সারাদেশ থেকে মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুকদের বঙ্গোপসাগরের সেন্ট মার্টিন ও টেকনাফ সংলগ্ন অংশে নিয়ে যায় পাচারকারীরা, সেখানে অপেক্ষায় থাকে বড় আকারের ট্রলার।
Published : 17 Nov 2014, 11:00 PM
যে কোনো উপায়ে ওই বড় ট্রলারে পৌঁছাতে পারলেই অথৈ সমুদ্রে যাত্রা শুরু হয় ‘ভাগ্য বদলের’ নেশায় থাকা যুবকদের, যদিও তাদের কারো ঠাঁই মেলে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে, কেউ সাগরেই প্রাণ হারান।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ থেকে ৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে ছয়শ’রও বেশি অরোহীসহ মিয়ানমারের পতাকাবাহী একটি ট্রলার থেকে ছয়শ’ জনকে আটকের পর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
ট্রলারটি আটককারী নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের ধারণা, এর আরোহীরা বাংলাদেশ উপকূল থেকে একটি নৌযানে করে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী সাগরে যায়। এরপর অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য মিয়ানমারের পতাকাবাহী ট্রলারে ওঠে।
সাগরে মানবপাচারের সময় আটকের নজির থাকলেও এর আগে গভীর সাগরে কোনো নৌযানে একসঙ্গে এত জনকে পাওয়া যায়নি।
টেকনাফ বিজিবি ৪২ ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক মো. আবু জার আল জাহিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পাচারকারীরা সীতাকুণ্ড, কুমিরা, চকরিয়া, মহেশখালী, উখিয়া ও রামু উপকূল ব্যবহার করে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। এক-দুই জনের দল থেকে শুরু করে ২৫-৩০ জনের দলও নানা পথে সেখানে যায়।
“তাদের সবারই লক্ষ্য সাগরে থাকা বড় আকারের ট্রলার। আমাদের সমুদ্রসীমার শেষপ্রান্তে বা বাইরে এসব ট্রলার মাসখানেক পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকে। ট্রলার ভর্তি হলে তারপর পাচারকারীরা রওনা হয়।”
মানব পাচার ঠেকাতে নজরদারির জন্য ওয়াইখং, দমদমিয়া, আবিদ ছড়া ও খুরের মুখ এলাকায় বিজিবির চেকপোস্ট আছে।
নিরাপত্তা জোরদারের পরও অভিনব উপায়ে পাচারকারীরা সাগরে যেতে চেষ্টা চালায় জানিয়ে আবু জার বলেন, “পিকনিক পার্টি, ব্যবসায়ী, কৃষি শ্রমিকসহ নানা ছদ্মবেশে মালয়েশিয়াগামীদের জড়ো করে পাচারকারীরা।
“প্রায় দুইশ-আড়াইশ কিলোমিটার সাগরপথ পাহারা দেওয়া মোটেও সহজ নয়। তবে এখনকার মতো সবাই সক্রিয় হলে মানব পাচার ঠেকানো সম্ভব।”
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইয়াং সোশ্যাল অ্যাকশনের (ইপসা) মানব পাচার প্রতিরোধ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক সিরাজ উদ্দিন বেলাল বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহীদের প্রথমে ঢাকা এবং পরে চট্টগ্রামে আনে দালালরা। শেষে ছোট ছোট দলে ভাগ করে তাদের কক্সবাজার-সেন্ট মার্টিন ও টেকনাফে নিয়ে যাওয়া হয়।
“সেখান থেকে সাগরে মিয়ানমারের সীমানায় থাকা মালয়েশিয়াগামী ট্রলারে তুলে দেওয়া হয়। পুরো উপকূলজুড়ে নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলে এবং পাচারকারী চক্রের মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনা গেলেই কেবল মানবপাচার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।”
গত চার বছর ধরে পাচারের উদ্দেশ্যে জড়ো করাদের আটকের স্থান ও আটকদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, ভিন্ন ভিন্ন পথ ব্যবহার করে তারা সবাই টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিন পৌঁছানোর চেষ্টা করছিলেন।
২০১১ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত নতুন-পুরনো মিলিয়ে পাঁচটি পথ ব্যবহার করেছে মানব পাচারকারী চক্র।
২০১১ সালের শেষ তিন মাসে বিজিবির ১০টি অভিযানে মোট ৫৭ জন মালয়েশিয়াগামীকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ও সাবরাং থেকে উদ্ধার করা হয়।
২০১২ সালের প্রথম ছয় মাসে আলাদা ছয়টি ঘটনায় টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ ও নগরী থেকে ৯৬ জনকে উদ্ধার করে পুলিশ।
এরপর গতিপথ পাল্টে বাঁশখালী উপকূল ব্যবহারের চেষ্টা করে মানবপাচারকারীরা। ওই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর বাঁশখালীর ছনুয়া ইউনিয়নের সমুদ্র উপকূলীয় ছেলবন এলাকা থেকে ১১২ জন মালয়েশিয়াগামীকে উদ্ধার করে পুলিশ। এটাই ছিল চট্টগ্রামে ধরা পড়া মালয়েশিয়াগামীদের সবচেয়ে বড় দল।
২০১৩ সালে আবার টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপসহ, সাবরাং, বালুখালী নদী, মেরিন ড্রাইভ এলাকায় ব্যবহার শুরু করে পাচারকারীরা। ২০১৪ সালের শুরুতেও একই প্রবণতা ছিল।
চলতি বছর নগরী ও সীতাকুণ্ডের নৌ ও সমুদ্র পথ ব্যবহারের চেষ্টা করছে পাচারকারী চক্র।
নগরীর শাহ আমানত সেতু সংলগ্ন এলাকা থেকে গত ৯ সেপ্টেম্বর ১০ জন ও ১৩ সেপ্টেম্বর নয় জন মালয়েশিয়াগামীকে উদ্ধার করে বাকলিয়া থানা পুলিশ। সীতাকুণ্ডের উত্তর ছলিমপুর থেকে ১২ জনকে উদ্ধার করা হয় ১৪ সেপ্টেম্বর।
১৩ অক্টোবর নগরীর লালদীঘি পাড় এলাকা থেকে সুনামগঞ্জের ১৫ জনকে উদ্ধার করে পুলিশ। তারা সবাই মালয়েশিয়া যেতে হোটেলে জড়ো হয়েছিল।
১৬ অক্টোবর নগরীর শাহ আমানত সেতু এলাকায় কক্সবাজারের চকরিয়াগামী একটি বাস থেকে উদ্ধার করা হয় ৩৯ জনকে।
২৭ সেপ্টেম্বর নগরীর চান্দগাঁও থেকে ১৭ জন মালয়েশিয়াগামীকে উদ্ধার করা হয়। যারা সিরাজগঞ্জ, নরসিংদী ও যশোর থেকে এসেছিলেন টেকনাফ হয়ে মিয়ানমার যেতে।
আর এর ধারাবাহিকতায় ৯ নভেম্বর কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন থেকে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যেতে রওনা হওয়া ১১ জনকে একটি ইঞ্জিন নৌকাসহ আটক করে কোস্টগার্ড।
সেপ্টেম্বর মাসে নগরীতে এরকম চারটি অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া বাকলিয়া থানার ওসি মো. মহসিন বলেন, “আগে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সরাসরি টেকনাফে লোকজন জড়ো হতেন। ইদানিং সময়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকাতে তাদের জড়ো করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
“তবে সব দালালেরই গন্তব্য সমুদ্রপথে টেকনাফ বা সেন্টমার্টিনের আশেপাশে মালয়েশিয়াগামীদের জড়ো করা।”