খুন করে ইট বেঁধে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল তাদের

অপহরণের তিন দিন পর নারায়ণগঞ্জের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ ছয়জনের লাশ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকও নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 April 2014, 06:52 PM
Updated : 1 May 2014, 11:31 AM

বুধবার দুপুরের পর বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের শান্তিনগর এলাকা সংলগ্ন নদীতে কয়েকটি লাশ ভাসতে দেখে স্থানীয়রা পুলিশে খবর দেয়।

এরপর পুলিশ গিয়ে নদীর এক কিলোমিটারের মতো এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে একে একে ছয়টি লাশ তুলে আনে। পরে যার যার স্বজনরা লাশগুলো সনাক্ত করে। 

নিহত সবারই হাত-পা বাঁধা ছিল, পেটে ছিল আঘাতের চিহ্ন। ১৮টি ইট এক-একটি বস্তায় ভরে একটি লাশের সঙ্গে দুটি বস্তা বেঁধে তাদের ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল।

গত রোববার অপহৃত এই ব্যক্তিদের জীবিত উদ্ধারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের আশা প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ছয়জনের লাশের সন্ধান মিলল।

লাশ উদ্ধারের পর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে গণভবনে ডেকে নিয়ে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন।

এই অপহরণের ঘটনায় গত ‍দুদিনে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, র‌্যাবের সিও এবং দুটি থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়।

এদিকে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর নজরুলের লাশ উদ্ধারের পর বিকালে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নেমে আসে তার সমর্থকরা, ফলে বন্ধ হয়ে যায় গাড়ি চলাচল। ভাংচুরের পাশাপাশি একটি পেট্রোল পাম্পে আগুনও ধরিয়ে দেয়া হয়।

অপহরণের প্রতিবাদে প্রায় প্রতিদিন সড়ক অবরোধ করছিল এই কাউন্সিলরের সমর্থকরা। বুধবার তাদের বিক্ষোভ হয় হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে।

নজরুল (৪৪) ও চন্দন সরকার (৬০) ছাড়া নিহতরা হলেন-শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদের সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কমিটির সহসভাপতি তাজুল ইসলাম, ৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগকর্মী মনিরুজ্জামান স্বপন ও লিটন এবং চন্দনের গাড়িচালক মো. ইব্রাহিম। তাদের সবার বয়স ৪০ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য নজরুল সিটি কর্পোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন।

আওয়ামী লীগের এই নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় জোড়া খুনের অভিযোগসহ অন্তত ১৫টি মামলা এবং বহু সাধারণ ডায়রি (জিডি) রয়েছে।

ঢাকার ধানমণ্ডিতে অ্যাডভোকেট বাবর আলী হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে নজরুলের ফাঁসির দণ্ড হলেও উচ্চ আদালত থেকে তিনি বেকসুর খালাস পান। 

গত রোববার একটি মামলায় নারায়ণগঞ্জের আদালতে হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন নজরুল। দুপুরের পর তিন সঙ্গীকে নিয়ে প্রাইভেটকার নিয়ে বের হন তিনি, গাড়ি চালাচ্ছিলেন জাহাঙ্গীর।

আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে ওঠার পরপরই এই পাঁচজনকে অপহরণ করা হয়। ওই সময় থেকে নিখোঁজ ছিলেন অ্যাডভোকেট চন্দন ও তার গাড়িচালক।   

আইনজীবীর গাড়িটি নজরুলের গাড়ির পরপরই আদালতপাড়া থেকে বেরিয়েছিল জানিয়ে চন্দনের পরিবার ধারণা করে আসছিল, কাউন্সিলের অপহরণের ঘটনা দেখে ফেলায় হয়তো তাদেরও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।

অপহরণের রাতে নজরুলের গাড়িটি গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরে শালবনের পাশে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। চন্দন সরকারের গাড়ি পাওয়া যায় পরদিন ঢাকার গুলশানে। 

গাড়ি উদ্ধার হলেও তার আরোহী এই সাতজনের কোনো সন্ধান মিলছিল না।

এর দুই সপ্তাহ আগে পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিকও অপহৃত হয়েছিলেন একই সড়ক থেকে, ৩৫ ঘণ্টা পর তিনি ছাড়া পান।

লাশ উদ্ধার, সনাক্ত

গত রোববার অপহৃত হওয়ার পর থেকে তার অনুসন্ধানে পুলিশ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কারা এতে জড়িত সেই বিষয়ে কোনো তথ্য জানা যাচ্ছিল না।

নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি স্বামীকে উদ্ধারে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা চেয়ে আসছিলেন।

এর মধ্যে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন,অপহরণকারীদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে এবং তিনি আশা করছেন শিগগিরই অপহৃতরা উদ্ধার হবেন।

এর ঘণ্টা খানেক পর বেলা ৩টায় বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের শান্তিনগর এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে লাশ ভাসার খবর যায় থানায়। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ যায়, আশঙ্কা থেকে নজরুলের স্বজনরাও ছুটে যান সেখানে।

এরপর নৌকায় করে পুলিশ নদীতে নেমে সন্ধ্যা পর্যন্ত কচুরীপানার মধ্য থেকে একে একে ছয়টি তুলে আনে।

প্রতিটি লাশের হাত-পা বাঁধা ছিল এবং লাশ যাতে নদীতে ডুবে থাকে সেজন্য বস্তার মধ্যে ইট ঢুকিয়ে দেহের সঙ্গে বেঁধে দেয়া হয়েছিল।

প্রথমে পাজামা-পাঞ্জাবি পরা এবং মুখে দাড়ি আছে এমন একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তার দুই হাত পিঠের দিকে নিয়ে বাঁধা ছিল। পেটের ফেঁড়ে নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসছিল।

লাশ অর্ধগলিত অবস্থায় ছিল বলে পুলিশ তা থেকে নজরুলকেও চিনতে পারছিল না বলে সাংবাদিকদের জানান ঘটনাস্থলে থাকা বন্দর থানার পরিদর্শক মোকাররম হোসেন।

লাশের অবস্থা কী- জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা মোকারম বলেন, “সবারই হাত-পা বাঁধা ছিল এবং পেটে জখম ছিল, যা থেকে নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসছিল। এটা বলা যায় যে তারা হত্যাকাণ্ডের শিকার।”

এর মধ্যে একটি কাউন্সিলর নজরুলের বলে নদী তীরেই সনাক্ত করেন তার ভাই আব্দুস সালাম। পরনের পাঞ্জাবি দেখে সালাম তার ভাইকে চিনেছেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান বন্দর থানার ওসি আকতার মোরশেদ।

অন্য লাশগুলো নিয়ে যাওয়া হয় নারায়ণগঞ্জ সদর (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতাল মর্গে।

সেখানে স্বপনের লাশ সনাক্ত করে তার ভাই রিপন। তাজুলের লাশ সনাক্ত করে তার ভাই আনিস। ইব্রাহিমের লাশ সনাক্ত করেন তার ভাগ্নে আবু বকর ও সাঈদ। লিটনের লাশও তার স্বজনরা সনাক্ত করেন।

মর্গে চন্দন সরকারকে সনাক্ত করেন এই আইনজীবীর মেয়ে অপর্না সরকার এবং ভাগ্নে অ্যাডভোকেট প্রিয়তম দে।

প্রিয়তম দে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাতে আংটি এবং ব্রেসলেট দেখে বুঝেছি।”

পরে মর্গে লাশগুলোর সুরতহাল হয়। এরপর গভীর রাতে সিটি কর্পোরেশন মাঠে নজরুলের জানাজা হয়। 

ব্যক্তিগত আক্রোশে হত্যা?

নজরুল অপহরণের পরপরই স্ত্রী ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নূর হোসেন এবং সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. ইয়াসিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন।

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান বলেছেন,  জমিজমাসহ বিভিন্ন বিষয়ে দ্বন্দ্ব থেকে ব্যক্তিগত আক্রোশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন।

সেলিনা রোববার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “নূর হোসেন ও ইয়াসিন এলাকায় জমি দখল, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজির করে আসছিলেন। আমার স্বামী এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করার কারণেই তাকে কয়েকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল।”

তার বক্তব্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সিটি কর্পোরেশনের একটি রাস্তা প্রশস্তকরণ কাজকে কেন্দ্র করে নূর হোসেনের ফুফাতো ভাই মোবারকের সঙ্গে নজরুলের বিরোধ ও বাগবিতণ্ডা হয়।

ওই ঘটনার পর নূর হোসেনের আত্মীয় মোবারক বাদী হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় নজরুলের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। সেই মামলায় নিম্ন আদালতে হাজির হয়ে জামিন নেয়ার পরপরই নজরুল অপহৃত হন।

সেলিনার দাবি, এই অপহরণকাণ্ডে নূর হোসেনেরও হাত রয়েছে।

নূর হোসেনের সঙ্গে সেদিন যোগাযোগ করা হলে তিনি নজরুলের স্ত্রীর অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমি এই ঘটনায় কোনোভাবে সম্পৃক্ত নই।”

এরপর থেকে এই দুই আওয়ামী লীগ নেতার কেউই প্রকাশ্যে আসছেন না।

দলীয় কোন্দলের বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের নেতা এ কে এম শামীম ওসমান সেদিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “নূর হোসেন ও নজরুল ইসলামের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকতে পারে, কিন্তু এ নিয়ে অপহরণ ও গুমের মতো ঘটনা ঘটতে পারে বলে আমার মনে হয় না।”

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বুধবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে গণভবন থেকে বেরিয়ে আসার পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা রাজনৈতিক কারণে ঘটেনি। যতদূর জেনেছি, জমিজমাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে।”

এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত কঠোর জানিয়ে তিনি বলেন, “যাদের নাম এসেছে, তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করা হবে।”

নজরুলের পরিবারের করা মামলায় তাদের আসামিও করা হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। পরিবার তো অলরেডি মামলা করেছে।”

অপহরণের পর থেকে প্রতিদিনই বিক্ষোভ করে আসছিলেন নজরুলের সমর্থকরা। লাশ পাওয়ার পর মহাসড়ক আটকে বিক্ষোভের সময় তারা নূর হোসেন ও ইয়াসিনের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। ইয়াসিনের মালিকানাধীন একটি পেট্রোল পাম্পে আগুনও দেন তারা।