মাউন্ট কিনেয়িতি থেকে মাউন্ট এভারেস্ট (পর্ব-চার)

বিকালের ফ্লাইটে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা ২০ নভেম্বর। ১৯ তারিখ পুরোদিন আর ২০ তারিখ দুপুর পর্যন্ত কাঠমান্ডু আর এর আশপাশের জায়গাগুলো ঘোরা যাবে। কিরণকে জানালাম, সে নাগরকোটের হোটেল রিজার্ভেশন বাতিল করল।

আনোয়ার সাত্তার, দক্ষিণ সুদান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 March 2017, 08:11 AM
Updated : 4 March 2017, 10:40 AM

সন্ধ্যায় বের হলাম কেনাকাটার জন্য। থামেল জুড়েই রাস্তার দু’পাশে সারি সারি দোকান। আমি একটি খাপসহ নেপালের বিখ্যাত ‘ভোজালি’ কিনলাম। খুবই সুন্দর দেখতে। ইন্ডিয়ান এক দোকান থেকে জয়পুরি কাজ করা কাপড়ের কিছু হ্যান্ডব্যাগ কেনা হল। আগেই ঠিক করলাম, আমরা এমন কিছু কিনব না যা দেশে পাওয়া যায়। ‘ইয়াক’ (তিব্বতের লোমশ গরু জাতীয় প্রাণী)-এর লোমের তৈরি কিছু শীতের চাদর কিনলাম।

সবকিছুই বেশ দামাদামি করে কিনতে হল। আর এ কাজে নীপা বেশ পারদর্শী। আর একটা জিনিস বেশ কাজে লাগল। নীপা বেশ ভাল হিন্দি বলতে পারে। ফলে আমাদের ইন্ডিয়ান ট্যুরিস্ট মনে করেছিল সবাই এবং ইন্ডিয়ানদের মনে হল নেপালিরা একটু সমীহই করে। এমনিতেই নেপালিরা ভদ্র এবং বিনয়ী জাতি। রাতের খাবার সারা হল নেপালি থালি দিয়ে।

কাঠমান্ডুর আশেপাশে

১৯ নভেম্বর, ২০১৬। এদিন সকালে তাড়া ছিল না। তাই ধীরে-সুস্থে ঘুম থেকে উঠে নীচে রেস্টুরেন্টে গেলাম ৮টায়। সেই রাজসিক ব্যুফে ব্রেকফাস্ট। সকাল সাড়ে ৯টায় ট্যাক্সি নিয়ে আসলো সুমন থাপা, যে আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করেছিল। ১৯ এবং ২০ নভেম্বর যত ঘোরাঘুরি এবং ২০ নভেম্বর এয়ারপোর্টে নামিয়ে দেওয়া পর্যন্ত এই সুমন থাপাই ছিল আমাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী।

 প্রথমে গেলাম যথারীতি উঁচু পাহাড়ের উপর অবস্থিত ‘বুদ্ধনাথ মন্দির’। এটি একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির। ছোট্ট একটি জলাধারে একটি স্বর্ণালী বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে। সেখানে সবাই কয়েন ছুঁড়ে মারছিল মনোষ্কামনা পূরণের জন্য। সবার দেখাদেখি কয়েন কিনে ছুঁড়ে মারলাম। এই মন্দিরে প্রচুর বানরও ছিল।

এরপর যাওয়া হল ‘স্বয়ম্ভুনাথ’ বৌদ্ধ আশ্রমে। এটি একটি বিখ্যাত বিশালায়তন বৌদ্ধ আশ্রম। জাপান, চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়াসহ পূর্ব-এশিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রচুর দর্শনার্থী দেখলাম।

পাটান সিটির প্রাচীন মন্দির

 

পাটান সিটির প্রাচীন মন্দির ও প্রাসাদ

এরপর গেলাম বিখ্যাত ঐতিহাসিক এবং প্রাচীন ‘পাটান সিটি’ দেখতে। এটি ইউনেস্কো  স্বীকৃত বিশ্বের অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান। নেপালে আসার আগে এই পাটান সিটির কথা শুনেছিলাম, কিছু ছবিও দেখেছিলাম। ২০১৫ সালের এপ্রিলের প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে অনেক স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে। তারপরও হাজার বছরের প্রাচীন পাটান সিটি দেখে আমি বিস্ময়াভিভূত ! মন্ত্রমুগ্ধ! কিংবা তার চেয়েও বেশি কিছু। এই অনুভূতি ভাষায় যথাযথভাবে ব্যক্ত করার নয়।

প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক স্থানের প্রতি আমার প্রচণ্ড আকর্ষণ কাজ করে। এইসব স্থান আমার মধ্যে এক ধরনের নস্টালজিক অনুভূতি তৈরি করে। কল্পনায় দেখার চেষ্টা করি কয়েক শতাব্দি, এমনকি সহস্র বছর পূর্বের এসব জায়গায় প্রাচীন মনুষের বিচরণ, কেমন ছিল তাদের জীবনাচরণ।

পাটান সিটির একটি বুকলেটে পাটান সিটিকে বলা হয়েছে ‘দ্যা সিটি অভ ফাইন আর্টস’। পাটান সিটির অন্য নাম ‘ললিতপুর’। এই শহরটির চার কোণায় চারটি বড় স্টুপা ( গম্বুজ আকৃতির কাঠামো যা বৌদ্ধ মঠ হিসেবে তৈরি হয়েছে) রয়েছে। এই মনুমেন্টগুলো আড়াইশ’ খৃস্ট পূর্বাব্দে ভারতীয় সম্রাট অশোক তার তীর্থযাত্রা সফরে যখন নেপাল উপত্যাকায় এসেছিলেন, তখন নির্মাণ করেছিলেন বলে বিশ্বাস করেন ঐতিহাসিকেরা। এতটাই প্রাচীন!

 রাজা ভীর দেবা ২৯৯ খ্রিস্টাব্দে ললিতপুর বা পাটান সিটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই শহরে বিভিন্ন আকৃতির এবং আকারের ১ হাজার ২০০ বৌদ্ধ মনুমেন্ট রয়েছে। বিভিন্ন শতাব্দিতে বিভিন্ন রাজারা এসব তৈরি করেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে তিন তলা বিশিষ্ট হিরণ্য বর্ণ বৌদ্ধ মহাবিহার, সহজ বাংলায় বললে বৌদ্ধ স্বর্ণ মন্দির। এটি ১২ শতাব্দিতে রাজা ভাষ্কর ভার্মা নির্মাণ করেছিলেন। এমনি অনেক সুপ্রাচীন মন্দিরে ঐশ্বর্যশালী হয়ে আছে এই প্রাচীন শহর। এত বছর পরও এই শহর এখনও দাঁড়িয়ে আছে অসাধারণ, চমৎকার, মনোমুগ্ধকর, জাঁকজমকপূর্ণ ও সুনিপুণ স্থাপত্যশৈলী নিয়ে।

পাটান সিটির প্রাচীন মন্দির ও প্রাসাদ

পাটান সিটির প্রাচীন মন্দির ও প্রাসাদ

 

কাঠমান্ডু দরবার স্কোয়ার

এটিও কাঠমান্ডুর প্রাচীন তিনটি রাজকীয় দরবার ও প্রাসাদের একটি। এটির অন্য নাম বসন্তপুর দরবার ক্ষেত্র। এটিও ইউনেস্কো  স্বীকৃত বিশ্বের অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান। এখানে মাল্লা ও শাহ বংশীয় রাজাদের তৈরি করা বিভিন্ন নয়নাভিরাম প্রাসাদ ও মন্দির রয়েছে। এখানেও ২০১৫ সালের এপ্রিলের প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে অনেক স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে।

এই স্থানটির গোড়াপত্তন হয় তৃতীয় শতকে। কাঠমান্ডুর প্রথম স্বাধীন রাজা রত্ন মাল্লা, যিনি মাল্লা রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা, তিনি ১৪৮৪ সন থেকে ১৫২০ সন পর্যন্ত রাজা ছিলেন। তিনি এই স্থানটিকে রাজ দরবার এবং রাজপ্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন। পরে শাহ বংশীয় রাজারা ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত তাদের রাজ দরবার এবং রাজপ্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার করেন।

পাটান সিটির প্রাচীন মন্দির ও প্রাসাদ

 

ডাল তরকারি আর পালক পনির

দরবার স্কোয়ার দর্শনের পর হোটেলে ফিরতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। হোটেলের রেস্টুরেন্টেই ডিনার সারা হল। বাচ্চারা চিকেন ফ্রাইড রাইস নিল। আমি আর নীপা নিলাম রুটি আর ইন্ডিয়ান মেন্যু থেকে ডাল তড়কা (ঘন ডালের তরকারি) আর পালক পনির (পনির দিয়ে পালং শাকের তরকারি)। চমৎকার স্বাদ! এই স্বাদ ভোলার মত নয়।

ছবি ৭-ডাল তরকারি আর পালক পনির

চলবে...

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash.bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!