চাঁদপুরের অটোচালক শরীফ ছোটভাই রাকিবকে খুঁজতে ঢাকায় এসেছিলেন ছয় দিন আগে। ভাইকে না পেয়ে বাড়ি ফেরার জন্য বৃহস্পতিবার ভোরে সদরঘাটে এসে পড়েন বিপত্তিতে।
Published : 21 Apr 2016, 11:27 PM
বেলা গড়িয়ে যাওয়ার পরও যাওয়ার পথ না পেয়ে হতাশ শরীফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকাল থেকে সদরঘাটে অপেক্ষা করছি, কিন্তু কোনো লঞ্চ দেখছি না।”
বুধবার মধ্যরাত থেকে নৌযান শ্রমিকদের অনির্দিষ্টকাল ধর্মঘট শুরুর পর শরীফের মতো অনেকে সকালে সদরঘাটে গিয়ে এই বিপত্তিতে পড়েন। তারা সবাই দক্ষিণাঞ্চলের নানা জেলার যাত্রী।
দিনভর এই অবস্থা চললেও বিকালে যাত্রীবাহী কিছু লঞ্চ চলাচল শুরু হলে জনভোগান্তির অবসান হলেও মালবাহী নৌযানগুলো চলাচল বন্ধই রয়েছে।
বেতন বাড়ানোসহ ১৫ দফা দাবি পূরণের সরকারি আশ্বাস বাস্তবায়ন না হওয়ায় ‘বাধ্য হয়ে’ এ কর্মসূচি দিয়েছেন বলে শ্রমিক নেতাদের দাবি।
“আমাদের শ্রমিকরা বর্তমানে মাত্র ৪ হাজার ১০০ টাকা বেতন পায়। এ টাকা দিয়ে চলা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এজন্য বর্তমান বাজারদর ও আনুষঙ্গিক খরচ বিবেচনা করে বেতনের পরিমাণ ৮ হাজার ২৫০ টাকা করার দাবিতে এ ধর্মঘট ও কর্মবিরতি করছি,” বলেন নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাহ আলম।
তবে শ্রমিকদের এ চাওয়াকে ‘অতিরিক্ত’ বলছেন লঞ্চ মালিকরা। ‘সম্রাট’ লঞ্চের মালিক আওলাদ হোসেন বলেন, “আমরাও বেতন বাড়ানোর পক্ষে। কিন্তু ৮ হাজার ২৫০ টাকা অনেক বেশি।”
ধর্মঘটের কারণে সকাল থেকে সদরঘাটের জেটি থেকে যাত্রীবাহী কোনো লঞ্চই ছাড়ছিল না। তবে রাতে দক্ষিণ জনপদ ছেড়ে আসা লঞ্চগুলো যাত্রী নামাচ্ছিল শুধু।
যাত্রী দুর্ভোগ দেখে দুপুরে সদরঘাটে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল সংস্থার (লঞ্চ মালিক সমিতি) কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে লঞ্চ চালানোর ঘোষণা দেন সংগঠনটির প্রধান উপদেষ্টা গোলাম কিবরিয়া টিপু।
তার ঘোষণার পর বিকালে পন্টুনে ভেড়ে এমভি ফারহান-২, ৪, ৬, ৮ লঞ্চগুলো। এরপর ভেড়ে টিপু-১২, পারাবত-১০, জামাল-৩, জাহিদ-৩, বন্ধন-৮, জিলানী, মানিক-৯, সম্রাট-২, মহারাজ-৭, মাইন রিফাত-১ ও সিলভার সান।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিআইডব্লিউটিসির লঞ্চ মধুমতিও ভেড়ানো হয় ১৩ নম্বর পন্টুনে।
বিকাল ৩টায় প্রথমে সদরঘাট থেকে মুন্সীগঞ্জ রওনা হয় এমভি বন্ধন। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ভোলার মনপুরার পথে ছেড়ে যায় এমভি ফারহা-২। এরপর অন্য লঞ্চগুলোও ছাড়তে থাকে।
সকাল থেকে সদরঘাটে অপেক্ষায় থাকা চাঁদপুরের যাত্রী শরীফ, কামরুল, বারেক মিয়া ও তামান্নাসহ অনেকে ফারহান-২ লঞ্চে উঠেন।
সকাল থেকে ধর্মঘটের খবর শুনে বিকালে অন্য সব জেলার যাত্রী কম হলেও চাঁদপুরের যাত্রী ছিল বেশি।
এমভি টিপুর মহা-ব্যবস্থাপক ফারুক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফারহান-২ লঞ্চটি মনপুরায় যায়। কিন্তু চাঁদপুরের যাত্রীদের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে সেই জেলার যাত্রীও নেওয়া হয়।”
বিআইডব্লিউটিসির মধুমতি স্টিমারটি বাগেরহাটের উদ্দেশে সদরঘাট ছেড়ে যায় সন্ধ্যায় ৭টার দিকে।
সংস্থার সহকারী মহাব্যবস্থাপক শাহ বরকত উল্লাহ বলেন, ৮১০ জন যাত্রী নিয়ে স্টিমারটি রওনা হয়েছে। তবে স্টিমারে ৫০০ জন চাঁদপুরের যাত্রী ছিল।
সদরঘাট থেকে প্রতিদিন প্রায় ৪৫টি লঞ্চ ছেড়ে যায় বলে জানান বিআইডব্লিউটিএর পরিবহন পরিদর্শক মো. শরীফ উদ্দিন। বুধবার সদরঘাট থেকে ৬৪টি লঞ্চ ছেড়ে যায়।
সদরঘাট দিয়ে দিনে কত যাত্রী যাতায়াত করে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছুটির দিন প্রায় ৭০/৮০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করে। অন্যান্য দিন ৪৫ থেকে ৫০ হাজার যাত্রী থাকে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৃহস্পতিবার সদরঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়ার লঞ্চগুলোর মধ্যে সমিতির প্রধান উপদেষ্টা টিপুরই লঞ্চ রয়েছে পাঁচটি। বাকি লঞ্চগুলো তিন-চারজন মালিকের।
একজন নৌ-শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সব ধর্মঘটেই টিপুর সব লঞ্চ ছাড়ে। তাদের ১৮টি লঞ্চ রয়েছে।
প্রতিদিনের চেয়ে লঞ্চের সংখ্যা কম কেন- জানতে চাইলে গোলাম কিবরিয়া টিপু বলেন, “অনেক লঞ্চের মাস্টার ও চালককে চা খাওয়ার কথা বলে সমিতির নেতারা তাদের কাছে নিয়ে ভুল বোঝাচ্ছে। তাই অনেকে যথা সময়ে সদরঘাটে আসতে পারেনি।”
ধর্মঘটে কেন লঞ্চ ছাড়ছেন- জানতে চাইলে টিপুর কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক ফারুক হোসেন বলেন, “শ্রমিক ফেডারেশন নিয়ম না মেনে ধর্মঘট ডেকেছে। তারা (শ্রমিক নেতারা) হুটহাট করে ধর্মঘট ডাকে। কোনো রকম আলোচনায় আসে না। তাই ধর্মঘটে লঞ্চ চালাই।”
ধর্মঘটে থাকা অন্য সংগঠন বাংলাদেশ জাহাজী শ্রমিক ফেডারেশনে সভাপতি শুকুর মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেসব লঞ্চ চলছে, তা মালিকরা নিজস্ব লোক দিয়ে চালাচ্ছে। এখানে কোনো শ্রমিক নেই। এমন কি মাস্টার-চালক ছাড়া লঞ্চগুলো চালানো হচ্ছে।”
তবে বিআইডব্লিউটিএর পরিবহন পরিদর্শক শরিফ উদ্দিন বলেন, “প্রতিটি লঞ্চের মাস্টার-চালক দেখে তবেই লঞ্চগুলো ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।”