সংকটময় একটি সময়ে যুক্তরাজ্যকে সামলানোর গুরুদায়িত্ব পাচ্ছেন ট্রাস। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ‘বলিষ্ঠ পরিকল্পনা’ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
Published : 06 Sep 2022, 12:24 AM
জ্বালানি সংকট এবং মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে সারা বিশ্বের মত যুক্তরাজ্যেরও দিশেহারা অবস্থায়। সংকটময় এ সময়ে দেশ সামলানোর গুরুদায়িত্ব পাচ্ছেন লিজ ট্রাস।
নানা কেলেঙ্কারির জেরে গত জুলাইয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিতে বাধ্য হন বরিস জনসন। পদত্যাগ করেন কনজারভেটিভ পার্টির প্রধানের পদ থেকেও।
সোমবার নতুন নেতা বেছে নিয়েছে কনজারভেটিভ পার্টি। মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে তিনিই হবেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী।
এদিন বরিস জনসন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দেওয়ার পর ট্রাস দলীয় প্রধান হিসেবে রানির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন এবং রানি তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠনের আহ্বান জানাবেন।
এবারের দলীয় প্রধান হওয়ার দৌড়ে ট্রাসের সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক। তবে শেষ পর্যন্ত তাকে পরাজিত হতে হয়।
জয়ী হওয়ার পর লন্ডনে একটি কনফারেন্স সেন্টারে সংক্ষিপ্ত ভাষণে ট্রাস দেশের বর্তমান সংকট মোকাবেলায় শিগগিরই ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
বিস্তারিত না জানালেও তিনি বক্তৃতায় কর কর্তন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধারে ‘বলিষ্ঠ পরিকল্পনা’ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি ‘জ্বালানি সংকট মোকাবেলা, জনগণের ওপর চেপে বসা জ্বালানির বাড়তি খরচের বোঝা অপসারণ এবং জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে কাজ করারও অঙ্গীকার করেছেন।
দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রা:
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদের ঘোর বিরোধী ছিলেন, পরে সেটির পক্ষেই কথা বলেছেন। এখন তিনি কর কর্তনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের জীবনযাত্রায় ব্যয় বৃদ্ধির সংকট মোকাবেলা করতে চাইছেন। তার এই কৌশল স্পষ্টতই কনজারভেটিভ দলের সাধারণ সদস্যদের ভোট জয় করতে বড় ভূমিকা রেখেছে।
কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই বিতর্কিত চরিত্র ট্রাস। ব্রেক্সিটের পক্ষে তার কঠোর অবস্থানকে এখন সমালোচকরা কুৎসিত চক্রান্ত হিসেবেই দেখছেন।
এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে তারা ট্রাসের রাজনৈতিক জীবনের প্রথমদিককে টেনে এনেছেন। ট্রাস শুরুতে রাজতন্ত্রের চরম বিরোধী একজন লিবারেল ডেমোক্রেট ছিলেন। যিনি ওই সময় মাদক বৈধ করার পক্ষে ছিলেন। এখন তিনি রক্ষণশীলতার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
ট্রাসকে বরাবরই যুক্তরাজ্যের লৌহমানবী সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে তুলনা করা হয়। থ্যাচারের মত তিনিও অপেক্ষাকৃত নম্রতা দিয়ে শুরু করেছেন। যেখান থেকে শুরু করে থ্যাচার একসময় পুরুষ অধ্যুষিত একটি বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করেন।
দারুণ সংকটে দেশ
ট্রাস এমন একটি সময়ে সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন যখন যুক্তরাজ্য নানান সংকটে জর্জরিত। সেখানে জ্বালানি ও খাবারের দাম হু হু করে বাড়ছে। হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে অপেক্ষমানদের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। সরকারি কর্মচারি, বন্দরের কর্মী এমনকী আইনজীবীরা নানা দাবিতে ধর্মঘট করছেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনে জয়ের ধারা অব্যাহত রাখার চাপও রয়েছে।
যুক্তরাজ্যে জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি বেড়ে গেছে। গত চার দশকের মধ্যে প্রথমবার দেশটিতে পণ্যমূল্য এতটা বেড়ে গেছে। জ্বালানি, খাদ্য এবং তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি এজন্য দায়ী।
ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ বছরের শেষ দিকে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে তা ১৩ শতাংশে পৌঁছে যাবে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আশঙ্কা এ বছর শেষ হওয়ার আগেই যুক্তরাজ্যে মন্দা দেখা দিতে পারে।
শীত মৌসুমে জ্বালানিসংকট আরও প্রকট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে, সিটি গ্রুপের পূর্বাভাস, ২০২৩ সালের শুরুতে যুক্তরাজ্যের মূল্যস্ফীতি ১৮ শতাংশ ছাড়াতে পারে।
এতসব গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার পূর্বাভাসের মধ্যেই সোমবার ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের মূল্য ০ দশমিক ৩ শতাংশ পড়ে গেছে। ১৯৮৫ সালের পর ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের এতটা অবনমন হয়নি।
এদিকে ট্রাসের কর কর্তন নীতি দেশটির সাধারণ নাগরিকদের জন্য কতটা সহায়ক হবে সেটা নিয়েও বিশেষজ্ঞরা সন্দিহান, বিশেষ করে এক দশকের কঠোর নীতির পর।
যুক্তরাজ্যবাসীকে এখন সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় ফেলেছে জ্বালানির বাড়তি দাম। ইউক্রেইন যুদ্ধের জেরে রাশিয়া থেকে সরবরাহ কমে আসায় জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বেড়েছে। শীতে তা আরও বাড়বে।
আগামী অক্টোবর নাগাদ দেশটিতে পরিবারপ্রতি গড় জ্বালানি ব্যয় বেড়ে ৪ হাজার ১০৬ ডলারে উন্নীত হতে পারে। জ্বালানির সরবরাহ দ্রুত নির্বিঘ্ন করতে না পারলে শীতে ঠাণ্ডায় জমে অনেক মানুষ মারা যেতে পারেন বলেও সতর্ক করে দিয়েছেন বিশ্লেষকদের অনেকেই।
জনসনের ভূত:
ট্রাসের নতুন সরকারকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের দীর্ঘ ছায়ার নিচে ঢাকা পড়ে থাকতে হবে বলেও মনে করছেন অনেকে। জনসনের আমলে দেশের জনগণের মধ্যে কনজারভেটিভ পার্টির জনপ্রিয়তা কমেছে।
২০১৯ সালে বাঁধভাঙা জয় নিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন জনসন। তার মাত্র তিন বছর পর নিদারুণ অজনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি।
করোনাভাইরাস বিধি ভেঙে পার্টির আয়োজনসহ নানা বিতর্ক ও সমালোচনার জেরে গত জুলাইয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন বরিস জনসন।
চাই সঠিক নীতি
যুক্তরাজ্যে শিগগিরই জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম কমে আসবে, এমনটা আশা করছেন না কেউই। ফেডারেশন অব স্মল বিজনেস ইউকের প্রধান মার্টিন ম্যাকটাগ বলেন, ‘‘আমি ভীত। ভাল কিছুর আশা করতে পারছি না।’’
লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ফিসকাল স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ বেন জারানকো বলেন, ‘‘এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হল জ্বালানির দামে লাগাম টানা। কেননা, গরিব মানুষের জন্য জ্বালানি পণ্যের বাড়তি ব্যয় মেটানো কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য তাদের অন্য খাতে ব্যয় কমাতে হচ্ছে।’’
তবে বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, ট্রাসের নীতি বাস্তবায়িত হলে সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাবে। সংকট দূর হবে না, বৈষম্য বাড়বে। এ বিষয়ে লন্ডনের থিঙ্কট্যাংক রেজল্যুশন ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ জোনাথন মার্শাল বলেন, ‘‘কর কমানোর সুবিধা পাবেন ধনী ব্যক্তিরা। তাদের হাতে আগে থেকেই প্রচুর অর্থ রয়েছে।’’
তিনি মনে করেন, তার চেয়ে বরং জনগণকে সাশ্রয়ী হতে উদ্বুদ্ধ করা এবং জ্বালানির অপচয় কমানোর মধ্য দিয়ে সংকট সামাধানের চেষ্টা করা যেতে পারে।