প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণের চক্রান্তের মামলায় গ্রেপ্তার শফিক রেহমানকে পাঁচ দিন ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ।
Published : 16 Apr 2016, 10:34 AM
শফিক রেহমানের বিরুদ্ধে প্রমাণ আছে: জয়
‘ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে’ শফিক রেহমানকে
শনিবার সকালে রাজধানীর ইস্কাটনের বাড়ি থেকে বিএনপিঘনিষ্ঠ এই সাংবাদিককে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে নেওয়া হয়। দুপুরের পর তাকে পাঠানো হয় ঢাকার আদালতে।
২০১৫ সালে করা ওই মামলায় শফিক রেহমানকে সাত দিন হেফাজতে চেয়ে আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির সহকারী কমিশনার হাসান আরাফাত।
অন্যদিকে ৮১ বছর বয়সী এই সাংবাদিকের জামিনের আবেদন করেন বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের নেতা সানাউল্লাহ মিয়াসহ অন্যরা।
জামিন আবেদনের শুনানিতে আইনজীবীরা বলেন, এজাহারে তার নাম নেই। ষড়যন্ত্রেও তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ মামলার কাগজপত্রে নেই।
“ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রে, আর মামলা হল এখানে। এফআইআর (প্রাথমিক তথ্যবিবরণী) এ কলামে ঘটনা দেখানো হয়েছে বিএনপি কার্যালয়ে। এ মামলায় শফিক রেহমানকে আটক রাখা অনুচিত,” বলেন আইনজীবী জয়নাল আবেদীন মেসবাহ।
ঢাকার মহানগর হাকিম মাজহারুল ইসলাম জামিনের আবেদন নাকচ করে রিমান্ডের আবেদনে সায় দিয়ে পাঁচ দিন পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দেন।
শনিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বাড়ি থেকে শফিক রেহমানকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়ার কথা তার স্ত্রী তালেয়া রেহমান সাংবাদিকদের জানালে পুলিশ তখন কিছু বলছিল না।
এই বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে গোয়েন্দা পুলিশের কেউ মুখ খুলছিলেন না।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মারুফ হোসেন সরদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০১৫ সালের অগাস্ট মাসের পল্টন থানার একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
পরে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীপুত্র জয়কে ‘অপহরণের চক্রান্তে’ এফবিআইকে ঘুষ দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপির এক নেতার ছেলের দণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশ পুলিশ যে মামলাটি করেছিল, তাতেই গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে শফিক রেহমানকে।
ওই মামলাটির এজাহারে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের জাসাস নেতা মোহাম্মদ উল্লাহ মামুনের ছেলে রিজভী আহমেদ সিজারের এফবিআইকে ঘুষ দেওয়ার কারণে দণ্ডের ঘটনায় তা করা হয়েছে।
এজাহারে বলা হয়, রমনা থানায় গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক ফজলুর রহমানের করা সাধারণ ডায়েরির তদন্ত করতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে জানা যায়, “২০১১ সালের সেপ্টেম্বর পূর্বে যে কোনো সময় হতে জাসাস-এর সহ-সভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহ মামুনসহ বিএনপি ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটভুক্ত অন্যান্য দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ ঢাকা শহরের পল্টনস্থ জাসাস কার্যালয়ে, আমেরিকার নিউ ইয়র্কে, যুক্তরাজ্যে ও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় আসামিরা একত্রিত হয়ে যোগসাজশে সজীব ওয়াজেদ জয়কে আমেরিকায় অপহরণ করে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল।”
এতে উল্লেখ করা হয়, এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য মামুন ও জোটভুক্ত অন্যান্য দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্ব রিজভী আহমেদ সিজারকে দায়িত্ব দেয়। এজন্য অর্থায়নও করা হয়।
বাংলাদেশি এক রাজনীতিকের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সংরক্ষিত তথ্য পেতে এফবিআইয়ের এক সদস্যকে ঘুষ দেওয়ায় ২০১৫ সালে সিজারের কারাদণ্ড হয়।
ওই রাজনীতিকের নাম মার্কিন আদালতের নথিপত্রে প্রথমে উহ্য রাখা হলেও প্রসিকিউশনের নথিতে তাকে ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও তার তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা’ বলা হয়।
সিজারের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে রায়ে বলা হয়, ‘অপহরণ,ভয় দেখানো ও ক্ষতি করাই’ ছিল তার তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্য।
সিজার কিছু তথ্য বাংলাদেশি ‘একজন সাংবাদিককে’ সরবরাহ করেছিলেন এবং বিনিময়ে ‘প্রায় ৩০ হাজার ডলার’ পেয়েছিলেন বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়।
ওই ঘটনাটি নিয়ে ২০১৫ সালের ৩১ মে ডিবির পরিদর্শক ফজলুর রহমান রমনা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন, যা ৪ অগাস্ট পল্টন থানায় মামলায় রূপান্তরিত হয়। শফিক রেহমানকে ওই মামলায়ই গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
মারুফ সরদার বলেন, “২০১৩ সালে শফিক রেহমান বিদেশ গিয়েছিলেন। তখন এই ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।”
শফিক রেহমানকে নিয়ে যাওয়ার বর্ণনা দিয়ে তালেয়া রেহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডিবি পরিচয়ে কয়েকজন লোক বাসায় ঢোকে। ‘আমাদের সঙ্গে যেতে হবে’ বলে তাকে নিয়ে যায় তারা।”
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সাইদুর রহমানের ছেলে শফিক রেহমানের স্ত্রী তালেয়া নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ডেমোক্রেসিওয়াচের নির্বাহী পরিচালক।
ইস্কাটন গার্ডেন রোডের ওই বাড়ির কম্পাউন্ডে সামনের দোতলা বাড়িতে ডেমোক্রেসিওয়াচের কার্যালয়। পেছনে তিনতলা বাড়ির তৃতীয় তলায় সপরিবারে থাকেন শফিক রেহমান।
তালেয়া সাংবাদিকদের বলেন, “তারা (পুলিশ) এসে নিজেদের বৈশাখী টেলিভিশনের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে জানায়, তারা শফিক রেহমানের সাক্ষাৎকার নিতে এসেছে। যদিও তার (শফিক) কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট এই সময় ছিল না। একটু সন্দেহও হয়েছিল।”
ওই ব্যক্তিদের সামনের ভবনে ডেমোক্রেসিওয়াচের কার্যালয়ে বসতে দেওয়া হয়। সেখানে তাদের চা-নাশতাও দেওয়া হয় তাদের।
তালেয়া জানান, তিন ব্যক্তি নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিলেও তাদের একজনের হাতে একটি ডিজিটাল ক্যামেরা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। শফিক রেহমানের দেরি দেখে ওই তিনজন ভেতরের বাড়ির দিকে রওনা হয়।
বাড়ির দারোয়ান আব্দুল মতিন মোল্লা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই তিনজন একটি কার্ড তার হাতে দিয়ে তা তিনতলায় শফিক রেহমানকে পৌঁছে দিতে বলেন।
“স্যার কার্ড দেখে তা ম্যাডামকে দিতে বলেন। আমি কার্ডটি নিয়ে নিচে নামতে নামতে দেখি স্যারও নেমে আসছেন। ওই সময় ওই তিনজনও উপরে উঠতে থাকে। তারা ‘আমরা ডিবির’ লোক বলে কার্ডটি আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। স্যারকে ধরে নিয়ে যায়।”
পুলিশের মাইক্রোবাসটি বাড়ির সামনেই ছিল। সেখানে শফিক রেহমানকে তোলার পর তা মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ের দিকে চলে যায়।
শফিক রেহমান সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘মৌচাকে ঢিল’র সহকারী সম্পাদক সজীব ওনাসিস সাংবাদিকদের বলেন, “সকাল ১১টার দিকে ডিবি অফিস থেকে ম্যাডামকে ফোন করা হয়েছে। উনার (শফিক) জন্য নাশতা ও ওষুধপত্র নিয়ে যেতে বলা হয়েছে।”
পরে বাড়ি থেকে ওষুধ ও নাশতা নিয়ে ডিবি কার্যালয়ে গেলেও শফিক রেহমানের দেখা পাননি স্ত্রী। তবে তাদের কাছ থেকে ওষুধ ও খাবার নেয় পুলিশ।
যে তিনজন শফিক রেহমানকে আটক করতে এসেছিল, তারা দুদিন আগে ভূমিকম্পের পরে বৈশাখী টেলিভিশনের নাম করে সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিল বলে সজীব দাবি করেন।
তবে সেদিন তারা শফিক রেহমানের দেখা পাননি।
শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে সকাল ১১টার দিকে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ওই বাড়িতে দেখা যান।
তিনি তালেয়া রেহমানকে বলেন, “আপনি চিন্তা করবেন না। বিষয়টি আমরা ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে জানিয়েছি।”
দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্যে কাজের সুবাদে শফিক রেহমান ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নিয়েছেন।
শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন, এটা ‘চরম স্বেচ্ছাচারিতার বহিঃপ্রকাশ’।
সরকারের ‘গণবিরোধী নীতির’ বিরুদ্ধে কথা বলার জন্যই এই সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি করেন খালেদা।
শফিক রেহমান নানা সংবাদ মাধ্যমে কাজ করলেও গত শতকের ৮০ এর দশকে সাপ্তাহিক যায়যায়দিন সম্পাদনার মধ্য দিয়ে ব্যাপক পরিচিতি পান।
তখন সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের রোষানলে পড়ে তাকে বাংলাদেশ ছাড়তেও হয়েছিল। এরশাদের পতনের পর ফের বাংলাদেশে ফেরেন বিবিসিতে কাজ করে আসা এই সাংবাদিক।
এক দশক পরে বিএনপির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠতে দেখা যায়। এর মধ্যে দৈনিক যায়যায়দিন বের করেন তিনি। তবে চালাতে না পারার পর যায়যায়দিনের স্বত্ব বিক্রি করে দেন তিনি।
‘লাল গোলাপ’ নামে একটি অনুষ্ঠান নিয়ে এখন সম্প্রচার মাধ্যমে সক্রিয় তিনি। খালেদা জিয়ার নানা কর্মসূচিতে তাকে দেখা যায়।