চলতি মাসে সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকা রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর উপর এ হামলা চালানো হয়।
Published : 20 Aug 2024, 03:32 PM
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বন্দি শিবির থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকা রোহিঙ্গাদের ওপর ড্রোন দিয়ে হামলা চালিয়ে অন্তত ২০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে কিছুদিন আগে।
৫ অগাস্ট সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকা পরিবারগুলোর উপর ওই হামলা চালানো হয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা গেছে, কাদার মধ্যে লাশের পর লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
সেদিনের এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে ফেরা কয়েকজন রোহিঙ্গা বিবিসিকে তাদের এই ভয়ংকর জীবন যুদ্ধের কথা জানান।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ফায়াজ ও তার স্ত্রী সেদিনের লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা তুলে ধরে জানান, হাজার হাজার ভীতসন্ত্রস্ত রোহিঙ্গা রাখাইনের মংডু শহরের কাছে নাফ নদীর তীরে পৌঁছে নৌকায় ওঠা শুরু করেছে তখনই তাদের উপর ড্রোনের সাহায্যে হামলা শুরু হয়।
ফায়াজ বলেন, “তখন চারদিকে চিৎকার ও আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে।”
৫ অগাস্টের এই নির্বিচার হামলার আগ থেকেই ওই এলাকার গ্রামগুলোতে আক্রমণ চালানো হচ্ছিল। তখন একমাত্র বিকল্প হিসেবে নিরাপদ আশ্রয় নিতে তারা বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন।
ফায়াজ তাদের শেষ সম্বলটুকু নিয়ে দৌড়াচ্ছিল, সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী এবং তিন সন্তান। ৮ মাসের ছোট সন্তান ছিলো ফায়াজের শ্যালিকার কোলে।
প্রথম গোলাটি মুহূর্তেই তার শ্যালিকার জীবন কেড়ে নেয়। কোলে থাকা ফায়াজ দম্পতির ছোট্ট শিশুটি মারাত্মকভাবে আহত হলেও তখন জীবিত ছিল।
"আমি দৌড়ে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিলাম। আমরা একটু নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিয়ে হামলা থামার অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সন্তান নিস্তেজ হয়ে পড়ে, বুঝতে পারি যে মারা গেছে,” বলেন ফায়াজ।
নিসারও মা, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও বোনকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রায় সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে নদীর তীরে পৌঁছে গিয়েছিলেন।
"আমরা মাথার ওপর ড্রোনের উপস্থিতি টের পাই। এরপর বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শুনতে পাই," বলেন তিনি।
"তারা ড্রোন ব্যবহার করে আমাদের ওপর বোমা নিক্ষেপ করে।”
নিসারের সঙ্গে থাকা তার পুরো পরিবার এই হামলায় নিহত হয়। এই হামলা থেকে একমাত্র নিসারই বেঁচে ফিরেছেন।
ফায়াজ, তার স্ত্রী ও দুই সন্তান পালিয়ে নৌকাযোগ নদী পার হয়ে যান। অনেক অনুনয়-বিনয় করা সত্ত্বেও মাঝি ফায়াজকে নিহত শিশুটির লাশ সঙ্গে আনতে দিতে রাজি হননি।
ফায়াজ বলেন, “তাই আমি নদীর তীরে একটি গর্ত খুঁড়ে তাড়াতাড়ি তাকে কবর দিয়ে চলে আসি।”
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ, এই লম্বা পথ পাড়ি দিতে যেয়ে অনেকেই কাছের মানুষকে হারিয়েছে। নিঃস্ব হয়েছে শত শত পরিবার।
তবে মৃত্যুর মুখ থেকে যারা ফিরে এসে বাংলাদেশে অবস্থান নিতে পেরেছে তারা এখন তুলনামূলক নিরাপদে আছেন। তবে ঠিক কতদিন বাংলাদেশে অবস্থান করতে পারবেন এটা নিয়ে তারা শঙ্কিত তারা।
এদিকে পুরো পরিবারকে হারানো নিসার এখনও ঘটনার ধাক্কা সামলে উঠতে পারছেন না। আকাশ পাতাল ভেবেও কূল পাচ্ছে না, কীভবে একদিনে তার পুরো পৃথিবী তছনছ হয়ে গেল।
নিসার বলেন, "যদি জানতাম এমনটা হবে, তাহলে আমি সেদিনই পালিয়ে আসার চেষ্টাটা করতাম না।”
মিয়ানমারের ভেতরে ঠিক কী ঘটছে সেটা জানতে পারা বেশ কঠিন। তবে সেদিন যারা বেঁচে ফিরতে পেরেছিল তাদের বলা কথা গুছিয়ে একটি চিত্র তৈরি করতে পেরেছে বিবিসি।
বেঁচে যাওয়া নিরস্ত্র রোহিঙ্গা বেসামরিকরা সবাই দুই ঘণ্টার মধ্যে অনেক বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন বলে জানিয়েছেন।
বেসরকারি মানবিক সাহায্য সংস্থা মেদসাঁ সঁ ফ্রোঁতিয়ের জানিয়েছে, আহতদের অর্ধেকই নারী ও শিশু।
বেঁচে যাওয়াদের ভিডিও বিশ্লেষণ করে বিবিসি দেখেছে, নদীর তীর রক্তাক্ত লাশে ঢেকে গেছে, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। নিহতের সংখ্যা যাচাই করা না গেলেও একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী বিবিসিকে জানিয়েছেন, তারা অসংখ্য মৃতদেহ দেখেছেন।
এই মর্মান্তিক ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা মানুষগুলো জানান, তাদের ওপর নৃশংস হামলা চালিয়েছে মিয়ানমারের অন্যতম শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। তারা আরও জানান, প্রথমে তাদের গ্রামে হামলা করা হয়, পালাতে বাধ্য করা হয় এবং পালাতে গেলে নদীর তীরে আবারও হামলা চালানো হয়।
কিন্তু আরাকান আর্মি হামলার দায় অস্বীকার করেছে। আরাকানের এই বিদ্রোহী বাহিনী ও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ওই হামলার জন্য একে অপরকে দায়ী করেছে।
আরাকান আর্মির মুখপাত্র খাইং তুখা হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে বিবিসির প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'আমাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এ ঘটনা ঘটেনি।”
তিনি আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনার জন্য রোহিঙ্গা আন্দোলনকারীদের দায়ী করেছেন।
নিসার অবশ্য তার বক্তব্যে অনড় ছিলেন; তিনি বলেন, “আরাকান আর্মি মিথ্যা বলছে। হামলাগুলো তারাই করেছে। সেদিন আমাদের এলাকায় শুধু তারাই ছিল।
“কয়েক সপ্তাহ ধরে তারা আমাদের ওপর হামলা চালাচ্ছিল। তারা কোনো মুসলিমকে জীবিত রাখতে চায় না।”
মিয়ানমারের বেশিরভাগ রোহিঙ্গা মুসলিম, বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য রাখাইনে সংখ্যালঘু হিসেবে বাস করে।
দুই সম্প্রদায়ের মধ্যকার তিক্ত সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডকে জাতিসংঘ 'জাতিগত নিধনের পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ' হিসেবে বর্ণনা করেছে।
স্থানীয় রাখাইন পুরুষরাও তখন এই হত্যাকাণ্ডে যোগ দেয়। এখন রাখাইনের জান্তা ও আরাকান আর্মির মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংঘাতের মধ্যে রোহিঙ্গারা আবারও আটকা পড়েছে।
বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়ার এবং মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বেঁচে যাওয়া রোহিঙ্গারা বিবিসিকে বলেছেন, তারা যে সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছেন, সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানাতে চান যাতে এগুলো নথিভুক্ত হয়।
"আমার সব শেষ হয়ে গছে। এখন আমি সব হারিয়েছি। আমি জানি না কেন বেঁচে গেলাম," বলেন নিসার।
রাখাইনে নিজের বাড়ির কাছে গোলাবর্ষণ বেড়ে যাওয়ায় এক ধনী রোহিঙ্গা ব্যবসায়ী নিজের জমি ও বাড়ি বিক্রি করে দেন। কিন্তু দ্রুত সংঘাত আরও তীব্র হয়ে ওঠে এবং ৫ আগস্ট সকালে পরিবারটি মিয়ানমার ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
একটি ভিডিওতে মেয়ের মৃতদেহ দেখিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ওই ব্যবসায়ী বলেন, “আল্লাহর নাম বলতে বলতে আমার কোলেই আমার মেয়ে মারা গেছে। তাকে খুব শান্ত দেখাচ্ছে, যেন সে ঘুমাচ্ছে। সে আমাকে খুব ভালোবাসতো।”
একই ভিডিওতে, তার স্ত্রী এবং বোনকে দেখা যাচ্ছিল। বোমা হামলা শিকার হয়েও তারা তখনও বেঁচে ছিলেন, কিন্তু উভয়ই গুরুতরভাবে আহত হওয়ায় হামলার মধ্যে তাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসতে ব্যর্থ হন। তাই তিনি তাদের ফেলে রাখার যন্ত্রণাদায়ক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পরে জানতে পারেন তারা মারা গেছেন।
ফায়াজ বলেন, "কোথাও নিরাপদ ছিলাম না, তাই আমরা নদী পার হয়ে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হই। স্ত্রী সন্তান নিয়ে যাতে নিরাপদে চলে আসতে পারি, তাই শেষ সম্বল কিছু টাকা মাঝিকে দিয়ে দেই নদী পার করে দেওয়ার জন্য।”
তিনি তার মৃত ছেলের একটি ছবি তুলে ধরেন। ক্রুদ্ধভাবে বিবিসির সামনে তার ৮ মাসের নিহত সন্তানের রক্তাক্ত দেহের ছবি তুলে ধরে ফায়াজ বলেন, “আরাকান আর্মি যদি আমাদের ওপর গুলি না চালায়, তাহলে কে করেছে? যে দিক থেকে গোলাগুলো এসেছিল, আমি জানি আরাকান আর্মি সেখানে ছিল। আর্মি যদি গোলা ছুঁড়ে না থাকে তবে কী আকাশ থেকে বজ্রপাত হচ্ছিল?"
আরও পড়ুন:
মিয়ানমার থেকে পালানোর সময় ড্রোন হামলায় শিশুসহ '২০০ রোহিঙ্গা নিহত'