বেবী মওদুদ: সৎ, সাহসী আর স্নেহময়ী একজন

ছেষট্টি বছরের জীবনে সাংবাদিকতা, লেখালেখি, রাজনীতি যেমন করেছেন, তেমনি সংগঠক ও অধিকারকর্মী হিসাবেও তিনি ছিলেন সোচ্চার।

মোহাম্মদ আব্দুল হালিমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 July 2014, 03:03 PM
Updated : 11 April 2019, 12:12 PM

প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর নিষ্ঠার জোরে বেবী মওদুদ হয়ে উঠেছিলেন সবার প্রিয় ‘বেবী আপা’।

দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে শুক্রবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যান এ এন মাহফুজা খাতুন বেবী মওদুদ।

মৃত্যুর দিনটি পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স এডিটর। আর এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীর ভাষায় তিনি ছিলেন, ‘সৎ, সাহসী আর অসম্ভব স্নেহময়ী একজন মানুষ’।

১৯৪৮ সালের ২৩ জুন কলকাতায় বাবা আবদুল মওদুদ এবং মা হেদায়েতুন নেসার ঘরে জন্ম নেন বেবী মওদুদ।

পরিবারে সবসময়ই ছিল একটা শিক্ষার আবহ। তার ওপর বাবা আবদুল মওদুদ ছিলেন নামকরা বিচারপতি। শিক্ষার এই পারিবারিক আবহই হয়তো বেবী মওদুদের চিন্তা-মননে আমৃত্যু একটা ছাপ ফেলেছিল।

সাফল্যের সাথে স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ষাটের দশকে বেবী মওদুদ পা রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায়। মুক্তিযুদ্ধের আগে অগ্নিগর্ভ সেই দিনগুলোতেই যোগ দেন ছাত্র রাজনীতিতে।  

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে বেবী মওদুদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য। একাত্তরে অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় আরেক মহিয়সী নারী বেগম সুফিয়া কামালের সঙ্গে কাজ করেন তিনি। 

বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের আগে ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র পরিষদের (রাওয়ালপিণ্ডি) আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন বেবী মওদুদ। ১৯৬৭-৬৮ মেয়াদে তিনি ছিলেন রোকেয়া হল ছাত্রী সংসদের সাহিত্য সম্পাদক।

১৯৯১ সাল থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন বেবী মওদুদ। সে সময় তাকে পুলিশের লাঠিপেটারও শিকার হতে হয়েছিল।

 

বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ঘনিষ্ঠ এই নারী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বান্ধবী। তার মৃত্যুর পর এক শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি আমার দীর্ঘদিনের একজন প্রিয় বন্ধুকে হারালাম।”

বিভিন্ন  অঙ্গনে পদচারণার পরও বেবী মওদুদের কাছে তার নিজের প্রথম পরিচয় ছিল তিনি একজন সাংবাদিক। 

২০১১ সালে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “সংসদ সদস্য হওয়ার কোনো আকাঙ্ক্ষা বা স্বপ্ন আমার ছিল না৷ এ নিয়ে আমি কখনও চিন্তা-ভাবনাও করিনি৷ আমি সবসময় একজন সাংবাদিক হিসেবে এদেশের রাজনীতি বলেন, সমাজ বলেন - এ নিয়ে যতোটা সচেতন থাকা যায়, যতোখানি সম্ভব কাজ করা যায় - তার চেষ্টা করেছি এবং করে যাচ্ছি৷”

ষাটের দশকে ইত্তেফাক ও চিত্রালীর সংবাদদাতা হিসেবে বেবী মওদুদের সাংবাদিকতা শুরু। এরপর ছিলেন সাপ্তাহিক ললনার রিপোর্টার ও সহকারী সম্পাদক।

সাপ্তাহিক রানার, দৈনিক আজাদ, দৈনিক গণবাংলা, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রায় বিভিন্ন দায়িত্বে কাজ করার পর ২০০৯ সালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে যোগ দেন তিনি।

২০০৯ সালে বঙ্গভবনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নতুন ওয়েবসাইট উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান।

 

২০১৩ সালের অক্টোবরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের যাত্রা শুরুর সাত বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে বেবী মওদুদ।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি একজন অধিকার কর্মী হিসাবেও বেবী মওদুদ সবসময় সোচ্চার ছিলেন। আমৃত্যু তিনি ছিলেন জাতীয় নারী ও শিশু উন্নয়ন পরিষদের সদস্য।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বেবী মওদুদ বাংলা একাডেমিরও আজীবন সদস্য ছিলেন।

সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ ও প্রতিবন্ধীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও কাজ করে গেছেন তিনি। এ বিষয়ে কয়েকটি বইও লিখেছেন। 

এছাড়া ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশে সাংবাদিক কল্যাণ ফান্ড ও বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য হিসাবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।

নবম জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য হওয়ার পাশাপাশি বেবী মওদুদ ছিলেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি এবং লাইব্রেরি কমিটির সদস্য।

দুই ছেলের জননী বেবী মওদুদ ভালোবাসতেন বই পড়তে। শখ ছিল গান শোনা আর নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো। আর ছোটবেলা থেকে লেখালেখি তো ছিলই।

তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ছোট গল্প ‘মনে মনে’; উপন্যাস ‘দুঃখ-কষ্ট-ভালোবাসা’; পাকিস্তানে বাংলাদেশের নারী পাচার (রিপোর্টাজ), নারী ভুবন (কলাম), অন্তরে বাহিরে (কলাম), ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা’; ‘বাংলাদেশের নারী বাংলাদেশের চলচ্চিত্র’; ‘বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার’; ‘নিভৃত যতনে’; ‘রোকেয়া টাফ’; ‘আমার রোকেয়া’; ‘চিরন্তন প্রতিকৃতি রোকেয়া’; ‘শেখ মুজিবের ছেলেবেলা’; ‘সষি পুষি টুষি’ (ছড়া); ‘দীপ্তর জন্য ভালোবাসা’; ‘টুনুর হারিয়ে যাওয়া’; ‘শান্তর আনন্দ’; ‘এক যে ছিল আনু’; ‘মুক্তিযোদ্ধা মাণিক’; কিশোর সাহিত্য সমগ্র এবং ‘আবু আর বাবু’ উল্লেখযোগ্য।