সাত খুনের ঘটনা তদন্তে আদালতের নির্দেশে গঠিত প্রশাসনিক তদন্ত কমিটিতে দেয়া বক্তব্যে নিহতদের স্বজনরা হত্যাকাণ্ডের জন্য র্যাবকে দায়ী করেছেন।
Published : 10 May 2014, 08:32 PM
নূর হোসেনকে ‘ক্রসফায়ারে’ না দেয়ার দাবি
৭ খুন: চাকরি গেল সেই ৩ র্যাব কর্মকর্তার
র্যাব-১১ এর চাকরিচ্যুত তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনার দাবিও জানিয়েছেন তারা।
শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নিহত সাতজনের পরিবারের ২৫ সদস্যের সঙ্গে কথা বলার পর তদন্তের ‘স্বার্থে’ কোনো কথা সাংবাদিকদের বলতে রাজি হয়নি তদন্ত কমিটি।
র্যাব-১১ এর তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার বা জিজ্ঞাসাবাদ না করলে তদন্ত এগোবে কি না- জানতে চাইলে সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি তদন্ত কমিটির প্রধান শাহজাহান আলী মোল্লা।
চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডে র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর হাই কোর্টের নির্দেশে গত বুধবার সাত সদস্যের এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, যাদের সাতদিনের মধ্যে অগ্রগতি জানাতেও বলা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার অপহরণ এবং লাশ উদ্ধারের স্থান পরিদর্শনের পর শনিবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তদন্ত কমিটির সদস্যরা নিহতদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন।
তদন্ত কমিটিতে ব্ক্তব্য দিতে প্রথম যান নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি, ভাই আব্দুস সালাম ও শ্বশুর শহীদুল ইসলাম (শহীদ চেয়ারম্যান)।
সাক্ষ্য দিয়ে বেরিয়ে শহীদুল সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা তদন্ত কমিটিকে বলেছি, এই ঘটনায় র্যাব জড়িত। আমরা জড়িত র্যাব সদস্যদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছি।”
র্যাবের কারো নাম বলেছেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, র্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মাহমুদ, মেজর আরিফ হোসেন ও র্যাব-১১ নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্প অফিসের অধিনায়ক এম এম রানার নাম বলে এসেছেন তিনি।
৩০ এপ্রিল লাশ উদ্ধারের দুদিন পর শহীদুল অভিযোগ করেন, নূর হোসেন ৬ কোটি টাকা দিয়ে র্যাবের মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
অপহরণের পর সামরিক বাহিনীর ওই তিন কর্মকর্তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রত্যাহার করা হয়। শহীদুলের অভিযোগের পর তাদের চাকরি থেকে অবসরে পাঠানো হয়। এদের একজন তারেক সাঈদ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর জামাতা।
শহীদুল সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ও তার পরিবার এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাকে হুমকি দেয়া হচ্ছে।
তবে কে হুমকি দিচ্ছে তা তিনি বলেননি। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার পরই পুলিশের নিরাপত্তায় গাড়িতে চড়ে শহীদ চেয়ারম্যান বাড়িতে পথে রওনা হন।
নজরুল পরিবারের পর সাক্ষ্য দিতে যান আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারের দুই মেয়ে সুস্মিতা সরকার ও সেজুতি সরকার। নিহতের জামাতা রঞ্জিত দেবনাথ ও বিজয় কুমার পালও তাদের সঙ্গে ছিলেন।
বিজয় পাল সাংবাদিকদের বলেন, “তদন্ত কমিটি আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিল, আমরা কাউকে সন্দেহ করি কি না? আমরা বলেছি, ঘটনার শুরু থেকে হত্যার ধরন থেকে আমাদের মনে হচ্ছিল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ এর সঙ্গে জড়িত।
“কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও তথ্য উপাত্ত দেখে আমাদের মনে হয়েছে, এর সঙ্গে র্যাব-১১ জড়িত।”
২৭ এপ্রিল আদালত প্রাঙ্গণ থেকে নজরুল চার সহযোগী নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলেন চন্দন সরকার। পরে নজরুলদের সঙ্গে চন্দন ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিমের লাশ পাওয়া যায়।
চন্দনের পরিবারের ধারণা, অপহরণের ঘটনা দেখে ফেলায় এই আইনজীবী ও তার গাড়িচালককেও হত্যা করা হয়।
তদন্ত কমিটিতে বক্তব্য দিয়ে বেরিয়ে ইব্র্রাহিমের স্ত্রী হনুফা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা শুনেছি আমার স্বামীসহ ৭ জনকে হত্যার ঘটনায় প্রশাসনের লোকজন জড়িত। আমার স্বামী কিছুই জানত না, স্যারের গাড়ি চালাতে গিয়ে সে মারা গেছে।”
হনুফার সঙ্গে ইব্রাহিমের বাবা আবদুল ওহাব মিয়া, ছেলে রনি, বোন রহিমা, ভাগ্নে শাকিলও তদন্ত কমিটির সামনে উপস্থিত হন।
সেদিন আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর নজরুলের গাড়ি চালাচ্ছিলেন মো. জাহাঙ্গীর। ওই গাড়িতে ছিলেন শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদের সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কমিটির সহসভাপতি তাজুল ইসলাম, ৭নং ওয়ার্ড যুবলীগকর্মী মনিরুজ্জামান স্বপন ও সিরাজুল ইসলাম লিটন। তারা নজরুলের বন্ধু ছিলেন।
স্বপনের পরিবারের পক্ষে বক্তব্য দিতে উপস্থিত হন তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আলী খান, স্ত্রী মোর্শেদা বেগম, ভাই রিপন। স্বপনের দুই শিশুকন্যাও ছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে।
রিপন সাংবাদিকদের বলেন, আদমজী ইপিজেডের ব্যবসা নিয়ে নজরুলের সঙ্গে নূর হোসেনের দ্ব›দ্ব ছিল। কয়েক মাস আগে ঝুটভর্তি তিনটি গাড়ি নূর হোসেনের সহযোগীরা নিয়ে যায়।
“তার পর থেকে ভাই (স্বপন) বলত , ‘নজরুল ভাই বিপদে আছে, আমিও বিপদে আছি, যে কোনো সময় কিছু একটা হয়ে যেতে পারে’।”
জাহাঙ্গীরের পরিবারের পক্ষে অন্তসত্ত্বা স্ত্রী সামসুন্নাহার নুপুর, মা মেহেরুন নেছা, ভাই শাহজাহান সাজু, শাহবুদ্দিন বক্তব্য দেন।
তাজুলের পরিবারের পক্ষে ছিলেন তার মা তাসলিমা, বাবা আবুল খায়ের, ভাই সাইফুল ইসলাম রাজু। লিটনের পরিবারের পক্ষে তার বড় ভাই রফিকুল ইসলাম, ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম মিন্টু বক্তব্য দেন।
সবার সাক্ষ্য নিয়ে বেরিয়ে আসার পথে তদন্ত কমিটির প্রধান শাহজাহান মোল্লা অপেক্ষমান সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা নিহত ৭ জনের পরিবারের ২৫ জনের সঙ্গে কথা বলেছি। তদন্তের স্বার্থে সেসব বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না।”
১২ ও ১৫ মে গণশুনানি
শাহজাহান মোল্লা নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের এই তদন্ত কমিটি আগামী ১২ ও ১৫ মে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গণশুনানি নেবেন, যাতে এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে যে কেউ সাক্ষ্য দিতে পারবেন।
জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দুই দিনই সকাল ১০টা থেকে সাক্ষ্য নেয়া হবে।
বিএনপির প্রতিবাদ
নারায়ণগঞ্জে হত্যা, গুম ও খুনের প্রতিবাদে পুলিশের বাধায় সমাবেশ করতে না পেরে মুখে কালো কাপড় বেঁধে মানববন্ধন করেছে বিএনপি।
বিএনপি ১৪ মে খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জে সভা করতে চাইলেও প্রশাসন অনুমতি দেয়। এর প্রতিবাদে দুপুরে সমাবেশ করতে চাইলে তাতেও পুলিশ বাধা দেয়।
নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামাল বলেন, “সকাল থেকেই বিপুল সংখ্যক পুলিশ দলীয় কার্যালয় ঘিরে রাখে। তারা সমাবেশের মাইক ও ব্যানার নিয়ে যায়।”
এই বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি মঞ্জুর কাদের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সড়কে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় বিএনপিকে সমাবেশ করতে দেয়া হয়নি।”
আইনজীবীদের কর্মসূচি স্থগিত
র্যাব কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনার প্রশাসনের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব-১১ কার্যালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচি স্থগিত করেছেন নারায়ণগঞ্জের আইনজীবীরা।
রোববারের ওই কর্মসূচি স্থগিত করলেও ওই দিন দুপুরে আদালত চত্বরে মানববন্ধন ও কালো ব্যাজ ধারণ কর্মসূচি পালন করবেন বলে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন।
এদিকে নারায়ণগঞ্জে হত্যা, গুম ও অপহরণের ফলে জনমনে আতঙ্ক দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবিতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে স্মারকলিপি দিয়েছে হিউম্যান রাইটস ফর পিস ফর বাংলাদেশ।
দুপুরে সংগঠনের সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ এবং সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী এই স্মারকলিপি দেন। জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতিও এসময় উপস্থিত ছিলেন।