যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ানে বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের তৎপরতা এবং এর পেছনে ইউরোপ-আমেরিকা ফেরতদের ভূমিকা তুলে ধরে বুধবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে।
এতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও রাজনীতিবিদ, মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনের কর্মী ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে।
ঢাকার নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিটিশ জিহাদিরা বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থানের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। তরুণ ধর্মীয় মৌলবাদীদের তারা আইএসের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলছে।
“ব্রিটেনের বাঙালি কম্যুনিটিগুলো থেকে উগ্রবাদে অর্থায়নকারী ও লোক সংগ্রহকারীরা স্থানীয়দের আন্তর্জাতিক জিহাদে অংশ নিতে উৎসাহ জোগাচ্ছে এবং সালাফি গোষ্ঠীগুলোতে বাংলাদেশিদের সংখ্যা বাড়ছে।”
এ বিষয়ে গার্ডিয়ানকে শেখ হাসিনা বলেন, “মাঠ পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকারের আরও উদ্যোগ নেওয়া উচিত। পূর্ব লন্ডনে জামায়াতের বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে। এটা সত্য। তারা টাকা সংগ্রহ করছে, তারা টাকা পাঠাচ্ছে।”
সম্প্রতি ব্লগার হত্যায় ব্রিটিশ নাগরিক তৌহিদুর রহমানকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তৌহিদুর নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অর্থের জোগানদাতা এবং ব্লগার অভিজিৎ ও অনন্ত হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী বলে দাবি করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এছাড়া জেএমবি, ইসলামিক স্টেট ও একিউআইএস (আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা) সংশ্লিষ্ট আরও বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ বাংলাদেশির কথা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সামনে এসেছে।
সর্বশেষ গত মাসে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ড্রোন হামলায় নিহত আইএস সদস্য রুহুল আমিন ও রেয়াদ খান ব্রিটিশ বাংলাদেশি বলে গণমাধ্যমের খবর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক সেনা গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞকে উদ্ধৃত করে এতে বলা হয়, “বাংলাদেশের উপর আইএসের নজর রয়েছে। সিরিয়া ও ইরাকে আইএসের পক্ষে লড়াই করতে যাওয়া বাংলাদেশির সংখ্যা ৩০ জনের মতো।
“ভারত থেকে আইএসআইএসে যাওয়ার ট্রানজিট রুটও হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। জঙ্গিবাদে লোক সংগ্রহ করতে ব্রিটেন থেকে আসা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের সংখ্যাও বাড়ছে।”
নিরাপত্তা নিয়ে কর্মরত একটি এনজিওর পরিচালক বলেছেন, “বাংলাদেশজুড়ে মৌলবাদীদের অনেকগুলো শক্তিশালী পকেট রয়েছে। অনেক তরুণ আছে যাদের কোনো চাকরি নেই বা কোনো সম্ভাবনা নেই। তাদের একমাত্র অভিজ্ঞতা মাদ্রাসা ও মসজিদ। গ্রামাঞ্চলে তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবেশের সুযোগও নেই। এরা ব্যবহৃত হতে চায়। তাই খুব সহজেই তাদের নিজেদের কাজে লাগানো যায়।
যুক্তরাজ্য থেকে যখন বাঙালিরা আসে তখন তাদের পক্ষে এদের নিয়ন্ত্রণ করা খুব সহজ হয়ে পড়ে বলে তিনি মনে করছেন।
“জিহাদে লোক সংগ্রহকারীরা লন্ডন থেকে আসছে, জার্মানি থেকে আসছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসছে। তারা শিক্ষিত, তারা বিশ্ববিদ্যালয়েও গিয়েছেন, তাই তারা বেশি পরিশীলিত।”
এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিলও মৌলবাদের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করেছে বলে মনে করেন তিনি।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের কঠোর অবস্থানের সমর্থন জানিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এর বাইরে তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশের মৌলবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার বিষয়টি নজরের বাইরে রাখছে তারা।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে সমালোচনা এলেও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে অনড় শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলেও বলছেন তিনি।
“মৌলবাদী গ্রুপগুলো চেষ্টা করছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। এবং কিছু লোক তাদের উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছি।”
তবে পশ্চিম থেকে বাংলাদেশে মৌলবাদী চিন্তাধারার বিস্তৃতি ঠেকাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করেন শেখ হাসিনা।
পূর্ব লন্ডনের বাঙালি কম্যুনিটির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্ক সুপ্রতিষ্ঠিত মন্তব্য করে এর পক্ষে যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মতো জামায়াত নেতাদের সেখানে বক্তব্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ইহুদি-মুসলিম ‘ইন্টারফেইথ’ সংগঠন স্ট্যান্ড ফর পিসের বক্তব্য অনুযায়ী, “পূর্ব লন্ডন মসজিদ ও ইসলামিক ফোরাম অফ ইউরোপ-দুটোই ব্রিটেনে জামায়াতের সংগঠকরা চালায়। উভয় প্রতিষ্ঠানই ব্যাপকভাবে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা ও তাত্ত্বিক গুরু সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীর লেখার প্রচার চালায়।”
ব্লগার হত্যায় তৌহিদুরকে গ্রেপ্তারের আগে গত বছর সামিউন রহমান নামে এক ব্রিটিশ বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আইএসের এজেন্ট হিসেবে তিনি ঢাকা ও সিলেটে ওই জঙ্গি গোষ্ঠীর পক্ষে লোক জোগাড়ের চেষ্টা করছিলেন বলে পুলিশ বলছে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী হিযবুত তাহরিরও বাংলাদেশে উগ্রপন্থার উত্থানে কাজ করছে বলে গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞের বরাত দিয়ে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
“হিযবুত একটি খেলাফত চায়। তারা আইএসআইএসের একটি প্রদেশ বা স্টেট হতে চায়। হিযবুত কর্মীরা মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে তাদের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের একটি বড় সংখ্যায় নারী কর্মী আছে-তারা সবাই স্কার্ফ পরে।”