এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণে সরকার নির্ধারিত ফি’র বাইরে যে বাড়তি অর্থ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়েছে, তা ফেরতের নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।
Published : 06 Jan 2015, 11:56 AM
তা ফেরত না দিলে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি বাতিল বলে গণ্য হবে বলেও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের বেঞ্চের আদেশে বলা হয়েছে।
মঙ্গলবার দেওয়া এই আদেশে বলা হয়, “সচিব ও ১০ বোর্ডের চেয়ারম্যান এই মর্মে আদেশ জারি করবে যে, সমগ্র বাংলাদেশে যে সব বিদ্যালয় সরকার নির্ধারিত এসএসসি পরীক্ষার ফি এবং আইনগতভাবে আদায়যোগ্য ফি বহির্ভূত কোনো বাড়তি ফি আদায় করেছে, সেসব ফি আগামী ২০ জানুয়ারির মধ্যে শিক্ষার্থীদের ফেরত দেবে। তা না হলে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি বাতিল বলে গণ্য হবে।”
“ওইসব ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা পরবর্তী তিন বছরের জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটি ও গভর্নিং কমিটির নির্বাচনের জন্য অযোগ্য বিবেচিত হবেন।”
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের একটি প্রতিবেদন দেখার পর গত ডিসেম্বর মাসে হাই কোর্টে রাজধানীর অতিরিক্ত ফি গ্রহণকারী ২৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানকে তলবের আদেশ দিয়েছিল।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত ফি নিয়েছে বলে ঢাকা বোর্ডের তদন্তে ধরা পড়ে। পরে প্রকাশিত আদালতের লিখিত আদেশে দেখা যায়, ফি ফেরত দেওয়া ছয়টি প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও সভাপতিকে বাদ দেওয়া হয়।
বাকি ২০টি স্কুলের অধিকাংশ বিবাদীরা আদালতে হাজির ছিলেন। শুনানি শেষে আদালত বিবাদীদেরকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেয়।
ভিকারুননিসা নুন স্কুল ও মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, উদয়ন স্কুলের সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, রাজউক স্কুল অ্যান্ড কলেজের চেয়ারম্যান শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
শুনানিতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ রায়কে উদ্দেশ্যে করে আদালত বলে, সরকারের পক্ষ থেকে সবার জবাব দেননি কেন?
জবাবে বিশ্বজিৎ রায় বলেন, “জবাবের সব অনুলিপি পাইনি। যেগুলো পেয়েছি সেগুলো দিয়েছি। কেউ কেউ সরাসরি আদালতে দাখিল করেছে।”
মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের কাছে আদালত জানতে চায়, সরকারের আইন এভাবে কি লঙ্ঘন করা উচিত? এখন তো দেখছি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে।
মেননের পক্ষের আইনজীবী শ ম রেজাউল করিম বলেন, নিয়মিত ক্লাসের বাইরে কোচিং ক্লাস নেওয়া হয়। এই জন্য অতিরিক্ত অর্থ নিতে পারবে বলে বোর্ডের সার্কুলারে বলা আছে। সেভাবেই নেওয়া হচ্ছে।
আদালত বলে, “কত নিতে পারবেন, সর্বোচ্চ ১২০০ টাকা। এর থেকে বেশি তো না। আমাদের সময় তো কোন কোচিং ছিল না। কেউ টেস্ট পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে শিক্ষকরা পাগলপ্রায় হয়ে যেত। বাড়িতে গিয়ে পড়াত।”
রেজাউল বলেন, “ঠিক। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। যাই হোক, বোর্ড নোটিস দেওয়ার পর অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দেওয়া হয়েছে।”
আদালত বলে, “এখানে শুধু ২০টি স্কুলের প্রেক্ষাপট। আমরা অতিরিক্ত ফি নেওয়ার ব্যাপারে সারা দেশের সব শিক্ষা বোর্ডের ব্যাপারে আদেশ দিয়েছিলাম। ঢাকা ও বরিশাল শিক্ষা বোর্ড জবাব দিয়েছে।”
‘জানেন না সচিব’
বিশ্বজিৎ রায় বলেন, “ঢাকা শহরের এমনও স্কুল আছে, যেখানে এক একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১৮ হাজার টাকা করে নিয়েছে। এটা পত্রিকায় আসেনি। অভিভাবকরা আমাদের জানিয়েছেন।”
এরপর আদালত শিক্ষা সচিবকে উদ্দেশ্য করে বলে, “১৯৬১ সালের আইন অনুসারে সব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে শিক্ষা বোর্ডকে। কিন্তু আপনারা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা বোর্ডকে পাশ কাটিয়ে একের পর এক প্রজ্ঞাপন জারি করে থাকেন। এ ধরনের বহু নজির আছে। কেন এটা করেন?”
শিক্ষা সচিব বলেন, “আমি দায়িত্ব পেয়েছি তিন মাস। এভাবে বললে তো আমি বলতে পারব না। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হয়ত জবাব দিতে পারব।”
আদালত বলে, “সৃজনশীল ব্যবস্থা প্রবর্তন করে আপনারা আদেশ জারি করেছেন। এটা করার আপনারা কে? কাজটা তো বোর্ডের।”
তখন সচিব বলেন, সৃজনশীল ব্যবস্থাটা একটা রাষ্ট্রীয় নীতির বিষয়। এটা সরকারি সিদ্ধান্ত।
আদালত বলে, “আপনি তো শিক্ষা সচিব, আপনি কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি? আমরা যতটুকু বলেন, রাজউক ও রেসিডেন্সিয়ালের সভাপতি।”
তখন সচিব বলেন, “আমি ঠিকই সভাপতি, তবে বেশি ফি নেওয়ার বিষয়টি আমি জানি না।”
আদালত বলে, বেশিরভাগ স্কুলই গ্রাম অঞ্চলের। সেখানকার শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ অভিভাবকই অস্বচ্ছল। এভাবে ফি নিলে সেটা তাদের জন্য অসহনীয় হয়।
সচিব বলেন, “সব কিছু মন্ত্রণালয় থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।”
আদালত বলে, “আমরা আগে আদেশ দিয়েছি যে, কেউ বর্ধিত ফি দিতে না পারলে তাকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখা যাবে না। কোটিংয়ের নামে বাড়তি টাকা নেওয়া হচ্ছে। এরপরে বাইরে কোচিং সেন্টার কেন?”
শিক্ষা সচিব বলেন, “বৃটেনের মতো দেশেও কোচিংয়ের ব্যবস্থা আছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা তাদের মতো উন্নত হলে হয়ত আমরা কোচিং ব্যবস্থা না রাখার পক্ষে বলতে পারতাম।”
আদালত তখন জানতে চায়, বাংলাদেশের কমিউনিটি স্কুলের শিক্ষার রেটিং সারা বিশ্বের মধ্যে কততম?
উত্তরে সচিব বলেন, “আমি জানি না।”
আদালত তখন বলে, বাংলাদেশের অবস্থান ওপরের দিকে।
শুনানির এক পর্যায়ে রেজাউল করিম বলেন, “আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলেছেন, এখানে একটা ইউনিভার্সিটির চারজন ভিসি। হাই কোর্ট থেকেই চারজন পৃথকভাবে আদেশ নিয়ে সমানতালে সনদ বিক্রি করছেন।”
আদালত বলে, বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য লোভ কেন? স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে থাকার এত আগ্রহ কেন?
সচিব বলেন, “টাকা পয়সা আছে।”
আদালত বলে, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান আদালতের নির্দেশ মানছে না। কিন্তু মন্ত্রণালয় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? কেউ মান্য না করলে শাস্তি কী?
সচিব বলেন, “আইনে কোনো শাস্তি নেই। সুনির্দিষ্ট একটি আইন করা উচিত।”