মিশন দারফুর: একজন পুলিশের স্মৃতি হাতড়ানো

লুঙ্গি পরে ভ্যানে শুয়ে পক্স আক্রান্ত এই আমি যখন এসএসসি পরীক্ষা দিতে যাই, তখনও ভাবিনি ‘পুলিশ’ হব। এসএসসি পরীক্ষায় নকল সাপ্লাই দিতে গিয়ে যখন পুলিশের লাঠির বাড়ি ও দৌঁড়ানি খেয়েছি, তখনও ভাবিনি ‘পুলিশ’ হব।

মোহাম্মদ আশিকুর রহমান, সুদানের দারফুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Feb 2017, 07:56 AM
Updated : 8 Feb 2017, 07:56 AM

ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউট থেকে যখন রাতে সোহরাওয়ার্দী পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে টিএসসি যেতে গিয়ে পুলিশের ঝাড়ি খেয়েছি, তখনও ভাবিনি ‘পুলিশ’ হব। দুই দুইবার যখন সেনাবাহিনীর আইএসএসবি থেকে আউট হয়েছি, তখনও ভাবিনি ‘পুলিশ’ হব।

না ভাবা এই আমি ঠিক-ই পুলিশ হয়ে গেলাম। ভেতরের মানুষটি রয়ে গেলেও বাইরের আমি ‘পুলিশ’ হয়ে গেলাম। আমি পুলিশ, পুলিশ মামা, পুলিশ কাকা, পুলিশ ভাই হয়ে নিজেকেই হারিয়ে ফেলি যেন! তাই বলে ভুলি না- ‘আমি শুধু পুলিশ-ই নই, মানুষও বটে’। আমি এখনও আবেগে আপ্লুত হই- ভালোবাসা, মায়া, মমতা পেলে। তখন মনে হয়, আমি পুলিশ হলেও অন্তঃকরণে একজন রক্তমাংসের মানুষ।

দেশের মধ্যে খুব বেশি জায়গায় ঘুরতে যাবার সৌভাগ্য না হলেও এই পুলিশের চাকরির কল্যাণে ‘জাতিসংঘ রক্ষাবাহিনী’র একজন গর্বিত সদস্য হয়ে দেশ থেকে প্রায় সাড়ে আট হাজার কিলোমিটার দূরে সুদানে আজ আমি। বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিভিন্ন অফিসারদের সাথে আলাপচারিতা, পরিচয় আমাকে সমৃদ্ধ করছে।

 বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করছি এই আমি, মানে পুলিশ আমি। এখানে যখন দেখি, আমার প্রিয় দেশের অফিসাররা বিভিন্ন জায়গায় স্ব স্ব যোগ্যতায় দেশের লাল-সবুজ পতাকা সগৌরবে উড়িয়ে চলছে, তখন গর্বে বুক ভরে যায়। আজ জাতিসংঘে আমাদের দেশের সূর্যসন্তানেরা বাংলাদেশকে এমন এক উচ্চতায় আসীন করেছেন, যা শুনলে আর দেখলে অহংবোধ হয়।

সুদানে আসার পর থেকেই যে সব দেশিয় অফিসারদের সাথে দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে- তখনই এক অন্যরকম ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হচ্ছে মন-প্রাণ-হৃদয়। নতুন আসায় প্রথমদিন আমাদের সৌজন্যে বাংলাদেশের অফিসারেরা আমাদেরকে লাঞ্চ করিয়েছিল ৩১শে আগস্ট, ২০১৬ সালে।

আমাদেরকে এক অনন্য সম্মানে ভূষিত করলেন সেক্টর নর্থের কমান্ডার ডিআইজি আব্দুল্লাহেল বাকি স্যার। আমাদের সাথে পরিচিত হলেন, আর তাতেই ক্ষ্যান্ত না হয়ে আমাদের সকলকে তার অনুভূতি ও পুলিশে আসার কাহিনী বলার জন্য সুযোগ করে দিলেন। আর আমরাও এমন কল্পনাতীত সংবর্ধনা পাওয়ার পর আমাদের জীবন বৃত্তান্ত সবিস্তারে বর্ণনা করলাম।

স্যার আমাদের সকলের কথা মনোযোগের সাথে ধৈর্য ধরে শুনলেন, মজা করলেন এবং আমাদেরকে উৎসাহিত করলেন। সে এক অভাবনীয় মুহুর্ত। দেশ থেকে এতোদূরে এসেও মন খারাপ করার কি আর ফুরসৎ মেলে এমন আত্মার আত্মীয়দের কাছে পেলে ?

গত বছরের ২৫ আগস্টে বিভিন্ন দেশের শান্তিরক্ষী পুলিশসহ আমরা ১৮ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী পুলিশ ‘আল ফেশার এয়ারপোর্ট’ নেমেই রোটেশন অফিসারের পক্ষে এসপি মহিউল স্যার আমাদেরকে স্বাগত জানালেন। ট্রেনিং ক্লাসে গিয়েও স্যার ট্রেনিং কার্যক্রম পরিচালনা করলেন। এরপর ড্রাইভিং পরীক্ষায় ইন্সপেক্টর আইনুল স্যারের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম আমরা।

সময়ে-অসময়ে কাছে পেলাম বড়ভাই-বন্ধুরূপী মশিউরকে। সে আমাকে বুদ্ধি দিয়ে, সাহস দিয়ে নির্ভাবনায় রেখে চলেছে প্রতিনিয়ত। যে অফিসেই যাই, সেখানে আমাদের অফিসারেরা আছেই।

ফর্মে নামের বানানে ভুল, সমস্যা নেই। পাশের রুমেই দেশের নেভাল অফিসার লে. কমোডর চিশতি স্যার আছে না? সাহস করে দুরু দুরু বক্ষে এগিয়ে গেলাম তার কাছে। তিনি নিজে আমাকে আরেকটা ফর্ম টাইপ করে দিলেন।

এতোকিছুর পরেও আমরা দেশের জন্য ভারাক্রান্ত থাকি, থাকি পরিবার-সন্তান, বাবা-মায়ের জন্য, বন্ধু-আত্মীয়দের জন্য। আর তাইতো দিন-রাতের ভাগে যখনই সময় পাই, মোবাইল আর কানের দোস্তি যায় বেড়ে। নেটওয়ার্ক দুশমনিতে বিরক্ত হই, কিন্তু হাল ছাড়ি না আপনজনের একটু কথা শুনতে। চেষ্টা চলতেই থাকে রবার্ট ব্রুসের মতো।

পরিবার-সন্তান, বাবা-মা, আত্মীয়-বন্ধুদের মুখের একটু কথাও আট হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এসে মন-প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। সময়ের হেরফেরে মাঝে মধ্যেই টালমাটাল হই। সকল বাঁধা পেরিয়ে প্রিয়জনের একটু ভালোবাসার কথা আমাদের দূরে থাকার কষ্ট, শারীরিক কষ্ট ভুলিয়ে দেয়।

চলে যাচ্ছে এভাবেই, আশা করি এভাবেই বাকি দিনগুলিও চলে যাবে। সকল কষ্টের তীব্রতা আমাদের দায়িত্বের কাছে যেন বাঁধা না হয়, সে দোয়া আর শুভ কামনা কাম্য সকলের কাছে। আমাদের সফলতাই দেশের সফলতা ও গৌরব, পরিবার-পরিজনেরও গৌরব। শান্তিতে আমরা, এই অশান্ত আমরা।

লেখক: সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী হিসেবে কর্মরত

ইমেইল: ash.pol2000@gmail.com