ছেলের কফিনের সামনে অশ্রুসিক্ত খালেদা

দেড় বছর আগে শেষবার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ব্যাংককে; মালয়েশিয়া থেকে তার লাশ ফেরার পর কান্নায় ভেঙে পড়লেন তার মা বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া।

সুমন মাহমুদ প্রধান রাজনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Jan 2015, 08:28 AM
Updated : 27 Jan 2015, 08:11 PM

গত শনিবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয় কুয়ালালামপুরে মৃত্যু হয় কোকোর। মুদ্রাপাচারের একটি মামলায় ছয় বছরের সাজা মাথায় নিয়ে ২০০৮ সাল থেকে তিনি নির্বাসনে ছিলেন।

মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে মঙ্গলবার বেলা ১১টা ৩৭ মিনিটে ঢাকায় পৌঁছায় কোকোর মরদেহ। একই ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন কোকোর স্ত্রী, দুই মেয়ে, মামা শামীম এস্কান্দার এবং খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালু।

এরপর দুই শতাধিক নেতাকর্মী অ্যাম্বুলেন্সে করে কফিন নিয়ে যান বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে।  সেখানে উপস্থিত হাজারখানেক কর্মী-সমর্থকের ভিড় ঠেলে বেলা ১টা ৪০ মিনিটে অ্যাম্বুলেন্স থেকে খয়েরি রঙের কফিনটি নামিয়ে কার্যালয়ের নিচতলার একটি কক্ষে নেওয়া হয়।

কফিন খোলার পর একটি গিলাফ দিয়ে কোকোর মরদেহ ঢেকে দেওয়া হয়। তার স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি দুই মেয়ে জাফিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমানকে নিয়ে উপরে যান, যেখানে অপেক্ষা করছিলেন পুত্রশোকে কাতর খালেদা জিয়া।

কিছুক্ষণ পর খালেদা জিয়ার দুই ভাইয়ের স্ত্রী নাসরিন সাঈদ ইস্কান্দার ও কানিজ ফাতেমা দুই পাশ থেকে ধরে অশ্রুসিক্ত খালেদা জিয়াকে নিচে নামিয়ে আনেন। ঘিয়ে রংয়ের শাড়ি পরিহিতা বেগম জিয়া যখন ওই কক্ষে প্রবেশ করেন, তখন উপস্থিত অনেকেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন।

ছেলের কফিনের সামনে এসে কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন খালেদা জিয়া। এরপর গুমড়ে কেঁদে ওঠেন তিনিও।

নিচ তলার ওই কক্ষে আত্মীয় ও দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। খালেদা যখন কফিনের দিকে ঝুঁকে ছেলের মুখ দুই হাতে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন, তার উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালুকেও কফিনের অন্যপাশে বসে কাঁদতে দেখা যায়। 

পরিবারের সদস্যদের শেষবার দেখার জন্য কোকোর কফিন ওই কক্ষে রাখা হয় প্রায় এক ঘণ্টা। এর মধ্যে প্রায় ৩৫ মিনিট খালেদা জিয়া সেখানে ছিলেন। কফিনের পাশে বসেই তিনি ছেলের জন্য মোনাজাতে হাত তোলেন।

এরই মধ্যে তিনি বার বার কফিনে শোয়ানো ছেলের মুখের দিকে তাকান এবং দুই নাতনীকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে ওঠেন। তাকে দুই পাশ থেকে ধরে রাখেন দুই ভাইয়ের স্ত্রী এবং কোকোর স্ত্রী শর্মিলা।

কোকোর শ্বশুড়বাড়ির লোকজন, খালেদার বড় ছেলে তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমানের মা সৈয়দা ইকবালমান্দ বানু, জোবাইদার বড় বোন শাহিনা খান জামান বিন্দু, খালেদার দুই ভাইয়ের পরিবারের সদস্য, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান, বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস এবং সেনা, বিমান ও নৌ বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন কর্মকর্তা এ সময় সেখানে ছিলেন।

পরে খালেদার সামনেই কফিনটি ঢেকে দেওয়া হয়; অশ্রুসিক্ত বিএনপি চেয়ারপারসন দাঁড়িয়ে থেকে ছোট ছেলেকে শেষ বিদায় জানান।

একদিকে লাশের কফিন অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়, অন্যদিকে খালেদা জিয়াকে দুই পাশ থেকে ধরে দোতলায় নিয়ে যান তার দুই ভাইয়ের স্ত্রী।

বেলা পৌনে ৩র দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে কোকোর কফিন নিয়ে যাওয়া হয় বায়তুল মোকাররমের দিকে। সেখানে জানাজা শেষে তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করার কথা রয়েছে।

সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর জন্ম ১৯৭০ সালে, কুমিল্লা সেনানিবাসে।

জরুরি অবস্থার সময় ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদার সঙ্গে তার ছেলে কোকোও সেনানিবাসের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হন। পরের বছর ১৭ জুলাই তখনকার সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে যান কোকো।

সেখান থেকে তিনি পাড়ি জমান মালয়েশিয়ায়। স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে কুয়ালালামপুরে একটি ভাড়া ভাসায় তিনি থাকছিলেন।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৯ সালে ক্ষমতা নেওয়ার পর কোকোর সাময়িক মুক্তির মেয়াদ আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর আদালতের ডাকে না ফিরলে তাকে পলাতক দেখিয়েই মুদ্রা পাচারের অভিযোগে দুদকের করা একটি মামলার বিচার শুরু হয়।

ওই বছরের ২৩ জুন মুদ্রা পাচারের মামলার রায়ে আরাফাতকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেয় বিচারিক আদালত; সেই সঙ্গে ১৯ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়।

২০১১ সালের ২৩ জুন ওই মামলার রায়ে কোকোর সাজার রায় হয়; পলাতক থাকায় আপিলের সুযোগ পাননি তিনি। তবে বিএনপির দাবি, এই মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

২০১৩ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়ে খালেদা জিয়া ব্যাংককে যাত্রাবিরতি করে ছোট ছেলেকে দেখতে গিয়েছিলেন। সেটাই ছিল মায়ের সঙ্গে তার শেষ সাক্ষাৎ।