অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কারে ট্রাম্পের কট্টর দৃষ্টিভঙ্গি যুক্তরাষ্ট্রের এখনকার রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তিকেও গাঢ় করছে।
Published : 23 Mar 2025, 02:14 PM
শিশু নির্যাতকদের খুঁজে বেড়াতেন যেসব ফেডারেল এজেন্ট তারা এখন সাঁড়াশি তল্লাশি চালাচ্ছেন সেসব অভিবাসীদের খোঁজে, যারা যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাস করছেন।
মুদ্রা পাচার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হোমল্যান্ড সিকিউরিটির তদন্ত কর্মকর্তারা হানা দিচ্ছেন রেস্তোরাঁ আর ছোটখাট দোকানে, খুঁজছেন সেইসব অভিবাসীদের যাদের কাজ করার অনুমোদন নেই।
মাদক চোরাকারবারি ও কর জালিয়াতির বিভিন্ন অভিযোগ সামলাতেন যে এজেন্টরা তাদের নতুন দায়িত্ব পড়েছে অভিবাসন আইন কঠোরভাবে কার্যকরে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প কোটি কোটি ‘বিদেশি অপরাধীকে’ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর যে অঙ্গীকার করেছেন, তা বাস্তবায়নে মাদক পাচার, সন্ত্রাসবাদ থেকে শুরু করে যৌন নির্যাতন ও জালিয়াতিসহ নানান অপরাধ দমনে নিয়োজিত লোকবল-সম্পদ কমিয়ে আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার হাজারো ফেডারেল কর্মকর্তাকে এভাবেই তাদের আগের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে অবৈধ অভিবাসী ধরার কাজে নামানো হয়েছে, বলছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
২০ জনেরও বেশি সাবেক-বর্তমান ফেডারেল এজেন্ট, অ্যাটর্নি ও অন্যান্য ফেডারেল কর্মকর্তাদের বলা কথার ভিত্তিতে ট্রাম্প প্রশাসনের চাপে আইন প্রয়োগকারী কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোর কাজে এ বড়সড় পরিবর্তনের চিত্র উঠে এসেছে। ৯/১১-র সন্ত্রাসী হামলার পরবর্তী সময় বাদ দিলে গত আড়াই দশকে এমনটা আর দেখা যায়নি।
যে কর্মকর্তারা রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের বেশিরভাগই নাম-পরিচয় গোপন রাখতে বলেছেন, কেননা তারা নিজেদের কাজ নিয়ে কথা বলার জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত নন।
“ফেডারেল সরকার এত বিস্তৃত পরিসরে লোকবল ও সম্পদ অভিবাসন নীতি কার্যকরে কাজে লাগিয়েছে, এমনটা এর আগে কখনো দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। যখন আপনি সংস্থাগুলোকে বলেন, যা করছো তা বন্ধ করো, এখন এটা করো, তারা যাই করছিল তা পেছনের আসনে চলে যাবে,” বলেছেন ডেমোক্র্যট-রিপাবলিকান দুই প্রশাসনের কাজ করা হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সাবেক কর্মকর্তা থেরেসা কার্ডিনাল ব্রাউন।
জানুয়ারির আগে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করতো মূলত দুটি সংস্থা। ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট- আইসিই এবং কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন। এই দুই সংস্থার মোট কর্মীসংস্থা ৮০ হাজার। এদের বাইরে অন্য সংস্থাগুলো অবৈধ অভিবাসসীদের নিয়ে খুব একটা মাথাই ঘামাতো না।
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি পুরো বদলে গেছে। আইসিই এবং কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন তো আছেই, বেশিরভাগ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে এখন অগ্রাধিকারভিত্তিতে অভিবাসন নীতি কঠোরভাবে কার্যকরে নজর দিতে হচ্ছে।
এসব নিয়ে রয়টার্সের প্রশ্নের জবাবে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব ট্রিসিয়িা ম্যাকলাফলিন বলেছেন, অবৈধ বিদেশিদের খুঁজে বের করতে, ধরতে ও ফেরত পাঠাতে মার্কিন সরকার কেন্দ্রীয় ও রাজ্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে মোতায়েন করেছে।
মার্কিন কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই তাদের কর্মীদের নিয়ে প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছে, “তারা যুক্তরাষ্ট্রকে নানান হুমকি থেকে সুরক্ষা দিচ্ছে।”
মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি হোয়াইট হাউজও।
বিভিন্ন সংস্থার কাজের অগ্রাধিকারে পরিবর্তন নিয়ে বিস্তৃত কিছু জানায়নি ট্রাম্প প্রশাসন।
২০০১ সালের সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিন কংগ্রেস অন্যান্য সংস্থা থেকে এক লাখ ৬৯ হাজার কর্মী নিয়ে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রণালয় বানিয়েছিল, সেসময় এফবিআইও তাদের দৃষ্টির প্রায় পুরোটাই সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছিল।
অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কারে ট্রাম্পের কট্টর দৃষ্টিভঙ্গি যুক্তরাষ্ট্রের এখনকার রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তিকে আরও গাঢ় করছে।
সেনেটের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ডেমোক্র্যাট নেতা ডিক ডারবিন বর্তমান প্রশাসনের অবৈধ অভিবাসীবিরোধী অভিযানকে ‘অপচয়মূলক, সম্পদের দিকভ্রান্ত ব্যবহার’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
“করপোরেট জালিয়াতি, সন্ত্রাসবাদ, শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়ন ও অন্যান্য অপরাধ মোকাবেলার কাজে থাকা কর্মকর্তা ও এজেন্টদের সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে আগের তুলনায় অনিরাপদ করে তোলা হচ্ছে,” রয়টার্সকে এমনটাই বলেছেন তিনি।
তবে আইন প্রয়োগকারী কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোর কাজের অগ্রাধিকারে এ পরিবর্তন অন্য গুরুত্বপূর্ণ অপরাধের তদন্তকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এমনটা মানতে নারাজ মার্কিন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল টড ব্ল্যাঞ্চ।
তিনি বলেন, “আমরা অভিবাসনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি, এ কারণে অন্য সহিংস অপরাধ দমনে পূর্ণশক্তি ব্যবহার করছি না এমন ধারণা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করছি আমি।”
অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, গত কয়েক বছর ধরে যা হয়েছে আদতে তা এক ধরনের অনুপ্রবেশই, আমরা এখন এটি ঠিক করার চেষ্টা করছি।”
চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ফিরেই ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোকে অবৈধ অভিবাসীদের ‘অনুপ্রবেশ’ মোকাবেলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করতে বলেন।
রিপাবলিকান এ প্রেসিডেন্ট মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে হওয়া অপরাধ, গ্যাং সহিসংতা, মাদক চোরাচালান এগুলোর পেছনে সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি হচ্ছে দেশটিতে থাকা আনুমানিক এক কোটি ১০ লাখ অবৈধ অভিবাসী। অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ শুষে নিচ্ছে এবং দেশটির নাগরিকদের চাকরি ও কাজের সুযোগ কমিয়ে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ তার।
ট্রাম্পের এসব অভিযোগের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার দেওয়া তথ্য-উপাত্তের মিল নেই বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশের পরপরই এফবিআই, ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডিইএ) ও এটিএফ নামে পরিচিত ব্যুরো অব অ্যালকোহল, টোবাকো, ফায়ারআর্মস অ্যান্ড এক্সপ্লোসিভ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবৈধ অভিবাসীদের ধরার অভিযানের ছবি দেওয়া শুরু করে।
অথচ এ বছরের আগে এটিএফকে কখনোই অভিবাসন নীতি কার্যকরে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। সংস্থাটি মূলত আগ্নেয়াস্ত্র সংক্রান্ত অপরাধ, বোমাবাজি, অগ্নিসংযোগ এবং অ্যালকোহল ও তামাকের অবৈধ চালান নিয়ে তদন্ত করতো।
কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের অভিষেকের পর সংস্থার আড়াই হাজার কর্মীর প্রায় ৮০ শতাংশকেই এখন সামান্য পরিমাণ হলেও অভিবাসন নীতি কার্যকর সংক্রান্ত কাজ করতে হচ্ছে, বলেছেন এটিএফের কার্যক্রমের সঙ্গে পরিচিত দুই কর্মকর্তা।
এটিএফের এজেন্টদেরকে মূলত অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অভিবাসীদের খুঁজে বের করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, বলেছেন এক কর্মকর্তা।
প্রায় ১০ হাজার কর্মীর ডিইএ- কাজ ছিল মাদক উৎপাদক ও চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে লড়া, এখন এর কর্মীদের প্রায় এক চতুর্থাংশকে নামানো হয়েছে অবৈধ অভিবাসী ধরার অভিযানে, বলেছেন সাবেক এক কর্মকর্তা। তিনি ডিইএ-র এখনকার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এ তথ্য জেনেছেন।
এজেন্টদের কাজের ধরনে পরিবর্তনের কথা নিশ্চিত করেছেন আরও দুই সাবেক কর্মকর্তা; তবে ঠিক কী পরিমাণ কাজ বদলেছে সে বিষয়ে তারা কিছু বলতে পারেননি।
আগের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নতুন দায়িত্বে আনা অধিকাংশ কর্মকর্তারই অভিবাসন আইন নিয়ে তেমন অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ নেই, বলছে এই সূত্রগুলো।
উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কথা। যার আড়াই হাজার নিরাপত্তা কর্মকর্তার কাজ হচ্ছে কূটনীতিকদের সুরক্ষা দেওয়া এবং ভিসা ও পাসপোর্ট জালিয়াতির মূলোৎপাটন করা। এখন তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসরত বিদেশিদের নিয়ে ‘তদন্ত, তাদের অবস্থান শনাক্ত ও তাদের আটক করার’ কাজে সহায়তার কাজও দেওয়া হয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পাঠানো হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রী ক্রিস্টি নোয়েমের ১৮ ফেব্রুয়ারির এক মেমোতে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।
রয়টার্সকে দেওয়া বিবৃতিতে এটিএফ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তারা যে অভিবাসন নীতি কার্যকরে সহায়তা করছে তা স্বীকার করে নিয়েছে। অবশ্য কত সংখ্যক কর্মীকে কাজে লাগানো হয়েছে, তাদেরকে দিয়ে কী কী কাজ করানো হচ্ছে তার বিস্তারিত বলতে তারা রাজি হয়নি।
এসব পরিবর্তনের সঙ্গে অভিবাসন নীতি কার্যকরে ট্রাম্প প্রশাসনের ‘বাড়াবাড়ির’ নানান খবরও আসছে। ডজনের বেশি মামলায় ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক ক্ষমতা ও অন্যান্য আইনি সীমায় দেওয়া এখতিয়ারের বাইরে কাজ করার অভিযোগও আনা হয়েছে।
এর মধ্যে আছে- অষ্টাদশ শতকের যুদ্ধকালীন ক্ষমতার আইন ব্যবহার করে ভেনিজুয়েলার একটি গ্যাংয়ের সন্দেহভাজন সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে পাঠানো এবং ফিলিস্তিনের পক্ষে হওয়া বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে আটক, যার যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে থাকার অনুমতিপত্র রয়েছে।
হোয়াইট হাউজ বলছে, তারা তাদের সাংবিধানিক ক্ষমতার মধ্য থেকেই কাজ করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের কাজ ও নিরাপত্তার সুরক্ষা দিচ্ছে।
তাদের পদক্ষেপে মিলেছে মিশ্র ফল।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্ত অতিক্রম করে দেশটিতে ঢুকতে চাওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীর সংখ্যা কয়েক দশকের মধ্যে গেল ফেব্রুয়ারিতেই সবচেয়ে কম দেখা গেছে। এদিকে অভিবাসন আইন লঙ্ঘন করায় আটককৃতের পরিমাণে দেখা যাচ্ছে উল্লম্ফন, যার ধারাবাহিকতায় আসছে মাসগুলোতে ফেরত পাঠানো অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা হু হু করে বাড়বে বলেই অনুমান বিশ্লেষকদের।