শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় বেবী মওদুদকে শেষ বিদায়

নিজের কাছে তার প্রথম পরিচয় ছিল তিনি একজন সাংবাদিক; প্রেসক্লাব ছিল তার কাছে বাড়ির মতোই। সেই জাতীয় প্রেসক্লাবেই সবার শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় শেষ বিদায় নিলেন এ এন মাহফুজা খাতুন বেবী মওদুদ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 July 2014, 04:58 PM
Updated : 26 July 2014, 02:35 PM

প্রবীণ সাংবাদিক, লেখক, নারী অধিকার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও সাবেক সাংসদ বেবী মওদুদ দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে শুক্রবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যান।  তিনি ছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স এডিটর।

জাতীয় প্রেসক্লাবে জানাজা ও শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন সাবেক এই সংসদ সদস্য।

এর আগে রাত সাড়ে ৯টার দিকে বেবী মওদুদের মরদেহ জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হলে সেখানে নেমে আসে শোকের ছায়া। তিনি ছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের স্থায়ী সদস্য।

দীর্ঘদিনের সহকর্মীদের অনেককেই এ সময় আবেগ আপ্লুত হয়ে উঠতে দেখা যায়। ‘স্নেহময়ী বেবী আপা’র জন্য চোখ মুছতে দেখা যায় ক্লাবের কয়েকজন কর্মচারীকেও।

প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীসহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কর্মীরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

২০১৩ সালের ২৩ অগাস্ট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম আয়োজিত ‘সংবাদে ঐশী: পুলিশ ও গণমাধ্যমের আচরণ’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বেবী মওদুদ।

শুক্রবার রাতে জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিক এ এন মাহফুজা খাতুন বেবী মওদুদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ছবি: নয়ন কুমার/ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

 

প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে জানাজার পর বেবী মওদুদের কফিনে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানান তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল জয়নাল আবেদীন।

তিনিই বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানার পক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিলও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

এরপর স্পিকার শিরীন শারমীন চৌধুরী, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এবং তথ্য কমিশনার সাদেকা হালিম এই সাবেক সাংসদের কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

এছাড়া সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও প্রকাশকদের সংগঠনের পক্ষ থেকেও আলাদাভাবে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়।

অন্যদের মধ্যে সিপিবির উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য মনজুরুল আহসান খান, আওয়ামী লীগ নেতা নূহ-উল আলম লেনিন ও জাহাঙ্গীর কবির নানক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব ইহসানুল করীম হেলাল, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এ কে এম শামীম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন জানাজায় অংশ নেন।

সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক হাবিবুর রহমান মিলন, জগলূল আহমেদ চৌধুরী, শফিকুর রহমান, ফরিদ হোসেন, আজিজুল ইসলাম ভুঁইয়া, বাসসের প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, মহাসচিব এম এ আজিজ, আবদুল জলিল ভুঁইয়া, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আলতাফ মাহমুদ, সাধারণ সম্পাদক কুদ্দুস আফ্রাদ, জাহাঙ্গীর আলম প্রধান, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি শাহেদ চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খানও অংশ নেন জানাজায়।

সাংবাদিক ও সাবেক সাংসদ এ এন মাহফুজা খাতুন বেবী মওদুদ শুক্রবার রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা যান। দীর্ঘদিনের বন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: তানভীর আহমেদ/ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

সাংবাদিক ও সমাজ কর্মী বেবী মওদুদ শুক্রবার ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা গেলে তাকে শেষবারের মত দেখতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। ছবি: তানভীর আহমেদ/ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

 

এর আগে বিকালে বেবী মওদুদের মৃত্যুর খবর পেয়েই ইউনাইটেড হাসপাতালে ছুটে যান তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বান্ধবী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এক শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি আমার দীর্ঘদিনের একজন প্রিয় বন্ধুকে হারালাম।”

হাসপাতাল থেকে বেবী মওদুদের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার ধানমণ্ডির বাসায়। সেখানে এশার নামাজের আগে এবং পরে ধানমণ্ডির ঈদগাহ মসজিদে দুই দফা জানাজা হয়। তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এরপর কফিন নিয়ে যাওয়া হয় প্রেসক্লাবে।

জাতীয় প্রেসক্লাবে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে রাত পৌনে ১১টায় বেবী মওদুদকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স বনানী কবরস্থানে পৌঁছায়। সেখানেই স্বামী অ্যাডভোকেট মো. হাসান আলীর কবরে তাকে দাফন করা হয়।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পুলিশ মহা পরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার, বেবী মওদুদের পরিবারের সদস্য এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কর্মীরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

আগামী শুক্রবার ১ অগাস্ট ধানমণ্ডির বাসায় বেবী মওদুদের কুলখানি হবে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

বেবী মওদুদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালের ২৩ জুন, কলকাতায়। তার বাবা আবদুল মওদুদ ছিলেন একজন বিচারপতি। আর মায়ের নাম হেদায়েতুন নেসা। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।

১৯৬০ এর দশক থেকে সাংবাদিকতায় জড়িত বেবী মওদুদ দৈনিক সংবাদ, বিবিসি, দৈনিক ইত্তেফাক, বাসস ও সাপ্তাহিক বিচিত্রায় দীর্ঘদিন কাজ করার পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে যোগ দেন।

মুক্তিযুদ্ধের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকার দিনগুলোতেই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হন বেবী মওদুদ। নব্বইয়ের দশকে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনেও তিনি সোচ্চার ছিলেন।

নবম জাতীয় সংসদে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংরক্ষিত নারী আসন থেকে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এবং লাইব্রেরি কমিটির সদস্য হিসাবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৬৭ সাল থেকে সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করেছেন বেবী মওদুদ। লিখেছেন শিশু-কিশোরদের জন্যও। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ সম্পাদনাতেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বইও রয়েছে তার।

নারী অধিকারের পক্ষে সোচ্চার বেবী মওদুদের কাজ রয়েছে প্রতিবন্ধীসহ সমাজের সুবিধাবঞ্চিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। এ বিষয়ে কয়েকটি বইও লিখেছেন তিনি।