বাঁশিতে রাগ আহির ভৈরব বাজিয়ে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের চতুর্থ দিনের সমাপ্তি টানলেন পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। তার আগেই মঞ্চে ঢলে পড়েন চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী।
Published : 01 Dec 2014, 01:14 PM
অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকেই চলে গেলেন কাইয়ুম চৌধুরী
ঢাকার শ্রোতাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ শিল্পীরা
ঘরির কাঁটায় ৩টা ৫০ মিনিট। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের চতুর্থ দিনের শেষ পরিবেশনায় মঞ্চে বসেছেন পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া।
খানিক প্রস্তুতি শেষ করেই পণ্ডিত চৌরাসিয়া জানালেন - মত্ত তালে আলাপ, জোড় সহকারে আহির ভৈরব শোনাবেন। এ খবর কানে পৌঁছাতেই করতালিতে শিল্পীকে অভিবাদন জানালেন শ্রোতারা। ভোরের প্রাথর্ণার রাগ আহির ভৈরবেই নতুন এক ভোরকে আবাহন জানানো হবে।
বাঁশি-পণ্ডিত মুদারা থেকে তারা পর্যন্ত ওঠানামা করে আলাপ শেষ করতে সময় নিলেন ৩০ মিনিট। মুগ্ধ শ্রোতাদের মন হিমেল ভোরে তবু যেন আরও চাই, আরও চাই বলছে চুপিসারে। জোড় শেষ করতে সময় নিলেন আরও প্রায় ৩০ মিনিট। এরপরই শ্রোতাদের কাছ থেকে জানতে চাইলেন কী শুনতে চান তারা - ‘কীর্তন’ নাকি ‘হরেক রকম’? এক বছর পরে আবার পেয়েছি তাই সবটুকুই চাই - এমন ভাব নিয়ে শ্রোতাদের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিচিৎকার - দুটোই শুনবেন তারা। পণ্ডিত চৌরাসিয়া বললেন, তথাস্তু।
পণ্ডিত চৌরাসিয়ার সঙ্গে মঞ্চে উঠেছিলেন তবলাশিল্পী পণ্ডিত যোগেশ সামসি, পাখওয়াজশিল্পী পণ্ডিত ভাওয়ানি শঙ্কর ও সহযোগী বাঁশিশিল্পী বিবেক সোনার। রাগ পরিবেশনার সময় আলাদা করে প্রত্যেককেই নিজস্বতা প্রদর্শনের সুযোগ দিলেন পণ্ডিত চৌরাসিয়া।এদিন শিল্পী হিসেবে আরও ছিলেন স্বরূপ হোসেন, আমান আলী খান এবং আয়ান আলী খান, পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার, কৌশিকী চক্রবর্তী।
তবলা বাজিয়ে স্বরূপ হোসেন বাংলাদেশের আরেক শিল্পী অমিত চৌধুরীর পরপরই মঞ্চে উঠেন। দিনের দ্বিতীয় পরিবেশনায় ওস্তাদ রবিউল হোসেন পুত্র স্বরূপ তবলায় কাঁপন তুলে যেন বলছিলেন লহরা, রেলা তার কাছে নস্যি। তিনি তিনতাল পরিবেশন করেন, তাকে হারমোনিয়াম সঙ্গত করেন আলমগীর পারভেজ।
চতুর্থ দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয় ভরতনাট্যম শিল্পী অমিত চৌধুরীর নৃত্যের তালে তালে। আধিতালে রাগ নাট্টাই-এ নটরাজ বন্দনা ‘নটেশা কৌথুয়াম’ দিয়ে শুরু তার পরিবেশনা। এরপর বসন্ত রাগে নাট্যাংশ ‘নটনম আডিনার’, সবশেষে পূরবী রাগের তিল্লানা পরিবেশন করেন রূপক তালে।
অমিতকে বেহালা সঙ্গত করেন সত্য বিশাল অভিরেড্ডি, মৃদঙ্গ সঙ্গত করেন সুরিয়া নারায়নান গোপাল কৃষ্ণাণ, নাট্যভঙ্গমে ছিলেন রাজদীপ ব্যানার্জি এবং কণ্ঠসংগীতে ছিলেন সুকুমার গোবিন্দন কুট্টি।
সেনীয়া বাঙ্গাস ঘরানার সরোদিয়া ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের দুই ছেলে আমান ও আয়ান সংগীতে ষষ্ঠ প্রজন্ম। বয়সে তরুণ দুই ভাই ইতোমধ্যেই প্রতিভার স্বাক্ষর তৈরি করেছেন বাজিয়ে হিসেবে। আজ তারই স্বাক্ষী হলেন ঢাকার শ্রোতা।
আমান-আয়ানের সঙ্গে তবলায় ছিলেন সত্যজিৎ তালওয়ালকার ও পণ্ডিত ফতেহ সিং গাঙ্গানি। বয়সে দুই প্রবীণ তালবাদ্যকরের সঙ্গে এদিন দুই ভাইয়ের দারুণ এক খেলা উপভোগ করেছেন শ্রোতারা।
পণ্ডিত উলহাস কাসলকরের ছেলে সামিহান কাসলকার মঞ্চে ওঠেন এরপরে। তিনি সদ্যপ্রয়াত চিত্রশিল্পী কাইয়ূম চৌধুরীকে উৎসর্গ করে রাগ মালকোষ পরিবেশন করেন। বাবার মতোই তিনি বিলম্বিত, দ্রুত খেয়াল ও তারানার মাধ্যমে তার পরিবেশন শেষ করেন। পরবর্তীতে সোহিনি রাগে খেয়াল পরিবেশন করেন। তাকে তবলা সঙ্গত করেন সঞ্জয় অধিকারী এবং হারমোনিয়ামে গৌরব চট্টোপাধ্যায়।
ঢাকার শ্রোতাকে স্বাক্ষী করে দক্ষিণ-পশ্চিম সম্মিলনের এক অনবদ্য পরিবেশনা উপহার দিলেন পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার এবং গনেশ রাজাগোপালান। তাদের পশ্চিম ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীত ধারার সরোদ ও দক্ষিণী অর্থাৎ কর্নাটকি ধারার বেহালার যুগলবন্দি ছিল এক কথায় অপূর্ব।
পরিবেশনা শুরু করার আগেই পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার যুগলবন্দি পরিবেশনার উদ্দেশ্য ও কার্যকরণ বর্ণনা করেন। তিনি আরও জানান, ‘পেন্টাটনিক স্কেলে’র রাগ হওয়ার কারণে রাগ হিন্দোলম ও মালকোষ সমপর্যায়ের বলা চলে।
একইসঙ্গে দক্ষিণী রাগ হিন্দোলম বাজান গণেশ রাজাগোপালান এবং মালকোষের পশ্চিমা ধাঁচ বাজান পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার। এই দুই রাগের সম্মিলন দেখান দুই শিল্পী।
পণ্ডিত হরিপ্রাসাদ চৌরাসিয়ার ঠিক আগে মঞ্চে ওঠেন কৌশিকী চক্রবর্তী। উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী হলেও বাংলা, হিন্দি, তামিলসহ নানা ভাষার সিনেমায় কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। বিলম্বিত, খেয়াল ও তারানা সহকারে রাগ বাগেশ্রী পরিবেশন করেন প্রথমে। এরপর পাহাড়ি রাগে দুটি ঠুমরী গেয়ে তার পরিবেশনা শেষ করেন। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত যোগেশ শামসি। কৌশিকীর রাগ পরিবেশনায় গত দুইবারের তুলনায় ভিন্নতা লক্ষ্য করা গেছে।
আয়ান আলী খান ও আমান আলী খানের সরোদ পরিবেশনা শেষে শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
এদিন উৎসব প্রাঙ্গন আর্মি স্টেডিয়ামে প্রায় ৫৫ হাজার লোক সমাগম হয় বলে জানায় আয়োজক বেঙ্গল ফাউন্ডেশন।
একক পরিবেশনায় অংশ নেবেন - বিশাল কৃষ্ণ (নাচ), কিশোরী আমোনকার (কণ্ঠ), মনিরুজ্জামান(বাঁশি), অশ্বিনী ভিডে দেশপান্ডে (কণ্ঠ), উদয় ভাওয়ালকার (কন্ঠ ধ্রুপদ), ওস্তাদ আমজাদ আলী খান (সরোদ)।