বিরোধী জোট নতুন করে হরতাল ঘোষণার পর বিএনপির তিন শীর্ষ নেতাসহ খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও বিশেষ সহকারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
Published : 09 Nov 2013, 02:50 AM
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বড় দুই দলের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মধ্যে শুক্রবার ছুটির দিনে এই ঘটনাপ্রবাহে আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের রাজনীতি।
রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে রাতেই ভাংচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। রোববার থেকে সারা দেশে ৭২ ঘণ্টা হরতালের আগেই শনিবার হরতাল ডাকা হয়েছে পাঁচ জেলার বিভিন্ন উপজেলায়।
বিএনপি বলছে, শীর্ষ নেতাদের অবিলেম্বে মুক্তি দেয়া না হলে হরতাল আরো দীর্ঘায়িত হবে। এই হুমকির পর জনমনে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আরো বেড়েছে।
অন্যদিকে তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, হরতাল ঘিরে বিরোধী দলের নাশকতার প্রেক্ষাপটে সরকার গ্রেপ্তারের মতো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে।
আরো তিন দিন হরতাল
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দুই সপ্তাহে তিন দিন করে ছয় দিন হরতালের পর শুক্রবার বিকালে ১৮ দলীয় জোটের মহাসচিবদের বৈঠক শেষে আরো ৭২ ঘণ্টার হরতালের ঘোষণা দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
রোববার ভোর ৬টা থেকে শুরু হয়ে বুধবার ভোর ৬টা পর্যন্ত এই হরতাল চলবে।
তিনি বলেন, “নির্দলীয় সরকারের দাবিতে ইতোমধ্যে আমরা দুই দফায় হরতাল করেছি। কিন্তু সরকার তাতে কোনো সাড়া দেয়নি। সেজন্য বাধ্য হয়ে আমরা আবার কঠোর কর্মসূচি দিয়েছি।”
জোটের ওই বৈঠকের পর বিকাল ৫টার দিকে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয় ঘিরে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। নিরাপত্তা বাড়ানো হয় খালেদা জিয়ার বাসার আশেপাশেও।
মহানগর পুলিশের গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার নুরুল আমীন বলেন, “বিরোধী দলীয় নেতার নিরাপত্তার স্বার্থেই নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।”
পাঁচজন গ্রেপ্তার
হরতালের ঘোষণার পর রাত সোয়া ৮টার দিকে কারওয়ান বাজারে হোটেল সোনারগাঁওয়ের সামনে থেকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার ও রফিকুল ইসলাম মিয়াকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ।
এছাড়া উত্তরায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জমিরউদ্দিন সরকারের বাসায়, শাজাহানপুরে মির্জা আব্বাস, পুরান ঢাকায় গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ধানমন্ডিতে ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল মান্নান ও মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক নাসিরউদ্দিন অসীমসহ বেশ কয়েকজন নেতার বাসায় পুলিশ তল্লাশি চালায়। বিভিন্ন স্থানে পুলিশি নিরাপত্তাও বাড়ানো হয়।
বিএনপির তিন নেতাকে কোন মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা না জানালেও মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার মাসুদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আগামীকাল তাদের আদালতে হাজির করা হবে।
এদিকে মধ্যরাত পেরিয়ে যাওয়ার পর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সনের বাসার সামনে থেকে গ্রেপ্তার হন তার উপদেষ্টা ও ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আওয়াল মিন্টু এবং খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী সামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস।
মওদুদ, আনোয়ার ও রফিকের মতো তাদেরও নিয়ে যাওয়া হয় মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে।
গাড়িতে আগুন, অবরোধ
বিএনপি নেতারা গ্রেপ্তার হওয়ার পরপরই রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মিরপুর ও আরামবাগে তিনটি গাড়ি পোড়ানো হয়। ফার্মগেইটে ফাটানো হয় হাতবোমা।
রাত পৌনে ১১টার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে যানবাহনে ভাংচুর চালায় বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়াও ঘটে।
তিনি বলেন, বাড়তি পুলিশ গিয়ে রাত ৩টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে রাতেই ভোলা ও পাবনা জেলা, কুমিল্লার হোমনা ও তিতাস উপজেলা; নোয়াখালীর সদর পূর্বাঞ্চল, কবিরহাট ও কোম্পানীগঞ্জে এবং ফেনীর দাগনভূইয়া উপজেলায় শনিবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকে স্থানীয় বিএনপি।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ ও কবিরহাটে অটোরিক্শা, বাস, ট্রাক ও মটরসাইকেল ভাংচুর করা হয়। এছাড়া জেলা শহরের পৌর বাজারের সামনে বিএনপি কর্মীরা একটি বাসে আগুন দেয় বলে পুলিশ জানায়।
আরো হরতালের হুমকি
শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার হওয়ার দুই ঘণ্টার মাথায় রাত ১০টার দিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
তিনি বলেন, “স্বৈরাচারী সরকার একতরফা প্রহসনের নির্বাচন করার জন্য দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তার করেছে। এই মুহূর্তে তাদের মুক্তি দিন। নইলে আমাদের ঘোষিত ৭২ ঘণ্টার হরতাল কর্মসূচি আরো জোরদার করা হবে, বৃদ্ধি পাবে।”
তিনি ৭২ ঘণ্টার হরতাল সফল করতে দলের নেতা-কর্মী ও দেশবাসীকে রাস্তায় নেমে আসার আহবান জানান।
অন্যদিকে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হরতালের আগে ‘অগ্নিসংযোগ ও অন্তর্ঘাতমূলক’ যেসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে, তা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শামিল।
“নাশকতা ও অন্তর্ঘাতমূলক কাজ থেকে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে সরকার।”
ইনু বলেন, “সংলাপ যখন কার্যকর রূপ নিতে চলেছে, তখন ৩দিন-৩দিন ৬ দিন হরতালের পর আবার ৩ দিনের হরতাল অমানবিক, মানবতাবিরোধী, শিক্ষাবিরোধী এবং দেশবিরোধী।”
পিছিয়ে যাচ্ছে পরীক্ষা
নতুন করে ৭২ ঘণ্টার হরতালের ঘোষণার পরপরই চলমান জেএসসি ও জেডিসির ওই তিন দিনের পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়ার কথা জানান আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তাসলিমা বেগম।
তিনি বলেন, পরীক্ষার নতুন তারিখ শনিবার জানিয়ে দেয়া হবে।
হরতালের কারণে স্থগিত করা হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাও। ১০ থেকে ১৪ নভেম্বর এই পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মিজানউদ্দিন জানান, শনিবার ভর্তি কমিটির বৈঠকের পর ভর্তি পরীক্ষার সংশোধিত সময়সূচি জানিয়ে দেয়া হবে।
দশম সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে চায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দল। তবে তা মানতে নারাজ আওয়ামী লীগের প্রস্তাব নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার।
এই পরিস্থিতিতে কূটনীতিকসহ বিভিন্ন মহলের সংলাপের তাগিদের মধ্যে গত ২৬ অক্টোবর খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে আলোচনার আমন্ত্রণ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
হরতালের মধ্যে সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে অসম্মতি জানিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা বলেছিলেন, হরতাল শেষে আলোচনা করতে তিনি রাজি।
এরপর দুই পক্ষ নতুন করে আলোচনার উদ্যোগ নিতে পরস্পরকে বলে আসছে।
এর মধ্যে বিরোধী দল নতুন করে হরতালের ডাক দিলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, সংলাপ চাইলে আর কখনো হরতাল না করার ঘোষণা দিতে হবে। অন্যদিকে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।