্যাকেট পাউরুটি কিনলাম ১০ পাউন্ড দিয়ে।

এরপর চোখে পড়লো বাওবাব গাছের ফল। এই ফলের ভেতরে সাদা সাদা বীজ থাকে যা পানিতে ভিজিয়ে শরবত করা হয়। বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন আছে বলে এই শরবত শরীরের জন্য ও পরিপাকতন্ত্রের জন্য ভালো। এই ফলে আছে প্রচুর ফাইবার, কমলার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভিটামিন সি, দুধের চেয়ে বেশি ক্যালসিয়াম, কলার চেয়ে বেশি পটাসিয়াম, ব্লুবেরির চেয়ে বেশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।

ধান ভানতে শীবের গীত গাওয়া লাগছে। অবাক হবার মতো তথ্যসমৃদ্ধ এই ফল ও গাছ সম্পর্কে কিছু লেখার লোভ ও ইচ্ছা সংবরণ করতে পারছিলাম না। গত বেশ ক’দিন ধরে আমি বিভিন্নভাবে এই ফলটি সম্পর্কে তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করেছি।

ফরাসি উদ্ভিদবিদ এডানসন বলেছিলেন, “জীবনে যত গাছ নিয়ে পড়াশোনা করেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে উপকারী গাছ এই বাওবাব।”

বাওবাব গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ‘এডানসোনিয়া ডিজিটেটা’। সুদানসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে প্রচুর পরিমাণে বাওবাব গাছ মরুভূমিতে একাকি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।

তবে অস্ট্রেলিয়াতে অনেক বাওবাব গাছ দেখতে পাওয়া যায়। ভারতের কর্ণাটকে, এমনকি বাংলাদেশের গাজীপুর-শ্রীপুরে এই গাছ রয়েছে বলে জানা যায়। বাওবাব বা তাবালদি হলো আফ্রিকা মহাদেশের খুব উপকারী এক গাছের নাম। বিশেষ করে মরু এলাকায় এই গাছ ও ফল এবং ফলের জুস অনেক কার্যকরী, উপকারী ও জনপ্রিয়।

এই ফলের ভেতরে সাদা প্রলেপ দেওয়া বীজ থাকে,এগুলো পানিতে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখতে হয়। এরপর চটকে বীজ ও অন্যান্য অংশ ছেকে ফেলে দিয়ে চিনি মিশিয়ে বা চিনি না মিশিয়েও ফ্রিজে রেখে ঠাণ্ডা করে বা বরফ মিশিয়ে এই শরবত খাওয়া হয়। এই শরবতকে সুদানিজ ভাষায় বলা হয় ‘তাবালদি’। এই শরবতের স্বাদ টক, রং ও স্বাদ অনেকটা তেঁতুল গোলা বা কদবেল গোলার মতো।

শরবত থেকে ফেলে দেওয়া বীজ থেকে তেল হয়, এবং যার খৈল পশুখাদ্য। ইউরোপ ও অন্যান্য পশ্চিমের দেশগুলোতে দিন দিন তাবালদি পাল্প পাউডারের চাহিদা এত বেড়ে গেছে যে, এখন নতুন করে নানা দেশে বাওবাব লাগানোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ন্যাশন্যাল জিওগ্রাফির একটি এস্টিমেটে বলা হয়েছে, পৃথিবীব্যাপী বাওবাবের চাহিদা মেটানোর জন্য আফ্রিকায় যে ফসল তৈরি হতে পারে, তার বাৎসরিক মূল্য অন্তত ১ বিলিয়ন ডলার।

বাওবাব গাছ দেখলে আপনার সেই রূপকথার গল্প যেটি অনেকেই বিশ্বাস করে এর সত্যতা বা মিল খুঁজে পাবেন। প্রচলিত গল্প আছে- স্বর্গে এই বাওবাব গাছের প্রতি শয়তানের কুদৃষ্টি পড়ে। সে স্বর্গ থেকে গাছটি তুলে মর্ত্যে এনে উল্টিয়ে মাটিতে পুঁতে দেয়। তাইতো এই গল্পটি শোনা বা জানা থাকলে গল্পটির সত্যতা বা মিল খুঁজে পাবেন নিশ্চিত।

গাছের ডালের উপরিভাগে ছোট ছোট অসংখ্য ডাল, যা দেখলে মনে হবে শেকড়। অধিকাংশ সময়ই গাছে পাতা থাকে না। আর গাছের গোড়ার দিক দেখলে তখন মনে হবে, গাছের মাথাসহ ডাল, পাতা মাটিতে পোঁতা। আফ্রিকান ভাষায় বাওবাব মানে হলো ‘উল্টো গাছ’।

একটা পূর্ণবয়স্ক বাওবাব গাছ তার শরীরের অভ্যন্তরে হাজার লিটার পানি ধরে রাখতে পারে, বৃষ্টি থেকে এই গাছ পানি ধরে রাখে বা মাটির নিচ থেকে পানি সংগ্রহ করে কাণ্ডের ভেতর জমা রাখে। সেই সঞ্চিত পানি শুষ্ক মৌসুমে মরু এলাকার আফ্রিকানরা গাছের গায়ে গর্ত বা ফুটো করে পানি সংগ্রহ করে। অনেকটা আমাদের দেশের খেঁজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের নলের মতো নল বসিয়ে পানি বের করে।

এছাড়া কাণ্ডের উপরিভাগে গর্ত করে কাণ্ডের ভেতরে পানির জলাধার তৈরি করে পানি সঞ্চয় করে বর্ষা মৌসুমে,আর শুষ্ক মৌসুমে পানির চাহিদা অনেকাংশে মেটে এই পানিতে। হাজার বছর আয়ুষ্কালের এই গাছের গায়ে গর্ত করে বসবাস, ডাকঘর, আশ্রয় এমনকি জেলখানা হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা গেছে।

তবে এ ধরনের গর্ত ও জলাধারের জন্যে তৈরি গর্ত করার ফলে আস্তে আস্তে কাণ্ড পচে গাছ মারাও যায়। কারণ গাছের কাঠ শক্ত নয়। যদিও মরতে কয়েকশ'বছর চলে যায়!

এই গাছ কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। সবচেয়ে প্রাচীন এই গাছের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায় লিল্যান্ডে। ধারণা করা হয় গাছটির বয়স ৬ থেকে ৭ হাজার বছর মাত্র! গাছটির ভেতরে কাণ্ড কেটে সুরঙ্গ করে একটি পানশালা তৈরি করা হয়েছে, যেখানে একসাথে ১৫-১৬ জন বসে সুরা পান করতে পারে। দৈনিক হাজার লোক এই পানশালায় ঢুকতে সকাল থেকে লাইন ধরে থাকে!

বাওবাবের ফলের আকৃতি অনেকটা মেহগনি ফলের মতো। কাঁচা বাওবাব ফল সবুজাভ থাকে। তখন এর উপরিভাগ নরম থাকে। বানরেরা এই কাঁচা বাওবাব ফলের উপরের পুরু আবরণ রুটির মতো করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায় বলে অনেকে এই বাওবাব গাছকে ‘মাংকি ব্রেড ট্রি’ বা বাংলায় বানরের রুটি গাছও বলে থাকে। বাওবাব ফল পাকলে এর উপরের আবরণ শক্ত হয়ে যায় এবং রংয়ের পরিবর্তন আসে।

এই ফলের আবরণের উপরিভাগে মখমলের মতো পাতলা স্তর থাকে। দেখতে অনেকটা ‘বিলাই চিমটি’ বা ‘দয়ার গুড়ো’র মতো লাগে,কিন্তু বিলাই চিমটির মতো চুলকানি হয় না। বাওবাবের ছাল বা বাকল থেকে দড়ি, বিভিন্ন রকম বাস্কেট, ঘর ছাওয়ার জিনিস ইত্যাদি তৈরি হয় বলে মাটি থেকে দুই-আড়াই মিটার পর্যন্ত এর ছাল সংগ্রহ করে মানুষ। এতে বাওবাব মরে না, নতুন করে আবার ছাল তৈরি করে নেয়।

বাওবাবের ফল সময়মতো সংগ্রহ না করলে তা ৬ মাস পর্যন্ত গাছে ঝুলে থাকতে পারে। এই শুকনো ফল পাউডার করে খাওয়া চলে, নষ্ট হয় না। গাছ থেকে ফল সংগ্রহের সুবিধার জন্য উঁচু গাছের গায়ে গর্ত করা হয় বা খুঁটি পোঁতা হয় যা গাছের ক্যানপিতে চড়ার জন্য কাজে লাগে। বাওবাব গাছের পাতাও ঔষধি গুণসম্পন্ন, বিভিন্ন রোগের উপশম করে এই পাতা।

বাওবাব গাছ উঁচু বিধায় প্রায়ই এই গাছের উপরে বজ্রপাত হয়, কিন্তু এই গাছে অগ্নি নির্বাপণ ট্যানিন নামক পদার্থের উপস্থিতি আছে বলে ক্ষতি কম হয়,মারা যায় না। বাওবাব নিয়ে সারা দুনিয়ার বিজ্ঞানীরা এখন কঠিন গবেষণায় লিপ্ত।

পৃথিবীর বহু জায়গায়, বিশেষত আফ্রিকায় এদের প্রচুর ফলন সম্ভব যা আমাদের দিতে পারে অতিরিক্ত স্বাদ ও পুষ্টি এবং এর ফলে সৃষ্টি হতে পারে প্রচুর কর্মসংস্থান, যা অবহেলিত দরিদ্র জাতিকে আর্থিকভাবে ওপরে টেনে তুলতে পারে।

লেখক: সদস্য, বাংলাদেশ পুলিশ,সুদানের দারফুরে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে কর্মরত।

ই-মেইল: ash.pol2000@gmail.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!