হাসিনা-খালেদাকে ব্যবসায়ীদের স্মারকলিপি

রাজনৈতিক সংঘাতে অর্থনীতির সঙ্কটের কথা তুলে ধরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Jan 2015, 11:58 AM
Updated : 1 Feb 2015, 09:16 AM

নির্দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি জোটের টানা অবরোধ এবং তাদের এই দাবি মানতে সরকারের অবস্থানের কারণে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি দিয়ে আসেন।

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত পোশাক শিল্পের তিন সংগঠন বিজেএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ নেতারা এই স্মারকলিপি দেওয়ার আগে কারওয়ান বাজারে বিজিএমইএ ভবনের সামনে মানববন্ধন করে।

ওই কর্মসূচিতে বক্তব্যে বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম বিরোধী জোটের অবরোধে নাশকতাকারীদের দ্রুত বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান।

গত ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপি জোটের লাগাতার অবরোধ চলছে। এতে প্রথম ১৬ দিনে সাড়ে ৩৬ হাজার টাকার বাণিজ্যিক ক্ষতি হয়েছে বলে সম্প্রতি একটি ব্যবসায়ী সংগঠন হিসাব দেখায়।

মানববন্ধনের পর দুপুরে আতিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ব্যবসায়ীদের ৯ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গুলশানে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে স্মারকলিপি নিয়ে যান।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল কাইয়ুম এবং খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ব্যবসায়ীদের স্মারকলিপি গ্রহণ করেন।

আতিকুল সেখানে সাংবাদিকদের বলেন, “বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে আমরা যেমন স্মারকলিপি দিয়েছি, তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও আমরা আজ তার দপ্তরে গিয়ে স্মারকলিপি দিয়ে এসেছি।

“এই স্মারকলিপিতে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও বলেছি, আমরা বাঁচতে চাই। একই দাবি বিএনপি চেয়ারপারসনকেও জানিয়েছি।”

অবরোধের কারণে বেনাপোলে পণ্যজোট

স্মারকলিপিতে রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে সাংঘর্ষিক অবস্থান থেকে সরে এসে ‘ব্যবসাবান্ধব রাজনীতি’ করতে রাজনীতিবিদদের প্রতি আহ্বান রাখা হয়।

বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “আমরা ৪৫টি সংগঠন, টেক্সটাইল ও এর বাইরে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে দেশের রাজনীতবিদদের প্রতি অর্থনীতি বাঁচানো জন্য আহ্বান জানাতে এসেছি। অবরোধে এই ২২ দিনে আমাদের অবস্থা চরমে পৌঁছেছে। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে আছে।

“সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে, বহির্বিশ্বে আমাদের দেশের বাজার নিয়ে যে ভাবমূর্তি রয়েছে, তা নষ্ট হচ্ছে। আর্থিকভাবে এই ক্ষতি নিরূপণ করা সম্ভব নয়।”

অবরোধ আহ্বানকারী বিএনপির প্রতি বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “আমরা রাজনীতিবিদদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি- আপনারা এমন রাজনীতি করুন, এমন কর্মসূচি দিন, যাতে দেশের অর্থনীতির ক্ষতি না হয়, যাতে মানুষও বেকার না হয় এবং আপনারাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সমাধান আসে।”

‘সামারি ট্রায়াল’ চান ব্যবসায়ীরা

আন্দোলনের মধ্যে যারা নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মারছে তাদের ‘সামারি ট্রায়াল’ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকরা।

দুই নেত্রীকে স্মারকলিপি দেওয়ার আগে সকালে কারওয়ান বাজারে মানববন্ধন রপ্তানিকারকদের পক্ষ থেকে বিজিএমইএ সভাপতি এই আহ্বান জানান।

বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএর ডাকে অনুষ্ঠিত এই কর্মসূচিতে পোশাক শিল্পে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন  সংগঠন, ট্রাক-কভার্ড ভ্যান মালিক ও চালক সমিতি, গাড়ি ব্যবসায়ীদের সমিতি, ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তাদের সমিতি, ইন্সুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন, পোশাক শিল্পের বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নসহ প্রায় ৫০টি সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশ নেয়।

বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল রাজনীতিবিদদের উদ্দেশে বলেন, “আপনারা রাজনীতি করেন, দেশ চালান আর আমরা অর্থনীতি সচল রাখার কাজ করি। মানুষ মেরে, অর্থনীতি ধ্বংস করে রাজনীতি করবেন না। অর্থনীতি সচল রেখে শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করুন।”

যারা শিল্প আর অর্থনীতি নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, বাংলাদেশকে অকার্য‌কর রাষ্ট্রে পরিণত করার ‘ষড়যন্ত্রে’ লিপ্ত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

“পাশাপাশি নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে। এটি এই মুহূর্তে থামানো না গেলে নিশ্চিতভাবেই একটি নেতিবাচক বার্তা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। আর তাই, যারা এই ধরনের ঘৃণ্য কাজের সঙ্গে জড়িত, আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সামারি ট্রায়াল করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিন।”

রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েছে দাবি করে আতিকুল আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে শ্রীলঙ্কার মতো করুণ পরিণতি ভোগ করতে হবে। শিল্প চলে যাবে অন্য দেশে।

টেক্সটাইল শিল্প মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি তপন চৌধুরী বলেন, “আমরা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। অনেকে আগুনে পুড়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। আবার অনেকে মারা গেছেন। এটা কোনো রাজনীতি হতে পারে না।

“রাজনীতিবিদ যারা দেশ চালান তাদেরকে বলব, দয়া করে এমন কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত হবেন না, যাতে দেশ-জাতি, অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। দয়া করে আমাদের বাঁচতে দিন।”

নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এস এম আসলাম সানি বলেন, “অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছি আমরা। ক্রেতারা বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছে না।

“এখন যা হচ্ছে তা রাজনীতির নামে অপরাজনীতি। আমরা তার প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা আশা করব, রাজনৈতিক দলগুলো দেশের স্বার্থে শান্তিপূর্ণ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে।”

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, “আমরা আশা করব, রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করবে। আমরা শান্তি চাই, কোনো সহিংসতা চাই না।”

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস বলেন, “আমরা এই সঙ্কটাপন্ন অবস্থার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই।”

এফবিসিসআইয়ের সহ-সভাপতি হেলালউদ্দিন আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের জন্য রাজনীতিকদের প্রতি আহ্বান জানান।

“হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি রাজনীতি থেকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। অর্থনীতির স্বার্থে আগামী ২০ বছর দেশে কোনো হরতাল-অবরোধ হবে না, সে আইন করুন।”

গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার সভাপতি হাবিবুল্লাহ ডন দ্রুত শান্তি ফেরানোর দাবি জানান।

গার্মেন্ট মালিক রাফেজ আলম বলেন, “সকল রাজনৈতিক দলকে সহিংস রাজনীতি থেকে সরে আসতে হবে। পেট্রোল বোমার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।”

সমস্যার সমাধানে সরকারকেও সহনশীল হতে অনুরোধ করেন তিনি।

তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী মাসুদ কাদের মনা বলেন, “হরতাল-অবরোধকে গণতান্ত্রিক অধিকার বলা হয়ে থাকে। কিন্তু যে হরতাল-অবরোধে মানুষ পুড়িয়ে মারা হয়, শিল্প কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়, অর্থনীতি ভেঙে পড়ে, শ্রমিক বেকার হয়, সেই গণতান্ত্রিক অধিকার আমরা চাই না।”

সকাল ১১টা থেকে শুরু হয়ে দুপুর ১২টার পরেও কিছুক্ষণ চলে এই মানববন্ধন। বিজিএমইএ কার্যালয়ের সামনের সড়কের দুই পাশে ‘আমরা মুক্তি চাই’ লেখা ব্যানার, প্ল্যাকার্ড হাতে দাড়িয়ে এ প্রতিবাদ জানান ব্যবসায়ীরা।