বৈধ কাগজ দেখাতে পারেনি আপন, এক সপ্তাহ সময়

শুল্ক গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে সাড়ে ১৩ মণ স্বর্ণালঙ্কার ও ৪২৭ গ্রাম হীরার মজুদের কোনো বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেননি আপন জুয়েলার্সের তিন মালিক।

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 May 2017, 02:07 PM
Updated : 17 May 2017, 02:26 PM

আর অবৈধভাবে মদ রাখা ও শুল্ক ফাঁকির অভিযোগের মুখে থাকা বনানীর রেইনট্রি হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অসুস্থতার কথা বলে সময়ের আবেদন পাঠিয়েছেন আইনজীবীর মাধ্যমে।

দুই পক্ষকেই আগামী ২৩ মে আবার শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়েছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে।

আপন জুয়েলার্সের তিন মালিক দিলদার ও তার দুই ভাই গুলজার আহমেদ ও আজাদ আহমেদকে বুধবার বেলা ১২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান।

তিনি বলেন, গত ১৪ ও ১৫ মে গুলশান ডিসিসি মার্কেট, গুলশান এভিনিউ, উত্তরা, মৌচাক ও জিগাতলার সীমান্ত স্কয়ারে আপন জুয়েলার্সের শাখায় অভিযান চালিয়ে প্রায় সাড়ে ১৩ মণ স্বর্ণালঙ্কার ও ৪২৭ গ্রাম হীরার গয়না আটক করা হয় সেগুলোর বৈধ উৎসের কাগজপত্র দেখাতে না পারার কারণে।

“তিনজন মালিক আজও বৈধ কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। তারা আরও ১৫ দিন সময় চেয়ে লিখিত আবেদন করেছেন। শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও দলিল সংগ্রহ করে আগামী ২৩ মে বেলা ২টায় তাদের সশরীরে উপস্থিত হয়ে মজুদ স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের ব্যাপারে শুনানিতে অংশ নিতে নির্দেশ দিয়েছে।”

প্রাথমিকভাবে যেসব অভিযোগে আপন জুয়েলার্সে অভিযান চালানো হয়েছিল, ‘তা প্রমাণিত হয়েছে’ বলে দাবি করেন শুল্ক গোয়েন্দা প্রধান।

শুল্ক গোয়েন্দা দপ্তরে দিলদার আহমেদ ও তার দুই ভাই

‘অন্যায় কিছু করিনি’

জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বেরিয়ে এসে আপনের অন্যতম মালিক দিলদার আহমেদ সাংবাদিকদের সামনে দাবি করেন, কোনো দোষ তিনি করেননি। 

“সারা দেশের লোক যেভাবে ব্যবসা করে আমিও সেভাবে করছি। আমরা কোথাও অন্যায় অবৈধ ব্যবসা করি না। আমাদের কাছে যেসব কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে সেগুলো দেওয়ার জন্য সময় চেয়েছি। আমি যদি কোনো অন্যায় করে থাকি, দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।”

শুল্ক গোয়েন্দারা বিক্রয় কেন্দ্রের ভল্টে গয়না সিল গালা করে রাখায় ব্যবসা করতে পারছেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে আপন মালিকদের। 

বনানীর ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি সাফাত আহমেদের বাবা দিলদার বলেন, “ব্যক্তিগতভাবে আমার দোকান বন্ধ হলে সারাদেশে সবার দোকান বন্ধ করা উচিত। আমি জুয়েলার্স সমিতির সেক্রেটারি ছিলাম। অনেক নীতিমালা করতে চেয়েও পারিনি। এখানে নীতিমালা থাকা দরকার, জবাবদিহিতা থাকা দরকার।”

সময়ের আবেদন দেওয়ার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন রেইনট্রি হোটেলের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির

রেইনট্রির আদনান ‘হঠাৎ অসুস্থ’

শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর আপন মালিকদের সঙ্গে বুধবার একই সময়ে বনানীর রেইনট্রি হোটেল কর্তৃপক্ষকে তলব করেছিল।

কিন্তু ওই হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এইচ এম আদনান হারুনের পক্ষে আইনজীবী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির ও রিয়াজ আহমেদ কাকরাইলে শুল্ক গোয়েন্দা দপ্তরে এসে এক মাসের সময়ের আবেদন জমা দেন।

পরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় জাহাঙ্গীর কবির সাংবাদিকদের বলেন, সকালে হঠাৎ আদনান হারুনের ‘রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ায়’ তিনি আসতে পারেননি।

“এ বিষয়টি জানিয়ে আমরা সময়ের আবেদন করেছিলাম। উনারা সময় মঞ্জুর করে ২৩ মে আসতে বলেছেন।”

আগের দিনও রেইনট্রি হোটেলের সংবাদ সম্মেলনে আসা আদনানের অসুস্থতার বিষয়ে কোনো চিকিৎসা সনদ জমা দেওয়া হয়নি বলে জানান এই আইনজীবী। 

শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের মহাপরিচালক মইনুল খান বলেন, “রেইনট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অসুস্থতার কথা বলে এখানে আসেননি। কিন্তু তার পক্ষে কোনো কাগজপত্রও আইনজীবীরা দেখাতে পারেননি। আগামী ২৩ মে বেলা ১১টায় তাদের আসতে বলা হয়েছে। সেদিন না এলে শুল্ক গোয়েন্দা দপ্তর একতরফাভাবেই শুনানির নিষ্পত্তি করবে।”

আপনের জন্য নির্দেশনা

মইনুল খান জানান, আপন জুয়েলার্সের বিপুল পরিমাণ সোনা ও হীরা গয়না আটক রাখা হলেও গ্রাহক ও তদন্তের স্বার্থে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

>> আপন জুয়েলার্সের বিভিন্ন শাখায় মেরামত ও পরিবর্তনের জন্য যারা ‘অক্ষত অবস্থায় অলঙ্কার গচ্ছিত রেখেছিলেন’, তারা ২২ মে বেলা ২টায় সংশ্লিষ্ট শাখায় উপস্থিত হয়ে রশিদ দেখিয়ে সেসব গয়না ফেরত নিতে পারবেন।

আপন জুয়েলার্সের মালিকপক্ষ এ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট গ্রাহকদের জানিয়ে দেবে।

তবে আটক সাড়ে ১৩ মণ স্বর্ণালঙ্কারে মধ্যে গ্রাহকদের গচ্ছিত স্বর্ণের পরিমাণ ১০ কেজির বেশি হবে না বলেই শুল্ক গোয়েন্দাদের ধারণা। 

>> আপন জুয়েলার্স কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, তাদের শাখায় রেজিস্ট্রার ও নথিপত্র সিলগালা থাকার কারণে শুল্ক গোয়েন্দাদের অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বা কাগজপত্র দেখাতে পারছেন না তারা।

তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার বেলা ২টায় শুল্ক গোয়েন্দাদের উপস্থিতিতে দোকান খুলে সেসব নথিপত্রের কপি সংগ্রহ করার অনুমতি দিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা দপ্তর।

গত সপ্তাহে আপন জুয়েলার্সের পাঁচ শাখায় অভিযান চালান শুল্ক গোয়েন্দারা

যে প্রেক্ষাপটে শুনানি

আপন জুয়েলার্সের অন্যতম মালিক দিলদারের ছেলে সাফাত আহমেদ ও তার বন্ধুরা গত ২৮ মার্চ বনানীর রেইনট্রি হোটেলে জন্মদিনের দাওয়াতে ডেকে নিয়ে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণ করে বলে গত ৬ মে থানায় মামলা হয়।

দিলদার ও তার ভাইদের বিরুদ্ধে সোনা চোরাচালানের অভিযোগ থাকায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশে একটি অনুসন্ধান কমিটি করে তদন্ত শুরু করে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর।এর অংশ হিসেবে গত ১৪ ও ১৫ মে ঢাকায় আপন জুয়েলার্সের পাঁচটি শাখায় অভিযান চালিয়ে সোনা ও হীরার গয়না ‘আটক’ করা হয়, যার মোট দাম ১৭৯ কোটি টাকা।

ওই সময়ই বনানীর হোটেল রেইনট্রিতে অভিযান চালান শুল্ক গোয়েন্দারা। চার তারকা ওই হোটেলের বিভিন্ন কক্ষ তল্লাশি করে ১০ বোতল বিদেশি মদ ও নথিপত্র জব্দ করা হয়।

শুল্ক গোয়েন্দারা জানান, হোটেল কর্তৃপক্ষ বারের লাইসেন্স দেখাতে না পারলেও সেখানে মদ রাখা হয়েছিল।

গত জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভ্যাট নিবন্ধন নিলেও কোনো অর্থ পরিশোধ না করে ওই হোটেল কর্তৃপক্ষ আট লাখ ১৫ হাজার টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে বলেও শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের অভিযোগ।

এরপর গত ১৪ মে ‘ব্যাখ্যাহীনভাবে’ সোনা ও হীরার গয়না মজুদের অভিযোগে আপন জুয়েলার্স এবং অবৈধভাবে মদ রাখার অভিযোগে বনানীর রেইনট্রি হোটেলের মালিকদের তলব করা হয়।

এছাড়া ভ্যাট ফাঁকি, শুল্ক ফাঁকি এবং মানি লন্ডারিং- এই তিন আইনে রেইনট্রি হোটেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতির কথাও জানান শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক শাফিউর রহমান।

ধর্ষণের ঘটনায় আলোচনার কেন্দ্রস্থল রেইনট্রি হোটেল

বনানীতে আবাসিক এলাকায় কে ব্লকের ২৭ নম্বর সড়কের ৪৯ নম্বর বাড়িতে চার তারকা ওই হোটেলটির মালিক আল-হুমায়রা গ্রুপ। ঝালকাঠি-১ আসনে আওয়ামী লীগের সাংসদ বজলুল হক হারুন ওই গ্রুপের চেয়ারম্যান। তার মেয়ে হুমায়রার নামে ওই গ্রুপের নাম। তার চার ছেলেমেয়েই পরিচালনা পর্ষদে আছেন।  

সাংসদ হারুনের ছেলেদের মধ্যে এইচ এম আদনান হারুন আছেন ওই হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে। তবে দেখাশোনা করেন মূলত তার ভাই মাহির হারুন।

মাহিরের বন্ধু পরিচয় দিয়েই সাফাত ধর্ষণের ঘটনার দিন ওই হোটেলে উঠেছিলেন বলে হোটেলকর্মীরা পুলিশকে জানিয়েছেন।

মামলার আসামিদের মধ্যে সাফাত, তার বন্ধু সাদমান সাকিফ, সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন ও দেহরক্ষী রহমত আলী গ্রেপ্তারের পরে রিমান্ডে রয়েছেন।

সাফাতের বন্ধু সাদমান সাকিফ পিকাসো রেস্তোরাঁর অন্যতম মালিক ও রেগনাম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ হোসেন জনির ছেলে। মামলার আরেক আসামি নাঈম আশরাফ এখনও পলাতক।

গত ৬ মে দায়ের করা মামলার এজাহার অনুযায়ী, গত ২৮ মার্চ রেইনট্রি হোটেলে সাফাত ও নাঈম দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছিলেন। অন্য তিনজন ছিলেন সহায়তাকারী।

অভিযোগকারী তরুণীদের একজন জানিয়েছিলেন, পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে তারা রেইনট্রি হোটেলে সাফাতের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। তাদের নিতে গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন সাফাতের গাড়িচালক ও দেহরক্ষী। ধর্ষণের সময় দেহরক্ষী রহমতকে দিয়ে ভিডিও ধারণ করা হয়েছিল বলেও অভিযোগ করেছেন ওই তরুণী।