‘খাঁচায়’ গেলেই টাকা-ফোন বেহাত, খেতে চাইলে মারধর

কম টাকায় বিদেশ যাওয়ার প্রলোভনে পা দিয়ে ট্রলারে উঠলেই শুরু হয় নির্যাতন; এরপর বিদেশে ‘দাসত্বের’ অভিজ্ঞতা না হলেও সাগরে কয়েকদিনের দুর্দশায় অসুস্থ হয়ে ফিরেছেন মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে ফিরে আসা ব্যক্তিরা।

উত্তম সেনগুপ্তবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Nov 2014, 05:45 PM
Updated : 19 Nov 2014, 03:57 AM

ছয় শতাধিক মানুষ নিয়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রার পর আটক মিয়ানমারের পতাকাবাহী ট্রলারটি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরীর ১৫ নম্বর এলাকা সংলগ্ন নৌবাহিনীর রেডি রেসপন্স বার্থে (আরআরবি) নিয়ে আসা হয়।

এসময় ট্রলারের যাত্রীদের মধ্যে অনেককেই অসুস্থ ও ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর দেথা যায়। এ সময় প্রাথমিক চিকিৎসা ও খাবার দেয়া হয় যাত্রীদের।

উদ্ধারদের কয়েকজন জানান, দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উপকূল থেকে মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুকদের জড়ো করা হয় বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার প্রায় শেষ প্রান্তে অবস্থান নিয়ে থাকা ওই ট্রলারে।

ট্রলারে ওঠার পর দিনে দুই বেলা শুকনা মরিচ দিয়ে ভাত দেওয়া হত তাদের। কখনো কখনো একটু ডাল জুটত পাতে।

কেউ অল্প খরচে বিদেশ যেতে, কাউকে জোর করে এবং নারীদের মধ্যে কয়েকজন মালয়েশিয়া প্রবাসী স্বামীর কাছে যেতে ওই ট্রলারের যাত্রী হয়েছিলেন।

ট্রলারটি মালয়েশিয়ার পথে যাত্রাও করেছিল। পরে নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ ‘দুর্জয়’ সেটিকে ধাওয়া করে ধরে ফেলে।

‘দুর্জয়’র কমান্ডার নাঈম রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সেন্টমার্টিন থেকে ১২০ নটিক্যাল মাইল দূরে এবং বাংলাদেশের সমুদ্রের এক্সক্লুসিভ ইকনোমিক জোনের দক্ষিণ অংশে স্থলভাগ থেকে প্রায় ২৩০ নটিক্যাল মাইল দূরে থাকা ট্রলারটি আটক করা হয়।

“আটকের সময় ট্রলারটি বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মাত্র ১৫ নটিক্যাল মাইল ভেতরে অবস্থান করছিল। রোববার থেকেই ট্রলারটি আমরা অনুসরণ করছিলাম।”

কমান্ডার নাঈম বলেন, “গতিবিধি সন্দেহজনক হওয়ায় শুরুতে আমরা ট্রলারটিকে চ্যালেঞ্জ করি। ট্রলারটি না থেমে এগিয়ে যেতে থাকে। পরে ধাওয়া করে সেটিকে ধরা হয়।”

তিনি বলেন, ট্রলারের ভেতর অমানবিকভাবে গাদাগাদি করে বসিয়ে রাখা হত আরোহীদের। খাবার বা পানি চাইলে চলত মারধর। এমনকি মাথা উঁচু করলেও মারা হত যাত্রীদের।

“এটি ফিশিং ট্রলার নয়, অনেকটা কার্গো ট্রলারের মত। এর তিনটি ডেকের প্রতিটিতে দুইশ জন করে লোক রাখা হয়েছিল। ট্রলারটি আটকের পরও আমাদের ধারণা ছিল না এতে এত মানুষ আছে,” বলেন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা নাঈম রহমান।

ছয় বন্ধুসহ এই ট্রলারের যাত্রী হয়েছিলেন সুনামগঞ্জের জালালগঞ্জের মাগুর গ্রামের জমির হোসেন (৩২)।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত ১০ অক্টোবর কক্সবাজার বেড়াতে এলে সুজন নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি জনপ্রতি দুই লাখ টাকায় তাদের মালয়েশিয়া পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব দেন।

“৩১ অক্টোবর আবার কক্সবাজার এসে সুজনের হাতে জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা করে দিই। কক্সবাজার শহরের কলাতলী এলাকায় কক্সভিউ হোটেলে দুই দিন আমাদের রাখা হয়।”

এরপর ২ নভেম্বর হিমছড়ি এলাকা থেকে তাদের একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকায় জোর করে তুলে দেওয়া হয় জানিয়ে জমির বলেন, “তখন সাগরের গর্জন দেখে এতো ছোট নৌকায় উঠতে আমরা অস্বীকৃতি জানিয়েছিলাম।

“ছোট ইঞ্জিন নৌকাটি চারদিন চলার পর আমরা বড় ট্রলারটিতে পৌঁছাই। সেখানে আমাদের কাছে থাকা টাকা ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নেয় পাচারকারীরা। এরপর থেকে প্রতিদিন শুধু দুই বেলা অল্প পরিমাণে ভাত দেওয়া হত।”

টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা দুই ভাই পেটান আলী (১৫) ও মোহাম্মদ আলী (১৭) জীবিকার জন্য টেকনাফ সদরের মোহাম্মদ রফিকের বাড়িতে মাটি কাটার কাজ নেন।

দৈনিক চারশ টাকার বিনিময়ে কাজের কথা থাকলেও দুই দিন কাজ করার পর তাদের জোর করে টেকনাফ থেকে একটি ছোট ট্রলারে তুলে দেওয়া হয়। এর কয়দিন পর দুই ভাইয়েরও ঠাঁই হয় ওই ট্রলারে।

শুধু বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নয়, মালয়েশিয়া যেতে ওই ট্রলারে জড়ো করা হয়েছিল মিয়ানমারের মংডু এলাকার বাসিন্দাদেরও।

ট্রলার থেকে উদ্ধার হওয়া তসলিমা (২০) মিয়ানমারের মংডুর বাসিন্দা। তার স্বামী মালয়েশিয়ায় খাকে।

তসলিমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্বামীর ফোন পেয়ে মালয়েশিয়া যেতে সাত দিন আগে মংডু থেকে ছোট একটি ট্রলারে এসে এই ট্রলারে উঠেছিলেন তিনি।

মংডুর আরেক বাসিন্দা মোবিনাও বলেন, স্বামীর কথায় দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে ট্রলারে উঠেছিলেন তিনি।

টেকনাফের শাপলাপুরের বাসিন্দা জুলেখাও (২৪) তিন বছর ধরে মালয়েশিয়া প্রবাসী স্বামী আবদুল জোবায়েরের কথায় সেখানে যেতে স্থানীয় দালালের সহযোগিতায় ওই ট্রলারের যাত্রী হন বলে জানান।

টেকনাফের পিয়াসা বেগমের (৬০) ছেলে মাহমুদ সিদ্দিক কয়েক বছর ধরে মালয়েশিয়ায় থাকেন। তার কথা মতই ছেলের বউ-নাতিসহ পাঁচ জনকে নিয়ে মালয়েশিয়া চলে যেতে ট্রলারে উঠেছিলেন বলে জানান পিয়াসা।

ট্রলারের ৬২৫ যাত্রীর মধ্যে ১৬ জন দালাল বলে নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। দালালদের মধ্যে ১৪ জন মিয়ানমারের নাগরিক, দুইজন বাংলাদেশি।

এছাড়া ট্রলারে ৩১ জন নারী ও ২৬ জন শিশু ছিল। বাকিরা পুরুষ। তবে নারী ও পুরুষদের মধ্যে কতজন বাংলাদেশের ও কত জন মিয়ানমারের নাগরিক তা জানা যায়নি।

নৌবাহিনীর কর্মকর্তা নাঈম রহমান বলেন, এতো বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে কে কোন দেশের তা বের করতে সময় লাগবে। আগে তাদের খাবার ও চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। পরে তদন্ত ও যাচাই-বাছাই শেষে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।