বাংলাদেশ সীমান্তে বসবাস হলেও নাগরিকত্বে ভারতীয় হওয়ায় কোনো দেশের নাগরিক সুবিধাই তারা কখনও পাননি। ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশের স্কুলে পড়ার সুযোগ পেলেও এ দেশে তাদের চাকরি হয়নি; এমনকি ছিটমহলের সীমানা পেরিয়ে বিয়েতেও তোলা হয়েছে আপত্তি।
‘খাঁচায় বন্দি পাখির’ এ দশা থেকে মুক্তির আভাসে ‘স্বাধীনতা আসছে’ বলে মন্তব্য করলেন ছিটমহলের বাসিন্দারা।
কুড়িগ্রাম সীমান্ত থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার ভেতরে ফুলবাড়ি থানায় ১ হাজার ৬৪৩ একর আয়তনের দাশিয়ার ছড়া বাংলাদেশের ভেতরে সর্ববৃহৎ ভারতীয় ছিটমহল। লোকসংখ্যা প্রায় ৯ হাজার। স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী, দাসিয়ার ছড়ার নতুন ঠিকানা হবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় কমিটির দাশিয়ারছড়া শাখার সভাপতি মো. আলতাফ হোসেন সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।
“একই আলো-বাতাসে মানুষ হলেও আমরা পাইনি স্বাধীনতার স্বাদ। খাঁচার পাখির বন্দিজীবনে আমরা ৬৮ বছর কাটিয়ে দিয়েছি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এক ভয়ানক জীবন যাপন করেছি।
“হাসপাতাল নাই, বিদ্যুৎ নাই, স্কুল-কলেজ নাই, বিচার-আচার নাই, কোনো দেশেই সহজে চলাচলের উপায় নাই। এক ভয়ানক জীবন।”
আলতাফ হোসেন জানান, তাদের মধ্যে যে শিক্ষিত মানুষ একেবারে নেই, তা নয়। অনেকেই বাংলাদেশি ঠিকানা ব্যবহার করে লেখাপড়া করেছেন। কিন্তু ছিটমহলের বাসিন্দা হওয়ায় চাকরির সুযোগ তাদের হয়নি।
“প্রথম পুলিশি তদন্তে পার পেয়ে আনতা আলীর ছেলে আব্দুল মান্নান সেনাবাহিনীতে ট্রেইনিংও শুরু করে। কিন্তু সীমান্তের মানুষ হওয়ার কথা উঠায় দ্বিতীয় তদন্তের জন্য পাঠানো হয়, তখন ছিটমহলের বাসিন্দা হিসেবে চিহ্নিত করা হলে তিনি চলে আসতে বাধ্য হন।”
অথচ এ দুই পরিবারের বাংলাদেশেও বাড়ি রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “যাদের বাংলাদেশে বাড়ি বা জমি আছে, তারাও যদি এভাবে বঞ্চিত হন, তাহলে কেবল ছিটমহলের ঠিকানাধারীদের কী হবে? তারা চাকরির আবেদন করতে সাহসই পায় না।”
একই জেলার ভুরুঙ্গামারী থানার বামনিকুটি ছিটমহলের বাসিন্দাদের মুখেও একই কথা শোনা যায়।
এ এলাকার বাসিন্দা শাহজাদী বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশ সরকার আমাদের পোলাপানরে পড়তে দেয়। কারণ পড়তে দিলে আমরা টাকা দিমু। কিন্তু চাকরি দেয় না। কারণ চাকরি দিলে তাদের টাকা দিতে হয়।”
শাহজাদীর দুই সন্তান বাংলাদেশের স্কুলে পড়াশোনা করছে।
তিনি বলেন, “আমার মেয়ে পিএসসিতে এ প্লাস পাইছে। কিন্তু সে উপবৃত্তি পায় না। অনেক খারাপ রেজাল্টেও অনেকে উপবৃত্তি পায়।”
কোনো কোনো স্কুল ছিটমহলের ছেলে-মেয়েদের ভর্তিতেও সমস্যা করে বলে জানান তিনি।
“এতদিন ভারতের নাগরিক ছিলাম। কিন্তু ভারত আমাদের ভালোভাবে নিত না। আবার বাংলাদেশে ঢুকতেও নানা বাধা।
“আইয়ুব খানের আমলে একবার আর এরশাদের আমলে একবার আমাকে বিডিআর ধরে নিয়ে গেল। গত কয়েক বছর তো ভারতে যাওয়ারও সাহস পাই নাই।”
একই ছিটমহলের বাসিন্দা মো. নুরুজ্জামান বলেন, “ছিটমহলের সমস্যাগুলো বলে বোঝানো যাবে না। পাগলার হাট থেকে বিদ্যুতের লাইন আসছে। সোজা লাইন গেলে আমাদের ছিটমহলের ভেতর দিয়েই যেত। কিন্তু ছিটমহলের পাশে এসে লাইনটা ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন চারদিকে বিদ্যুৎ আছে, কিন্তু আমাদের এখানে নাই।”
তিনি জানান, বাংলাদেশে বিয়ে করতে গিয়েও তাকে বিপত্তিতে পড়তে হয়েছে। কোনো পরিবার তাদের মেয়েকে ছিটের বাসিন্দার সঙ্গে বিয়ে দেয় না, কারণ কোনো ঝামেলা হলে মামলা করা যায় না।
ছিটমহল বিনিময় কমিটির আলতাফ হোসেনের সঙ্গে কথোপকথনে ছিটমহলের বিচার ব্যবস্থাসহ তাদের চাওয়া-পাওয়ার নানা প্রসঙ্গ উঠে আসে।
তিনি জানান, আগে দাশিয়ারছড়ার ‘মুরুব্বিরা’ বসে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন। এরপর ১৯৮০ সালে একটি আনুষ্ঠানিক প্রশাসন পায় ছিটমহলবাসী।
তখন একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। তাদের তত্ত্বাবধানে ইউনিয়ন পরিষদের মতো করে নির্বাচন চালু হয়, যাতে একজন চেয়ারম্যান ও নয়জন মেম্বার নির্বাচনের ব্যবস্থা তৈরি হয়। তারাই এ এলাকার প্রশাসন।
১৯৮০ সাল থেকে দুই মেয়াদে ১০ বছর মো. নুরুজ্জামান মিয়া এ এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন। পরে আসগর আলী ও নজরুল ইসলাম নামে দুই ব্যক্তি দুই মেয়াদে চেয়ারম্যান হন।
কিন্তু জনগণের দাবি-দাওয়া পূরণে চেয়ারম্যানদের ‘নিষ্ক্রিয়তার কারণে’ গত কয়েক বছর ধরে এ নির্বাচনও বন্ধ বলে জানান তিনি।
“আগে এখানে খুন করে ধরা পড়লেও সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল জরিমানা।”
আলতাফ হোসেন বলেন, “বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। ওই তিন চেয়ারম্যানের কেউ ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন না। তবে নুরুজ্জামান মিয়া এখন বাংলাদেশেই বসবাস করছেন।
“আসগর আলী সাহেব ছিটমহলে বাস করলেও তিনি বাংলাদেশের ঠিকানার পাসপোর্ট দিয়ে হজ করেছেন।”
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ভেতর ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হবে। একইভাবে ভারতের ভেতর থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল হয়ে যাবে ভারতের ভূমি।
এ প্রক্রিয়ায় ছিটমহলবাসীরা তাদের জমিতে তাদের ভিটামাটিতে বসবাসের সুযোগ পাবেন। কাউকে স্থানান্তরের প্রয়োজন হবে না। তবে তাদের জাতীয়তা বদলে যাবে। কেউ আগের জাতীয়তা বজায় রাখতে চাইলে তিনি আগের দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাবেন।
নাগরিকত্ব বেছে নেওয়ার সুযোগ পেলে কত মানুষ ভারতে যেতে পারে- এমন প্রশ্নে আলতাফ বলেন, “২০১২ সালে এ নিয়ে এলাকায় একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। সে সময় দুটি পরিবার ভারতে যাওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছিল।
“কিন্তু সম্প্রতি সেই দুটি পরিবারকে আমরা জিজ্ঞেস করেছি, আপনারা ভারত যাবেন কি না। তারা বলেছে, আগে আগ্রহ থাকলেও এখন আর যেতে চান না।”
অবশ্য মিজানুর রহমান নামে এক ব্যক্তি ‘ইউনাইটেড কাউন্সিল’ নামে একটি সংগঠন করে ভারত যাওয়ার কথা বলে আসছেন।
আলতাফ হোসেন বলেন, “তার সঙ্গে অন্য কেউ আছে কি না তা আমরা জানি না। তবে মিজানুর রহমান বলছেন, ছিটমহল বিনিময় হলে তিনি ভারত চলে যাবেন।”
ছিটমহল বিনিময়ে শুধু বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নয়, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাও পাওয়া যাবে বলে প্রত্যাশা করছেন বাসিন্দারা।
আলতাফ বলেন, “আমাদের ৬৮ বছরের বঞ্চনার প্রতিবিধান কীভাবে হবে? শুনেছি পশ্চিমবঙ্গে এই ছিটমহলের মানুষদের পুনর্বাসনের জন্য ভারত ৩ হাজার ৮ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। আমরাও বাংলাদেশ সরকারের কাছে উন্নয়নের জন্য প্যাকেজ বরাদ্দ চাই, যা দিয়ে এখানকার শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য খাতে কাজ করা যাবে।”
একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ছিটমহলবাসীদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা বরাদ্দেরও দাবি জানান তিনি।
বামনিকুটি ছিটমহলের কৃষক সাইফুর রহমান ধান নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সাংবাদিক দেখে এগিয়ে আসেন; এক গাল হেসে বলেন তার উচ্ছ্বাসের কথা।
বলেন, “বাংলাদেশ হওয়ায় আমরা খুশি।”