রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে সহিংসতাকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব সংস্থাকে ‘আন্তরিকভাবে’ কাজ করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
Published : 28 Mar 2015, 01:19 PM
র্যাবের একাদশতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
পেট্রোল বোমায় মানুষ পুড়িয়ে মারার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “এটা কোনোমতেই বরদাস্ত করা যাবে না। কাজেই এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা যা যা নেবার- সকলকেই তা নিতে হবে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে হবে। এ ব্যাপারে সকলকেই আন্তরিকভাবে কাজ করে যেতে হবে।”
শনিবার সকালে কুর্মিটোলায় র্যাবের সদরদপ্তরে বাহিনীর দরবারে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যারা জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারতে পারে, তারা কখনো দেশের কল্যাণ চাইতে পারে না, মানুষের কল্যাণ চাইতে পারে না। নিরীহ মানুষগুলোর অপরাধ কী? তাদের কেন এভাবে পুড়িয়ে মারা হবে?”
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের গত প্রায় তিন মাসের অবরোধে যাত্রীবাহী বাসসহ বিভিন্ন যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপে দগ্ধ হয়ে শতাধিক মানুষ মারা গেছেন।আহত হয়েছেন হাজারের বেশি। হাজারের বেশি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে এই সময়ে।
যানবাহনে অগ্নিসংযোগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আন্দোলন মানে হচ্ছে- পুড়িয়ে মানুষ মারা, আর সম্পদ পুড়িয়ে দেওয়া। আমি অন্তত আমার জীবনে এই আন্দোলন কখনো দেখিনি।
“আমরা আন্দোলন দেখেছি জনগণকে সম্পৃক্ত করে। বর্তমানে বিএনপি-জামাত জোট যে আন্দোলন করে যাচ্ছে- সেটা তো আন্দোলন না। মনে হচ্ছে যেন বাংলাদেশের অগ্রগতি রোধ করবার জন্য, একটা জিঘাংসা চরিতার্থ করবার জন্যই মানুষের ওপর প্রতিশোধ নেওয়া, মানুষকে পুড়িয়ে মারা, মানুষের ক্ষতি করা।”
“আমরা চাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। ইনশাল্লাহ, আমরা তা পরবো। মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলা করে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব। যতো বেশি আমরা অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হব ততোবেশি আমরা প্রত্যেকের চাহিদা মেটাতে পারব।”
বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার আমলে ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ এলিট বাহিনী হিসেবে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটিলিয়ন-র্যাবের যাত্রা শুরু হয়।
দেশের কোনো সরকার প্রধান হিসাবে শনিবারই প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা র্যাবের সদরদপ্তরে যান।
জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তৎপরতা অব্যাহত রাখার তাগাদা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “উগ্র জঙ্গিবাদ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। এই জঙ্গিবাদের হাত থেকে আমাদের দেশকে রক্ষা করা আমাদের একান্তভাবে প্রয়োজন। সরকার গঠনের পর থেকে এই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনা করে যাচ্ছি।”
জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা এবং জঙ্গি সংগঠনগুলোর ‘অসংখ্য’ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে-মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এর ফলে জঙ্গি সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড এখন সীমিত। এ ব্যাপারে তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে। কোনো মতেই বাংলাদেশে আমরা জঙ্গি তৎপরতা চালাতে দেব না।”
জঙ্গিবাদ ঠেকাতে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদান এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী।
“সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে,” বলেন তিনি।
বনদস্যু ও জলদস্যুদের দমনে র্যাবের ‘বলিষ্ঠ ভূমিকা’র কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “মাঝে মাঝেই তারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।”
জাল মুদ্রা ও পাসপোর্ট ধরায় র্যাবের ভূমিকা কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এরসাথে আন্তর্জাতিক চক্র কাজ করে। তাই এজন্য আমাদের প্রতিবেশী দেশের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ করা দরকার।”
অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা রোধে র্যাবকে অভিযান চালিয়ে যেতে চলেন তিনি।
র্যাবের ভেজালবিরোধী অভিযানে জনমনে ‘স্বস্তি’ এসেছে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “এ বাহিনী প্রতিনিয়ত সফল অপারেশনের মাধ্যমে সারাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করছে। এর ফলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়েছে।
“পেট্রোল বোমা আর অস্ত্র বিভিন্ন জায়গায় ধরা পড়েছে। সময়মতো যদি না ধরতে পারতো র্যাব তাহলে আরো কতো ক্ষতি করত?”
উপকূলীয় অঞ্চল এবং সুন্দরবন রক্ষায় কোস্ট গার্ড ও বর্ডার গার্ডের সঙ্গে র্যাবের যৌথ অভিযানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এজন্য যা যা করার আমি করব।”
তিনি বলেন, “আমরা হিসাবে করে দেখেছি। আমাদের জনসংখ্যা এতো বেশি। আমরা সেভাবে মানুষের সেবা দিতে গেলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই জনবল বৃদ্ধি করা একান্তভাবে অপরিহার্য।
“তাই র্যাবের ব্যাটালিয়নের সংখ্যা বৃদ্ধি ও সাংগঠনিক কাঠামো সংস্কার করার বিষয়ে আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি। আমরা এই উদ্যোগ গ্রহণ করব।”
অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে র্যাব অপহৃত শিশু ও ব্যক্তিকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিলেও পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ না হওয়ার সমালোচনা করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “যদিও যখন একটা ভালো কাজ হয়, সেটা পত্র-পত্রিকায় বেশি প্রচার পায় না। দেখা যাচ্ছে ব্যাপক সংখ্যক অপহৃত ব্যক্তিকে র্যাব তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়েছে- সেই সংবাদ কিন্তু খুব বেশি পত্রিকায় দেখা যায় না।
“অপহরণ হলে যতোটা দেখা যায়, উদ্ধারের পর খবরটা বেশি নেওয়া হয় না। জানি না, এটা সাংবাদিকতার দুর্বলতা নাকি সংবাদের গুরুত্ব কোনটাকে দিতে হবে। মানে অপরাধটাকে যতোটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, অপরাধী যখন ধরা পড়ে বা সেটাকে যখন শোধন করা হয়- সেটার গুরুত্ব একটু কমই পাওয়া যায়। সেটা আমাদের দেশের জন্য দুর্ভাগ্য।”
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের শুরুতেই র্যাবের একাদশতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে এই বাহিনীর সব পর্যায়ের কর্মকর্তা ও সদস্যদের শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি দায়িত্ব পালনকালে যারা মারা গেছেন তাদের স্মরণ করেন।
র্যাবের উন্নয়নে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা গত ছয় বছরে র্যাবের উন্নয়নে ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়েছি। এ বাহিনীর নতুন নতুন ব্যাটালিয়ন উদ্বোধন করা হয়েছে। ১১টি র্যাব ব্যাটালিয়নকে আমরা স্থায়ী জায়গা বরাদ্দ দিয়েছি।
“র্যাব সদরদপ্তর এবং গাজীপুরে র্যাবের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জন্যও স্থায়ী জায়গা দেওয়া হয়েছে। র্যাবের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয়েছে।”
র্যাবের অপারেশনাল শক্তি বাড়াতে দুটি হেলিকপ্টারসহ প্রয়োজনীয় যানবাহন বরাদ্দ দেওয়ার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে হাই-টেক যন্ত্রপাতি ও আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। র্যাব প্রকৃত অর্থেই এখন এলিট ফোর্স। আমরা এ ফোর্সকে আরো আধুনিক ও সময়োপযোগী করতে যা যা প্রয়োজন তার সবকিছুই করব, ইনশাআল্লাহ।”
সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীসহ সাত বাহিনী এবং বেসামরিক প্রশাসনের সদস্যরা র্যাবে কাজ করেন।
“এ পেশায় আপনাদের আন্তরিক থাকতে হবে। আপনি যখন যার কমান্ডে আছেন, যে দায়িত্ব পালন করছেন- সে দায়িত্ব আপনাকে যথাযথভাবেই পালন করতে হবে।
“যখন যেখানে কাজ করবেন- সেখানকার নীতিমালা, সেখানকার আইন, সেখানকার বিধি সেগুলো আপনাকে মেনে চলতে হবে। এ ব্যাপারে সকলকে আরো আন্তরিক হওয়ার জন্য আমি অনুরোধ জানাচ্ছি।”
দরবারে র্যাব সদস্যদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী।
শুরুতেই র্যাবের মহাপরিচালক পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদ বক্তব্য রাখেন।
প্রধানমন্ত্রী র্যাব সদরদপ্তরে গিয়ে পৌঁছালে তাকে গার্ড অফ অনার দেওয়া হয়।
দরবার শেষে প্রধানমন্ত্রী অধিনায়ক সম্মেলন এবং প্রীতিভোজে যোগ দেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী র্যর্যাবের ছয়টি নতুন ব্যাটালিয়ন ভবনের উদ্বোধন এবং গাজীপুরে বাহিনীর প্রশিক্ষণ স্কুল ও আরো দুটি ব্যাটালিয়ন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।