কেউ কুচবিহার মহারাজার কৃষিপ্রজার উত্তরাধিকারী, কেউ সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় জমি বদলে এপারে এসেছেন, কেউ জমির মালিক হয়েছেন স্ট্যাম্পে চুক্তি করে, আবার কেউ জমি কিনেছেন মুখবিশ্বাসে।
Published : 18 May 2015, 01:32 AM
এভাবেই ভোগ দখলে থাকা জমির মালিকানায় রয়েছেন ছিটমহলের অধিবাসীরা। ছিটমহল বিনিময় হলে এই জমির মালিকানা কীভাবে নির্ধারিত হবে-তা জানা নেই কারও।
তাই ছিটমহল বিনিময়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়ে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার হাতছানি থাকলেও ভূমির মালিকানা প্রশ্নে মুখ ভার অনেকের।
কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার ছোট গাড়লজোড়া-২ ছিটমহলের বাসিন্দা মো. আলীম উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১৯৪৭ সালে এখানে হিন্দুরা থাকত। ছিটমহলে থাকতে অসুবিধা হওয়ায় তারা এই জমি বিক্রি করে ভারতের মূল ভূখণ্ডে চলে যায়। চাষের জমি হিসাবে বাংলাদেশিরা এই সব জমি কিনে নেয়।
“আমরা সাতচল্লিশের আগে ‘গয়াবাড়িতে’ (ভারত) থাকতাম। সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলে ‘আজবাড়িতে’ (বাংলাদেশ) আসলাম।
“এক সময় বাংলাদেশিদের কাছ থেকে এই জমি কিনি। হিন্দুরা বিক্রির সময় তারা দলিল করে দিয়ে গেছে। কারণ দলিলতো ভারতে হয়। কিন্তু আমরা কিনার সময় দলিল করতে পারি নাই। কারণ বাংলাদেশিরা ভারত যেতে পারে না। অন্য কাগজও নাই। মুখবিশ্বাসে এই সব জমি কিনছি।”
এই ছিটমহলের অধিবাসী মো. মহিউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেকে বলেন, বাংলাদেশ হওয়ার পর আমাদের এই জমিই আবার আমাদের কিনতে হবে।”
লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট ইউনিয়নে অবস্থিত বনশপাচাই ভিতর কুঠির বাসিন্দা মো. নুরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের পূর্ব পুরুষরা কুচবিহার মহারাজার কৃষিপ্রজা ছিলেন। মহারাজাকে নিয়মিত খাজনা দিয়ে তারা জমি ভোগ- দখল করে আসছিলেন।
রাজার রাজত্ব বিলুপ্ত হওয়ার পর ভারত সরকারকে খাজনা দেন। তাও এক সময় বন্ধ হয়ে যায় সীমান্ত পারের জটিলতায়।
খাজনা দেওয়া বন্ধের ঘটনার বর্ণনা দেন নুরুলের ছেলে মো. হারুন অর রশীদ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিয়মিত জমির খাজনা না দিলে অধিকার থাকে না। তাই আমরা নিয়মিতই খাজনা দিতাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বড় চাচা জমির কাগজপত্র নিয়ে কুচবিহার যাচ্ছিলেন।
“সে সময় জমির দলিল দেখিয়েই এই ছিটমহলের মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করতো। মাঝে মাঝে হয়রানি করলেও এভাবে ভারতে অনেকেই যেত। কিন্তু চাচাকে বিএসএফ সীমান্ত থেকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়।
কাছাকাছি সময়ে খাজনা দিতে গিয়ে আরও অনেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর এই ছিটের বাসিন্দারা ভারতমুখী হওয়া বন্ধ করে দেয় বলে জানান হারুন।
“আমাদের অনেকেরই পুরান দিনের কাগজপত্র আছে। কিন্তু খাজনা বাকি। তবে অনেক জমিজমা এরপরও হাত বদল হয়েছে। সেগুলো হয়েছে স্ট্যাম্পে সই করে,” বলেন তিনি।
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার ৭ নম্বর উপেনচৌকি ছিটমহলের দুলাল হোসেনের বিষয়টি অন্যরকম।
তিন ছেলের বাবা দুলালের জন্ম মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে। জন্মের কিছুদিন পরই মারা যান বাবা।
ছিটের নানা ঝক্কি সামলাতে না পেরে বড় ভাই খলিলুর রহমান চলে গেছেন ভারতের কুচবিহারে। পরে দুই বোনেরও বিয়ে হয় ভারতে। আরেক ভাই জাহিদুল ইসলাম থাকেন পাশের অন্য একটি ভারতীয় ছিটমহলে।
ছিটমহলের অসুবিধা জানতে চাইলে দুলাল বলেন, “বাবা-দাদা থাকতে আমাদের ১০-১২ বিঘা সম্পত্তি ছিল। ছোটবেলায় বাবা মারা গেছে। বড় ভাই ভারতে থাকে। কে দেখবে সম্পত্তি? সব বেদখল হয়ে গেছে।”
কে দখল করেছে-অনেকবার প্রশ্ন করেও তার উত্তর পাওয়া যায়নি।
এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “ভাই এ সব বলে কী লাভ হবে? জমির তো কোনো কাগজপত্র নাই। বড় হওয়ার পর মুরুব্বিরা বলছে, ওই সব জমি আমাদের ছিল।”
এক প্রশ্নের জবাবে দুলাল বলেন, ছিটমহল বিনিময় হলে ভারতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন তিনি।
“কিন্তু জমির তো দলিল নাই-এটা মাঝে মাঝে ভাবায়, নতুন কোনো ঝামেলায় পড়ি কি না। আমাদের ছিটের কারোরই তেমন কোনো কাগজপত্র নাই।”
বর্তমান বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বিলের অপরপাশে নিজেদের আগের বাড়ি দেখিয়ে দেন মতিয়ার, সাতচল্লিশে সেখান থেকে চলে এসেছিল তাদের পরিবার।
বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় কমিটির দাসিয়ারছড়া শাখার সভাপতি মো. আলতাফ হোসেন গত সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার বাপ-দাদারা কুচবিহার মহারাজার প্রজা ছিলেন। এই ছিটের অধিকাংশ মানুষ এভাবেই জমির মালিক।”
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার দাসিয়ার ছড়ার এই বাসিন্দা বলেন, ২০০৫ সালের পর ভারতে আর তাদের কোনো জমির রেজিস্ট্রেশন হয়নি। এরপর যে সব জমি বিক্রি হয়েছে, সেগুলো বাংলাদেশি স্ট্যাম্পে স্থানীয় মুরুব্বিদের সাক্ষী রেখে হস্তান্তর হয়েছে।
পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের দহলা খাগড়াবাড়ি ছিটমহলের মো. আবদুর রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দা ১৯৪৭ সালে জমি বিনিময় করে এখানে এসেছেন। এই ছিটের সে সময়ের বাসিন্দা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ওই পারের জমি দিয়ে এখানে আসেন তারা। স্ট্যাম্প ও দলিল দুইভাবেই এই বদল হয়েছে।
ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ অংশের সভাপতি মইনুল হক বলেন, প্রতিটি ছিটমহলে তাদের কমিটির সদস্যরা স্থানীয় মুরুব্বিদের নিয়ে এ বিষয়ে কাজ করেছে। জমি হাতবদলের সময় যেন কিছু কাগজপত্র থাকে সে ব্যবস্থা তারা করেছে।
“এখানে তো একটি বিশেষ পরিস্থিতি ছিল। ছিটমহল বিনিময় হলে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে জমির মালিকানা নিয়মিতকরণ করে নেওয়া যাবে।”
ভূমির বন্দোবস্ত কীভাবে হবে জানতে চাইলে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক এ বি এম আজাদ
বলেন, “এটার উত্তর দেওয়ার মতো সময় এখনো হয়নি। আমাদের অফিসিয়াল নির্দেশনা এখনো কিছুই আসেনি। অতএব নির্দেশনা আসার আগ পর্যন্ত এই বিষয়ে মন্তব্য করার সুযোগ হয়নি। এটা সরকারের নিয়ম ও আইন-কানুনের সঙ্গে জড়িত।”
প্রচলিত আইনে কাগজপত্র না থাকলে তারতো মালিকানা থাকে না, তাহলে এখানে কী হবে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “প্রতিটা ক্ষেত্রতো একভাবে বিবেচনায় নেওয়া যাবে না। এটা একটা বিশেষ ক্ষেত্র, বিশেষ পরিস্থিতি। এখানে সরকারের পলিসি ঠিক করবে-বিষয়টা কীভাবে মোকাবেলা করা হবে।
“এখন পলিসি ছাড়া তো কথা বলা বা কোনো একটা প্রেডিকশন করা ঠিক হবে না।”
ভারতীয় সীমান্তে অবস্থিত বাংলাদেশি ছিটমহলের কেউ যদি বাংলাদেশে চলে আসে তাহলে তাকে ভূমি দেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে জেলা পর্যায়ে সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা আজাদ বলেন, “বিনিময় বিষয়টা কীভাবে করবে, সেটা সরকারের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নীতিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার।
“আমার এই সম্পর্কে কিছু বলার উপায় নেই। এলে কী হবে, না এলে কী হবে- পুরোটাই সরকারের পলিসির ব্যাপার। আমার এই সম্পর্কে কিছু বলার উপায় নেই।”