হাস্যরস আর খোশগল্পে সময় পার সংসদে

জাতীয় পার্টির একজন নারী সাংসদের সঙ্গে ডেপুটি স্পিকারের ‘হাস্যরস’, বিবৃতি দিতে দাঁড়িয়ে উপমন্ত্রী জয়ের অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য এবং নামাজের বিরতির পর প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে খোশগল্পে অনেকটা ‘হালকা মেজাজেই’ শেষ হয়েছে মঙ্গলবারের অধিবেশন।  

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Sept 2014, 07:53 PM
Updated : 17 Sept 2014, 06:19 AM

বুধবার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সংসদে পাশের জন্য ওঠার কথা রয়েছে, যার মধ্যে দিয়ে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা আবার সংসদের হাতে ফিরবে।     

মঙ্গলবার জাতীয় পার্টির সাংসদ নূর-ই-হাসনা লিলি চৌধুরী সম্পূরক প্রশ্নের সুযোগ পেয়ে ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “মাননীয় স্পিকার আপনাকে ধন্যবাদ। অনেক চেষ্টার পর আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলাম, এজন্য আপনাকে আবারো ধন্যবাদ।”

ফজলে রাব্বী এ সময় লিলিকে বলেন, “আপনি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবেন না- এমন স্পিকার কি হবে?”

লিলি বলেন, “এর উত্তর আমার কাছে আছে। কিন্তু এখানে বলতে পারছি না মাননীয় স্পিকার, একটু অসুবিধা আছে।”

এদিকে সম্পূরক প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়ে কৌশলে নিজের তারকা চিহ্নিত একটি প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকেন নারায়ণগঞ্জের সাংসদ শামীম ওসমান।

ডেপুটি স্পিকার এ সময় তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, “আপনি সম্পূরক প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়ে এই প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন না।”

এরপরেও শামীম ওসমান প্রশ্নটি তুলতে চাইলে ফজলে রাব্বী বলেন, “আপনি কাজটা ঠিক করেননি, আপনি কাজটা ঠিক করেননি। আমি দুঃখিত মাননীয় সংসদ সদস্য।”

অধিবেশন শুরুর পর দিনের প্রথম তারকাচিহ্নিত প্রশ্নের নম্বর উত্থাপন না করে সাংসদ এ কে এম শাহজাহান কামাল পুরো প্রশ্নটি পড়ে ফেলেন।

ফজলে রাব্বী তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, বিধি অনুযায়ী পুরো প্রশ্ন পড়ার দরকার নেই, শুধু তারকা চিহ্নিত প্রশ্নের নম্বরটি উত্থাপন করবেন।

পদ্মার ভাঙনরোধ নিয়ে জরুরি জন-গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করে একটি নোটিস পড়েন জাতীয় পার্টির সাংসদ সালমা ইসলাম। পানিসম্পদ মন্ত্রী নোটিশের জবাব দেন।

এরপর সম্পূরক প্রশ্নের ফ্লোর পেয়ে সালমা বলেন, “যেহেতু মাননীয় মন্ত্রী বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তাই আমি আমার নোটিসটি প্রত্যাহার করলাম।”

ডেপুটি স্পিকার এ সময় সালমাকে বলেন, “মাননীয় সাংসদ, বিধি অনুযায়ী আপনি নোটিস প্রত্যাহার করতে পারেন না। আপনি একটি সম্পূরক প্রশ্ন করতে পারেন।”

পরে নিজের ভুল স্বীকার করে সালমা আর কোনো সম্পূরক প্রশ্ন করেননি।

মাগরিবের নামাজের বিরতির পর সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অধিবেশনে না ফেরায় বেশ কয়েকজন সাংসদকে অধিবেশন কক্ষেই খোশ গল্পে ব্যস্ত দেখা যায়।

এ সময় কেউ কেউ নিজের আসন ছেড়ে অন্যের আসনে বসে গল্পে মশগুল হন, কেউ আবার পত্রিকা পড়ে সময় পার করেন।

রাত ৭টা ৫০ মিনিটে সাংসদ সলিম উদ্দিন তরফদার প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজের চেয়ারটি পেছন দিকে ঘুরিয়ে হুইপ শহীদুজ্জামান সরকারের সঙ্গে গল্প শুরু করেন। রাত ৮টায় প্রধান হুইপের চেয়ার ছাড়েন তিনি।

পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে দেখা যায় নিজের আসন ছেড়ে হুইপ মাহবুব আরা বেগম গিনি ও সাগুফতা ইয়াসমিন অ্যামিলির মাঝের আসনে বসে দুজনের সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত। 

এদিকে আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে কথা শেষ করেই আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সঙ্গে আলাপে মশগুল হয়ে পড়েন।

আর নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের ডান পাশের আসনে বসে গল্প করে সময় কাটান সাবিনা আক্তার তুহিন।

সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর চেয়ারে হেলান দিয়ে মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গে গল্প করতে দেখা যায় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবুকে।

মাগরিবের নামাজের বিরতির পর প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই পত্রিকায় চোখ বোলাতে দেখা যায় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীকে।

প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে সাংসদ আব্দুর রহমান নিজের আসন ছেড়ে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর চেয়ারে বসে কাজী ফিরোজ রশীদের সঙ্গে গল্প করেন।

রাত ৮টার মিনিট পাঁচেক আগে অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেই একটি ফাইল নিয়ে দ্বিতীয় সারিতে ওবায়দুল কাদেরের পাশে বসে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সামনের সারিতে প্রবীণ এই সাংসদের আসন এ সময় খালিই থাকে।

শামীম ওসমান নিজের আসনে না থাকায় তার আসনে বসে ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পী গল্প করেন মৃণাল কান্তি দাসের সঙ্গে।

আর হুইপ আতিউর রহমান আতিককে দেখা যায় নতুন হুইপ গিনির আসনের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে।

এছাড়া একাত্তর বিধিতে মনোযোগ আকর্ষণের সময় বেশ কয়েকজন সাংসদকে নিজের আসন ছেড়ে অন্যের আসনে বসে গল্প করতে দেখা যায়।

মন্ত্রণালয় নিয়ে মন্ত্রীদের নির্ধারিত বিধিতে বিবৃতি দিতে দাঁড়িয়ে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে সংসদে হাস্যরসের সৃষ্টি করেন যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়।

দিনের কার্যসূচির শেষভাগে আইন প্রণয়ন শেষ করে ডেপুটি স্পিকার জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক জয়কে ৩০০ বিধিতে বিবৃতি দেয়ার সুযোগ দেন। তরুণ এ উপমন্ত্রী বিবৃতি শুরু করেন বঙ্গবন্ধু ও দেশ মাতৃকার জন্যে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনায়।

ডেপুটি স্পিকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলতে থাকেন, “গত বাজেট অধিবেশনে বক্তৃতা দেয়ার সময় আপনি আমাকে সময় বাড়িয়ে দিয়েছিলেন- এজন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আজও আপনিই অধিবেশনে রয়েছেন। ...সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল আগামীকাল সংসদে উঠবে। বিলটি বাহাত্তরের চেতনায় ফিরে যাওয়ার জন্যে...।”

কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী ৩০০ বিধিতে শুধু মন্ত্রীরা তাদের মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে বিবৃতি তুলে ধরতে পারেন। বিবৃতি দেয়ার আগে এর বিষয় সম্পর্কে স্পিকারকে অবহিতও করতে হয়।

কিন্তু জয়ের অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য শুনে অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত সাংসদের অনেকেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। কয়েকজনকে মুখে প্রশ্ন নিয়ে একে অন্যের দিকে তাকাতে দেখা যায়।

ডেপুটি স্পিকার এক পর্যায়ে উপমন্ত্রী জয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “আগামীকাল [ষোড়শ সংশোধন] বিলটি সংসদে পাস হবে। এ বিষয়ে আজকে কথা না বলাই সমীচীন। আপনাকে নিবৃত্ত থাকার অনুরোধ করছি। আপনি আপনার মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে বিবৃতি দিতে পারেন।”

জয় তখন বলতে থাকেন, “আমার বিবৃতিটি লেখা নয়। সংসদের শিষ্টাচার ও কার্যপ্রণালী বিধি মেনে আজ নিজের ভাবনা নিয়ে বিবৃতি দিচ্ছি। আমার ভাবনায় রয়েছে তা... ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে।”

তার এ বক্তব্য শুনে অধিবেশন কক্ষে হাসির রোল পড়ে যায়। জ্যেষ্ঠ একজন নেতা জয়কে উদ্দেশ্য করে বলেন, “কিছু লেখা রয়েছে? বিবৃতি দেয়ার কিছু না থাকলে বসে পড়।”

বিরোধী দলীয় প্রধান হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী অপর প্রান্ত থেকে বলেন, “আপনাদের হুইপরা কী করে? হুইপিং নেই?”

নৌ মন্ত্রী শাজাহান খান এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানও ইশারায় জয়কে বসতে বলেন।

এই পরিস্থিতির মধ্যেও উপমন্ত্রী বলতে থাকেন, “আমি আমার এলাকার জনগণের জন্য কিছু বলতে চাই। আমি একটা সুখবর দিতে চাই... আমি নতুন সাংসদ।”

এবার ডেপুটি স্পিকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জয়কে উদ্দেশ্য করে বলেন, “মাননীয় উপমন্ত্রী, আপনি বসেন। আপনি মনে হয় প্রস্তুত নন। আপনি চাইলে পরে প্রস্তুতি নিয়ে ৩০০ বিধিতে আগামীকাল বা পরশু বিবৃতি দিতে পারেন।”

এরপর তিনি জয়ের মাইক বন্ধ করে দেন। ফ্লোর জুড়ে তখনো হাসির রেশ।