মাউন্ট কিনেয়িতি থেকে মাউন্ট এভারেস্ট (পর্ব-পাঁচ)

নেপাল ভ্রমণের শেষ দিনটা এসে গেলো। ২০ নভেম্বর, ২০১৬ সাল। সকাল ৯টায় একেবারে ব্যাগপত্রসহ নীচে নামলাম।

আনোয়ার সাত্তার, দক্ষিণ সুদান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 March 2017, 05:21 AM
Updated : 5 March 2017, 05:41 AM

সেই রাজসিক ব্যুফে ব্রেকফাস্ট। ট্যাক্সি নিয়ে সুমন থাপা হাজির। রিসেপশনে কিরণ পাউডেল উপস্থিত। বিদায় জানাল আন্তরিকভাবে।

আমাদের প্রথম গন্তব্য নেপাল রয়্যাল প্যালেস। নেপাল থেকে রাজতন্ত্র বিদায় নেওয়ার পর এটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। সকাল সাড়ে ১০টায় রয়্যাল প্যালেসে পৌঁছালাম। কিন্তু দর্শনার্থীদের জন্য দুপুর ১২টায় এটি খোলা হবে।

ঢাকার ফ্লাইট বিকেল ৫টায়, ৩টার মধ্যে এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে হবে। ভক্তপুর যাওয়া- আসায় দুই ঘণ্টা লাগবে। রয়্যাল প্যালেস খোলার অপেক্ষা আর করলাম না। বাইরের লন থেকে কিছু ছবি তুলে ভক্তপুরের উদ্দেশ্য রওনা দিলাম।

প্রাচীন ভক্তপুর দরবার স্কোয়ার ও রাজপ্রাসাদ

এটিও ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্বের অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান। ভক্তপুর মূল কাঠমান্ডু শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। ভাক্তপুরের প্রাচীন নাম ‘খোপা’, এটি ‘ভাদগাঁও’ নামেও পরিচত। ভক্তপুর প্রাচীনকালে ভারত ও তিব্বতের মধ্যে বাণিজ্য রুট হিসেবে ব্যবহৃত হতো এবং কাফেলা যাত্রাপথে এর অবস্থান এই শহরকে সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যশালী করেছে। এর প্রাচীন ঐতিহাসিক মিনার, নিপুণ কারুকাজের প্রাসাদ, মন্দির ও স্থাপত্য পর্যটকদের মোহাবিষ্ট করে তোলে। কাঠমান্ডুতে এই স্থানটিই পর্যটকেরা সবচেয়ে বেশি পরিদর্শন করেন।

ভক্তপুরের প্রাচীন প্রাসাদ

৫৫ জানালার প্রাসাদ

এটি মাল্লা রাজবংশের রাজা যক্ষ মাল্লা ১৪২৮ সালে নির্মাণ করেন। ১৭ শতকে রাজা ভূপতিন্দ্র মাল্লা এর সংস্কার করেন। ইটের সুনিপুণ গাঁথুনি, অনুপম ভাষ্কর্য নকশা, ৫৫ জানালার ব্যালকনি এবং কাঠ খোঁদাইয়ের  প্রাচীনতম এক অনন্য মাস্টার পিস হিসেবে এটিকে মনে করা হয়।

৫৫ জানালার প্রাসাদ

নিয়াটাপোলা টেম্পল

‘নিয়াটাপোলা’ নেওয়ারি শব্দ, এর মানে হচ্ছে পাঁচতলা বিশিষ্ট। এটি পাঁচতলা বিশিষ্ট মন্দির, পাঁচটি মূল ধর্মীয় উপাদানের প্রতীক। এই ধরনের সুনিপুণ স্থাপত্য এবং শৈল্পিক সৌন্দর্যে নির্মিত এটিই এ পর্যন্ত নেপালের সর্বোচ্চ এবং সবচেয়ে বড় প্যাগোডা।

নিয়াটাপোলা টেম্পল

দ্যা গোল্ডেন গেইট

এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর এবং সমৃদ্ধির নমুনা বলা হয়ে থাকে। রাজা রঞ্জিত মাল্লা এটি নির্মাণ করেন। দরজাটিতে হিন্দু দেবী কালী এবং গরুড় প্রতিকৃতি চিত্রিত আছে, আরও চিত্রিত আছে দুই স্বর্গীয় দেবীসহ অন্যান্য হিন্দু পৌরাণিক প্রাণি। বিখ্যাত ইংরেজ ইতিহাসবিদ এবং শিল্প সমালোচক পার্সি ব্রাউন এই গোল্ডেন গেইট বা স্বর্ণ দ্বার সম্বন্ধে বলেন, “সমগ্র রাজ্যে সবচেয়ে সুন্দর অংশ।” এটি একটি রত্নের মত স্থাপিত, আশেপাশে চমৎকার ও চোখ ধাঁধানো উপাদান।

 

স্বর্ণ দ্বার

রাজা ভূপতিন্দ্র মাল্লার মূর্তি

অনুপম শৈল্পিক এবং অনন্যসাধারণ ভাষ্কর্যের উদাহরণ এটি।

রাজা ভূপতিন্দ্র মাল্লার মূর্তি

রাজা ভূপতিন্দ্র মাল্লার মূর্তি

তুসাহিতি

এটি ডিম্বাকৃতির, সামান্য খাঁজ বিশিষ্ট কূপ এবং ফোয়ারা। রাজা সিদ্ধিনর সীমা মাল্লা ১৬৪৭ সালে নির্মাণ করেন, সম্ভবত বিভিন্ন ধ‌র্মীয় অনুষ্ঠানে প্রক্ষালণ সম্পাদন করতে। এটি গিলটি করা ব্রোঞ্জ দিয়ে সজ্জিত ফোয়ারা, গরুড় মূ‌‌র্তির উপর লক্ষ্মী-নারায়ণের একটি চিত্র,  যার প্রতিটি পাথর স্বর্ণমণ্ডিত ধাতুর দ্বারা উত্কীর্ণ এবং একটি বড় সর্পমূ‌‌র্তি রয়েছে কিনারা ঘিরে।

তুসাহিতি

তুসাহিতি

 

ভৈরব নাথ মন্দির

এই মন্দিরটি রাজা জগত জ্যোতি মাল্লা নির্মাণ করেন এবং শিল্প অনুরাগী রাজা ভূপতিন্দ্র মাল্লা এর সংস্কার করেন ১৭ শতাব্দিতে।

ভৈরব নাথ মন্দির

দত্তত্রেয়া মন্দির

রাজা যক্ষ মাল্লা ১৪২৮-১৪৮২ সালে এটি নির্মাণ করেন। ১৪৮৬ সনে এটি জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ১৫২৮ সালে রাজা বিশ্ব মাল্লা এটির সংস্কার করেন। এটি নিয়ে মানুষের বিশ্বাস, বড় একটি গাছের বড় একটি টুকরা থেকে এই মন্দির তৈরি করা হয়েছিল। সুনিপুণ কাঠ খোঁদাই  ও অনুপম ভাষ্কর্যের অনন্য নিদর্শন এই মন্দির।

দত্তত্রেয়া মন্দির

উপরে যেসব প্রাচীন স্থাপনাগুলোর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে ,এমনই অসংখ্য প্রাচীন স্থাপনা সমগ্র ভক্তপুর জুড়ে রয়েছে। এটি তাই শুধু প্রাচীন শহর-ই নয়, অনন্যসাধারণ সুনিপুণ স্থাপত্যের ও কারুকার্যময় কাঠ খোঁদাইয়ের এক শৈল্পিক শহরও বটে। কয়েক ঘণ্টায় এই শহরকে আবিষ্কার করা সম্ভব নয়, কয়েকদিন এমনকি কয়েক সপ্তাহ প্রয়োজন এই শৈল্পিক শহরকে পুরোপুরি আবিষ্কার করতে হলে।

বিদায়ের সুর

ভক্তপুরেই প্রাচীন একটি দালানে অবস্থিত রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। দুপুর ২টায় রওনা দিয়ে বেলা ৩টায় ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম। বিকেল ৫টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে আমাদের বিমান ছেড়ে দিল। প্রাচীন শহরগুলো পরিদর্শনের সময় এক ধরনের নস্টালজিক অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করে ছিল। দেশে ফেরার পরও বেশ কিছুদিন আমি সেই অনুভূতিতে আচ্ছন্ন ছিলাম।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash.bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!