কফি হাউজ এখন আর আড্ডাবাজদের নয়

মানুষ এখন চলছে ঘড়ির কাঁটা ধরে। কফিতে চুমুক দিলেও সময় নেই গল্প-আড্ডার। কফি হাউজও চায় না ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা মানুষেরা তাদের আতিথ্য নিক।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 March 2024, 03:59 PM
Updated : 17 March 2024, 03:59 PM

বহু রাজনৈতিক, সাহিত্য ও চলচ্চিত্র আন্দোলনের সূতিকাগার কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজের যাত্রার ৪১ বছর পর গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লিখেছিলেন- ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’।

মান্না দে’র কণ্ঠে জনপ্রিয় সেই গান বাজছে পরবর্তী আরো চার দশক ধরে; গানের কথায় যে ভাব আর আবেগ মানুষকে নাড়া দেয়, কফি হাউজ নিয়ে সেই তৃষ্ণা এখন আরো প্রবল।

কিন্তু কফি হাউজের সেই আড্ডাটা সত্যিই আর নেই।

মানুষ এখন চলছে ঘড়ির কাঁটা ধরে। কফিতে চুমুক দিলেও সময় নেই গল্প-আড্ডার। কফি হাউজও চায় না ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা মানুষেরা তাদের আতিথ্য নিক।

দ্য হিন্দুর সাংবাদিক বিশ্বনাথ ঘোষ লিখেছেন, কফি হাউজের কিছু জিনিস আগের মতই আছে, কিন্তু কিছু জিনিস বদলে গেছে পুরোপুরি।

“কিছু জিনিস বদলায়নি, যেমন কিছু মানুষকে এখনো কফি আর ফিশ ফ্রাই নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। যেটা বদলেছে, সেটা হল, এই মানুষগুলো সেই মানুষ নয়, যারা এক সময় এক কাপ কফি নিয়ে বসে বসে ঘণ্টা পার করে দিত।”

এখন গ্রাহক আগের চেয়ে বেশি, কিন্তু তাদের সময় বড় কম। মানুষ আসছে, দ্রুত কিছু মুখে দিয়েই উঠে যাচ্ছে, এরপর আসছে নতুন কেউ।

এই পরিবর্তনের দুটো দিক আছে। মান্না দের গানের কথা ভাবতে ভাবতে যারা ইতিহাসের দ্যুতি খুঁজতে আর মোটামুটি সস্তায় স্ন্যাক্স-কফি খেতে আসছেন, তাদের কফি হাউজ আগের মতই সেবা দিচ্ছে। আবার কফি হাউজও সেইসব ক্রেতা বেশি পাচ্ছে, যারা এক কাপ কফি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দেয় না।অল্প সময়ে যত বেশি ক্রেতা, তত বেশি আয়।

ঝটপট ব্যবসা

কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে ১৮৭৬ সালে নির্মাণ করা হয় অ্যালবার্ট হল। ১৯৪২ সালে ভবনটিকে কফি হাউজে রূপান্তর করে ভারতীয় কফি বোর্ড। ১৯৪৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এর নামকরণ হয় ‘কফি হাউজ’ ।

দেড় দশক আগেও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ধুঁকতে থাকা কফি হাউজ এখন সুদিনের দেখা পেয়েছে। কেবল যে বসার জায়গা বাড়ানো হয়েছে তাই নয়, কলকাতার বাইরে বহরমপুরে একটি শাখাও খুলছে কফি হাউজ। আসছে পয়লা বৈশাখে এর উদ্বোধন হতে পারে।

এখন কফি হাউজ পরিচালনা করে ‘ইন্ডিয়ান কফি ওয়ার্কার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’। এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাভেদ বললেন, নিচতলায় আগে ৪৪টি টেবিল ছিল, এখন হয়েছে ৫২টি। আর উপরের তলায় ৩৭টির জায়গায় টেবিল বসেছে ৪২টি।

“গত দুই বছরে পরিবর্তন বলতে এটাই হয়েছে। কফি হাউজের সংস্কৃতি বিবেচনায় পরিবর্তন খুব বেশি হয়নি। কেবল প্রজন্মের পরিবর্তন হয়েছে।”

এই কফি হাউজেই ৩৫ বছর ওয়েটার হিসাবে কাজ করেছেন জাভেদ। তারপর কফি ওয়ার্কার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটির চেয়ারম্যান হয়েছেন। এই পদের মেয়াদ ৫ বছর। দ্বিতীয় দফা তিনি ওই দায়িত্ব পেয়েছেন।

বদলেছে সংস্কৃতি

চেয়ারম্যান যাই বলুক, কফি হাউজের একজন কর্মী বললেন, কাজের পরিবেশ ও সংস্কৃতিও পাল্টে গেছে।

“এখন কর্মীদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যাই বেশি। কেবল এক কাপ কফি নিয়ে গা এলিয়ে বসে থাকা গ্রাহকদের আমরা আর উৎসাহ দিই না।

“আপনি যদি এখানে সময় কাটাতে চান, তবে আপনাকে খাবার অর্ডার দিতে হবে। শুধু আড্ডা দেবার জন্য দীর্ঘ সময় আপনি টেবিল দখল করে রাখতে পারেন না।”

অথচ এক দশক আগেও তাদের মনোভাব এমন ছিল না। সাংবাদিক বিশ্বনাথ ঘোষ লিখেছেন, কলকাতা এখন ঐতিহ্য সচেতন হয়েছে, এমনকি কফি হাউজও এখন সম্ভবত তার মূল্য বুঝতে শুরু করেছে। ২০ টাকার এক কাপ কালো কফির সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডার জায়গা হয়ে থাকতে কফি হাউজ এখন খুব একটা আগ্রহী নয়। তাছাড়া সমাজের ওপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবও এখন স্পষ্ট। সশরীরে আড্ডা দেবার সময় মানুষের হাতে নেই।

কফি হাউজের পুরনো দিনের কথা তুলে ধরে অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা অসীম কুমার চক্রবর্তী বলেন, “১৯৮০ এর দশকের শুরুর দিকে আমার কলেজ জীবনে সারাটা দিনই আমরা সেখানে কাটিয়ে দিতাম। সত্যি সত্যি সারাটা দিন। সেখানে আমি দেখেছি, সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় বসে থাকতেন।”

কলেজ দিনগুলোর স্মৃতি মনে করে এখনো পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে কফি হাউজে যান অসীম কুমার।

নষ্ট করার সময় হাতে নেই

অসীম কুমার হিন্দুকে বলেন, “ওখানে আগের মত কোলাহল নেই। আগের মত অত ধূমপানও কেউ করে না। আইনগতভাবে যদিও এরকম পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ, তারপরও কফি হাউজে গ্রাহকদের ধূমপানের স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছে। হয়ত পুরনো চর্চার কারণেই কর্তৃপক্ষ ধূমপানের বিষয়টি দেখেও দেখে না।”

তিন দশক ধরে কফি হাউজের ওয়েটার হিসেবে কাজ করছেন কাবুল। আগের চেয়ে তিনি এখন বেশি ব্যস্ত।

তার ভাষ্য, “আজকাল মানুষের হাতে সময় নেই। তারা আসে, খায়, চলে যায়। তাদের নষ্ট করার মত সময় নেই।”

৪০ বছরের বেশি সময় কফি হাউজের সঙ্গে রয়েছেন এখনকার চেয়ার‌্যামন মোহাম্মদ জাভেদ। দীর্ঘ এই সময়ে স্মরণীয় সময় কোনটি? তিনি বললেন, “কোভিডের সময়কাল। সেটাই ছিল সেরা সময়; কারণ কাউকে কাজে আসতে হয়নি।”