মিশন দারফুর: সুদানিজরা যে কারণে গোসল করে না!

আমাদের পেট্রোল টিমের গাড়ি দেখলেই সুদানিজ বাচ্চারা বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে বা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে দেয়।

মোহাম্মদ আশিকুর রহমান, সুদানের দারফুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 April 2017, 09:17 AM
Updated : 29 April 2017, 09:17 AM

এই বুড়ো আঙুল দেখানোটা আমাদের দেশে রাগ দেখাতে ব্যবহার হয়। আমরা বলি ‘কচু’, কিন্তু তারা এ কারণে দেখায় না। তারা থাম্পস আপ করে আমাদের স্বাগত জানায়। আমরাও পাল্টা তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে থাম্পস আপ করে জবাব দেই। যদিও তারা মুখে এর সাথে একটা শব্দ উচ্চারণ করে- ‘সাদিক’ (বন্ধু)।

কাঁচবদ্ধ গাড়ির ভেতরে থাকায় তাদের কথা কানে এলেও আমরা ‘সাদিক’ বলি না। এরা আমাদের ডিউটি রুটিন খুব ফলো করে। যতবারই আমরা ক্যাম্পের বাইরে গিয়েছি, ততবারই তাদের হয় বাড়ির পাশে রাস্তায় কিংবা বাড়ির সামনে পেয়েছি। মাঝেমধ্যে আমাদের কেউ কেউ এদের পাউরুটি, বিস্কুট, চকোলেট, দুধ, দই, জুস, বাদাম বা পানি দেয়। একটু খাবার আর পানিয় পাবার আশায় এরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।

এই চরম অভাবী বাচ্চাদের মধ্যেও একটা শৃংখলা দেখেছি, সততা দেখেছি। কারো হাতে খাবারের প্যাকেট দিলে পাশের জন বা অন্যরা কাড়াকাড়ি বা হাতাহাতি করে না। আবার যদি একজনের হাতে খাবার বা প্যাকেট দিয়ে বলা হয়- বাকি সঙ্গীদের সাথে শেয়ার করার জন্য, এরা ঠিক তা-ই করে।

বৃষ্টি ও নদী-নালাহীন এই মরু পাহাড়ময় দেশে এরা একটু খাবার পানির জন্য দূর-দুরান্তে ছুটে বেড়ায়। ইন্টারন্যাশনাল ডিসট্রেসড পিউপল (আইপিডি) ক্যাম্প ও গ্রামগুলোতে একটি করে পানির পাম্প বা পানির ট্যাংক রয়েছে খাবার রান্না ও পানি পান করার জন্য। আবার অনেক ক্যাম্প বা গ্রামে তাও নেই। তারা অন্য গ্রাম বা ক্যাম্প থেকে পানি সংগ্রহ করে। এসব পাম্প আর ট্যাংক ওয়ার্ল্ড ভিশনসহ বিভিন্ন এনজিও সংস্থা তৈরি করে দিয়েছে।

সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কাছে খাবার বা পানিয় সহায়তা আসে বছরে এক কি দু’বার। তাও সব ক্যাম্প আর গ্রাম এমন সৌভাগ্যের দেখা পায় না। এরা গোসল করে না পানির অভাবে। যেখানে খাবার পানির তিব্র সংকট, সেখানে গোসলের চিন্তা অলীক! গোসল করার চিন্তা মাথায় আনা এদের জন্য আমাদের দেশের বস্তির ছেলের সুইমিংপুলে গোসলের চেয়েও বেশি অবাস্তব বাসনা।

সেদিন পেট্রোলে গিয়েছিলাম দুটো আইডিপি ক্যাম্প দেখার জন্য। প্রথমটায় গিয়ে দেখি বেশকিছু সুদানিজ বয়স্ক লোক গাছের নিচে পাটি বিছিয়ে বসে আছেন। সবাই তাদের ট্র্যাডিশনাল জোব্বা পরা আর দু’একজনের মাথায় টুপি। তাদের সঙ্গে সালাম ও কুশলাদি জিজ্ঞাসায় জানতে পারি- পাশের বাড়ির এক মহিলা সন্তানসম্ভবা। আল্লাহ্‌র রহমত থাকলে কিছুক্ষণ পরই নতুন এক সুদানিজ পাবেন তারা। একারণেই তাদের অধীর অপেক্ষা।

মিষ্টি খাওয়ার জন্য আমাদের কিছুক্ষণ থাকতে অনুরোধ করলেন আইডিপি প্রধান শেখ। আমাদের ডিউটি আছে একথা বলে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আরেকটা আইডিপি ক্যাম্পে গেলাম। সেখানে ৫০/৬০ জন বাচ্চা আমাদের গাড়ির কাছে ভিড় করে খাবার ও পানীয় চাইলো। আমাদের নিরাপত্তায় থাকা তাঞ্জানিয়ান পিকেএফ তাদের সাধ্যমতো খাবার ও পানীয় দিলো।

আর আমরা পুলিশরা আমাদের কাজ করলাম। একটা সুদানিজ বাচ্চার দিকে আমার খেয়াল গেলো। সে অন্য বাচ্চাদের মতো ছুটাছুটি করছে না। বড়দের মতো দুই হাত পেছনে ধরে চারদিক গম্ভীরভাবে নজর বোলাচ্ছে। শিশু হলেও তার আচরণ প্রাপ্ত বয়স্কদের মতো, চেহারায় মুরুব্বিয়ানা। বেশ কিছু সময় তাকে খেয়াল করে অবশেষে সে মুরুব্বির ছবি উঠালাম।

লেখক: সদস্য, বাংলাদেশ পুলিশ, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী হিসেবে সুদানে কর্মরত

ই-মেইল:  ash.pol2000@gmail.com

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!